Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ডিসেম্বর ১০, ২০২১

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

চিত্র: ধীরাজ চৌধুরী

আমি যখন অষ্টম শ্রেণীতে তখন আমাদের স্কুলে একজন বাংলার শিক্ষক আসেন, সদ্য বি.এ পাস করে জীবনের প্রথম চাকুরিতে ঢুকেছেন।  তাঁর নাম জনাব মুখলেসুর রহমান। ব্রাক্ষ্ণণবাড়িয়ার নবীনগর থানায় তাঁর বাড়ি। দীর্ঘ দেহ, বড়ো চোখ, মিষ্টি কণ্ঠস্বর—তাঁর চলাফেরা এবং কথাবলার ঢং সবই অন্যদের থেকে আলাদা। তিনি সর্বদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরতেন। আমরা বলতান কবি কবি ভাব। কবিতা লিখতেন কি না জানি না, কিন্তু চমৎকার কবিতা আবৃত্তি করতেন, প্রথম দিন ক্লাসে ঢুকেই তিনি আমাদের চমকে দিলেন এই বলে যে, তাঁর প্রিয় কবি মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল—এই তিন প্রধানের কেউ নন, তাঁর প্রিয় কবির নাম জীবনান্দ দাশ। এমন আশ্চর্য কথা শুনলে কার না কৌতূহল হয়। আমরা স্যারের প্রতি দারুণ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। জীবনানন্দের কথা তখন আমরা শুননি বললেই চলে। পাঠ্য পুস্তকে অনেক কবির মধ্যে জীবনান্দ নামে একজন কবিও আছেন বটে, কিন্তু তাই বলে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মাইকেল এঁদের চেয়েও তিনি স্যারের প্রিয়? আমাদের অন্য কোনও শিক্ষক তো জীবনানন্দের কথা বলেন নি, তাহলে? মুখলেসুর রহমান স্যার অতঃপর পাঠ্য বইয়ের অন্তর্ভুক্ত জীবনানন্দের কবিতাটির প্রতি আমাদের দূষ্টি আকর্ষণ করলেন। কবিতটির নাম ‘আবার আসিব ফিরে।’ তিনি আমাদের কাউকে কাউকে কবিতাটি আবৃত্তিই করতে বললেন,  আমিও তাদেরই একজন। আমরা কবিতাটি আবৃত্তি করতে গিয়ে সবাই হোচট খেলাম। জীবনানন্দের কবিতার সঙ্গে সেদিনই আমাদের প্রথম পরিচয়।  আমাদের সবার আবৃত্তিই ছিল অতিশয় নিম্নমানের । তিনি তাতে মোটেও দুঃখিত বা বিরক্ত হলেন না, তিনি তো জানতেনই,  এধরণের কবিতা আমরা পূর্বে পড়িনি। কবিতার ছন্দটি বুঝতে না পারার ফলে কবিতাটা আমাদের কাছে গদ্য বলেই মনে হয়েছিল। এমন সরাসরি কথা বলার ঢংটা যে কবিতায় আসতে পারে পূর্বে কোনও কবির কবিতায় আমরা তেমন কোনো দৃষ্টান্ত পাই নি। বাক্যগুলিও বেশ দীর্ঘ দীর্ঘ—পড়তে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা। তবে কবিতার কথাগুলো এবং বিশেষ ভাবে কবিতায় ব্যবহৃত চিত্রকল্পগুলো আমার বেশ ভালো লাগল। ঐ কবিতায় বর্ণিত প্রকৃতির সঙ্গে আমি আমার নিজের  গ্রাম প্রকৃতিরও বেশ মিল খুঁজে পেলাম। মুখলেসুর রহমান স্যার নিজেই কবিতাটি আবৃত্তি করে আমাদের বুঝিয়ে দিলেন কীভাবে আধুনিক কবিতা আবৃত্তি করতে হয়। নাটকীয়তাহীন এমন আটপৌরে আবেগের আবৃত্তি আমরা পূর্বে শুনিনি। স্যারের আবৃত্তি শুনে আমরা মুগ্ধ হলাম। কবিতাটার ভাবার্থ, উপমা-চিত্রকল্প এবং ছন্দও স্যার আমাদের বুঝিয়ে দিলেন।


কবিতার ছন্দটি বুঝতে না পারার ফলে কবিতাটা আমাদের কাছে গদ্য বলেই মনে হয়েছিল।


আমরা একইসঙ্গে মুখলেসুর রহমান স্যার এবং কবি জীবনানন্দ দাশের ভক্তে পরিণত হলাম। তিনি বেশিদিন আমাদের স্কুলে থাকেন নি, মাত্র বছর খানেক ছিলেন। এরই মধ্যে তিনি স্কুলের ছাত্রদের মাঝে অন্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। একবার নেত্রকোণা থেকে ডায়নামা ভাড়া করে এনে বারহাট্টা স্কুলে তিনি রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী পালন করেছিলেন। ওটাই ছিল বারাহাট্টার পর্থম বিজলিবাতির অনুষ্ঠান। বিজলিবাতির আলোতে উদ্ভাসিত বারহাট্টা স্কুলটাকে সেদিন আলোকসজ্জিত মহানগরীর মতোই মনে হয়েছিল। সেই বিজনিবাতির খেলা দেখার জন্য আমাদের স্কুলে হাজার-হাজার নারী-পুরুষের ভিড় হয়েছিল। অনুষ্ঠানটিও দারুন উপভোগ্য হয়েছিল। এলাকার মানুষ আজও সেই অনুষ্ঠানের স্মৃতি স্মরণে রেখেছে।

বি.এ পড়ার জন্য তিনি যেদিন বারহাট্টা থেকে বিদায় নিয়ে চলে যান সেদিন আমাদের এই প্রিয় শিক্ষককে বিদায় জানাতে রেলস্ট্রশনে উপস্থিত অনেক ছাত্রের চোখই অশ্রুসিক্ত হয়েছিল । তাঁর বিদায়ে আমি খুবই দুঃখ পেয়েছিলাম।জীবনানন্দের কবিতার অনুকরণে তিনি উপস্থিত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘ আবার আসিব ফিরে’। কিন্তু তিনি আর ফিরে আসেন নি। তাঁর সঙ্গে আমাদের আর যোগাযোগ ছিল না। বি.এ পাশ করে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে তিনি ব্রাক্ষ্ণণবাড়িয়ায় ফিরে গিয়েছিলেন। ১৯৭১-এ আমাদের এই প্রিয় শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধাদের ছোঁড়া একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট গ্রেনেডের আঘাতে নিহত হন বলে জানতে পারি। স্যার ন্যাপ করতেন। ঘটনার দিন তিনি একটি চায়ের স্টলে বসে চা খাচ্ছিলেন, তাঁর পাশে বসে চা খাচ্ছিল একজন  রাজাকার। শুনেছি মুক্তিযোদ্ধাদের টার্গেট, সেই রাজাকারটি আজও বেঁচে আছেন। কী বিচিত্র এই দেশ। ওরা কেমন মুক্তিযোদ্ধা ছিল, জানি না।

ক্রমশ…


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!