- ধা | রা | বা | হি | ক
- জানুয়ারি ১৯, ২০২২
আমার ছেলেবেলা

গড়মা গ্রামের মণীন্দ্র গুণ মহাশয় বারহাট্টা থেকে মাইল চারেক দূরে বাউসি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। তিনি ছিলেন বি. এ. বি. এল । আমরা যখন সেভেন ক্লাসে পড়ি তখন তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়ে বারহাট্টা চলে আসেন। তিনি ছিলেন একজন প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নিষ্ঠাবান আদর্শ শিক্ষক। যৌবনের প্রথম দিনগুলি তিনি কাটিয়েছিলেন মাণিকগঞ্জের ইব্রাহিমপুর স্কুলে—তেইশবছর তিনি ঐ স্কুলের প্রধানশিক্ষক ছিলেন। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে ঢাকার প্রখ্যাত প্রকাশনী সংস্থা খান ব্রাদার্সের প্রতিষ্ঠাতা জনাব মোসলেম আলী খান এবং বাংলা একাডেমীর প্রোগ্রাম অফিসার জনাব মোতাহার আহমদ—এই দুজনের মুখে আমি মণীন্দ্র গুণ মহাশয়ের অনেক প্রশংসা শুনেছি। আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ যে খান ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, তার পেছনেও মণীন্দ্র গুণ মহাশয়ের একটা পরোক্ষ ভূমিকা ছিল। মোসলেম খান সাহেব আমার পদবী দেখেই আমার প্রতি আকৃষ্ট হন। মণীন্দ্র গুণ মহাশয় ছিলেন আমার জ্ঞাতি ভাই। সম্পর্কে ভাই হলেও তিনি চিলেন আমার বাবার সমবয়সী। তিনি এতোটাই রাশগম্ভীর প্রকৃতির ছিলেন এবং তাঁর শিক্ষকসুলভ গাম্ভীর্যটা এমনভাবে তিনি সর্বদা বজায় রেখে চলতেন যে, বাড়িতেও আমরা তাঁকে দাদা বলার সাহস পেতাম না, আমরা বাড়িতে গেলেও তাকে স্যার বলেই সম্বোধন করতাম। তিনি যে আমাদের জ্ঞাতিভাই একথাটা একসময় আমরা ভুলে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। পড়া না পারলে কিংবা স্কুলে বা স্কুলের চৌহদ্দির বাইরে কোথাও কখনো কোনো অশোভন ব্যবহার করে ধরা পড়লে তিনি ছাত্রদের এমনসব আপমানজনক শাস্তির ব্যবস্থা করতেন যে কিছুদিন স্কুলে মুখ দেখানোই কঠিন হয়ে পড়তো । তাঁর একটি প্রিয় শাস্তি ছিল হাঁটু মুড়ে কান ধরে শ্রেণীকক্ষের বাইরের বারান্দায় ছাত্রদের এমনভাবে বসিয়ে রাখা যাতে অন্যান্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদেরও নজরে পড়ে। এই শাস্তিটা ছিল তাঁর একেবারে নিজস্ব আবিষ্কার। আর ক্লাসের ভিতরে তো প্রায়ই আমাদের নানা রকমের শাস্তি ভোগ করতেই হতো। পরে অবশ্য অপমানিত শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, ঐ স্যারের দন্ড ভোগ করাটা আর আমাদের কাছে তেমন একটা অগৌরবের ব্যাপার বলে মনে হতো না।
স্যারের প্রিয়পাত্র হওয়ার জন্য আমাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না, কিন্তু কাজটা ছিল খুবই কঠিন। সমগ্র জেলায় বৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েও মতিই স্যারের কাছ থেকে কোনো প্রকারের সমীহ আদায় করতে পারে নি—আমরা কোন ছাড়?
একবার স্যারের প্রিয় পাত্র হওয়ার আশায় আমি আমার বন্ধু হুসেন আলীর সঙ্গে একটা চরম বিশ্বাসঘাতকতা পর্যন্ত করেছিলাম। হুসেন আলী তখন নিয়মিত বিড়ি খেতো । বিড়ি না খেতে পারলে নাকি তার ভাত হজম হতো না। পড়ায় মন দিতে পারতো না । টিফিনের সময় আমরা দল বেঁধে বাজারে যেতাম বুট, বাদাম, লজেন্স, বিস্কুট এই সব কিনতে। হুসেন আলী তখন টেন্ডুপাতার পরিমল বিড়ি কিনতো। স্যার জানতেন, ছাত্রদের মধ্যে বিড়ি খাওয়া চালু হয়েছে—সম্ভবত তিনি সুনির্দিষ্ট অভিযোগও পেয়ে থাকবেন। ক্লাসে ঢুকেই তিনি একদিন আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন:
‘তোদের মধ্যে বিড়ি-খোর কে কে আছিস, দাঁড়া। ‘
অনেকক্ষণ কেটে গেলো, কেউ দাঁড়ালো না। দাঁড়াবার কথাও নয়, স্যার হয়তো তেমনটি আশাও করেন নি। এবার তিনি বললেন:
তোদের মধ্যে যে অন্তত চার পাঁচজন বিড়ি খানেঅলা আছে, তাও আমি খবর রাখি। তোরা যারা বিড়ি খাস না, তোরা বল দেখি কে বিড়ি খায়।
হুসেন আলী ছিল আমার পাশে, সে আমার হাতে সঙ্গে সঙ্গে চিমটি কাটলো, তারমানে আমি যেন তার কথা না বলি। চিমটি খেয়ে আমি সতর্ক হয়ে পড়লাম, তখন আমার পাশে হুসেন আলী, সামনে স্যার। ভাবলাম স্যারের প্রিয়তা লাভের এই মোক্ষম সুযোগটা হাতছাড়া করাটা ঠিক হবে না। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, হুসেন আলীর সঙ্গে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করব। সিদ্ধান্তের উত্তেজনায় আমার নাড়ীর চঞ্চলতা বৃদ্ধি পেলো—সেই চঞ্চলতা স্পর্শ করলো হুসেন আলীকেও। সে আবারও চিমটি কাটলো আমার হাতে, এবার পূর্বের চাইতে আরো জোরে। কিন্তু কাটলে কী হবে, প্রথমবার চিমটি কেটে সে যে ভুলটা করে ফেলেছিল অজস্র চিমটিতেও তা আর শোধরানোর উপায় ছিল না, কেননা ততক্ষণে আমি আমার মনস্থির করে ফেলেছি । আমাদের দু’জনের মধ্যে যে একটা দ্বন্দ্ব চলছে, স্যার তা বেশ বুঝতে পারলেন। মনে হয় হুসেন আলীর দিকে তাঁর পূর্ব থেকেই একটা সন্দিগ্ধ দৃষ্টি ছিল। তিনি আমাকে দাঁড়াতে বললেন। আমি উঠে দাঁড়ালাম, হুসেন আলী তখনো আমাকে প্রাণপণে চিমটি কেটে চলেছে। কিন্তু আমি নির্বিকার। স্যারের দিকে তাকিয় বললাম : ‘হুসেন আলী…।’
যারা বিড়ি খায় না, কিন্তু গোপনে বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তারাও সমান অপরাধী।
একটি আধপোড়া এবং তিনটি তরতাজা বিড়িসহ হুসেন আলী স্যারের হাতে ধরা পড়লো।
যে-উদ্দেশ্যে আমি বিশ্বাসঘাতক করেছিলাম সে-উদ্দেশ্য সফল হলো না, মাঝখানে হুসেন আলীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বটা বেশ কিছু দিনের জন্য নষ্ট হল। বেবেছিলাম কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তিযোগ্য ছাত্রদের গোপন তালিকা থেকে এবার আমার নামটা কাটা যাবে। কিন্তু বাস্তবে তার কোনো প্রমাণ পাওয়া গেল না। তিনি বললেন: যারা বিড়ি খায় না, কিন্তু গোপনে বিড়ি খাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে, তারাও সমান অপরাধী। আমি তাদের চেহারা দেখলেই বুঝতে পারি। সুতরাং, নির্মলেন্দু তুমিও দাঁড়িয়ে থাকো।’
এই দিব্যদৃষ্টি সম্পন্ন শিক্ষকের পাল্লায় পড়ে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। আমরা তাঁর অসুস্থতার জন্য ভগবান এবং আল্লাহার কাছে প্রার্থনা করতাম, কিন্তু একদিনের জন্যও তিনি স্কুল কামাই করতেন না। একবার বৃষ্টির দিনে স্কুলে বেশকিছু শিক্ষক অনুপস্থিত ছিলেন। স্কুল ছুটি হয়ে যাবে ভেবে আমরা বেশ আনন্দের মধ্যে ছুটির ঘন্টার অপেক্ষা করছি, এমন সময় মণীন্দ্র স্যার বেত হাতে আমাদের ক্লাসে প্রবেশ করলেন। আমাদের ক্লাসে আসার আগে দশম শ্রেণীতে গিয়ে ছাত্রদের ‘রেইনি ডে’ একটি ইংরেজী রচনা লিখতে দিয়েছেন, নবম শ্রেণীর ছাত্রদের দিয়েছেন একই বিষয়ে বাংলা চরনা লিখতে, অষ্টমশ্রেণীর জন্য বরাদ্দ হয়েছে সুলতান মাহমুদের ভারত আক্রমন সম্পর্কে যাহা জান তাহা—এবং তারপর এসেছেন আমাদের জ্বালাতে। কেন জানি না, তিনি আমাদের ক্লাসে এসে বললেন: ‘তোরা চুপ করে বসে কবিতা লেখ। আমি আসছি।’ অন্যান্য শ্রেণীতে তাঁর নির্দেশ কতটুকু পালিত হচ্ছে তার তদারকি করার জন্য তিনি উঠে গেলেন। ভাগ্য ভালো ষষ্ঠশ্রেণীতে একজন শিক্ষক ছিলেন, তা না হলে তাদের কপালে নির্ঘাত গল্প লেখার নির্দেশ জুটতো।
আমরা স্যার চলে যাওয়ার পর চোখে সর্ষেফুল দেখতে দেখতে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। তারপর শুরু হলো সাদা কাগজের সঙ্গে উড পেন্সিলের মহাযুদ্ধ। তাতে অনেক কাগজ নষ্ট হলো, কবিতা হলো না। মতি এবং সর্ববিদ্যাবিশারদ রণজিৎ পর্যন্ত ব্যর্থ হল। যোগেন্দ্র চক্রবর্তীর কবিতা সংগ্রহ করা এবং আবু ডাক্তারকে নিয়ে ব্যঙ্গ কবিতা রচনা করার একটি পূর্ব-অভিজ্ঞতা থাকায় সবার দৃষ্টি তখন আমার দিকে নিবদ্ধ—কিন্তু আমার মনে হয় অভিজ্ঞতার কারণে নয়, স্যারের ভয়েই আমি একটি আট-পঙক্তির কবিতা দাঁড় করিয়ে ফেলতে সমর্থ হলাম। কবিতা না হোক অন্তত কবিতার মতো কিছু একটা তো হয়েছে—লিখছি আর কাটছি, এমন সময় স্যার ফিরে এলেন। এসেই বললেন:
‘কী লিখেছিস পড়।’
যাকেই বলেন সেই উঠে দাঁড়ায়, কিন্তু কিছু না পড়ে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কথাই বলে না। মতি, হেলাল, রণজিৎ, চন্দন কেউ না। তখন স্যারের দৃষ্টি পড়লো পেছনের বেঞ্চে জানলার পাশে বসা আমার দিকে—ওটাই ছিল আমার বাঁধা জায়গা।
আমি ভয়ে ভয়ে উঠে দাঁড়ালাম। আমার দাঁড়ানোর ভঙ্গির মধ্যেই প্রকাশ পাচ্ছিল যে আমি কিছু একটা দাঁড় করিয়েছি। পড়তে লজ্জা পাচ্ছিলাম। স্যার ধমকে উঠলেন: ‘ছাইমাথা কী লিখেছিস পড়’
সবাই তখন আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। আমিই তাদের শেষ-ভরসা। আমি বুকে সাহস সঞ্চয় করে কবিতাটি পড়লাম:আমি তখন পড়ি যে ভাই
বারহাট্টা হাইস্কুলে,
একে অন্যে থাকি হেথায়
ভাই বন্ধু বলে।
এই স্কুলটি অবস্থিত
কংশনদীর তীরে
আমাদের বাড়ি হইতে
দেড় মাইল উত্তরে।’ক্লাসের মধ্যে বিদ্যুৎতরঙ্গের মতো একটা আনন্দের ঢেউ খেলে গেলো। সেই আনন্দের ঢেউ যেন স্যারকেও কিছুটা স্পর্শ করলো। আমরা তাঁর চিরবিরক্ত মুখখানিতে একটা হঠাৎখুশির ঝলকানি দেখতে পেলাম। এতক্ষণ তিনি দাঁড়িয়ে ছিলেন, এবার চেয়ারে গিয়ে বসলেন। এবং আমাকে পুনর্বার কবিতাটি পড়তে বললেন। আমি পূর্বের চাইতে আরও প্রত্যয়ের সঙ্গে কবিতাটি পড়লাম। প্রথম পাঠের সময় আমার আবৃত্তির মধ্যে একটা লজ্জামিশ্রিত জড়তা ছিল, ছিল নিজের লেখা বলে—দ্বিতীয়বার পড়ার সময় মনে হলো আমি অন্য কোনো কবির কবিতা পাঠ করছি। আমার কবিতা শুনে স্যার হেসে ফেললেন। বললেন: ‘হু, তর কবিতাটি তো হইছেই মনে হয়।’ স্যারের স্বীকৃতি পেয়ে ক্লাসের মধ্যে একটা স্বস্তির ভাব ফিরে এলো। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে করে বললেন:
‘কী তরা কী কস, হইছে’
সমস্বরে সবাই বললো: ‘হইছে স্যার হইছে। ‘
স্যার বললেন: ‘যা, আজ তরার ছুটি।’
আমাদের ছুটি দিয়ে মৃদু হেসে তিনি ক্লাস থেকে বেরিয়ে গেলেন। ক্লাসের সবাই আমাকে ঘিরে ধরল। আমার কবিতাটা হয়ে যাওয়াতে সবাই খুব খুশি। বন্ধুরা আমাকে কবি বলে ক্ষেপাতে শুরু করল। আমি যেমন লজ্জা পেলাম তেমনি একটু গর্বিতও বোধ করলাম। আমার মনে হলো, আমি অন্য সবার চেয়ে আলাদা, আমার একটা গোপন শক্তি আছে।
❤ Support Us