Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • জানুয়ারি ১৯, ২০২২

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

চিত্র: ধীরাজ চৌধুরী

বাবা না-শোনালে কী হবে ততদিনে কবিতা এবং কবিদের প্রতি আমার মনের মধ্যে একটা দুর্বলতা সৃষ্টি হয়ে গেছে। আমাদের আশপাশের গ্রামে কোথাও কোনো কবি আছেন কিনা সে-সম্পর্কে খবর নিতে থাকলাম কিন্তু পাওয়া গেলো না—একজন লোককবির সন্ধান পাওয়া গেলো, তাঁর নাম যোগেন্দ্র চক্রবর্তী। তিনি লোকান্তরিত হয়েছেন আমার জন্মের অনেক আগেই। তিনি পার্শ্ববর্তী বারঘর গ্রামের লোক ছিলেন, মুখে মুখে কবিতা বানাতে পারতেন। আমি খাতাকলম নিয়ে  লেগে গেলাম তাঁর কবিতা সংগ্রহের কাজে; কিন্তু সংগ্রহ করতে নেমে দেখলাম মাঠ একেবারে ফাঁকা। যোগেন্দ্র চক্রবর্তীর কথা অনেকেই মনে রেখেছে কিন্তু তাঁর রচিত কোনো সম্পূর্ণ কবিতা পাওয়া গেলো না। এলাকার বিভিন্ন মানুষকে নিয়ে তিনি ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করতেন; সেগুলোর কিছু কিছু সংগৃহীত হলো। তাঁর কবিতা সংগ্রহ করতে গিয়েই আমি ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করার প্রেরণা লাভ করি। বারঘর গ্রামের হাতুড়ে বৈদ্য আবু ডাক্তার হন আমার প্রথম শিকার। আবু ডাক্তারের আসল নাম ছিল কৃষ্ণপ্রসন্ন চক্রবর্তী। ডাক্তারি শুরু করার আগে তিনি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের যজমানি করে বেড়াতেন। ক্রমবর্ধমান হারে যজমানদের দেশত্যাগ এবং তাঁদের আর্থিক অবস্থার অবনতি ঘটার ফলে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন আবু ডাক্তার দেখলেন বিপদ , যজমানিতে চলবে না। নিম্নবর্ণের হিন্দুদের পুরোহিত হওয়ার ব্যাপারে তাঁর আপত্তি ছিল। শাস্ত্রপাঠের পরিবর্তে তিনি সহজ চিকিৎসাপদ্ধতি করায়ত্ত করার দিকেই মনোযোগী হন এবং অত্যন্ত আকস্মিকভাবেই একদিন তিনি নিজেকে ডাক্তার বলে ঘোষণা করেন। নিম্নবর্ণের যে হিন্দুরা এতদিন তাঁর ধর্মীয় চিকিৎসার বাইরে ছিল, এবার তাঁরাও জীবিকা-উপার্জনের সহজ কাঁচামালে পরিণত হয়, নবাগত মুসলমানদের মধ্যেও তাঁর চিকিৎসা প্রসার লাভ করে। আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কিঞ্চিৎ এল্যোপ্যাথি মিশিয়ে তিনি এক বিশেষ ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি আবিষ্কার করেন। অ্যালকালি মিকশ্চার বলে একটা ঔষধ তখন বারহাট্টা সরকারী দাতব্য চিকিৎসালয়ে খুব চালু ছিল। এলাকার বিভিন্ন রোগী বিভিন্ন রোগ নিয়ে ওই দাতব্য চিকিৎসালয়ে যেতো, কিন্তু ফেরার সময় দেখা যেতো সবাই একই ঔষধ নিয়ে ফিরছে। আবু ডাক্তার ওই দাতব্য চিকিৎসালয় থেকেই অ্যালকালি মিকশ্চার তৈরীর বিদ্যাটা শিখেছিলেন; পরে মহৌষধিটির সাম্যবাদী প্রয়োগের ক্ষেত্রটাকে তিনি আরও প্রসারিত করেন। তাঁর খ্যাতির আরও একটা কারণ ছিল এই যে, তিনি রোগীদের ভিজিট প্রদানের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। অর্থের একাধিপত্যকে অস্বীকার করে বাজারে মূল্য সৃষ্টিকারী  যে কোনো বস্তুকেই তিনি ভিজিট রূপে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলে তাঁর পসার ও উপার্জন একই সঙ্গে বৃদ্ধি পায়। আমরা তাঁকে প্রায়ই রোগীদের বাড়ি থেকে আম কাঁঠাল আলু লাউ কলা মূলা নারকেল চাল ডাল ইত্যাদি পুঁটলি বেঁধে নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেখতাম। সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করতো, কিন্তু তিনি নির্বিকার চিত্তে উচ্চকিত হাসিতে সবকিছুকে উড়িয়ে দিতেন। এটি ছিল তাঁর এক মোক্ষম কৌশল।

তাঁকে নিয়ে লেখা আমার কবিতাটি প্রথমে ছোটোদের মধ্যে এবং পরে বড়দের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। একসময় তা আবু ডাক্তারের কানেও পৌঁছে। একদিন স্কুলে যাবার পথে তাঁর সঙ্গে আমার হঠাৎ দেখা হয়ে যায়—তিনি সকালের বাজার করে বারহাট্টা থেকে ফিরছিলেন। মুখোমুখি হতেই তিনি একগাল হাসিতে ফেটে পড়লেন, চিনেও না চেনার ভান করে বললেন: ‘নির্মলেন্দু না?’
আমি সম্মতিসূচক মাথা নেনে বললাম : ‘হ।’
তিনি মৃদু হেসে বললেন: ‘তুমি নাকি কবি হইছো ?’
বুঝলাম আসল কথাটা তিনি একটু পরেই বলবেন। কী উত্তর দেব তাই ভাবছিলাম। কবি শব্দটা নিজের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় বেশ লজ্জাও পাচ্ছিলাম। চোখ মাটির দিকে নুয়ে এলো। আমতা আমতা করে বললাম: ‘না যোগেন্দ্র চক্রবর্তীর কবিতা সংগ্রহ করতে গিয়ে হঠাৎ উচ্ছে হলো কিছু একটা …’ তিনি আমার মুখের কথা কেড়ে নিলেন। কবি যোগেন্দ্র চক্রবর্তী যে ব্যঙ্গ কবিতা লিখতেন সেটা তাঁর ভালোই জানা ছিল। ফলে তাঁর রাগটা যোগেন্দ্র চক্রবর্তী এবং আমার মধ্যে ভাগাভাগি হয়ে গেল: ‘ও, তুমি যোগেন্দ্রর শিষ্য হইতে চাও?’
আমি মাথা নেড়ে বললাম : ‘না, না তা কি সম্ভব? তিনি অনেক বড় কবি ছিলেন, আমি তো সবেমাত্র …’ এ পর্যন্ত বলেই আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। তিনিও আমার সঙ্গে হাসিতে যোগ দিলেন। চারদিকে তাকিয়ে নিয়ে বললেন:
‘তোমার কবিতাটা আমারে দেখাইও তো।’
অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে মাথা নেড়ে আমি বললাম : ‘আচ্ছা। ‘
মনে মনে বললাম আমার কোথায়, এ-তো আপনারই কবিতা।
আমার আরও একটি ছোট্ট কবিতা ভাইবোনদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কবিতাটি হচ্ছে মাত্র দুই পঙক্তির:
কচি পাঁঠা বৃদ্ধ মেষ
ভগল কবিরাজ ডাক্তার এষ।
কচি পাঁঠা বৃদ্ধ মেষ—একটি প্রচলিত প্রবাদ, আমার ভোজনরসিক কাকা প্রায়ই বলতেন। ওই প্রবাদের সঙ্গে আমাদের গ্রামের হদীসম্প্রদায়ের একজন কবিরাজ (ঝাড়ফুঁকও তার চিকিৎসার অন্তর্ভুক্ত ছিল) ভগলচন্দ্র সিংহ এবং সেনবাড়ির জনৈক ঘরজামাই, স্বঘোষিত ডাক্তার শচীন্দ্রচন্দ্র এষ মহাষয়কে যুক্ত করে লেখা দুই পঙক্তির এই কবিতাটি গ্রামের ছেলেপেলেরা চিৎকার করে পথে ঘাটে আওড়াতো। ভগল সিংহের সঙ্গে এষ বাবুর কোনো প্রিয়-সম্পর্ক পূর্বে ছিল না, কিন্তু পরে আমার ওই কবিতার তাড়া খেয়ে এই দুইজনের মধ্যে এক মধুর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পরিবেশের  উপর কবিতার প্রভাব দেখে আমি ব্যাপারটার মধ্যে বেশ একটা মজা পেয়ে যাই। আমি অনুভব করতে পারি যে, আমার মাথার মধ্যে একটা পোকা ঢুকেছে, বাবার ভাষায় ‘কবিতার পোকা।’


  • Tags:

Read by:

❤ Support Us
Advertisement
Hedayetullah Golam Rasul Raktim Islam Block Advt
Advertisement
Hedayetullah Golam Rasul Raktim Islam Block Advt
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা
error: Content is protected !!