Advertisement
  • গ | ল্প
  • জানুয়ারি ১৯, ২০২২

উইল

বন্দনা মুখার্জী
উইল

ছবি: দেব সরকার।

মোবাইলটা বেজেই চলেছে।অফিস যাওয়ার আগে আরো অনেক কিছু করার থাকে অন্যনার। তাই মোবাইলে ‘আন নোন নম্বর’ দেখে ফোনটা তুলল না অনন্যা। কিন্তু পরমুহূর্তে ফোনটা আবার বেজে ওঠায় বিরক্ত হয়ে হ্যালো বলতেই অপর প্রান্ত থেকে গম্ভীর স্বরে বললেন, ‘আমি অনন্যা চক্রবর্তীর সঙ্গে কথা বলতে চাই’। হ্যাঁ বলুন আমিই অনন্যা চক্রবর্তী। প্রতিমা চক্রবর্তী আপনার কে হন? নামটা শুনেই চমকে উঠল অনন্যা। ভয় মেশানো গলায় জানতে চাইল, কেনো কী হয়েছে? আমি কাঁকুড়গাছি মঠ থেকে মহারাজ বলছি। প্রতিমা দেবী আজ আমাদের মঠে এসেছিলেন। সেখানেই ওনার হার্ট অ্যাটাক করে। দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি উনি আর নেই। অফিসের খাতা খুঁজে এই নম্বরটা পাওয়া যায়। তাই আপনাকে খবরটা জানালাম। ততক্ষণে অনন্যা কান্নায় ভেঙে পরেছে। কাজের বাঈ সবিতা পাশেই ছিল ও তাড়াতাড়ি ফোনটা হাতে নিয়ে বলল, ‘দিদি আপনাকে পরে ফোন করবে।’  অনন্যা কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছে না।  প্রতিমা দেবী শুধু ওর শাশুড়ি মা নয়, উনি ছিলেন বন্ধু, পরামর্শদাতা এবং সবচেয়ে কাছের মানুষ। সেই মা আর নেই!

আর কোনও দিন ওকে কাছে টেনে নেবে না! এই আকস্মিক ধাক্কা সামলানো অন্যন্যার কাছে সহজ নয়, অথচ এখন অনেক কাজ। সবিতা ইতিমধ্যে চা আর বিস্কুট নিয়ে এসেছে। অনন্যা নিজেকে সামলে প্রথমেই ওর অফিস কলিগ দুর্গা কৃষ্ণমূর্তিকে ফোন করল। ওর স্বামী একজন ট্রাভেল এজেন্ট। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর কলকাতা যাওয়ার ফ্লাইটের টিকিট দরকার। সব শুনে দুর্গা যে চেন্নাইতে অনন্যার একমাত্র বন্ধু বলল, ‘ঠিক আছে তুমি শান্ত হও, আমরা আসছি। তোমাকে এয়ারপোর্টে ড্রপ করে দেব।’ এবার অনন্যা ফোন করল ওর মাসতুতো ননদ মিতুদিকে।

কাঁদতে কাঁদতে খবরটা দিয়ে বলল ‘মিতুদি তুমি দ্রুত কাঁকুড়গাছি পৌঁছাও।তুমি তে্া জানো মা একদম হৈ চৈ পছন্দ করতেন না। তাই কাকে কাকে খবর দেবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার ব্যাপার। আমি হয়ত বিকেলের মধ্যেই পৌঁছে যাব।’
সব শুনে মিতুদি একটাই প্রশ্ন করল, তুই কী চিরাগকে জানিয়েছিস? অনন্যা বলল, না, এক্ষুণি ফোন করছি। তবে তুমি তো জানো, ও কি বলতে পারে। যাক রাখছি।

পরের ফোনটা তথাকথিত স্বামী চিরাগকেই করল অনন্যা। চিরাগ একটা প্রাইভেট ফার্মে ভালই চাকরি করে। প্রায়ই অফিস ট্যুরে এখান-ওখান যায়। আপাতত হায়দ্রাবাদ গিয়েছে। অনন্যার ফোন পেয়ে প্রথমেই চিরাগ বলল, হঠাৎ ফোন করলে কেন? জানো তো এইসময় ব্যস্ত থাকি। প্রাণপণ নিজেকে সংযত রেখে অনন্যা চিরাগের মায়ের মৃত্যু সংবাদ দিল।  খবরটা শুনে চিরাগ বিন্দুমাত্র দুঃখিত হল না। বরং জানাল,  কি আর করা যাবে? এরকম খবর একদিন না একদিন আসবে। দিন পনেরো-কুঁড়ির আগে আমি যেতে পারব না। আমার মনে হয় তোমারও যাওয়ার দরকার নেই।’ সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার। এই বলে অনন্যা ফোন কেটে দিল।

পরমুহূর্তে আবার চিরাগের ফোন। বাধ্য হয়ে ফোনটা ধরল অনন্যা । চিরাগ উতলা হয়ে বলল, ‘আমি না যাওয়া পর্যন্ত মায়ের আলমারি-বাক্স কিছুই খুলবে না।’ লজ্জায়, ঘৃণায় অনন্যা ফোন রেখে দিল। সবিতাকে ফ্রিজের আর রান্না ঘরের
কিছু জিনিস নিয়ে নিতে বলে, গ্যাস, ফ্রিজ সব বন্ধ করে দিতে বলল অনন্যা।এরপর নিজের কিছু জিনিস এবং আইকার্ড গুলো এবং প্রয়োজনীয় টাকাপয়সাও গুছিয়ে নিল। এই সময় দুর্গা আর ওর স্বামী মিষ্টার কৃষ্ণমূর্তি এসে পড়লেন। বেলা একটায় ফ্লাইট। তারমানে হাতে আর পনেরো মিনিট। দুর্গা আসার পথে ২৫০০০ হাজার টাকা আর স্যান্ডুইচ এনেছে অনন্যার জন্য। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটা এই সহানুভূতিতে আবার প্রকশ পেল। দুর্গা বলল, কোনও চিন্তা নেই আমি অফিস সামলে নেব। তুমি সাবধানে যাও।এরপর ওরা এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরল।

অনন্যা, পথেই মিতুদিকে জানিয়ে দিল সাড়ে তিনটে বাজবে ওর পৌঁছতে। তারপর সোজা মঠে ছুটে যাবে ও।প্লেনে একটু থিতু হয়ে বসেই ওর প্রথমেই মনে পড়ল চিরাগের কথা, মায়ের মৃত্যুর সংবাদ শুনেও চিরাগের কোনও হেলদোল নেই, অপরন্তু সম্পত্তির চিন্তা খুরছে ওর মাথায়।ভালই হয়েছে, মাকে অন্তত এমন ছেলের হাতের আগুন পেতে হবে না। প্রতিমদেবীর কথা মনে করে ওর চোখের জল বাধ মানছে না। তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে চশমা টা বার করে পরে নিল।
প্রায় সাত বছর হয়ে গেল চিরাগের সঙ্গে ওর সম্বন্ধ করে বিয়ে। চিরাগের বাবার সঙ্গে আগে থেকেই অনন্যার বাবার পরিচয় ছিল। চিরাগ তখন সবে সিএ পাস করেছে। ওর বাবা হাইকোর্টে নাম করা ল-ইয়ার। তবে চিরাগ একমাত্র ছেলে হওয়া সত্ত্বেও ওর মা প্রতিমা দেবী(কলেজের প্রফেসর) ছেলের হবু বৌকে একবারও বিয়ের আগে দেখতে যান নি।
অনন্যা এম.এ ফাইনাল দিয়েছে। সুন্দরী, অবস্থাপণ্য ঘরের মেয়ে। অনন্যারা এক ভাই, এক বোন। দাদা ওর থেকে তিন বছরের বড়ো।বিয়ের আয়োজনে মেতে উঠল ওর পরিবার। নির্দিষ্ট দিনে বিয়ে হল অনন্যার। শাশুড়িকে বিয়ের আগে একবারও দেখে নি। তাই এক অজানা ভয়ে শ্বশুড়বাড়িতে প্রবেশ করল অনন্যা।শান্ত,ব্যক্তিত্বময়ী প্রতিমা দেবীকে দেখে ওর মনের সংকোচ দূর হল। খুব তাড়াতাড়ি প্রতিমা দেবীর সঙ্গে ওর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠল। কিন্তু চিরাগ আর ওর শ্বশুড় মশাইয়ের ব্যবহার দেখে অনন্যা বুঝল, দুইজনেই শুধু ডিগ্রি ধারণ করেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মূর্খ। সবসময় শাশুড়ি মাকে এবং পরে অনন্যাকেও কটু কথা শোনাতে ছাড়ত না। এই যুগেও তারা চায় বাড়ির বউরা চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে ঘর সংসার আর বাচ্ছা প্রতিপালন করা নিয়ে থাকবে। অর্থাৎ নারী স্বাধীনতার চরম বিরোধী তারা।
দীর্ঘদিন এরকম স্বামী-পুত্রের মাঝে থেকেও প্রতিমা দেবি নিজেকে নিলিপ্ত রাখতে পেরেছেন। অনন্যা কখনও শাশুড়ি মাকে জোরে কথা বলতে দেখে নি। সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে কলেজে পড়ানো, সন্ধ্যে বেলায় বাড়ি ফেরা তারপর কাছাকাছি একটা আশ্রমেও খানিকটা সময় কাটাতেন প্রতিমাদেবী।শ্বশুড় মশায়ের অমত থাকলেও এ ব্যাপারে শাশুড়ি মাকে জোর করতে পারতেন না। তবে অকথা-কুকথা বলতে ছাড়তেন না।শ্বশুড় মশাইয়ের সন্দেহবাতিক গ্রস্তের ব্যাপারটা বুঝতে বাকি রইল না অনন্যার। শাশুড়ি মায়ের বাপের বাড়ি অগাধ সম্পত্তি থাকায় শশুড় মাশাই বউকে পছন্দ না করলে্ও তার বিরোধীতা করতেন না।শ্বশুড় মশাই ছেলেকে কানে  ছোটোবেলা থেকেই তার মায়ের নামে বিষ ঢালত। ফলে চিরাগ ওর মায়ের সম্পর্ক কোনও ভাবেই সহজ হয় নি। বাবার সঙ্গ পেয়ে  অসম্ভব লোভী এবং জটিল মনের মানুষ তৈরী হল ছেলে।


‘আমি পূণ্য অর্জন করব বলে স্বামীর সেবা করি না। সব মহাপুরুষই বলে গেছেন আর্তপীড়িতের সেবা করা মানুষের ধর্ম। আমি শুধু আমার ধর্ম পালন করছি।


অনন্যার মনে পড়ল বছর চার আগের ঘটনা। ও আর চিরাগ তখন চেন্নাইতে থাকত। অনন্যা একটা অ্যাড এজেন্সিতে চাকরিতে জয়েন করল। চিরাগের বারণ থাকা সত্বেও অনন্যা চাকরি ছাড়ল না। ইতিমধ্যে অনন্যার মা মারা যান। বাবার সঙ্গে ফোনেই সম্পর্ক আবদ্ধ। বাপের বাড়ি যাওয়া আসা কম।কিন্তু ছুটি পেলেই শাশুড়ি মায়ের কাছে ছুটে আসত অনন্যা। প্রতিমা দেবীর সঙ্গে সময় কাটাতে ওর খুব লাগে। সেবারও চিরাগ আর ও দুজনে মিলে  তিনি-চারদিনের জন্য কলকাতায় এল। শ্বশুড়মশাই সেদিন বাড়ি ছিলেন না। হঠাৎ এক বয়স্ক ভদ্রলোক প্রতিমা দেবীর সঙ্গে দেখা করতে এলেন।প্রতিমা দেবীর সঙ্গে তেমন কেউ দেখা করতে আসে না। তাই ওনাকে দেখে একটু বিব্রত হল অনন্যা। ভদ্রলোক সদ্য রিটায়ার করেছেন। প্রতিমাদেবীর কলিগ। অনন্যা তাড়াতাড়ি চা আনতে গেল। ভদ্রলোক প্রতিমা দেবীকে বললেন, ‘দিদি আপনি আমার থেকে বয়সে ছোটো হলেও সর্ব্বজন শ্রদ্ধেয়। আমি একটা অনুরোধ নিয়ে্ আপনার কাছে এসেছি । জানেন তো আমার স্ত্রী মারা গেছেন। আমার সন্তানও নেই। পৈতৃক সম্পত্তি অগাধ। আমি এই বোঝা বইতে চাই না। কিছুদিনের মধ্যে হরিদ্বারে গুরুজীর আশ্রমে চলে যাব। যাওয়ার আগে সমস্ত সম্পত্তি আপনাকে দিয়ে যেতে চাই। আপনি সৎ কাজে ব্যাবহার করুন। প্রতিমা দেবী চমকে উঠলেন, এ কী কথা। এই সম্পত্তি আমি নিতে পারব না। কোনও মতে এই অনুরোধ আমায় করবেন না। বরং গুরুজীকে দান করুন। ভদ্রলোক দুঃখিত হয়ে বললেন তাহলে আপনার ছেলে চিরাগ  তো আমার ভাগ্নের সমান তাই ওর নামেই সবকিছু লিখে দিতে চাই। পরোক্ষভাবে আপনিই ওকে গাইড করতে পারবেন। এবার প্রতিমাদেবী বিরক্ত হয়ে এই প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিলেন। অনন্যা চা নিয়ে ঢুকতে গিয়ে দেখল দরজার আড়াল থেকে চিরাগ সব কথা শুনছে। কিন্তু পরবর্তী ঘটনার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না। চিরাগ দৌঁড়ে ঘরে ঢুকে বলল, আমায় স্বছন্দে আপনার সম্পত্তি আমায় দিতে পারেন। আমি একটা বব্যসা করতে চাই । প্রয়োজনীয় মূলধন জোগাড় করে উঠতে পারিনি। এই সম্পত্তি পেলে আমার উপকার হবে। অনন্যা লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল । এই প্রথম প্রতিমা দেবী জোরে ছেলের সঙ্গে কথা বললেন—চিরাগ তুমি এক্ষুণি ভিতরে যাও। চিরাগ সম্পত্তি পাওয়ার আশায় সব ভুলে গিয়ে বলল, ‘তুমি চুপ কর। উনি যেচে সম্পত্তি দিতে এসেছেন, তুমি কেনো হাতের লক্ষ্ণী পায়ে ঠেলছো। আমি তোমার মতো পারব না।’

ভদ্রলোক হয়ত ভেবে ছিলেন প্রতিমাদেবীর ছেলে তাঁর মতই হবে। কিন্তু চিরাগের এই রূপ দেখে উনি বিব্রত। অনন্যাকে বললেন-মা আমি এসব কিছুই খাব না। তুমি নিয়ে যাও।  চিরাগকে বললেন, আমাকে কয়েকদিন সময় দাও।আমি সব ব্যবস্থা করছি। চিরাগ তৎক্ষনাত উত্তর দিল, আমরা তো পরশুই চেন্নাই ফিরছি। তার আগে …
তাতে কী, চেন্নাই তো সামনেই প্রয়োজনে ফ্লাইটে চলে এসো। আপনার বাড়ির ঠিকানা আর ফোন নম্বরটা দিন। উনি বললেন আমার ফোনটা দোকানে সার্ভিসিংয়ে দিয়েছি। আর প্রয়োজনে তোমাকে বাড়িতে ডাকবোই, এতো ব্যস্ত হলে চলে।
প্রতিমা দেবী তক্ষুণি মনে মনে বলছেন ধরণী দ্বিধা হও। কিন্তু ওনার সম্বিত ফিরল, ভদ্রলোক যখন ওঁর পায়ে প্রণাম করে কোনও কথা না বলে বেরিয়ে গেলেন। প্রতিমা দেবী আর অনন্যা মুখোমুখি বসে, ঘর নিস্তব্ধ। রাতে শ্বশুড়মশাই বাড়ি ফিরলেন। চিরাগ সব কথা বলল। মায়ের ওপর ক্ষোভ উগরে দিল বাবার কাছে। ব্যস, বাবা আর ছেলে মিলে অকথ্য ভাষায় শাশুড়িকে আক্রমণ করতে লাগল। এমনকি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রতিমা দেবীকে জড়িয়ে অনন্যার সামনেই কটূকথা বলতে শুরু করল।

পরের দিন ভদ্রলোক কলেজে এলেন প্রতিমা দেবীর সঙ্গে দেখা করলেন। ক্ষমা চাইলেন অনুমতি ছাড়া ওনার বাড়িতে আসার জন্য। জানালেন, চিরাগকে এক পয়সাও তিনি দেবেন না। তবে এখনই চিরাগ সেটা জানতে পারুক সেটাও তিনি চান না।চিরাগের সামনে যে গাজরটা ছুলিয়ে এসেছেন। সেটা বরং আরও কিছুদিন ঝুলুক।

অনন্যা  চিরাগের এই রূপ দেখে স্তম্ভিত। একরাশ অস্বস্তি নিয়ে একা চেন্নাইয়ে  ফিরে এসেছিল। এরপর থেকে ও চিরাগকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে যেতে লাগল। বেশ কিছুদিন বাদে চিরাগের নামে চিঠি এসেছিল ওই ভদ্রলোকের কাছ থেকে, যাতে তিনি চিরাগের ব্যবসাতে টাকা না দিয়ে কোন একটা অনাথ আশ্রমে সব দান করে গেছেন জানিয়ে ছিলেন। এই চিঠি পেয়ে চিরাগের কিছুদিন কি আস্ফালন, লক্ষ্য করেছিলেন প্রতীমাদেবী।

সব এক এক করে মনে পড়ছে। বিয়ের আড়াই/ তিন বছর পরে অনন্যা একবার প্রতিমাদেবীর কাছে একাই এসেছিল আর খুবই কুণ্ঠিত হয়ে বলেছিল, ‘মা একটা কথা বলবো তুমি রাগ করবে নাতো?’ প্রতীমাদেবী অভয় দেওয়ার পর অনন্যা জানিয়েছিল, ও প্রেগনেন্ট হয়েছে বুঝতে পেরে সোজা কলকাতায় এসে অ্যাবশন করিয়ে নিয়েছে। মা তুমি অসাধারণ ধৈর্যশীলা, আমি অতটা নই। চিরাগের সন্তান যদি ওর মতো হয় আমি সহ্য করতে পারবো না।তাই অনেক ভেবে এই সিদ্ধান্ত । তুমি বলছিলে— হয়তো আমার বা তোমার স্বভাব ও পেতে পারত, কিন্তু চান্স ৫০/৫০, তাই আমি কোনরকম রিস্ক নিতে পারলাম না।’ অনন্যা ভেবেছিল এ সংবাদ শোনার পর শাশুড়ি মা দুঃখ পাবেন বা রাগ করবেন, কিন্তু প্রতিমাদেবী বললেন, “শোন তোর সংসার তোর, সেখানে তোর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। যা ভালো বুঝেছিস করেছিস, আমি শুধু চাই তুই ভাল থাক। আর তোর ভালোর জন্যেই বলছি এ কথা কাউকে বলিস না। অনেক অশান্তি হবে।”

বছর দুয়েক আগে আরো একবার শাশুড়ির মাহাত্ম্য দেখার সুযোগ হয়েছিল অনন্যার। শ্বশুর মশাইয়ের সেলিব্রাল অ্যাটাকের খবর পেয়ে ও কলকাতায় এসেছে। চিরাগ কয়েকদিন বাদে হায়দ্রাবাদ থেকে কোলকাতায় এল। মাস ছয়েক আগে থেকে চিরাগ হায়দ্রাবাদে নতুন অফিস জয়েন্ট করেছে। ও এখন ওখানেই থাকে। প্রথম কয়েকদিন শ্বশুরমশাই হাসপাতালে ছিলেন তারপর বাড়িতে নিয়ে আসা হল। ওনার এক দিক পক্ষাঘাতে পরে গেছে। অনন্যা সেইসময় লক্ষ্য করল শাশুড়িমা দিনরাত এক করে শ্বশুড় মশাইয়ের সেবা-যত্ন করছেন, আর অদ্ভুত কান্ড এরপরেও বাবা ছেলে সুযোগ পেলেই প্রতিমাদেবী আর অনন্যার কুৎসা গাইছে।  অনন্যা শাশুড়ি কে বলেছিল, ‘মা তোমার ইচ্ছে করে এইরকম একটা লোকের সেবা করতে? একটা আয়া রাখলেই তো হয়।’ প্রতিমা দেবী বলেছিলেন, ‘আমি পূণ্য অর্জন করব বলে স্বামীর সেবা  করি না। সব মহাপুরুষই বলে গেছেন আর্তপীড়িতের সেবা করা মানুষের ধর্ম। আমি শুধু আমার ধর্ম পালন করছি । আর আয়া রাখার কথা বলছিস? তারা এই ধরনের কথা শুনে বাইরে গিয়ে গল্প করবে সেটা আরো লজ্জার। যাইহোক কপালগুণে বাড়িতে আশার দিন ১০/১২ পরে আবার ওনার অ্যাটাক হয় আর সেবার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার সময় পাওয়া যায়নি। এইসব অতীত স্মৃতিতে অনন্যা এমনই আচ্ছন্ন হল যে প্লেন দমদম এয়ারপোর্টে নামবে  সিটবেল্ট বাঁধার ঘোষণা কানে আসতে ওর সম্বিত ফিরল।

এয়ারপোর্ট থেকে বাইরে বেরিয়েই ও দেখল মিতুদি গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।গাড়িতে উঠে প্রথমেই দুজনে খুব কাঁদলো। মিতুদি  হল প্রতিমা দেবীর বোনের মেয়ে। খুব অল্প বয়সে ওর বিয়ে হয়েছিল, কিন্তু মাত্র ৫ বছরের মধ্যেই সংসার সুখের মেয়াদ শেষ হয়। একটা অ্যাক্সিডেন্টে ওর স্বামী মারা যায়। তারপর অনেকের অনেক উপদেশেও হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে নিজের সিদ্ধান্তে অবিচল থেকে বিয়ের পিড়িতে আর বসে নি। ওর মা আর বাবা দাদা বৌদির সঙ্গে ওদের দেশের বাড়িতেই থাকেন। কিন্তু মিতুদি কলকাতায় একটা এনজিওর  সঙ্গে যুক্ত হয়।  অনন্যার মতো এই মিতুরও মাসি অন্ত প্রাণ।  ওরা মঠে এল। ২/৪ জন আত্মীয়ও এসেছেন। অনন্যার সঙ্গে সকলেই চিরাগকে দেখবে আশা করেছিল, কিন্তু বাস্তবে তা না হওয়াতে সকলে একটু ক্ষুণ্ণ হলেও কেউ কোনও প্রশ্ন করল না। কিছুক্ষণ বাদে একজন স্বামীজী অনন্যাকে বললেন, ‘এবার ওঠো মা বাকি কাজগুলো করতে হবে, মুখাগ্নি কে করবে?’ অনন্যা মিতুদির হাতটা ধরে বলল, ‘আমরা দুজনে একসঙ্গে করব।’ সব কাজ  নিয়ম মেনে হল। কোলকাতার ফ্ল্যাটের একটা চাবি সবসময় অনন্যার কাছে থাকে। ওরা রাতে এই ফ্ল্যাটে এসে স্নান সেরে সবে বসেছে, এমন সময় মঠের একজন স্বামীজী কিছু ফল মিষ্টি নিয়ে এলেন। মঠটা  ফ্ল্যাটের খুব কাছে তবুও ওরা অবা হল। মিতুও এখন কদিন অনন্যার সঙ্গে এখানে  থাকবে এমনটাই জানাল। স্বামীজী পরেরদিন ওদের একবার মাঠে আসতে বললেন, মহারাজ দেখা করতে বলেছেন।

সারারাত ধরে ওরা দুজন নানারকম আলোচনা আর স্মৃতিচারণায় বিভে্ার থাকল। মিতুদির কাছে অনন্য শুনলো, “আজ সকালে প্রতিমা দেবী যখন মঠে এসেছিলেন, তখন নিজের হাতে  সারদামা আর রামকৃষ্ণের ছবিতে ফুল-মালা দিয়ে সাজিয়ে প্রদীপ জ্বেলে  তারপর ভক্তিভরে প্রণাম করছিলেন। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ এইভাবে প্রণাম করতে দেখে মঠের একজন  ওনাকে ডাকেন, কিন্তু সারা না পেয়ে যখন মাথায় হাত দিয়ে, “মা ওঠো” বলতেই দেহটা পাশে পড়ে যায়। হতচকিত সবাই তাড়াতাড়ি ডাক্তার ডাকেন, কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ।” প্রতিমাদেবী কে সবাই খুব শ্রদ্ধা করত কিন্তু তার এই রকম অসাধারণ সুন্দর মৃত্যুতে সবাই তাকে দেবতার আসনে বসাতে চাইছে।
আর এই মায়ের ছেলে চিরাগ? না, অনন্যা এবার চিরাগকে ডিভোর্স দেবেই।

পরের দিন মিতু আর অনন্যা মঠে এসে মহারাজের সঙ্গে দেখা করল। নানারকম আলোচনার মাধ্যমে ঠিক হলো, কোনরকম বাহুল্য না করে মঠের নিকটবর্তী কালীবাড়িতে প্রতিমাদেবীর পারোলৌকিক কাজ  করবে অনন্যা আর মিতু । মহারাজকে ওরা বলল, ‘মাসির কাজ যেন খুব নিষ্ঠার সঙ্গে করা হয়। দেখবেন আর এই দিন কিছু কম্বল আর মিষ্টি দান করার ব্যবস্থা মহারাজকেই করতে হবে।’ অনন্যা বলল, “মহারাজ শ্রাদ্ধ উপলক্ষে লোক খাওয়ানো অত্যন্ত বাজে একটা প্রথা। আমরা ওসবের মধ্যে একদম যাব না। তবে এইদিন সন্ধ্যায় কোন একটা হল ভাড়া করে পরিচিত সকলকে ডেকে একটা স্মরণ সভা করতে চাই। আপনি অনুমতি দিন।মহারাজ বললেন, “এখন বুঝতে পারছি কেন দেবিজী (আশ্রমের সকলেই প্রতিমাদেবিকে দেবিজী বলতেন) আত্মীয় বলতে  শুধু তোমাদের দুজনের কথাই বলতেন। যাই হোক তোমাদের প্রস্তাব খুবই ভালো। তোমরা কতটা জানো জানিনা, এই মঠটা দেবীজীর দানেই গড়ে উঠেছে। এখানে একটা বেশ বড় হলঘর আছে যেখানে মাঝে মাঝে অনেকে বক্তৃতা, নামসংকীর্ত্তন, পাঠ হয়।  দেবীজীর স্মরণ সভা এই হলেই হোক এটাই আমার ইচ্ছে।” ওরা খুশি মনেই সম্মতি দিল। এরপর মহারাজ বললেন, ” সংসারের ঝামেলা নেব না বলেই আমরা সন্ন্যাস ধর্ম নিই। কিন্তু অনেক কিছুই করতে হয়। স্বামী বিবেকানন্দকে ও শেষ দিন পর্যন্ত উকিল, আদালত করতে হয়েছে। আমরা তো কোন ছাড়। দেবিজী এমনিতে খুব কম কথা বলতেন, কিন্তু বছর খানেক আগে উনি আমাকে জানান, উনি ওনার পরিচিত একজন ব্যারিস্টার ভদ্রলোকের কাছে আইন সম্মত একটা উইল করে গেছেন। আমি এবং মঠের আরো দুজন সেখানে সই ও করি। তোমরা যদি চাও তাহলে এখনই ওই ব্যারিস্টার ভদ্রলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করে উইল পড়ার ব্যবস্থা করতে পারি। অনন্যা বলল, “মহারাজ এই উইলে কি লেখা আছে তাতে আমার কোনো কৌতুহল নেই। কিন্তু এই দশদিন এই প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা করতে চাই না। তবু আপনি এই ব্যারিস্টার ভদ্রলোকের নাম আর ফোন নম্বরটা দিন, আমার অন্য দরকার আছে।”

এরপর বাড়ী এসে দুজনে একটু সেদ্ধ ভাত খাওয়ার পর অনন্যা এই ব্যারিস্টার ভদ্রলোককে (যার নাম জিতেন ভরদ্বাজ) ফোন করল। উনি প্রতিমাদেবীর মৃত্যু সংবাদ শুনে দুঃখ পেলেন।  অনন্যা বলল, আমরা মহারাজের কাছে শুনলাম মা একটা উইল করে গেছেন। কেন করেছেন জানিনা, তবে তিনি অত্যন্ত দূরদর্শী মহিলা ছিলেন। আমার আর মিতুদির ইচ্ছে মায়ের শ্রাদ্ধ শান্তির পর চিরাগের সামনে এই উইল পড়া হক। আমি আপনার কাছে একটা অন্য আর্জি জানাবার জন্য ফোন করছি। আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিরাগকে ডিভোর্স দিতে চাই। আপনি কাগজ পত্র রেডি করুন। আমি যতদূর ওকে জেনেছি, আমার মতে ও একজন ভীতু কাপুরুষ। আপনি যদি মিউচুয়াল ডিভোর্সের ব্যাবস্থা করেন, তাতে আমার শাশুড়ির আত্মা শান্তি পাবে। এর মধ্যে আমি একদিন আপনার সঙ্গে দেখা করব।’

মঠের হলঘরটা বেশ বড়। একসঙ্গে অন্তত্ত ১০০ জন বসতে পারে। এই কদিন মিতু আর অনন্যা প্রতিমাদেবির সব পরিচিতদের এই স্মরণ সভায় আসতে বলেছে। ওনার কলেজের প্রিন্সিপাল রুমাদি তো কেঁদেই ফেললেন। ব্যারিস্টার মিস্টার ভরদ্বাজের কাছে গিয়ে ওনাকেও এই দিন আসতে বলল অনন্যা। কথা প্রসঙ্গে উনি বলেছেন “কিছু ছলনার আশ্রয় নিতে হলেও চিরাগকে এই স্মরণ সভার পরেই আনতে হবে আমার কাছে। ওর সামনেই উইল ও পড়া হবে আর ডিভোর্সের কাগজ ও সই করিয়ে নেবেন।” আত্মীয় স্বজন ও কয়েকজন আছেন তবে তারা নিয়মভঙ্গ উপলক্ষে কিছু লোকজনকে খাওয়ানোর উপদেশ দিল। কেউ কেউ চিরাগের প্রসঙ্গ তুললো, অনন্যা শুধু “দেখি কি করা যায়” বলে চলে এল। দেখতে দেখতে দশদিন পেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে একদিনও চিরাগ ফোন করেনি।

পরের দিন খুব শান্ত পরিবেশে আর নিষ্ঠা সহকারে প্রতিমাদেবির পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হলো। আজ সন্ধ্যা ৬টায় স্মরণ সভা।মিতু আর অনন্যা ৫টায়  মঠে চলে এল।  ইতিমধ্যে এই হলের এক দিকে একটা ছোট্ট স্টেজ করা হয়েছে। প্রতিমাদেবীর একটা খুব বড় ছবি সুন্দর করে বাঁধিয়ে সাদা মালা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে। আস্তে আস্তে সবাই এলেন। প্রথমেই আশ্রমের সকলেই  অন্ধকার ঘরে হাতে প্রদীপ নিয়ে গান গাইল, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।” এরপর প্রধান মহারাজ তাদের দেবীজীর সম্বন্ধে কিছু কথা বললেন। এরপর প্রিন্সিপাল রুমাদি কলেজের কতটা ঘটনা তুলে ধরলেন, একটা আবৃত্তি করলেন। এখানে অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য কাউকে রাখা হয়নি, অথচ কি সুস্থভাবে অনুষ্ঠান হচ্ছে। প্রতিমাদেবীর এক ছাত্রী গাইল, “জীবনে মরণের সীমানা ছাড়িয়ে-“, প্রত্যেকের চোখে জল আর কি শান্ত পরিবেশ, মাঝে মাঝে অনেকেই ওনার সঙ্গে কাটানো মুহূর্ত তুলে ধরছেন। কেউ আবৃত্তি, কেউ গানের মাধ্যমে ওনাকে স্মরণ করা হল। কোথা দিয়ে দু ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। ইতিমধ্যে মঠের তরফ থেকে কয়েকজন চা আর বিস্কুট এনেছিলেন, কিন্তু কয়েকজন বাদে  কেউ তা মুখে তোলেনি।অনন্যা আর মিতু সামনেই বসেছিল আর অনর্গল চোখের জলে ভাসছিল। প্রায় শেষের দিকে মিতু উঠে গেল আর একটা মালা ছবিতে পরিয়ে গান ধরল, “তুমি কি কেবলই ছবি-।” এরপর মহারাজ অনন্যা কে কিছু বলতে বললেন। অনন্যা কান্না ভেজা কণ্ঠে সকলকে ধন্যবাদ দিল, তারপর মাতৃতুল্য শাশুড়ির সম্বন্ধে দু-এক কথা বলে গান ধরল, “দাঁড়িয়ে আছো তুমি আমার গানের ওপারে-।” অনন্যা এত ভালো গান করে সেটা কেউই জানতো না। কিন্তু ওর হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে আসা এই গান শুনে কেউ শুকনো চোখে থাকতে পারল না। হলের সবাই নিঃশব্দে উঠে দাঁড়িয়ে এই গানকে উপলব্ধি করলো। এবার অনুষ্ঠান শেষ হলো। সকলেই গভীর মন খারাপ অথচ ভরাট হৃদয়ে প্রায় নিঃশব্দে যে যার জায়গায় ফিরল।মহারাজ  ফুলে ঢাকা ছবিটা অনন্যার হাতে তুলে দিয়ে বললেন, “মঠের জন্যেও এরকম একটা  ছবি রাখা আছে। তোমাদের অনেক আশীর্বাদ করছি। কোন স্মরণ সভা এতো সুন্দর এতো মর্মস্পর্শী  হতে পারে আমার ধারণা ছিল না। উনি সত্যিই দেবী ছিলেন।

যাইহোক, এর দুদিন পর মিতু ব্যারিস্টার মিস্টার ভারাদ্বাজকে ফোন করল। উনি জানালেন সামনের শনিবার অর্থাৎ দুদিন পর বিকেল বেলা উনি সময় দিতে পারবেন উইল পড়ার জন্য। যদি এই সময়ের মধ্যে চিরাগকে আনা যায় তাহলে অনন্যার ডিভোর্সের পেপারেও সই করিয়ে নিতে পারবে। মিতু বেশ জোরের সঙ্গেই বলল এই দিন মানে শনিবার বিকেল ৫টার মধ্যে ও চিরাগকে এই বাড়িতে হাজির করবে। অনন্যার অবাক জিজ্ঞাসার উত্তরে বলল, “দেখনা আসে কিনা। ওকে আমি তোর চেয়েও ভালো চিনি। তুই শুধু কোনো কারণেই মাথা গরম করিস না, চুপ করে থাকিস। এরপর চিরাগকে ফোন করে শনিবার আসতে বলল। স্বভাবতই চিরাগ আসতে পারবে না জানালো। তখন মিতু চিরাগকে বলল, “মাসি একটা উইল করে গেছে যেটা এখনও হাইকোর্টের এক ব্যারিস্টারের কাছে আছে। উনি বলেছেন শনিবারের মধ্যে এই উইল পড়া না হলে আপাতত ফ্ল্যাটটা পুলিশ বন্ধ করে দেবে, সেরকমই নির্দেশ আছে, আর উইল পড়ার সময় তোকে, অনন্যাকে আর আমাকে থাকতে হবে। এখন আমি আর অনন্যা এখানে আছি, তুই যদি আসিস ভালো, না এলে ফ্ল্যাট উইল সব কোর্টের আন্ডারে চলে যাবে। ভেবে দেখ কি করবি? শনিবার বিকেলে ওনারা এই কাঁকুড়গাছি ফ্ল্যাটেই আসবেন, তোকে ৫টার মধ্যে এখানে উপস্থিত থাকতে হবে।” সবশুনে চীরাগ বলল, “ন্যাকামোটা একবার দেখো মিতুদি। আমি একমাত্র সন্তান সব সম্পত্তি আমিই পাব, তার আবার উইল কিসের? সারাজীবন জালাল, এখন মরেও শান্তি দেবে না। ঠিক আছে, আমি শনিবার বিকেলের মধ্যে পৌঁছে যাব। তবে উইল পড়া হয়ে গেলে এই দিনই আমি ফ্ল্যাট আর সম্পত্তি বুঝে নেব। পরের দিনই আমি চলে আসব। তাই তোমাদের ওই দিনই ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিতে হবে।” মিতু শুধু বলল, “আমরা তৈরি”। সত্যি এই মায়ের এই ছেলে, যাক ও যে আসবে মিতুদির ফাঁদে পা দিয়েছে এটাই স্বস্তির।

দেখতে দেখতে দিন কেটে গেল। নির্দিষ্ট দিনে বিকেল চারটে নাগাদ চিরাগ এল। এসেই একবার মায়ের ছবিটা দেখলো মাত্র তারপর আলমারির চাবি খুঁজে আলমারি খুলল- যতই আশা করুক কিছু শাড়ি শাল বই পেন ছাড়া কিছুই পেল না। একটা মাত্র ছোট্ট সুটকেস ছিল আলমারির মাথায় সেটাও খুলল, তবে সেখানে আর কিছু না পেলেও একটা ডাইরি পেলো। প্রত্যেক পাতা খুলে দেখল যদি কোনো দলিল বা এই জাতীয় কিছু পায়, কিন্তু কিছু না পেয়ে হতাশ হয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল। অনন্যা সঙ্গে সঙ্গে সেটা কুড়িয়ে মাথায় ঠেকিয়ে তুলে রাখলো।

ইতিমধ্যে মঠের দুজন মহারাজ, ব্যারিস্টার ভরদ্বাজ, একজন পুলিশ অফিসার আর প্রতিবেশী এক ভদ্রলোক একসঙ্গেই এলেন। অবশ্য মিতু আর অনন্যা জানতো এরা আসবেন। কিন্তু চিরাগ পুলিশ দেখে খুব ঘাবড়ে গেল,  রেগেও গেল। খুব জোরে জিজ্ঞেস করল, “উইল পড়তে পুলিশ লাগে জানতাম না তো?” মিস্টার ভারাদ্বাজ বললেন, “আপনি অনেক কিছুই জানেন না, এখন আমাদের কাজ আমাদের করতে দিন।” ইতিমধ্যে অনন্যা আর মিতু সবার জন্য চা বিস্কুট নিয়ে এলো। এরপর মিস্টার ভরদ্বাজ সিল করা খামটা পড়তে লাগলেন, “আমি প্রতিমা চক্রবর্তী সম্পূর্ণ সজ্ঞানে এবং সু ইচ্ছায় এই উইল লিখছি। আমার এই কাঁকুড়গাছির ফ্ল্যাট আমার নিজের টাকায় কেনা,  ইতিপূর্বে মধ্য কলকাতার যে ফ্ল্যাটে আমরা থাকতাম সেটাও আমার পৈতৃক সম্পত্তি। তাই গত দুবছর আগে আমার স্বামীর মৃত্যুর পর ওই ফ্ল্যাট বিক্রি করে মঠের কাছাকাছি এই ফ্ল্যাটটা কিনি। আমার পরে আমার পুত্রবধূ অনন্যা চক্রবর্তী এই ফ্ল্যাটের মালিক হবে। আমি কোনদিনও আমার স্বামীর একটি পয়সাও নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করিনি। ওনার মৃত্যুর পর ওনার টাকা, এফডি সার্টিফিকেট এবং আরও যা যা ছিল চিরাগ নিয়ে চলে যায়। সে ছোট থেকেই কোনদিন আমাকে মা বলে স্বীকার করেনি, আমারও ওর প্রতি কোনো দুর্বলতা নেই। আমার আত্মার শান্তি হবে ও যদি আমার পারলৌকিক কাজ না করে। তবে ওর কাছে আমি একটা ব্যাপারেই কৃতজ্ঞ। ওর মাধ্যমেই আমি অনন্যা কে পেয়েছি। মিতু আর অনন্যার জন্যই আমার বেঁচে থাকাটা সার্থক হয়েছে। মিতু আর অনন্যাকে আমার সমস্ত টাকা-পয়সা গয়নাগাটি অর্থাৎ স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির সবকিছু দিয়ে গেলাম। আমি জানি ওরা ভালো কাজেই এইসব ব্যবহার করবে তবু আমি ওদের দুজনকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম আমার সব সম্পত্তি ওরা ইচ্ছামত ব্যবহার করবে। যদিও বাহুল্য তবুও চিরাগকে আশীর্বাদ করছি ওর যেন সুবুদ্ধির প্রকাশ ঘটে। আমি আবার জানাচ্ছি আমার অর্জিত আর পৈতৃক সম্পত্তির যা কিছু আছে সব আমার কন্যাতুল্য বোনঝি মিতালী ব্যানার্জি অর্থাৎ মিতু আর আমার বৌমা অনন্যা পাবে। অনন্যার যদি ডিভোর্স হয় তাহলেও এই ব্যবস্থাই স্থায়ী হবে। এই উইল করতে এবং আমাকে নানা কাজে সাহায্য করার জন্য মহারাজদের কাছে আর জিতেন বাবুর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি ওনাদের নমস্কার জানাচ্ছি।আমি প্রতিমা চক্রবর্তী পয়লা ডিসেম্বর, ১৯১৭ সাল, ১/১২/১৯১৭।

উইল পড়া হলে মিতু আর অনন্যা নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল, কিন্তু চিরাগ অসম্ভব জোরে চিৎকার করে উঠে বলল, “অসম্ভব এ উইল জাল, আমি একমাত্র সন্তান আমার নামে কিছুই নেই, হতেই পারে না।” মিস্টার ভরদ্বাজ খুব অপমানিত হলেন। উনি বললেন, “শ্রীমান চীরাগ নিজেকে কন্ট্রোল করুন, এই ধরনের কথা একজন হাইকোর্টের ব্যারিস্টার যে সহ্য করবেনা সেটা আপনার জানা উচিত।” কিন্তু চিরাগ তখন রাগে জ্ঞানশূন্য, তাই বলল “দেখি সইটা” এই বলে হাতে নিয়েই উইলটা কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ফেলে হা হা করে হাসতে লাগলো।সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছেন বাকিরা হতবাক কিন্তু মিস্টার ভরদ্বাজ বললেন, “চিরাগ তুমি কতখানি নোংরা মনের সেটা সবচেয়ে ভালো জানতেন তোমার মা। তাই ওনার পরামর্শেই আমি তোমাকে জেরক্স কপিটা দিয়েছিলাম। এই দেখো খামের ওপর জেরক্স কথাটা লেখা আছে ছোট্ট করে। তবে তুমি যা করলে বিশেষত একজন আইন এবং একজন পুলিশ অফিসারের সামনে সেটা দণ্ডনীয় অপরাধ। উনি এক্ষুনি তোমায় অ্যারেস্ট করতে পারেন। তখন তোমার চাকরিও থাকবে না, আর অনন্যা মা এতদিন দেবীজীর সম্মানের কথা ভেবে তোমাকে ডিভোর্স দেয় নি, কিন্তু এবারও তোমাকে ডিভোর্স দিতে চায়। তুমি যত বড় হও না কেন প্রতিমা দেবির ছেলে তাই একটা সৎ পরামর্শ দিচ্ছি। তুমি এই মুহূর্তে ডিভোর্স পেপারে সই করে দাও, না হলে আমি অনন্যামাকে পরামর্শ দেব ও চাকরি ছেড়ে দেবে, তখন তোমাকে মোটা অংকের খোরপোষ দিতে হবে। ভেবে দেখো আমরা এতো জন তোমার যেরূপ দেখলাম তাতে অনন্যা মায়ের ডিভোর্স পেতে কোন অসুবিধা হবে না। আর এখন সই করে মিউচুয়াল ডিভোর্স যদি দিয়ে দাও তাতে তোমার মঙ্গল।” চিরাগ বললো, “ও আমায় কি ত্যাগ করবে, আমি এক্ষুনি ওকে ডিভোর্স দেব। আপনি কাগজ দিন আমি সই করে দেবো। মায়ের ন্যাওটা  হয়ে সব  সম্পত্তি বাগিয়ে এখন তো আরোই দেমাকে পা পড়বে না।” অনন্যা কিছু বলতে যাচ্ছিল। মহারাজ অনন্যা কে ইশারা করলেন চুপ করতে বললেন। চিরাগ চটপট কয়েকটা সই করে দিল, আর অনন্যা কে শুনিয়ে বললো, “আমি খুব তাড়াতাড়ি আবার বিয়ে করব”।

এবার মিতু বলল, “চিরাগ শর্ত অনুযায়ী তুই আজ আর এই বাড়িতে থাকতে পারবিনা।” “আমি তোমাদের মতো লোকেদের সঙ্গে থাকতেও চাই না।” এই বলে চিরাগ দুমদাম করে বেরিয়ে গেল। পুলিশ অফিসার একটা ফোন করলেন, চিরাগ জানতেও পারল না পুলিশের লোক ওর পেছনেই আছে। ও সোজা মধ্য কলকাতার একটা হোটেলে উঠলো আর পরের দিনই হায়দ্রাবাদ ফিরে গেল।

এরপর একদিনের জন্য মিতু আর অনন্যা চেন্নাই গেল। অনন্যা এই ফ্ল্যাটে ঢুকে নিজের দরকারি জিনিসপত্র নিল। সবিতাকে কিছু জিনিসপত্র আর ৩ মাসের মাইনে দিল। সবিতা খুব কাঁদছিল, কিন্তু উপায় নেই। এরপর ও ফ্ল্যাটের মালিকের কাছে গিয়ে ফ্ল্যাটের চাবি, এক মাসের ভাড়া আর চিরাগের ফোন নাম্বার দিল। ওনারা যাতে চিরাগের সাথে যোগাযোগ করে ফ্ল্যাট খালির ব্যবস্থা করেন তা জানাল। পরের কাজ চাকরিতে ইস্তফা। সেটা করতে বেশ বেগ পেতে হল। কেউই অনন্যা কে ছাড়তে চায় না। মিস্টার মেনন জিনি অনন্যার বস সব শুনে বললেন, “আপনি আমাদের কলকাতার অফিসে জয়েন করতে পারেন। আপনার মত একজন দক্ষ কর্মীকে ছাড়লে আমাদেরই অসুবিধা। যাই হোক কী করবেন কয়েকদিন বাদে আমাদের জানাবেন, ভাল থাকবেন।” ওদের সাথে সারা দিনই দুর্গা ছিল। দুর্গাকে ওর  টাকাটা ফেরত দিয়ে অনন্যা বলল, “তোমার টাকাটা ফেরত দিলাম কিন্তু তোমার ভালোবাসার কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।” ওরা সন্ধ্যের ফ্লাইটে কোলকাতা ফিরে এলো।

প্রতিমা দেবী বিভিন্ন মঠ মিশনের প্রচুর দান ধ্যান করতেন। তার পরেও ওনার সম্পত্তির পরিমাণ অনেক। মিতু আর অনন্যা একসাথেই থাকতে লাগলো, আর একটা পথশিশুদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করল। ওদের চিকিৎসা আর পড়াশোনার দায়িত্ব নিল। এছাড়া বয়স্ক মহিলাদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করল। দূরদর্শী দেবিজী জানতেন তার সম্পত্তির উত্তরাধিকারীরা এই রকমভাবেই সম্পত্তির সদ্ব্যবহার করবে। উপর থেকে উনি নিশ্চই আশীর্বাদ করছেন।

♦–♦♦–♦♦–♦


  • Tags:

Read by:

❤ Support Us
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
homepage block Mainul Hassan and Laxman Seth
Advertisement
শিবভোলার দেশ শিবখোলা স | ফ | র | না | মা

শিবভোলার দেশ শিবখোলা

শিবখোলা পৌঁছলে শিলিগুড়ির অত কাছের কোন জায়গা বলে মনে হয় না।যেন অন্তবিহীন দূরত্ব পেরিয়ে একান্ত রেহাই পাবার পরিসর মিলে গেছে।

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া স | ফ | র | না | মা

সৌরেনি আর তার সৌন্দর্যের সই টিংলিং চূড়া

সৌরেনির উঁচু শিখর থেকে এক দিকে কার্শিয়াং আর উত্তরবঙ্গের সমতল দেখা যায়। অন্য প্রান্তে মাথা তুলে থাকে নেপালের শৈলমালা, বিশেষ করে অন্তুদারার পরিচিত চূড়া দেখা যায়।

মিরিক,পাইনের লিরিকাল সুমেন্দু সফরনামা
error: Content is protected !!