Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • অক্টোবর ৯, ২০২১

আমার ছেলেবেলা

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

প্রত্যেক স্কুলেই দু’একজন আদুভাই থাকে। আমাদের স্কুলেও ছিল। আমাদের আদু ভাইয়ের নাম রফিজ। বারহাট্টা রেলস্টেশনের পাশেই গোপালপুরে তার বাড়ি। আমরা রেলস্টেশনের উপর দিয়েই স্কুলে যেতাম। স্টেশনের প্ল্যাটফরমে বিছানো পোড়া-কয়লার উপর দিয়ে হাঁটতে আমাদের খুব মজা লাগতো। আমরা স্কুলে যাবার পথে রফিজকে স্টেশনের চায়ের স্টলে বসে সর্বদা আড্ডা দিতে দেখতাম। বয়সে সে আমাদের চেয়ে বেশ বড় ছিল — কিন্তু পড়াশোনায় সে ছিল একবারে যাকে বলে মহাখারাপ। এক একটি কেলাসের মায়া ত্যাগ করতে তার অনেক বছর চলে যেতো। আমি যখন স্কুলে ভর্তি হই, তখন রফিজ ছিল সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। আমি যখন পঞ্চম শ্রেণীতে উঠেছি রফিজ তখনো একই ক্লাসে থেকে গিয়েছিল। শিক্ষকরা বলতেন, রফিজ হচ্ছে একটা আদর্শ গর্দভ, পরীক্ষা  করলে নাকি রফিজের মগজে গোবর পাওয়া যাবে। কিন্তু রফিজ বলতো, সব মিথ্যে কথা, আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। আমরাও ষড়যন্ত্রের কথাটাই বিশ্বাস করতাম; কেন না রফিজ ছিল খুবই দুর্বিনীত প্রকৃতির, ছাত্রনেতা। বিভিন্ন শিক্ষকের নাম ধরে সে অশ্লীল গালাগাল করতো। সঙ্গত কারণেই একসময় তার ধৈর্যের বাধ ভেঙে যায়। রেক্টর সাহেবকে পরিবর্তন করেই সে তার ভাগ্য পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। রফিজকে আমরা বেশ সমীহ করে চলতাম। একদিন স্টেশনে দাঁড়িয়ে সে আমাদের গতিরোধ করে এবং স্কুলে না গিয়ে তার সঙ্গে মোহনগঞ্জ যাবার নির্দেশ দেন। রফিজের নির্দেশ অমান্য করার সাহস এবং ইচ্ছা কোনোটাই আমাদের ছিল না। রফিজের নেতৃত্বে ট্রেনে চড়ে যদি মোহনগঞ্জ যেতে পারি তাহলে আমার একটা  দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পূরণ হয়, সুতরাং রফিজের নির্দেশে স্কুলে যাবার চিন্তাটাকে বিসর্জন দিয়ে অনেকের সঙ্গে আমিও ট্রেনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। কী উদ্দেশ্যে রফিজ আমাদের মোহনগঞ্জ নিয়ে যাচ্ছে, তা জানবার ইচ্ছেটা মনের কোণে দু’একবার উঁকি দিলেও, তাকে জিজ্ঞেস করার সাহস আমাদের কারোরই হয় নি। রফিজের মতো লোক যে আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের তার কোনো কাজের যোগ্য বলে মেনেছে, তাতেই গর্বে আমাদের মাটিতে পা পড়ছিল না। আমরা জানতাম রেলভ্রমণের জন্য টিকিট-সিস্টেমটা রফিজের বেলায় প্রযোজ্য নয়, তার সঙ্গে থাকলে এসব ব্যাপারে একেবারে নিশ্চিন্ত। অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রেন এলো। রফিজ ছাগলখেদা করে আমাদের ট্রেনের কামরায় তুলে দিলো। ট্রেনটা আমাদের স্কুলের পাশ দিয়েই যায়। স্কুলটাকে অতিক্রম করে যাবার সময় কী আনন্দ। এতদিন স্কুল থেকে ট্রেনটাকে দেখতাম, আজ ট্রেন থেকে স্কুলটাকে দেখছি। উত্তেজনার মধ্যে কখন যে অতিথপুর পেরিয়ে মোহনগঞ্জে এসে গেছি খেয়ালই করি নি। আমরা দ্রুত ট্রেন থেকে নেমে গেলাম।  এটাই এই লাইনের শেষ স্টেশন। বারহাট্টার চেয়ে স্টেশনটি অনেক বড়। সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চলের লোকজনও এই স্টেশনেই আসে; ফলে যাত্রীদের ভিড়ও অনেক। মোহনগঞ্জ মাছের জন্য বিখ্যাত, এখান থেকে মালগাড়ি বোঝাই করে ঢাকা এবং ময়মনসিংহে মাছ পাঠানো হয়। রেললাইনের পাশেই বড় বড় রুই, কাতলা, মৃগেল, বোয়াল মাছ টাল দিয়ে রাখা হয়েছে। উপরে নিচে বরফ দিয়ে, টুপরিতে মাছ ভর্তি করে ছালার চট দিয়ে সেই টুপরিগুলো সেলাই করছে একদল শ্রমিক — তারপর টুপরিগুলো তোলা হচ্ছে মালগাড়িতে। এতো মাছ একসঙ্গে দেখে পাগল হয়ে যাবার অবস্থা, কিন্তু ঐ দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখার সুযোগ ছিল না; রফিজ এসে আমাদের লাইন করে দাঁড়াবার নির্দেশ দিলে আমরা তার নির্দেশমতো দ্রুত শৃঙ্খলার  সঙ্গে দুই সারিতে দাঁড়ালাম। রফিজ তখন আমাদের কয়েকটি শ্লোগান শিখিয়ে দিলো। ‘নারায়ে তাকবীর-আল্লাহু আকবর’ এবং ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’— এই দুটো স্লোগান আমরা জানতাম, খালেক মৌলবী স্যার আমাদের শিখিয়ে-ছিলেন কিন্তু পরের দুটো শ্লোগান ছিল একেবারে নতুনঃ ‘বারহাট্টা স্কুলের রেক্টর সাহেবের পদত্যাগ চাই, পদত্যাগ চাই’ এবং ‘দুর্নিতী বাজ আবদুল হেকিম, মুর্দাবাদ।’ রফিজের নেতৃত্বে আমাদের দৃপ্ত মিছিল এগিয়ে চললো মোহনগঞ্জ বাজারের দিকে। দিনটি ছিল বুধবার, মোহনগঞ্জের হাটবার। বাজার লোকে লোকারণ্য। ভিড় ঠেলে আমরা এগিয়ে চলেছি। আমাদের শ্লোগানে শ্লোগানে প্রকম্পিত হচ্ছে মোহনগঞ্জের আকাশ বাতাস। আমরা সংখ্যায় প্রায় ত্রিশ চল্লিশের মতো এবং আমাদের নিয়ে বিভিন্ন দোকানে ঢুকছে এবং লোকজনের কাছে আমাদের আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী ব্যাখ্যা করছে। শেষে বলছে আসল কথাটি, আন্দোলনের জন্য কিছু অর্থ সাহায্য চাই। হাট বার বলে দোকানদাররা খুব ব্যস্ত ছিল, দলবদ্ধ ছাত্রদের ভয়ে অনেকেই তাড়াতাড়ি কিছু টাকা দিয়ে আমাদের বিদায় করছিল। রফিজের পকেট  ভরে উঠছিল টাকায়। তার পরিতৃপ্ত  মুখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলাম যে, আন্দোলনের আশু লক্ষ্য সফল হচ্ছে। এমন সময় ঘটলো বিপদ। জনৈক বেয়াড়া ব্যবসায়ী আমাদের নেতাকে ধরে ফেললো। রফিজ যতই ওই ব্যবসায়ীকে আন্দোলনের উদ্দেশ্য এবং প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করে, ব্যবসায়ী ভদ্রলোক ততই রেগে যান। এক পর্যায়ে তিনি তার দোকানের কর্মচারীদের নির্দেশ দিলেন, আমাদের লাঠিপেটা করতে  বাজার ছাড়া করতে। একজনকে থানায় পাঠালেন পুলিশকে খবর দিতে। দোকানের কর্মচারীরা ছিল সত্যিকারের গুন্ডা প্রকৃতির, তারা সত্যি সত্যিই লাঠি নিয়ে আমাদের তাড়া করলো। এরকম একটা পরিস্থিতির জন্য আমরা একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না, এরকম পরিস্থিতিতে কী করতে হবে রফিজ আমাদের সেকথা বলেও নি। মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলো। কথায় বলে জান বাঁচানো ফরজ, ওই ব্যবসায়ীর দোকানে অন্তরীণ নেতাকে ফেলেই আমরা তখন স্টেশনের উদ্দেশে প্রাণপণে দৌড়তে লাগলাম। ইস্টিশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে। এই ট্রেন ফেল করলে রাতের ট্রেনে ফিরতে হবে। ভালোই হলো, আমরা দিনে দিনেই বারহাট্টায়  ফিরতে পারবো। মনে মনে ভাবলাম, ভগবান যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন। ভাগ্যিস ঐ বেয়াড়া-ব্যবসায়ীটা ছিল। কিন্তু রফিজকে ছাড়া ট্রেনে চড়তে আমাদের সাহস হচ্ছিল না—দুশ্চিন্তায় যখন আমরা চোখে সর্ষেফুল দেখছি, তখন দেখা গেলো ছাড়া-পাওয়া পকেট মারের মতোই ঊর্দ্ধশ্বাসে দৌঁড়তে দৌঁড়তে আমাদের নেতা রফিজ আসছে। একটু আগে সে কেমন ছিল জানি না, কিন্তু আমরা তাকে অত্যন্ত উত্তেজিত এবং ক্ষিপ্ত রূপেই দেখলাম। সেনাপতি যেমন সৈনিকদের রণক্ষেত্র পরিত্যাগের নির্দেশ দেয় — রফিজও তেমনি আমাদের ট্রেনে চড়ার নির্দেশ দিলো। তার নির্দেশে আমরা দ্রুত ট্রেনে চড়লাম, পুনরায় মিছিলে যাবার চিন্তাটা ভাগ্যিস তার মাথায় আসে নি। রফিজ সঙ্গে থাকলে টিকিটের দরকার পড়ে না — এই লাইনের সমস্ত টিটিরাই রফিজকে চেনে এবং খাতির করে। আমরা রফিজের লোক। বিকেলের দিকে আমরা নিরাপদেই বারহাট্টায় ফিরে এলাম। তখনই মনে পড়লো, সারাদিন আমাদের পেটে কিছু পড়ে নি।

ওই রেক্টর-খেদানোর আন্দোলনে মোহনগঞ্জ বাজার থেকে সেদিন কত টাকা উঠেছিল এবং ওই রুদ্র ব্যবসায়ীর খপ্পর থেকে রফিজ শেষ পর্যন্ত কীভাবে মুক্তি পেয়েছিল — তা আমাদের আর জানা হয় নি। আমরা যে ভালোয় ভালোয় বাঘের খাঁচা থেকে ফিরতে পেরেছিলাম, তাতেই আমাদের আনন্দের সীমা ছিল না। ঘটনার পর থেকে রফিজ আর স্কুলে যেতো না — ব্যর্থ বিপ্লবের নায়কদের মতোই সে পালিয়ে বেড়াতো। পরদিন রফিজের অনুসারীদের শাস্তি হয়েছিল কান ধরে বেঞ্চের উপর একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা। কিন্তু যে-রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতাটি আমরা লাভ করেছিলাম, তার তুলনায় শাস্তিটা ছিল নিতান্তই সামান্য, গুরু পাপে লঘু দন্ড।

ক্রমশ…


  • Tags:

Read by:

❤ Support Us
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা
error: Content is protected !!