- ধা | রা | বা | হি | ক
- অক্টোবর ২৪, ২০২১
আমার ছেলেবেলা

চিত্র: দেব সরকার ।
একই বছরে আরেকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটে, যার জন্য আমাদের স্কুল আবারও ছুটি হয়ে যায়। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন (১৯৫৮ সনের ৭ অক্টোবর)। সারাদেশে সামরিক আইন বা মার্শাল ল’ জারি করা হয়। রাষ্ট্রক্ষমতার মানে কী, আইয়ুব খানের পূর্বে কারা দেশ চালাচ্ছিলেন এবং কেমন চালাচ্ছিলেন আমি এসবের কিছুই জানতাম না। এগুলো যে জানবার বিষয়, তাও আমাদের কেউ বলে নি । এসব ব্যাপারে কোনো উৎসাহই আমার ছিল না। রাজনীতির লাইনের মোট চারজনের নাম তখন আমার জানা ছিল—গান্ধী, জিন্নাহ, নেহেরু এবং সুভাষ বোস ।
আমার দেখা রাজনীতিবিদ বলতে তখন জানতাম দু’জনকে, মৌলানা আতাহার আলী খান এবং আজিজুল ইসলাম খান। মৌলানা আতাহার আলী শুভ্রশ্মশ্রুমন্ডিত প্রৌঢ়; বাড়ি কিশোরগঞ্জ; কিন্তু আজিজ ভাই টগবগে বিপ্লবী তরুণ—আমাদের পার্শ্ববর্তী যশমাধব গ্রামে তাঁর বাড়ি ! অদূর ভবিষ্যতে মৌলানা আতাহার আলী সাহেবই হবেন দেশের রাজা-খালেক মৌলবী স্যারের মুখে আমরা তাই শুনেছিলাম। কথাটা বিশ্বাসও হয়েছিল— কেননা তাঁর জনসভায় প্রচুর লোকসমাগম হতো, পক্ষান্তরে আজিজ ভাইয়ের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকলেও এলাকার বিপুল সংখ্যক মানুষের সমর্থন ছিল না। ফলে আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিতেও খালেক মৌলবী স্যারের কথাটাই সত্য এবং স্বাভাবিক বলে মনে হতো। মৌলানা আতাহার আলী সাহেবের নাম শোনার অপেক্ষাতেই ছিলাম—হঠাৎ বিনামেঘে বজ্রপাতের মতোই বারহাট্টার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে, খালেক মৌলবী স্যারের স্বপ্ন ভঙ্গ করে দিয়ে উচ্চারিত হলো আইয়ুব খানের নাম। আইয়ুব খান হলেন দেশের নতুন রাজা। এমন চমৎকার নাম আমি পূর্বে শুনি নি, ইতিহাসের বইয়েও কোথাও পাই নি। নামটা আমার খুবই পছন্দ হলো ।
স্কুলে পত্রিকা আসতো, ইংরেজি অবজারভার এবং বাংলা আজাদ । দুই পত্রিকাতেই বেশ বড় করে আইয়ুব খানের ছবি ছাপা হয়েছে । স্যার ক্লাসে ঢুকেই পত্রিকায় ছাপা নতুন মহামানবের ছবিটি আমাদের দেখালেন । সামরিক পোশাক-পরিহিত দীর্ঘদেহী, প্রজাপতি গুম্ফবিশিষ্ট আইয়ুবকে একজন লৌহমানব বলেই মনে হলো। সিমেনার নায়কদের তখনো দেখি নি, যাত্রাদলের নায়কদের দেখতাম; আমার দৃষ্টিতে তাঁরাই ছিলেন সুপুরুষ। আইয়ুব খান আমার মন থেকে সকল নায়কের ছবি মুছে দিয়ে তাঁর নিজের ছবিটাই বসিয়ে দিলেন। তাঁর সুদর্শন মূর্তি আমাদের সবারই খুব পছন্দ হলো ।
আইয়ুব খান আমাদের গতানুগতিক জীবনে বৈচিত্র্যের স্বাদ যুক্ত করলেন। মার্শাল ল’ জিনিসটা কী ও কেমন—তখন কারোরই তা জানা ছিল না। জানা না থাকলেও এটুকু বুঝা গেল যে, ব্যাপারটার মধ্যে একটা তেজীভাব আছে—শ’ বর্ণের উপরের রেফের মতোই সে হবে দুর্দান্ত, দুর্মর এবং দুর্ভেদ্য।অল্পদিনের মধ্যেই একদল মিলিটারী এসে উপস্থিত হলো বারহাট্টায়। তারা আমাদের স্কুলের নিকটবর্তী ডাক-বাংলায় এসে উঠলো। এর আগে আমরা শুধু মিলিটারীর নাম শুনেছি, চোখে দেখি নি। দেখামাত্র আমি তাদের চিনতে পারলাম—
এদের সবার চেহারার সঙ্গেই পত্রিকার পাতায় দেখা আইয়ুব খানের বেশ মিল আছে। এরা সবাই দীর্ঘকায়, স্বাস্থ্যবান, নায়কদের মতো সুপুরুষ—এবং এদের সবারই গাত্রবর্ণ আমার ঠাকুমার মতো উজ্জ্বল। স্কুলে যাওয়া আসার পথে আমরা ভয়ে ভয়ে দূর থেকে ওদের দেখতাম। মনে হতো খাঁচা থেকে ছেড়ে দেয়া সিংহশাবককেরা যেন গায়ে রোদ পোহাচ্ছে। মনে হতো ময়মনসিংহের পান্ডববর্জিত পূর্বপল্লী যেন অবশেষে পঞ্চনদের দেশ থেকে আসা আর্য সন্তানদের পদধূলিতে ধন্য হয়েছে।
রাজনীতির লাইনের মোট চারজনের নাম তখন আমার জানা ছিল—গান্ধী, জিন্নাহ, নেহেরু এবং সুভাষ বোস ।
বাড়িঘর পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য তারা নির্দেশ দিলো। রাস্তাঘাট এবং পুকুর ডোবাও তাদের নির্দেশে দ্রুত পরিষ্কার হয়ে যেতে থাকলো। আমরাও আমাদের বাড়ির পেছনের পুকুর (কামিনীসরোবর) থেকে জমে ওঠা কাটা ঝোপগুলি অযত্নে আবর্জনার জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল— সেগুলো একেবারে তুলে ফেলে দেয়া হলো । কার বাড়িতে কখন যে মিলিটারীরা এসে উপস্থিত হয় বলা যায় না। তবে আমাদের বাড়ি যে তাদের দৃষ্টি এড়াবে না তা সহজেই বলা চলে । ফলে আমাদের কাজ বাড়লো। আমার কাকামণি বিশেষভাবে আমাদের বাড়ি এবং সাধারণভাবে পুরো গ্রাম পরিচ্ছন্ন রাখার অভিযানের তদারকি করলেন । উদ্দেশ্য মিলিটারীদের মন জয় করা।
একদিন দুর্নীতির অভিযোগে বারহাট্টার রেশন ডিলার কুমুদ সরকারকে মিলিটারীরা ইউনিয়ন বোর্ডের অফিস থেকে ধরে নিয়ে গেল । এলাকায় সে-সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো দাবানলের মতো । বাঘে থাবা দিলে বা সাপে কাটলে মানুষ যেমন অন্তিমমুহূর্তে দ্রুত বিখ্যাত হয়— মিলিটারীর হাতে ধরা পড়ে কুমুদ সরকারও রাতায়াতি খ্যাতির চূড়ায় পৌঁছে গেলেন । আইয়ুব খানের পরই আমাদের কানে এলো কুমুদ সরকারের নাম। মিলিটারীরা বাংলোর সংক্ষিপ্ত আদালতে কুমুদ সরকারের বিচার করলো । শাস্তি নির্ধারিত হলো দশ ঘা বেত্রদন্ড । বেত্রদন্ডের এক পর্যায়ে কুমুদ সরকার অচৈতন্য হয়ে পড়েন, মিলিটারীরা তখন অচৈতন্য কুমুদ সরকারকে ফুটবল বানিয়ে বাংলোর সম্মুখস্থ সবুজ মাঠে ফুটবল প্র্যাকটিস করে। লোকমুখে এই নৃশংস আচরণের চাক্ষুষ বর্ণনা শুনে আমাদের হৃদকম্প উপস্থিত হয়। কুমুদ সরকারের জন্য সমবেদনা বোধ করলেও আমরা তা ভুলেও কোথাও প্রকাশ করলাম না । আমার বাবা-কাকা সবাই খুব ভয় পেয়ে গেলো । দুর্নীতির জন্য না হিন্দু-ব্যবসায়ী হওয়ার জন্যই কুমুদ সরকার এমন শাস্তি পেলেন—এ প্রশ্নের সদুত্তর না পেয়ে এলাকার হিন্দু-মুসলমানরা যখন প্রবল দ্বন্দ্বে ভুগছিলেন তখন একদিন খবর বেরুল যে, ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান মৌজালি তালুকদারকেও মিলিটারীরা ধরতে গিয়েছিল । পূর্ব থেকেই মৌজালি সাহেব ছিলেন সতর্ক—আক্রমণমাত্র তিনি বোর্ড-অফিসের দক্ষিণের জানালা দিয়ে ইঁদুরের মতো দ্রুত নির্গত হন এবং মাথা উঁচু আমনধানের ক্ষেতের ভিতর দিয়ে পালিয়ে বাঁচেন ।
ঘটনাটি একদিকে কিছুটা হাস্যরসের সৃষ্টি করে, অন্যদিকে হিন্দুদের মনে এই স্বস্তিভাব নিয়ে আসে যে, হিন্দুদের প্রতি কোনো বিশেষ বিদ্বেষ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে আইয়ুব খান রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন নি। ফলে আমার বাবা-কাকাসহ এলাকার হিন্দুরা দ্রুত আইয়ুবের সমর্থক হয়ে ওঠেন । শারীরিকভাবে আহত এবং সামাজিকভাবে অপমানিত কুমুদ সরকার পালিয়ে ভারতে চলে যান। কিছুদিন পলাতক থাকার পর চেয়ারম্যান মৌজালি সাহেব ডাক-বাংলোয় এসে মিলিটারীদের কাছে সারেন্ডার করেন। ততদিনে মার্শাল ল’-এর প্রথম ছোবলটা চলে গেছে ।
চুল ছোট করার জন্য নন্দুরা থেকে খুইদ্যা নাপিতকে আমাদের বাড়িতে ডেকে আনা হয়। মিলিটারীদের পছন্দসই মাপে চুল ছাঁটার ব্যাপারে সে অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা তার কাছে চুল কাটাতে রাজি হতাম না, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা মুখ বুজে খুইদ্যা নাপিতের ভোঁতা ক্ষুদের তলায়, তার ফাঁদ-সদৃশ দুই-হাঁটুর ভিতরে মস্তক অবনত করতে বাধ্য হই। আইয়ুব খান রাতারাতি খুইদ্যা নাপিতের ভাগ্য বদলে দেন । একেই বলে বিপ্লব ।
ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তা ধরে একদিন চারপাঁচজন মিলিটারী এসে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হয় । আমাদের বাড়িটি তখন একেবারে ছবির মতো তকতকে ঝকঝকে । বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার সামরিক নির্দেশটি এ-বাড়িতে যথাযথভাবে পালিত হয়েছে দেখে মিলিটারীরা খুশি হয় । আমাদের গাড়ি-বারান্দায় চেয়ার টেবিলগুলি তাদের আগমন দুর্ভাবনায় পূর্ব থেকেই সাজানো ছিল । তারা আরাম করে সেখানে উপবশেন করেন । কাকার সঙ্গে আকারে –ইঙ্গিতে এবং ইংরেজী-উর্দু-মিশিয়ে তারা আলাপ শুরু করে । কাকাও ভাঙা-ভাঙা উর্দুতে মিলিটারীদের কথার জবাব দেয়ার চেষ্টা করেন । এক পর্যায়ে উর্দু-বাংলায় মিশিয়ে আমার কাকা মিলিটারীদের কিঞ্চিৎ জলপানের জন্য অনুমতি প্রার্থনা করেন । কিন্তু ভেতর-বাড়িতে তখন তাদের জন্য টাটকা ঘিয়ের লুচি ভাজা হচ্ছিল । মিলিটারীরা শুধুমাত্র চা খেতে রাজি হয়। তখনই দেখা দেয় বিপদ-বাড়িতে চা ছিল কিন্তু চিনি ছিল না। বাজার থেকে তখন চিনি সম্পূর্ণ উধাও হয়েছে । মিলিটারীরা আমাদের আয়োজনের সবচেয়ে দুর্বল স্থানটিতেই আঘাত করলো । বললো: ‘কুছ নেহি, সেরেফ চা নিকলাও ।’
গলদঘর্ম হয়, অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে, যথাসম্ভব উর্দু শব্দে বাক্যগঠন করে কাকা বললেন: ‘ঘরমে তো চিনি নেহি, খেজুরের গুড় হ্যায়, গুড়ের চা খাবেন?’
ভাগ্য ভালো, বাজারে চিনির দুষ্প্রাপ্যতার সংবাদ মিলিটারীদেরও জানা ছিল, তারা বিরক্তি প্রকাশ না করে বললো: ‘ঠিক হ্যায়, কুছ পরোয়া নেহি। হামরা সাথ বাংলো মে চলো, তুমলোগকো চিনি দে দেয়গা ।’ তারা দ্রুত মিলিটারী কায়দায় উঠে পড়লো । আমার কাকাতো ভাই রামেন্দুদাকে চিনি আনতে পাঠানো হলো মিলিটারীদের পিছু পিছু । নিরাপদ দূরত্ব রেখে আমরাও ছুটলাম দল বেঁধে । বাংলো থেকে কিছুটা দূরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকলাম । কুমুদ সরকারের স্মৃতি আমাদের মনে, বলা তো যায় না, বাঘের খাঁচা থেকে ভালোয় ভালোয় না ফেরা পর্যন্ত আমাদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই সের ধবধবে সাদা চিনির একটি পুটলি নিয়ে রামেন্দুদা যখন ডাকবাংলো থেকে বেরিয়ে এলো তখন আমাদের আর আনন্দের সীমা থাকলো না। আমাদের চিনি প্রাপ্তির সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লো ।দীর্ঘদিন সেই চিনির অংশবিশেষ মিলিটারীদের জন্য যত্নসহকারে তুলে রাখা হয়েছিল—কিন্তু আমাদের বাড়িতে চা খাওয়ার জন্য ঐ মিলিটারীরা আর আসে নি। আইয়ুব খানের আগমনে আমাদের লাভ হয়েছিল দুই সের সাদা চিনি।
আমরা যখন পঞ্চনদের দেশ থেকে আসা মিলিটারীদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ তখন হঠাৎ একদিন যশমাধবের আজিজ ভাইকে পুলিশ গ্রেফতার করে। দেশের মানুষ যখন আইয়ুব খানের প্রশংসার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিল না, তখন আজিজ ভাই নাকি আইয়ুবের নিন্দা করে কোথায় একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন। তা এরকম করলে তো এমন হবেই।
❤ Support Us