Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • আগস্ট ১৫, ২০২১

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

চিত্র: সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় ।

সহজসরল গদ্যে, কথা বলার নিজস্ব ভঙ্গিতে শৈশবের দিনগুলো স্মরণ করছেন বাংলাভাষার জনপ্রিয় কবি। বলেন কম, শোনেন বেশি। কবিতায়ও কি ধরা দেয় তাঁর এ সংযম? গদ্যেও কি ছড়িয়ে থাকে আত্মমগ্নতার বিভূতি? নির্মলেন্দুর ‘ছেলেবেলা’ পড়তে পড়তে এরকম প্রশ্ন উঠতেই পারে। তাঁর-এ লেখা নিয়ে পাঠকের পছন্দের প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ায় আমরা মোহিত।

সম্পাদক

বড়বোন রূপালি এবং ছোটবোন সোনালির মাঝখানে কালো হীরের মতো মনে হয় আমি আমার মায়ের পেটের ভিতরে চাপা পড়েছিলাম। স্যান্ডুইচের সঙ্গেও তুলনা করতে পারি। অল্পদিনের মধ্যেই মামাবাড়ি থেকে আমার নতুন মা ফিরে এলেন। মা যখন বাপের বাড়ি গিয়েছিলেন, তখন আমার সবচেয়ে ছোটবোনটি দুলালী মারা গিয়েছিল। দুলালীর জন্য মনের মধ্যে একটা কষ্ট পুষে বেড়াতাম। বাবা বলতেন: ‘দূর বোকা, দেখিস দুলালী আবার ফিরে আসবে।’ আমার মায়ের ব্যাপারে বাবার কথা সত্য প্রমাণিত হওয়ার পর থেকে আমি বাবার কথা বিশ্বাস করতাম। মা যখন ফিরে এলেন তখন বাবার উপর আমার ভক্তিশ্রদ্ধা আরও বেড়ে গেলা—সত্যিই তো, মা’র কোলে  একটি ছোট্ট ফুটফুটে বোন, কী সুন্দর পিটপিট করে তাকাচ্ছে আমার দিকে।  বাবা বোনটির নাম রাখলেন ঝিল্লি। সোনালি, রূপালি, ঝিল্লি— বাবা চমৎকার মিলিয়ে মিলিয়ে নাম রাখতে পারতেন।

দাদামণি বাড়িতে না থাকায় আমার অবস্থাটা দাঁড়ালো তিন বোনের মধ্যে একটিমাত্র ভাই। ৩:১ । এমন চমৎকার বোন-ভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে জন্মেছিলাম বলেই বোধহয় ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের প্রতি আমার খুব দুর্বলতা। এদের দ্রুত লম্বা হওয়া লকলকে চুল, রক্তিম আভাযুক্ত টলটলে নরম গাল, হরিণের মতো টানা সুন্দর চোখ — এদের মিষ্টি কণ্ঠস্বর— চর্বিবহুল শুভ্রত্বকের লাবণ্য— সব মিলিয়ে আমার মনে হতো, আহা এরা কী সুন্দর। আমি যদি এদের মতো হতে পারতাম? আসলে আমি আমার স্বাস্হ্য ও দৈহিক সৌন্দর্য্যের ব্যাপারে একধরনের হীনমন্যতায় ভুগতাম। এমনিতেই আমি দেখতে সুন্দর ছিলাম না, আমার গাত্রবর্ণ ছিল বাকি সবার চাইতে কালো— স্বাস্থ্যে সকলের চেয়ে খারাপ। এর উপর প্রায়ই গায়ে খোস-পাঁচড়া হতো, নাক থেকে সর্দি ঝরতো নায়াগ্রার জলপ্রপাতের মতো। কোনো কারণেই আমাকে আকর্ষণীয় মনে হতো না। ফলে, নিজেকে বোনদের কাছে আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য আমি নতুন পথের সন্ধান  করতে থাকি।

মুখে মুখে ছড়া বানাই। রাজাউজির মারা গালগল্পের আসর বসাই। এসবের পাশাপাশি বিভিন্ন মৌসুমী ফল এনে বোনদের মধ্যে বিতরণ করি, অনেকটা রাষ্ট্রপতির রিলিফ বিতরণের মতো। কোথাও একটু বিশেষ কৃতীর পরিচয় না দিতে পারলে যে বিশিষ্টতা অর্জন করা সম্ভব নয়, তা আমি খুব ছোটবেলা থেকে বুঝতে শুরু করি। পাতলা দেহের সুবিধাটুকু কাজে লাগিয়ে আমি আম, জাম এবং লিচু এবং কুলের সময় কুল গাছের এমনসব অগম্য ডালে পৌঁছে যেতে শুরু করি, যা আমার অন্য ভাইরা ভাবতেও পারতো না। মেয়েরা ফল খুব ভালোবাসে কিন্তু ফল সংগ্রহের ব্যাপারে  প্রাকৃতিকভাবেই এরা ছেলেদের উপর নির্ভরশীল—সেই নির্ভরশীলতাকে পুঁজি করে আমি বোনদের উপর প্রবল দাপটে আমার আধিপত্যবাদী স্বপ্নকে চরিতার্থ করতে শুরু করি। আমি আমগাছের সবচেয়ে পাকা আমগুলি, জামগাছের সবচেয়ে পাকা জামগুলি, লিচুগাছের সবচেয়ে পাকা লিচুগুলি পাড়তে পারতাম। আসলে আমার বোধহয় ছোটবেলায় ওজনই ছিল না; এখনও আছে কিনা সন্দেহ। ফলে, আমি যা দিতে পারতাম, অন্য কারো পক্ষেই তা দেয়া সম্ভব ছিল না। নিজের পরের মিলিয়ে আমার মোট বোনের সংখ্যা ছিল প্রায় ডজনখানেক। এরা সবাই আমার অনুগত ভক্তে পরিণত হয়েছিল। আমাকে নিয়ে তাদের এতই গর্ব ছিল যে, একটি বিশেষ প্রাণীর সঙ্গে আমাকে তুলনা করতেও তারা দ্বিধা করতো না। ব্যঙ্গ করার জন্য নয়, আনন্দের আতিশয্যে, সিনসিয়ারলীই তারা কথাটা বলতো। বাইরে একটু বিব্রত বোধ করলেও ভেতরে ভেতরে পুলক অনুভব করতাম। বানর প্রাণীটিকে আমার ভালোই লাগতো।


মেয়েরা ফল খুব ভালোবাসে কিন্তু ফল সংগ্রহের ব্যাপারে  প্রাকৃতিকভাবেই এরা ছেলেদের উপর নির্ভরশীল…


আমার বড়োবোন রূপালির সঙ্গে আমার একটা পৃথক সম্পর্ক ছিল। ছোটবেলায় হাম বসে গিয়ে সে প্রায় চিররুগ্ন হয়ে পড়েছিল। তাকে সুস্থ করে তোলার জন্য বাবা তার পেছনে প্রচুর অর্থ এবং শ্রম ব্যয় করতেন। প্রায়ই সে থাকতো শয্যাশায়ী। শ্বাসকষ্টে সে ভুগতো। বাবা তার শয্যার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দিতেন। তার পেছনে বাবার অর্থ ব্যয় করা এবং সময় নষ্ট করা নিয়ে আমার নতুন মায়ের সংগে প্রায়ই বাবার মনোমালিন্য দেখা দিতো। ছোট হলেও আমি বুঝতে পারতাম, রূপালিকে বাবা খুব ভালোবাসেন, কিন্তু মা বিরক্ত হন। আসলে রক্তের গলগ্রহ না হলে অসুস্থ মানুষকে ভালোবাসা বেশ কঠিন। রুগ্ন বলেই রূপালি পড়াশোনা করতে পারত না। বাবা বলতেন: ‘ঠিক আছে তোর পড়াশোনার দরকার নেই।’ কিন্তু মা বাবার স্নেহের আদিখ্যেতা দেখে রাগ করতেন। মা তাকে পড়াশোনার চাপ দিতেন। আমার জেদী রুগ্ন বোনটি মায়ের কথায় কর্ণপাত করতো না, ফলে এক সময় মা তাকে প্রহার করতেন। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে বিভিন্ন ফল এনে তাকে খেতে দিতাম। প্রায়ই শয্যাশায়ী থাকতো বলে সে আমাদের দৌড়ঝাঁপের খেলাগুলোতে অংশগ্রহণ করতে পারতো না—একটু দৌড়ঝাঁপ করলেই তার কাশি শুরু হয়ে যেতো এবং একসময় কাশির সঙ্গে রক্ত বেরুতো। তার অসুস্থতার কথা ভেবেই আমি তার সঙ্গে লুডু এবং কড়ি খেলতাম। ছেলে হওয়ার জন্য দাদামণি আমাদের পরিবার থেকে বেরিয়ে যেতে পেরেছিল—মেয়ে হওয়ার জন্যই যে সে দাদামণির পথ অনুসরণ করতে পারে নি, তার বক্ষচাপা ক্ষোভ থেকে আমি তা বেশ বুঝতে পারতাম। তার শারিরীক অসুস্থতার কারণে আমাদের অনেক আনন্দই মাটি হয়ে যেতো। একবার রোগশোকে কাতর হয়ে, মনের দুঃখে আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করে সে ব্যর্থ হয়েছিল। রুপুদির জন্য আমার খুব কষ্ট হতো—ভাই হয়ে বোনের কষ্ট দূর করতে না পারার অক্ষমতায় আমার মন কেমন করতো।

ফলের প্রতি আমার জন্মের দুর্বলতা। আমাদের বাড়িতে আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু এইসব ফলের গাছ ছিল, কিন্তু আমাদের ভাই-বোনদের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে যাওয়ার ফলে আমাদের ফলের চাহিদা পূরণ হতো না। নজরুলের ‘লিচু চোর’ কবিতাটি আমার ফলসমস্যার সহজ সমাধান এনে দিলো। আমার মনে হলো নজরুল নিশ্চয়ই ছোটবেলায় লিচু চুরি করতেন, আর ফল চুরি করাটা এমন কিছু দোষের ও নয়; বিশেষ করে দুর্গাপূজার পরে, লক্ষ্ণীপূর্ণিমার রাতে ফল চুরি করার ব্যাপারে একধরনের ধর্মীয় স্বীকৃতিও ছিল। আমাদের গ্রামাঞ্চলে ঐ পূর্ণিমার রাতে আমরা সমবয়সী ভাইবন্ধুরা মিলে বিভিন্ন বাড়ি থেকে নারকেল, আখ, জাম্বুরা ইত্যাদি চুরি করতাম। এই বদভ্যাসটা লক্ষ্মী পূর্ণিমা চলে যাবার পরও থেকে যেতো।

আজকের মতো গ্রামের মানুষ তখন গাছের ফল চোখে চোখে পাহারা দিয়ে রাখতো না, ফলে ফল চুরি করাটা তুলনামূলকভাবে সহজও ছিল। তাছাড়া গুণ-বংশের ছেলেরা যে পথ দিয়ে যাতায়াত করে সেই পথের পাশের বাড়িঘরের লোকজনরা ভাবতেও পারতো না যে ঐ বংশে আমার মতো একজন পাকা ফল-চোরের আবির্ভাব ঘটেছে। বারঘর, গুহিলায়া, গড়মা—এইসব  গ্রামের খুব কম আম কাঁঠালের গাছই আছে যে-গাছের আম কাঁঠাল আমি পরখ করে দেখি নি। কাঁঠালের কষ হাত থেকে তুলে ফেলবার জন্য আমি পকেটে সরিষার তেল রাখতাম, আর কাঁচা আম ছোলার জন্য ছিল ঝিনুকের চাকু। গাছের পাতার আড়ালে দ্রুত আত্মগোপন করা এবং প্রয়োজনবোধে অনেক উঁচু থেকে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে দৌড়ে পালাবার ব্যাপারে আমি এতোটাই সিদ্ধি-লাভ করেছিলাম যে, আমাকে হাতেনাতে ধরে ফেলাটা খুবই দুরূহ ব্যাপার ছিল। চৌর্যবৃত্তির  আশ্রয় না নিলে আমি শৈশবে যে পরিমাণ ফলফলাদি ভক্ষণ করেছি তার একশতাংশও আমার কপালে জুটতো কিনা সন্দেহ। ঈশ্বরের কৃপায় শৈশবে আমাকে ফলের কষ্ট ভোগ করতে হয় নি।

বাবা যখন রবীন্দ্রনাথের ‘দুই বিঘা জমি’ কবিতাটি আমাদের আবৃত্তি করে শোনাতেন তখন উপেনের জন্য আমার খুব মন খারাক হতো। বেচারা নিজের গাছের দুটো আম পর্যন্ত খেতে পারলো না। কী অন্যায়। উপেন কেন যে বোকার মতো সাধু সাজতে গেলো, ভেবে পেতাম না; ভাবতাম উপেন চুরি করলেই পারতো আমার মতো। বাড়িতে আমার একটি বাফার স্টক ছিল ফলের। বলা বাহুল্য, তার পুরোটাই ছিল বিভিন্ন জনের গাছ থেকে গোপনে সংগৃহীত। গাছ থেকে নিজের হাতে পেড়ে পাকা আম খাওয়ার অভিজ্ঞতাই আলাদা; এই অভিজ্ঞতা যাদের নেই আমের প্রকৃত স্বাদ তাদের কখনই জানার কথা নয়। শহরের বাজার থেকে কেনা আম-কাঁঠাল-লিচু -নারকেল আমার কাছে নকলবস্তু বলেই মনে হয়। এ গুলোর সেই স্বাদ কোথায়? সদ্যপাড়া পাকা ফলের স্বাদই পৃথক, এর কোনো বিকল্প হয় না।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!