- ধা | রা | বা | হি | ক
- নভেম্বর ১৪, ২০২১
আমার ছেলেবেলা

আমরা ভাইবোনেরা ক্রমশ বড় হচ্ছি, আমাদের পড়াশোনার খরচ বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম, কিন্তু আমাদের আয়ের নতুন কোনো পথ খুলছে না। বাবা কবিরাজী করে ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করলেন, কিন্তু তাতে লাভের চাইতে ক্ষতিই বাড়লো, দেখা গেলো বিনা পয়সার রোগীদের ভিড় বাড়ছে। ফলে কবিরাজী করে ভাগ্য পরিবর্তনের আশা ভেবেই কিছু কিছু ঔষধ তৈরী অব্যাহত রাখলেন, যেমন লক্ষ্মীবিলাস, শূলহরণ, চ্যবনপ্রাশ ইত্যাদি।
আমাদের জমিগুলি তেমন উর্বর ছিল না অধিকাংশই ছিল এক-ফসলী। আমন এবং আউস ধান যা পাওয়া যেতো, বছরের খাদ্য-চাহিদা পূরণেই তা লেগে যেতো। আমাদের জমিগুলি ছিল গ্রামের দক্ষিণপ্রান্তে, নদীর তীর ঘেঁষে। বর্ষার সময় প্রায়ই নদীর জলে ডুবে যেতো বলে সেই জমিতে ধানচাষ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।পাট চাষ করা হতো। যে বছর পাট চাষ ভালো হতো এবং বাজারে পাটের ভালো দাম পাওয়া যেতো, সে বছর আমাদের চিন্তা থাকতো না। কিন্তু প্রায়ই হয় পাটের চাষ খারাপ হতো, অথবা পাটের দাম উঠতো না। কখনো কখনো জাঁক দেয়া পাটের চালি বন্যার জলে ভেসে যেতো, মাঝে-মাঝে চুরিও হতো। আমরা যতই বড় হতে লাগলাম, আমাদের অভাবও বাড়তে থাকলো। জ্যাঠামশাই বাড়ি-ভাড়া বাবদ মাসে ত্রিশ টাকা করে বাবা ও কাকার নামে মানিঅর্ডার পাঠাতেন। তেল নুন গুড় মসলার পেছনেই ওই টাকা লেগে যায়। গৌরীপুর বাজারে আফতাবউদ্দিন মুন্সীর দোকান থেকে আমরা বাকিতে জিনিসপত্র আনতাম—বাড়ি-ভাড়ার টাকা এলে সেই বাকি শোধ করা হতো। আমাদের বাড়ি-ভাড়া বাড়তো না, কিন্তু মুন্সীর দোকানের পাওনা ক্রমাগত বেড়ে যেতে থাকতো। মুন্সী সাহেব ছিলেন বাবার বন্ধু কিন্তু পাওনা টাকার তাগিদ দিতে তিনি প্রায়ই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। মাখন সরকারের কাপড়ের দোকানেও আমাদের বাকি বাড়তে থাকে। আমার স্কুলের বেতন, পরীক্ষার ফিস এবং খাতা-বই কেনার পয়সা যোগাড় করা ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের আর্থিক সংকটের চিহ্নগুলোও ক্রমশ প্রকট হয়ে ওঠে। মা বাড়িতে ঢেঁকি চালু করেন। ইতিপূর্বে হদীসম্প্রদায়ের মেয়েরাই আমাদের বাড়ি থেকে ধান নিয়ে যেতো এবং ঢেঁকি-ছাঁটা চাল দিয়ে যেতো। এই প্রথাটার নাম বাড়ানি। এতে প্রতি মণ ধান ছাঁটার পেছনে পাঁচ ছয় সের চাল দিতে হয়। বাড়িতে ঢেঁকি চালু করে মা সেই চালটা বাঁচাবার উদ্যোগ নিলেন। তাতে মায়ের কাজ তো বাড়লোই, আমাদের উপরও চাপ পড়লো। ধান উনুনে সিদ্ধ করা, রৌদ্রে শুকনো এবং তারপর ঢেঁকিতে ছাঁটা—এক বিরাট ঝামেলার ব্যাপার। মায়ের কষ্ট দেখে আমার কষ্ট হতো, আমি মাকে সাহায্য করতাম। মা’র একমাত্র ছোট ভাই, আমাদের প্রদীপ মামা, আমাদের বাড়িতে থেকে বারহাট্টা স্কুলে পড়তেন। তিনি পড়াশোনায় ভালো ছিলেন না। বয়সে আমার চেয়ে বছর তিন চার বড় হলেও ফেল করতে করতে আমার সহপাঠীতে পরিণত হয়েছিলেন। আমরা ভাই-বোন এবং প্রদীপ মামা মিলে ঢেঁকি পাড় দিতাম। মা ঢেঁকির আগায়, লুটের সামনে বসে হাত দিয়ে ধান নেড়ে দিতেন। কিছুক্ষণ পর পর আলগা হয়ে যাওয়া ধানের তুষ কুলা দিয়ে ঝাড়তেন—এই প্রক্রিয়াটা চলতে থাকতো যতক্ষণ না ধানের তুষ পুরোপুরি অপসারিত হয়ে ধানের ভিতর থেকে সাদা ধবধবে চাল বেরিয়ে আসতো। একবার মায়ের ডান হাতের দুটো আঙুল চুরুনের আঘাত লেগে থেঁতলে যায়। রক্তে ভিজে সাদা চালগুলি লাল বর্ণ ধারণ করে। এই দুর্ঘটনার জন্য আমিও কিছুটা দায়ী ছিলাম, মায়ের থেঁতলে যাওয়া আঙুল এবং রক্তে-ভেজা লাল চালের দিকে তাকিয়ে আমার খুব কষ্ট হলো। বাবা তখন মাকে এ কাজ থেকে নিবৃত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু কিছুদিন বিরতি দিয়ে মা আবার ধান ভাঙার কাজ শুরু করেন।
রবীন্দ্রনাথের মতো এমন নিষ্ঠুর মানুষ, পৃথিবীতে আর নেই। যদি সমুদ্র-দর্শনের আনন্দ দিয়ে মাসির বুকে রাখালকে ফিরিয়ে দিতেন, তাহলে কী ক্ষতিটা ছিল? দুঃখের ভিতর দিয়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়াই কি কবির কাজ?
আমাদের ঘরে প্রায়ই চাল থাকতো না, বিশেষ করে আমন ধান শেষ হয়ে যাওযার পর আউস ধান আসার আগের কয়েকটা দিন ছিল খুবই সংকটপূর্ণ—আমরা পাকতে শুরু করা ধানক্ষেতের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ভালো করে পাকবার সময় না দিয়েই ধান কেটে আনা হতো। বর্ষার দিনে ধান শুকনো যখন দুরূহ হয়ে উঠতো, তখনই হতো বিপদ। পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা নিয়ে ছোট ভাইবোনেরা মায়ের পাশে ঘুরঘুর করতো। আমি তখন পড়াশোনা এবং খেলাধুলা ফেলে মায়ের সাহায্যে এগিয়ে যেতাম। সদ্য ঢেঁকিছাঁটা চাল মা উনুনে চড়াতেন।
বাইরে থেকে আমাদের বাড়ির অবস্থা দেখে যেমনটি মনে হতো, ভেতরের অবস্থা ছিল তার বিপরীত। রসুনবাটা দিয়ে মা এক ধরনের ডালের বড়া (গ্রাম্য ভাষায় বলা হতো ডাইলের চটা) তৈরী করতেন, সেই বড়া দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে আমি স্কুলে চলে যেতাম। টিফিনের পয়সা থাকতো না, পেটে প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে দেড় মাইল হেঁটে বিকেলের দিকে যখন বাড়ি ফিরতাম, তখন নিজেকে খুবই দুঃখী মনে হতো। যে-জেলেরা একসময় আমাদের সস্তায় এবং কখনো বা বিনামূল্যে মাছ দিয়ে যেতো, তারা সবাই প্রায় ভারতে চলে গেছে। বাজারে মাছের দাম বাড়ছে। বাজার থেকে মাছ কেনার পয়সা জুটতো না। পূর্বে আমার মাছ ধরার ব্যাপারে বাবা আপত্তি করতেন, কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর আপত্তি তো করতেনই না, বরং খেলার পেছনে সময় নষ্ট না করে বিকেলে বড়শি নিয়ে মাছ ধরা ও মাঠে গরুকে ঘাস খাওয়ানোর ব্যাপারে আমাকে উৎসাহ দিতেন।
দাদামণি ভারতে চলে যাওয়ায়, তাঁর অবর্তমানে আমিই বাড়ির বড় ছেলে। আমাকে কেন্দ্র করেই বাবার ভবিষ্যতের স্বপ্ন আবর্তিত হতে শুরু করে। আমিই তাঁর প্রধান ভরসা — আমি লেখাপড়ায় মোটামুটি ভালো। পরীক্ষায় পাশ করে একদিন বড়ো চাকরি করে পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন করব, এমনটিই তিনি প্রত্যাশা করতেন। আমিও তেমনটিই চাইতাম—কিন্তু বৃত্তি পরীক্ষায় বৃত্তি না পাওয়ায় বাবা যেমন ব্যথিত হন, আমার আত্মবিশ্বাসেও তেমনি চিড় ধরে। অসহায় ডুবন্ত মানুষ যেমন বাঁচার আশায় খড়কুটো আকড়ে ধরে, বাবার অবস্থাটাও তেমনি। সংসারের টানাপোড়েনর মধ্যেও তিনি আমার পেছনে অর্থ লগ্নি করতে থাকেন। অংকের জন্য অংকের যাদুকর রামবাবুকে রেখে দেন, ইংরেজির জন্য মালেক মাস্টার এবং বাংলা ও সংস্কৃতের জন্য আমাকে বারহাট্টার প্রখ্যাত পন্ডিত, হরেন্দ্র গোস্বামীর সংস্কৃত টোলে ভর্তি করিয়ে দেন। বারহাট্টার বুড়ো সাব-রেজিষ্ট্রার সাহেবের এক পুত্র জনাব নূরুল হক এম, এ পরীক্ষা দিয়ে বারহাট্টায় বসে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন—আমাকে ইংরেজী পড়ানোর জন্য বাবা তাঁকে পাকড়াও করেন। বাবার অনুরোধ তিনি এড়াতে পারেন নি, ফলে কিছুদিন আমি তাঁর কাছেও ইংরেজির তালিম নিই। বাবা আমাকে নিয়ে সিভিল সার্ভিসের স্বপ্ন দেখতেন। মালতী কাকা ও অতসী কাকার দৃষ্টান্ত তুলে আমাকে প্ররোচিত করতেন, আমি যেন তাঁদের যোগ্য উত্তসূরি হতে পারি। তিনি অতসী কাকার মেধার দিকটাই শুধু বলতেন, তাঁর পাগল হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা যেতেন এড়িয়ে। আমিও একটা বড়কিছু হওয়ার বাসনা বুকে নিয়েই রাত্রে পড়তে বসতাম; কিন্তু নৌকোবিলাসের রাধিকা কৃষ্ণের বিরহে কাতর হয়ে যখন গ্রামের কোনো বাড়িতে করুণ সুরে গান ধরতো:
‘শ্যামকুণ্ডের মাটি তুলি,
যমুনার জলে গুলি’…
কিম্বা
‘না পোড়ায়ো রাধা অঙ্গ
না ভাসায়ো জলে’…আর সেই গানের সুরে তাল মিলিয়ে যখন বংশীবাদকের আড়বাঁশটি বেজে উঠতো রাতের নির্জনতাকে ছিন্নভিন্ন করে, তখন আমার মন মোগল সাম্রাজ্যের পতনের ইতিহাসকে অতিক্রম করে ছুটে যেতো দূরে, আরো দূরে। রাধার বিরহবেদনার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতো আমার কৈশোরিক চিত্তলোক। আমি বই বন্ধ করে মন্ত্রমুগ্ধের মতো গিয়ে হাজির হতাম ঢপযাত্রার আসরে। আমার চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়তো; কারো চোখে পড়ার আগেই আমি তা মুছে ফেলতাম। ওই অভিনয় কৃত ঘটনাসমূহ যে সত্য নয়, তা আমার মন কিছুতেই মানতে চাইতো না।
আমার মনের মধ্যে এমন সরল আবেগ সৃষ্টির পেছনে বাবার ভূমিকাটাও একেবারে গৌণ ছিল না। তিনি চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করতেন। একবার তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’ কবিতাটি আবৃত্তি করে আমাদের শুনিয়েছিলেন। রাখালের মৃত্যু আমাকে এতটাই ব্যথিত করেছিল যে আমাকে সামলাতে গিয়ে বাবাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের মতো এমন নিষ্ঠুর মানুষ, মনে হয়েছিল পৃথিবীতে আর নেই। তিনি যদি সমুদ্র-দর্শনের আনন্দ দিয়ে মাসির বুকে রাখালকে ফিরিয়ে দিতেন, তাহলে কী ক্ষতিটা ছিল? দুঃখের ভিতর দিয়ে মানুষকে আনন্দ দেওয়াই কি কবির কাজ? বাবা আমার প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারতেন না—তিনি আমাকে বোঝাতে চাইতেন, এসব সত্য নয় বাবা, কল্পনা। বললে কী হবে, আমার মনে হতো, কল্পনাই সত্য। এরপর বাবা আমাকে আর দুঃখের কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতেন না। আপন মনে বলতেন : ‘life is mathematics, not poetry.’
❤ Support Us