- ধা | রা | বা | হি | ক
- আগস্ট ২২, ২০২১
আমার ছেলেবেলা

চিত্র: পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান রায়
আমাদের ড্রিল মাস্টার ছিলেন নজর আলী স্যার। কংশের ওপারে তাঁর বাড়ি ছিল। তিনি আমাদের বাংলা পড়াতেন। তাঁর হাতের লেখা ছিল চমৎকার। তাঁর উৎসাহেই সুন্দর হস্তাক্ষরের প্রতি আমাদের আগ্রহ বৃদ্ধি পায়। ক্লাস শুরু হওয়ার পূর্বে আমরা শৃঙ্খলাবদ্ধ হয়ে সবাই স্কুলের ভেতরের মাঠটিতে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াতাম—পাকিস্তানের চাঁদতারাখচিত সাদা সবুজ নিশানটি আমাদের সামনে পতপত করে উড়তো। কিছুক্ষণ ড্রিল করার পর শুরু হতো জাতীয় সঙ্গীত—নজর আলী স্যারের সঙ্গে গলা মিলিয়ে আমরা সমস্বরে গাইতাম:
‘পাক সারজমিন সাদ বাদ
কিশওয়ারে হাসিন সাদাবাদ…
তু নিশানে আজমে আলীশান
আরজে পাকিস্তান।’কথাগুলোর অর্থ আমাদের বোধগম্য হতো না, কিন্তু সুরটা বেশ বালো লাগতো। ঢাকায় তখন ভাষা-আন্দোলন হয়ে গেছে, কিন্তু মফস্বলের এই স্কুলটিতে তখনও সে সংবাদ পৌঁছয়নি। বাষট্টিতে মেট্রিক পাশ করে, কেলেজে ভর্তি হওয়ার আগে ভাষা-আন্দোলন সম্পর্কে কোনো কিছু শুনেছি বলে মনে পড়ে না। প্রাইমারী স্কুলে তখন উর্দু ছিল বাধ্যতামূলক। খালেক মৌলবী স্যার আমাদের উর্দু পড়াতেন। বাংলা, ইংরেজী এবং উর্দু—এই তিন ভাষার অত্যাচারে আমাদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। উর্দুপড়া না পারার জন্য একদিন খালেক মৌলবী স্যার আমাকে নির্মমভাবে প্রহার করেন। তাঁর বেত্রাঘাতে আমার পায়ে দাগ পড়ে গিয়েছিল। উর্দুর প্রতি আমার কোনো বিদ্বেষ ছিল না। খালেক স্যারকেও আমি বেশ পছন্দই করতাম। বাঙালী ছেলেমেয়েদের উপর উর্দু চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে দেশে যে তখন একটা আন্দোলন চলছিল তা আমার জানবার কথা নয়, কিন্তু খালেক মৌলবী স্যার তা জানতেন এবং তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের বিরোধী। ফলে, বাংলা এবং ইংরেজী না পারার মতো উর্দু না পারার ব্যাপারটাকে তিনি সহজভাবে নিতে পারেন নি।
কিশোরগঞ্জের নেজাম-ই-ইসলাম পার্টির নেতা মৌলানা আতাহার আলী খান সাহেব একবার বারহাট্টায় এসেছিলেন। স্কুলের ছাত্রদের নিয়ে খালেক স্যার মিছিল করে স্টেশন গিয়েছিলেন। আতাহার আলী সাহেবকে সংবর্ধনা জানাতে। আমিও সেই মিছিলে ছিলাম। ওটাই ছিল আমার প্রথম কোনো মিছিলে অংশ নেয়া। ‘নারায়ে তাকবীর -আল্লাহূ আকবর, পাকিস্তান-জিন্দাবাদ, আতাহার আলী—জিন্দাবাদ ইত্যাকার ধ্বনিতে বারহাট্টার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করার স্মৃতি আমার মনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে ‘নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর’ কথাটার মধ্যে যে ছন্দধ্বনিত চাতুর্য আছে তা আমাকে খুব মুগ্ধ করেছিল। আমি বাড়িতেও এই শ্লোগানটি দিতাম। খালেক স্যারের নেতৃত্বে আমি ইসলামী আন্দোলনে অংশ নিচ্ছি, সেরকম কিছু আমার মনে হতো না—বড়দের কেউ তেমনটি মনে করিয়েও দিতেন না। মিলদুন্নবী উপলক্ষে স্কুলে হযরত মুহম্মদের (সঃ) ওপর রচনা প্রতিযোগিতা হতো। আমি একবার ঐ পতিযোগিতায় অংশ নিই। আমার হাতের লেখা বেশ সুন্দর ছিল। বিভিন্ন রচনা বই পাঠ করে আমি বেশ যত্নসহকারে মুহম্মদ (সঃ) সম্পর্কে রচনাটি তৈরী করি। কী আশ্চর্য আমার রচনাটিই প্রথম স্থান লাভ করে। আমাকে একটি চমৎকার হালকা সবুজ রঙের wing Sung চাইনীজ কলম উপহার দেওয়া হয়। রচনাটি কোনও হিন্দুছাত্রের লেখা —এই ভেবে বিচারকরা আমাকে বেশি নম্বর দিয়েছেন—এমন হীন ভাবনা আমার মনেও আসে নি। আমার ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে মতি, হেলাল, হোসেন আলী, হাশিম, ওয়াহেদ এরা সবাই ছিল মুসলমান। এরা আমাদের বাড়িতে আসতো। বাবা এদের পুত্রবৎ স্নেহ করতেন। তবে ঝগড়ার সময় ওরা আমাদের মালাউন বলে গাল দিতো, আমরাও উল্টো ওদের ‘গরুখাউরা’ বলে গাল দিতাম। কিন্তু ছোটদের এইসব ঝগড়ায় বড়রা কখনো নাক গলাতেন না। পরস্পরকে গালাগাল করার স্বাধীনতাটা তখন পুরোপুরি ছিল। ঘৃণা প্রকাশের স্বাধীনতা না থাকলে ভালোবাসা যে কতটা মেকী হয়ে যায়, পরে তা মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছি।
সিগারেট খাওয়ায় স্বাধীনতা লাভের জন্যই তখন আমিও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম, কিন্তু সাহস পেতাম না।
আমার দাদামণি বড়দার সঙ্গে কিছুদিন কিশোরগঞ্জে কাটাবার পর হঠাৎ একদিন পালিয়ে ভারতে চলে যান। কলকাতায় আমার ছোটমামা থাকেন, তাঁর ওখানেই গিয়ে ওঠেন। কিছুদিন প্রবল দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটানোর পর ছোটমামার পত্রে বাবা দাদামণির সংবাদ পেয়ে কিছুটা নিশ্চিত হন। মাতৃহীন বড় পুত্রের প্রতি বাবার স্বাভাবিক দুর্বলতা ছিল, তিনি দাদমণির জন্য হুন্ডি করে ছোটমামার কাছে যথাসম্ভব টাকা পাঠাতেন। কিন্তু দাদামণি নিজেকে সংসার থেকে বিতাড়িত বলে ভাবতেন ও বাবার স্নেহকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ফলে ক্রমশ আমাদের সঙ্গে তার দূরত্ব বাড়তে থাকে। ভারতে যাতায়াতের জন্য তখন পাসপোর্ট চালু হয়েছে, কিন্তু দাদামণির পাসপোর্ট ছিল না। আমাদের এক জ্ঞাতি খুড়তুতো বোন, লীলাদির বিয়ে হয়েছিল গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত বাঘরা গ্রামে। ঐ গ্রাম থেকে সীমান্তের দূরত্ব ছিল মাত্র মাইল দুয়েক। আমাদের ভগ্নিপতি শ্রীসতীশ সরকার মহাশয় ছিলেন ঐ এলাকার একজন প্রতিপত্তিশালী ধনী জোতদার। তাঁর সাহায্যেই দাদামণি মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে আসাম হয়ে কলকাতায় যাতায়াত করার একটা পথ আবিষ্কার করেন। পাক সীমান্তের ইপিআর এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষী বি এস এফ-এর সদস্যদের মধ্যে তখন একটা অলিখিত ভদ্রলোকের চুক্তি ছিল। এরা মাথাপিছু দশবিশ টাকার বিনিময়ে লোকজনদের সীমান্ত পার করে দিত।
পূর্ব-পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে যাওয়া উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য ভারত সরকার তখন কিছু সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছিল। বিমান রায় তখন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী। দাদামণি বিধান রায়ের সঙ্গে দেখা করেন এবং তাঁর সস্নেহ কৃপাদৃষ্টি লাভে সমর্থ হন। কলকাতা থেকে গ্রামে ফিরে এসে দাদামণি যখন বাবার সঙ্গে বিধান রায়ের কৃপালাভের গল্পটি বলতেন, বাবার মুখটি স্নিগ্ধ প্রশান্তিতে ভরে যেত। দাদামণির মুখে বিধান রায়ের গল্প শুনতে শুনতে আমরাও তাঁকে ভালবেসে ফেলেছিলাম। বিধান রায়ের মতো ডাক্তার তখন ভূ-ভারতে দ্বিতীয় কেউ ছিল না।
দাদামণি আমাদের জন্য চকলেট নিয়ে আসতেন। ঐ চকলেটের গন্ধ এখনো আমার নাকে লেগে আছে। একসময় আমার ধারণা ছিল বকুল এবং গন্ধরাজের গন্ধই বুঝি সর্বশ্রেষ্ঠ; চকলেটের গন্ধের সঙ্গে পরুচিত হওয়ার পর আমার সেই ভুল ধারণাটি ভেঙে যায়। আমরা মহানন্দে চকলেট চুষতাম আর দাদামণি আমাদের কৌতুহলী চোখের সামনে কাগজ দিয়ে নিজের হাতে বানানো সিগারেট খেতেন। সিগারেটের গন্ধটাকে চকলেটের গন্ধের চাইতেও ভালো লাগতো। সিগারেট খাওয়ায় স্বাধীনতা লাভের জন্যই তখন আমিও বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবতাম, কিন্তু সাহস পেতাম না। আমার দাদামণি ছিলেন অত্যন্ত স্বাস্থ্যবান, সাহসী এবং দুর্বিনীত প্রকৃতির-তার কথা আলাদা।
দাদামণি বাড়ি এসে বেশিদিন থাকতেন না, বাবা বাড়ি থেকে চলে যাবার ফাঁকে তিনি ধান পাট বিক্রি করতেন। মা ক্ষুদ্ধ হলেও কিছু বলতে সাহস পেতেন না। বাবা জেনেও না জানার ভান করে থাকতেন। কিছুদিন গ্রামের বাড়িতে কাটিয়ে, বাবার কাছ থেকে কিছু টাকা নিয়ে তিনি আাবার ভারতে চলে যেতেন। যাবার পূর্বে বাবা এবং কাকাকে ভারতে চলে যাবার পরামর্শ দিতেন—সেখানে হিন্দু উদ্বাস্তুদের কী কী সুবিধা দেয়া হচ্ছে, তার একটা লোভনীয় চিত্র তুলে ধরতেন। বাবাও রাজি হতেন-কিন্তু দাদামণি চলে যাবার পর বাবার দেশত্যাগের উৎসাহে ভাঁটা পড়তো।
বিধান রায়ের জন্য দাদামণি বাজার থেকে শুকনো মাছ কিনতেন। ময়মনসিংহের শুকনো মাছ নাকি বিধান রায়ের খুব পছন্দ। সেই শুকনো মাছের কতটা বিধান রায়ের পাকঘর পর্যন্ত পৌঁছতো, আমাদের টা জানবার সুযোগ ছিল না। তবে শুকনো মাছের ঝোল দিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে বিধান রায় পরম তৃপ্তিতে ভাত খাচ্ছেন—এরকম একটা দৃশ্য কল্পনা করে আমি খুব রোমাঞ্চিত এবং গর্বিত বোধ করতাম। পিতৃমাতৃস্নেহবঞ্চিত দেশত্যাগী পুত্রের উপর বিধান রায়ের কৃপাদৃষ্টি পড়েছে—এই ভেবে বাবাও একধরণের স্বস্তি বোধ করতেন। ছোটমামার পত্রে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ার পর দাদামণিকে নিয়ে বাবার দুশ্চিন্তার অবসান ঘটে—পরে বিধানরায়ের সুপারিশেই নির্মাণাধীন দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানায় দাদামণি একটি চাকরি হয়। সেই চাকুরি সূত্রে দুর্গাপুরে তিনি একটি চমৎকার কোয়ার্টারও পেয়ে যান। পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তু পুনর্বাসনে বা পশ্চিমবঙ্গের উন্নতির পেছনে ডাক্তার বিধান রায়ের অনেক অবদান আছে—সেজন্য নয়, দাদামণির প্রতি প্রদত্ত অনুগ্রহের জন্যই বিধান রায় আমাদের কাছে প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন, এবং তাঁর মৃত্যুতে দুঃখ পাওয়ার সঙ্গত কারণ সৃষ্টি হয়। এই পৃথিবীতে কে যে কখন কার কাজে লাগে, তা বলা খুবই কঠিন। বিধান রায় হয়তো ভাবতেও পারেন নি—একদিন অজস্র অবদান সমৃদ্ধ তাঁর জীবনের এই তুচ্ছতম অবদানের কথাটি পূর্ববাঙলার এক কবির ছেলেবেলায় এভাবে লিপিবদ্ধ হবে।
❤ Support Us