Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • সেপ্টেম্বর ২৫, ২০২১

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

প্রতীকী চিত্র

আমাদের গ্রামে একজন জনপ্রিয় রামমঙ্গল গায়েন ছিলেন, তাঁর নাম ছিল নরেন্দ্র গাইন। ঐ গাইন পরিবাররে ছেলেমেয়েরা স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় পদবী হিসেবে গুণ-ই ব্যবহার করতো। নরেন্দ্র গাইন বলতেন, গাইন হচ্ছে গুণ এর আদিরূপ। আমরা নরেন্দ্র গাইনের দাবি স্বীকার করতাম না, বরং এই উপাধি ব্যবহার করার জন্য আমরা ওদের ব্যঙ্গবিদ্রূপ করতাম। নরেন্দ্র গাইনের দাবির ভিতরে কিছুটা সত্যতা ছিল বলেই আমার মনে হতো—হয়তো আমাদের পূর্বপুরুষদের পেশা ও পারদর্শিতার মূল ধারাটি রায়মঙ্গল গায়নের ভিতর দিয়েই রক্ষিত হয়েছিল।

রায়মঙ্গল গানের জগতে নরেন্দ্র গাইন ছিলেন এক জীবন্ত কিংবদন্তী। তাঁর সামনে দাঁড়াবার মতো রামমঙ্গল গায়ক ময়মনসিংহে আর কেউ ছিলেন না। সপ্তখন্ড রামায়ণ তাঁর মুখস্থ ছিল। রামমঙ্গল প্রদর্শনের জন্য তাঁর একটি চার সদস্যের দল ছিল। নীরদ সেনের বাড়িতে, হরিপূজা উপলক্ষে প্রতিবৎসর রামমঙ্গলের আসর বসতো—ঐ বাড়িতেই সারারাত জেগে আমি নরেন্দ্র গাইনের রামমঙ্গল দেখতাম। শতশত লোক পিনপতন নীরবতার মধ্যে নরেন্দ্র গাইনের রামমঙ্গল শুনতো। আমাদের বাড়িতে তিনি কখনো রামমঙ্গল গান পরিবেশন করেন নি—সম্ভবত আমাদের প্রতি তাঁর ক্ষোভ ছিল। তাঁর এই বিশেষ কৃতী এবং জনপ্রিয়তাকে আমাদের বাবা-কাকারা যে খুব একটা মর্যাদা দিতেন না, তার পেছনে প্রচ্ছন্ন ঈর্ষাবোধও বিদ্যমান ছিল বলেই মনে হয়। তিনি গ্রামে খুব কমই থাকতেন। রামমঙ্গল ছিল তার নেশা এবং পেশা—দুই-ই। ফলে বিভিন্ন এলাকায় রামমঙ্গল গেয়ে, অনেকদিন পর পর তিনি বাড়িতে ফিরে আসতেন। গান গেয়ে পারিশ্রমিক পেতেন, ওটাই ছিল তাঁর জীবিকার প্রধান অবলম্বন। জমিজমা খুব একটা ছিল না বললেই চলে।

সেনবাড়ির হরিপূজার সময়, দিনে মহোৎসব হতো এবং রাতে হতো রায়মঙ্গল। ঐ নিয়মটা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছিল। রাত দশটার দিকে শুরু হতো পালা। সারারাত ধরে চলতো। আমরা রামমঙ্গলের আসরে বসেই আসন্ন সূর্যের আভায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা ভোরের আকাশ দেখতে পেতাম। কীভাবে যে পুরো একটি রাত কেটে যেতো, টেরই পেতাম না। নরেন্দ্র গাইন যাদুকরের মতো দর্শকশ্রোতাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে বসিয়ে রাখতেন। ফলে মাঝখানে ওঠা যাবে না, এমনটি ভেবে নিয়েই দর্শক শ্রোতারা তাঁর আসরে বসতেন।

তিনি ছিলেন দীর্ঘদেহী এবং গুণদের মতোই উন্নতনাসবিশিষ্ট, প্রশান্তবক্ষ এবং সুঠামস্বাস্থ্যের অধিকারী। যৌবনের নজরুলের মতোই বাবরি-দোলানো ঝাঁকড়া চুল ছিল তাঁর। চোখ দুটোও ছিল বেশ বড় এবং ভাসা ভাসা। দীর্ঘসময় ধরে আসরে বসেই তিনি মেকআপ নিতেন। নাটক এবং যাত্রাগানে দর্শকের দৃষ্টির আড়ালে মেকআপ নেয়ার যে রীতিটা ছিল, নরেন্দ্র গাইন সেই ধারাটাকে পাল্টে দিয়েছিলেন। প্রায় ঘন্টাখানেক সময় নিয়ে তিনি সাজতেন, মেয়েদের মতো আয়না নিয়ে বসে মুখে রঙ মাখতেন—রঙটা তৈরী করতেন সফেদার সঙ্গে কিঞ্চিৎ মেটে আবির মিশিয়ে। তাছাড়া রক্তচন্দন এবং শ্বেতচন্দনও ব্যবহার করতেন। কপালে তিলক কাটতেন, গালে দিতেন চন্দনের ফোঁটা। তাঁর মুখমন্ডলের রঙ গেরুয়াবসনের সঙ্গে একাকার হয়ে যেতো। গেরুয়া রঙের ধুতির সঙ্গে গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরতেন, একটি গেরুয়া রঙের উত্তরীয় রাখতেন কাঁধের উপর। পালা পরিবেশন সময় ঐ উত্তরীয়টা ঘটনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে স্থান পরিবর্তন করতো। কখনো তিনি তা মাথায় পাগড়ি করে বাঁধতেন, কখনোবা বাঁধতেন কোমরে আঁট করে, কখনোবা গলায় ঝুলিয়ে দিতেন। পালা শুরু করার পূর্বে কিছুক্ষণের জন্য তিনি ধ্যানে বসতেন, তাঁর ধ্যানমগ্ন রূপ দেখে মনে হতো, তিনিই বাল্মিকী।

তাঁর ধ্যান ভাঙার সঙ্গে সঙ্গে হারমোনিয়াম, খোল এবং করতাল বেজে উঠতো। নরেন্দ্র গাইন ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াতেন। তারপর তিনি দর্শকস্রোতাদের কাছে জানতে চাইতেন, কোন পালাটা তাঁরা শুনতে চায়—অধিকাংশ শ্রোতার দাবিকেই তিনি আমল দিতেন। তাঁর দলের একজনের নাম ছিল হরেন্দ্র-খোল বাজানো ছাড়াও তার কাজ ছিল গায়েনের সঙ্গে কথোপকথনের ভিতর দিয়ে রস পরিবেশন করা। নরেন্দ্র গাইন তাকে উদ্দেশ্য করে বিভিন্ন প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতেন, হরেন্দ্র এমন সব উত্তর দিতেন যা শুনে আমাদের পেটে খিল লেগে যেতো। ধর্মরসে আপ্লুত মুহূর্তগুলো হরেন্দ্র এবং নরেন্দ্র -দু’য়ের মধ্যকার সংলাপ বিনিময়ের মধ্য দিয়ে হঠাৎ করেই আমাদের আটপৌরে জীবনের স্তরে নেমে আসতো। তখন মনে হতো রামমঙ্গলের চরিত্রগুলো অযোধ্যা থেকে নয়, একেবারেই আশেপাশের গ্রাম থেকে উঠে এসেছে। আমার শিশু মনে বিশেষ ভাবে আবেদন সৃষ্টি করতো হনুমান—নরেন্দ্র গাইন এই হনুমান চরিত্রটিকে এমন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতেন, মনে হতো, রামমঙ্গল না বলে একে হনুমানমঙ্গল বলাটাই শ্রেয়! ভক্তি এবং বীরত্বের এমন অপূর্ব সমন্বয় হনুমান ছাড়া আর কোথায়?

বাড়িতে রামায়ণ পাঠ করে মাকে শোনাতাম, নিজের আগ্রহেও পড়তাম। কিন্তু রামায়ণের প্রকৃতরস এবং এর অন্তনির্হিত কাব্যশক্তির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে নরেন্দ্র গাইনের পরিবেশিত  রামামঙ্গল শুনে এবং তাঁর অপূর্ব অভিনয় দেখার মাধ্যমে। আশ্চর্য কুশলতায় তিনি রামায়ণের মূল চরিত্রসমূহের দ্বন্দ্ব-সংঘাত, প্রেম-ভক্তি, ছলনা ও কৌতূককে এমন নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন; মনে হতো মঞ্চে গায়েন একা নন—একা হয়েও তিনি বহু। একক অভিনয়ের এমন সাফল্য পরবর্তীকালেও আমি আর দেখি নি। তিনি যখন রাম তখন রাম, যখন সীতা তখন সীতা, যখন বীরশ্রেষ্ঠ হনুমান—তখন কী আশ্চর্য, তাঁকে মূর্তিমান হনুমান বলেই আমাদের ভ্রম হতো । শুধু আমি নই, বড়রাও তাঁর এই ক্ষমতাকে দৈবের দানরূপে বিবেচনা করতে বাধ্য হতেন।

বড়-শিল্পীদের মতোই তাঁর ব্যক্তিজীবন খুব সুখের ছিল না। স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক খারাপ ছিল, ছেলেমেয়েরাও পড়ালেখার ভালো ছিল না। প্রবল অর্থকষ্টে, প্রায় বিনা চিকিৎসাতেই তিনি অকালমৃত্যু বরণ করেন। শক্তিশেলবিদ্ধ লক্ষ্ণণের মতো তাঁকে বাঁচাতে গন্ধমাদন পর্বত থেকে বিশল্যাকরণী নিয়ে কোনো হনুমান এগিয়ে আসে নি। নরেন্দ্র গাইনের মৃত্যুতে আমাদের জীবন থেকে ‘রামমঙ্গল’ প্রায় লুপ্ত হয়ে যায়। রামহীন রামায়ণের মতোই, নরেন্দ্র গাইনহীন রামমঙ্গলের কথাও আমি ভাবতে পারি না।

 

ক্রমশ…


  • Tags:

Read by:

❤ Support Us
Advertisement
Hedayetullah Golam Rasul Raktim Islam Block Advt
Advertisement
Hedayetullah Golam Rasul Raktim Islam Block Advt
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা
error: Content is protected !!