Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • জানুয়ারি ১৭, ২০২২

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

১৯৬২-র গোড়ার দিকে আমাদের স্কুলে একজন নতুন শিক্ষক আসেন, তার নাম শ্রীযতীন্দ্র চন্দ্র সরকার। আমরা তখন দশম শ্রেনীর ছাত্র। মুখলেসুর রহমান স্যার চলে যাওয়ার পর আমাদের বাংলা সাহিত্যের ক্লাসগুলি প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল। যতীন স্যার আমাদের সাহিত্যের ভাঙা-হাটে নতুন প্রাণের জোয়ার নিয়ে আসেন। অল্পদিনের মধ্যেই তিনি আমাদের প্রিয় শিক্ষকে পরিণত হন। সমাজজীবনে কাব্য ও সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমার মনের মধ্যে যে সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছিল– তিনি তা দূর করেন। বিভিন্ন যুগে শিল্প-সাহিত্য কীভাবে সমাজের পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বিভিন্ন দেশের সাহিত্য ও সমাজ-ব্যবস্থার পর্যালোচনা করে তিনি আমাদের কাছে তা অকাট্য যক্তিতে তুলে ধরতেন। রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের কাব্য মূল্যায়নের ক্ষেত্রেও তিনি নতুন দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করেন, যা আগে আমাদের জানা ছিল না। তার কণ্ঠস্বর ছিল মাইকের মতো; বিষয়-ব্যাখ্যার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। আবেগ এবং ভাবের চাইতে তিনি যুক্তি এবং তথ্যভিত্তিক সাহিত্য পর্যালোচনা অধিকতর আস্থাশীল ছিলেন। সাহিত্য-বিজ্ঞান, ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, সমাজনীতি থেকে শুরু করে ধর্মতত্ত্ব পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়কেই তিনি তার আলোচনায় নিয়ে আসতেন। তিনি বলতেন যে, এগুলোর মধ্যে একটি নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে। পল্লী সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ আগ্রহ এবং পক্ষপাত ছিল। তার স্মৃতি শক্তি ছিল অবিশ্বাস্য, ফলে স্মৃতি থেকে তিনি প্রায়ই দীর্ঘ নির্ভুল উদ্ধৃতি ব্যবহার করতে পারতেন। তার বাড়ি ছিল কেন্দুয়ায়। থাকতেন স্কুলের লাগোয়া শচীন্দ্র দে মহাশয়ের বাড়িতে, তাদের মধ্যে কী একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। বাবার সঙ্গেও পরে তার ভালো সম্পর্ক হয়।

বারহাট্টা ক্লাবের প্রাণ পুরুষ ছিলেন কবিরাজ নারায়ণ চক্রবর্তী মহাশয়, তার একটি আয়ুর্বেদীয় ফার্মেসি ছিল গৌরিপুর বাজারে। এলাকার বিশিষ্ট সংস্কৃতিবান ব্যক্তিরা ঐ ফার্মেসিতে আড্ডা দিতেন। তিনি নিজে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির একজন কর্মী ছিলেন। তিনি ছিলেন বাবার বিশিষ্ট বন্ধু। বাজারে গেলে তো কথাই নেই, আড্ডা দেবার জন্যও বাবা নারায়ন বাবুর ফার্মেসিতে যেতেন। অচিরেই যতীন্দ্র স্যার ঐ আড্ডার প্রাণ-পুরুষে পরিণত হন। বিশিষ্ট সংস্কৃত-পণ্ডিত, কবিরাজ শ্রীহরেন্দ্র গোস্বামীর সঙ্গেও বাবার বিশেষ সুসম্পর্ক ছিল। কিছুদিন আমি তার টোলে সংস্কৃত পড়েছি। যতীন্দ্র স্যার ওখানেও বসতেন, ধর্মতত্ত্ব এবং সাহিত্য নিয়ে আলাপ আলোচনা হতো। আমিও সেই সব চমৎকার পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা কখনো কখনো শুনতাম। বাবা ছিলেন যতীন্দ্র স্যারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বাবা নিজে খুব পড়াশোনা করা পন্ডিত ব্যক্তি ছিলেন না, কিন্তু পন্ডিত এবং খ্যাতিমান ব্যক্তিদের প্রতি তার প্রচন্ড শ্রদ্ধাবোধ ছিল। বেশিদিন আমরা স্যারকে পাইনি। মাসছয়েক পরেই মাস্টার্স ডিগ্রি নেওয়ার জন্য তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যান। আমরা হঠাৎ-পাওয়া আমাদের এই প্রিয় শিক্ষককে হারিয়ে আবার সেই দুঃখকে অনুভব করি– মুখলেসুর রহমান স্যারের চলে যাওয়ার সময় যেমনটি আমাদের মনে হয়েছিল।

গৌরিপুর বাজারে মতিদের গুদামঘরের সামনের বারান্দায় একটা পুরনো সিঙ্গার সেলাইকল নিয়ে একজন ঢাকাইয়া খলিফা বসতো, তার নাম ছিল নয়া মিঞা। শীর্ণ দীর্ঘ দেহ, লম্বাটে মুখ। গায়ের রং কালো। যতো পাট করা কালোচুল, কিছুটা কোঁকড়ানো। তার প্রিয় পোশাক ছিল দামি লুঙ্গির উপর সাদা হাফশার্ট। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি, কিন্তু বিয়ে থা করেনি। যা উপার্জন করতো, চায়ের স্টলে আড্ডা মেরে, বন্ধু-বান্ধবদের খাইয়ে, যাত্রা সিনেমা দেখে উড়িয়ে দিতো। সে ছিল অন্য সকলের চেয়ে আলাদা। কাজে তার মন ছিল না, জমানোর জন্য অর্থ উপার্জনের দিকেও তার লক্ষ্য ছিল না। মনে হতো সে টাকা উপার্জন করে শুধু উড়ানোর জন্য। সংসারে এমন লোকের কখনো বন্ধু-বান্ধবের অভাব হয় না, কিন্তু প্রকৃত বন্ধু এরা কখনোই পায় না। বিভিন্ন বয়সের মানুষের সঙ্গে যে অনায়াসে মিশতে পারতো। মানুষকে কাছে টানার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। এ ব্যাপারে নয়া মিঞার প্রধান সহায় ছিল তার প্রাণখোলা হাসিমুখ এবং গল্প বলার সহজাত শক্তি। মুখে যেন কথার খই ফুটতো, গল্পুটে হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল বাজারজুড়ে।

আমার বন্ধু মতির সঙ্গে তার খুব ভাব। মতিই একদিন নয়া মিঞার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। মতি যে অবজারভার পত্রিকাটির রাখতো নয়া মিঞার প্রায়ই মতির ঘরে এসে ঐ পত্রিকায় চোখ বুলাতে। ইংরেজি সে জানতো না, কিন্তু এমনভাবে সে পত্রিকায় চোখ বুলাতো যারা তার ইংরেজি বিদ্যার দৌড় জানতো না, তারা ভাবতো নয়া মিঞার মতো লোকদের জন্যই ইংরেজি ভাষাটা এখনও দেশে চালু আছে– নইলে কবেই তা বিদেয় নিত। আসলে তার চোখ ঘুরে বেড়াতো ছবিতে। ছবি দেখে এবং মতির কাছ থেকে মূল সংবাদটা জেনে নিয়ে নয়া মিঞা বেরুতো লেটেস্ট সংবাদ বাজার মাত করতে।

মতির মাধ্যমে ঢাকার প্রতি আমার যে আকর্ষণটা সৃষ্টি হচ্ছিল– নয়া মিঞার সঙ্গে পরিচিত হবার পর, তার কাছে ঢাকা শহরের গল্প শুনে শুনে ঢাকার প্রতি আমার সেই আকর্ষণটা আরো বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। মতি বা আমি কেউই তখনো ঢাকায় যায় নি, আর নয় মিঞা কিনা সেই স্বপ্ননগরী ছেড়ে চলে এসেছে এই গণ্ড-গ্রামে। নয়া মিঞা বলতো, সে ঢাকা ছেড়েছে অর্থ উপার্জন করার জন্য নয়, বাজারের অন্য পাঁচজন ঢাকাইয়া ব্যবসায়ী যেমন। নয়া মিঞা নাকি পরিবারের সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এসেছে। নয়া মিঞাকে দেখে, তার মুখে জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার গল্প শুনে মনে হতো জীবনের পথে সে এক দুঃসাহসিক অভিযাত্রী। আপাতত যদিও তার নৌকা ভিড়েছে বারহাট্টায়, কিন্তু তার গন্তব্য অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে।

নয়া মিঞা আমাদের কাছে ঢাকা স্টেডিয়ামের গল্প বলতো। আমরা পত্রিকায় যে সিনেমা হলের বিজ্ঞাপন দেখতাম, যে হলে সিনেমা দেখে জীবন ধন্য করার স্বপ্ন দেখতাম– নয়া মিঞা ঐ সিনেমা হলগুলোর কোনটাতে কখন কোন ছবি দেখেছে তা মুখস্ত বলে যেতো। তার মুখস্ত বিদ্যাটা সে যে কেন লেখাপড়ার কাজে প্রয়োগ করেনি, ভেবে পেতাম না। মতি তখন ময়মনসিংহ জেলার শ্রেষ্ঠ ছাত্র। আমিও ছাত্র হিসেবে মন্দ নই, তাছাড়া কবিতা-টবিতা লেখার খবরটাও একেবারে লুকানো নেই। রঙধনু পত্রিকায় আমার নাম ছাপা হওয়ার সংবাদ তখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে। আমাদের দুজনের সঙ্গে নয়া মিঞার এই নতুন সম্পর্কটা সবারই চোখে পড়ল। বাজারের সবাই নয়া মিঞাকে সমীহ করতে শুরু করল। আমি, মতি ও নয়া মিঞা মিলে তখন ঘন্টার পর ঘন্টা গল্প করে কাটাই। সেই গল্পের বিষয় ঢাকা। আমরা টেস্ট পরীক্ষার পর পরই নয়া মিঞার নেতৃত্বে ঢাকা অভিযানের সিদ্ধান্ত নিই। নয়া মিঞা সানন্দে আমাদের নেতৃত্ব দিতে সম্মত হয়।

টেস্ট-পরীক্ষার আগে বাবার সঙ্গে আমার একটু চুক্তি হয়। চুক্তি অনুযায়ী স্থির হয়, আমি যদি টেস্ট পরীক্ষায় শতকরা ষাট ভাগের বেশি নম্বর পাই তাহলে তিনি আমাকে মতির সঙ্গে ঢাকা-অভিযানে যাবার অনুমতি দেবেন–এবং মেট্রিক পরীক্ষার পূর্বেই আমাকে একটি রিস্ট-ওয়াচ কিনে দেবেন। আমি পরের ঘড়িতে সময় দেখে পরীক্ষা দেওয়ার ব্যাপারটাকে অত্যন্ত বিরক্তিকর এবং অপমানজনক বলে ভাবতাম। বাবা রাজি হলেন। ফলে টেস্ট পরীক্ষায় ভালো ফল করার প্রতি আমারও আগ্রহ সৃষ্টি হলো। টেস্ট পরীক্ষার ফল বেরুনোর পরপরই আমরা ঢাকা যাবার দিন স্থির করে ফেললাম। বাবা চুক্তিমতো একশত টাকা বরাদ্দ করলেন।

আমাদের বাড়িতে ইস্ত্রি ছিল না। পিতলের ঘটির ভিতরে চুলার আগুন রেখে, ঘটি গরম করে কাপড় ইস্ত্রি করার একটি সহজ পদ্ধতি আমরা আবিষ্কার করেছিলাম। আমার পায়জামা এবং শার্টগুলি সেভাবেই ধুয়ে ইস্ত্রি করে আমি ঢাকার জন্য তৈরি হয়ে গেলাম।

আমাদের চৌদ্দগুষ্টির কেউ কখনো ঢাকা যায় নি। দু-একজন যাওবা গেছে, তারা গেছে ইন্ডিয়ান হাই কমিশনের অফিসে, মাইগ্রেশনের জন্য। লেখাপড়া করার জন্য বা ঢাকা দেখার জন্য কেউ কখনো যায় নি। নেহায়েত বিপদে না পড়লে ঢাকা যাওয়ার কথা কেউ ভাবতো না। ঢাকা যাওয়াটাকে তখন একটা বিপদের ঝুঁকি নেয়া বলেই গণ্য করা হতো। কোথায় থাকবো, কি খাবো, এসব ভাবনা নিয়ে বাড়িতে দুশ্চিন্তার অন্ত নেই। যাকে নিয়ে এত চিন্তা, এত দুর্ভাবনা, সেই আমি কিন্তু এসব ব্যাপার নিয়ে আদৌ ভাবছিলাম না। আমার খাওয়া নিয়ে কোনো দুর্ভাবনা ছিল না। আমাদের স্কুলে একবার পিকনিক হয়েছিল, স্কুলের মাঠের উত্তর প্রান্তে মুসলমান এবং দক্ষিণ প্রান্তে হিন্দুরা তাদের স্ব স্ব আয়োজন করেছিল। হিন্দু ও মুসলমানের এই পৃথক আয়োজনটা আমার পছন্দ হয়নি। আমি অনেক ভেবে চিন্তে শেষপর্যন্ত মতির পাশেই খেতে বসে গেলাম। এই নিয়ে প্রবল হৈচৈ পড়ে গেল। মুসলমানরা হিন্দুদের খেপাবার জন্য আমার নাম করে বলতে থাকলো যে আমি মুসলমান হয়ে গেছি। আমি হাসলাম। বললাম: ‘মুসলমান হওয়া বা হিন্দুর জাত যাওয়ার ব্যাপারটা কি এতোই সোজা?’ এই নিয়ে হিন্দুদের অনেকেই আমার নিন্দা করেছিল। বাবার কাছে বিচারও দেয়া হয়েছিল– কিন্তু বাবা আমাকে এ নিয়ে গালমন্দ করেন নি।

এই ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর মুসলমানদের হোটেলে না-খাওয়ার যে রীতিটা আমাদের পরিবারে প্রচলিত ছিল, আমি তার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে যাই। আমার খাদ্য গ্রহণের স্থান অনেক প্রসারিত হয়। ফলে ঢাকায় গিয়ে আমি যে হিন্দু হোটেল খুঁজবো না, তা আমার বাবা-মা ভাই-বোন সবাই নিশ্চিত বলেই জানতেন। গরুটা বাদ ছিল, এবার ওটাও যাবে– এই নিয়ে বিশেষ করে মায়ের মনে খুবই দুশ্চিন্তা ছিল। তিনি আমার কাছে সেই দুশ্চিন্তার কথা ব্যক্ত করলেন। আমি তাকে বুঝিয়ে বললাম: ‘আমি গরু খাওয়ার জন্য ঢাকায় যাচ্ছি না।’

ইতিপূর্বে ময়মনসিংহ পর্যন্তই ছিল আমার দৌড়, এবার চললাম ঢাকা। নয়া মিঞার নেতৃত্বে শুভদিনে আমাদের যাত্রা শুরু হলো।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!