- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- নভেম্বর ৩, ২০২১
জ্ঞানবৃক্ষ
ইংরেজি ভাষা সাহিত্যের কিংবদন্তী অধ্যাপক আর মননশীল কবি অমরেশ দত্তকে স্মরণ করলেন তাঁর যোগ্য ছাত্র সঞ্জীব দেব লস্কর

৬ আগস্ট, ২০২১, নিঃশব্দে চলে গেল তাঁর প্রথম প্রয়াণ দিবস। সম্পূর্ণ সুস্থ শরীরে অসাধারণ স্মৃতিশক্তি নিয়ে তিনি বেঁচেছিলেন একশো একবছর। আর মাত্র দুটি মাস পেরোলে পা দিতেন একশো দুই বছরে। জীবন্ত কিংবদন্তি, বহুমুখী প্রতিভা সম্পন্ন ব্যক্তিটি এই বিপন্ন সময়ে আমাদের সঙ্গে ছিলেন। আমরা বোধহয় এটা সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে পারিনি, এ সময়ে তাঁর নীরব উপস্থিতি যে আমাদের জন্য ছিল পরম প্রাপ্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, স্বাধীনতা সংগ্রাম, দেশভাগের শূণ্যতাবোধ তাঁরও ছিল। স্বাধীনতা-উত্তর রাজনীতি, সামাজিক অবক্ষয় কিংবা গৌরবের টুকরো টুকরো মুহূর্ত, জাতীয় জীবনে বহুস্তরীয় সৃজনশীলতার বিকাশ, বিচ্ছিন্নতার আগ্রাসন, মানবিকতার সংকট, অসহিষ্ণুতার বিস্ফার, সাম্প্রদায়িকতার উদগ্র আস্ফালন এবং পরিশেষে বিশ্বব্যাপী অদৃশ্য মারণব্যাধীর বিস্তার তাঁকে প্রত্যক্ষ করে যেতে হল।
গতবছর ৬ আগস্ট অতিমারির দুর্যোগ মুহূর্তে ছিল তাঁর নীরবযাত্রা। শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়েছিল সরকারি ব্যবস্থাপনায়।কুচকাওয়াজ এবং সুসজ্জিত চিতায় মাল্যদানপর্ব, সবই ছিল, কিন্তু যাঁদের নিয়ে তাঁর সারাজীবনের পথচলা, সেই গুণমুগ্ধ ছাত্রছাত্রী, বিশিষ্ট বিদ্বৎজন, শিক্ষাবিদ, কবি সাহিত্যিকদের উপস্থিতি ছাড়া তাঁর শেষযাত্রা কি মানা যায়? কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস তাঁর মহাপ্রয়াণ রাজ্যের বৌদ্ধিক জগতে তেমন কোন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি।তাঁর জন্য না ছিল কোন শোকসভা, না কোন স্মৃতিচারণ। আসামের সুধাকণ্ঠ বলে গিয়েছিলেন– ময় যেতিয়া এই জীয়নর মায়া এড়ি গুছিযাম / আশা করো মোর চিতার কাখত তোমার সহায় পাম/ নেলাগে মোর স্মরণী সভা নে লাগে মিছানাম’…(হরফবাংলা, ভাষা অসমিয়া) ইত্যাদি। কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ করেছি সারা রাজ্য সেদিন উত্তল হয়ে উঠেছিল এ অমর শিল্পীর শোকমিছিলে। আর ভাগ্যের এমনই পরিহাস, সরস্বতীর বরপুত্রের প্রয়াণ, যিনি দেশ-বিদেশে আসামের গৌরবের জয় পতাকা উড়িয়েছেন, তাঁর প্রায়াণও বৃহত্তর শোকযাপন দাবি করেছিল–এতে হাতে গোনা কতিপয় শোকার্থী।
অবশ্য তাঁর মৃত্যু কোন অপ্রত্যাশিত ছিল না। সময়টি ছিল প্রতিকূল। সেই যে বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাসে তিনি পড়াতেন মহাকবি শেক্সপিয়ারের ‘ম্যাকবেথ’– ‘শি শুড হ্যাভ ডাইড হিয়ার আফটার। দেয়ার উড হ্যাভ বিন অ্যা টাইম ফর সাচ অ্যাওয়ার্ড’। জীবনের একক্রান্তি লগ্নে পত্নীর মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছোলে ম্যাকবেথ আর্তনাদ করছে এ মুহূর্তে এ দুঃসহ বার্তা গ্রহণ করার ক্ষমতাও তাঁর অবশিষ্ট নেই। জীবন যে তাঁর কাছে এক দুঃস্বপ্ন, ‘অ্যা ওয়াকিং শ্যাডো – অ্যা টেল টোল্ডবাই অ্যান ইডিয়ট, ফুল অব সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি সিগনিফায়িং নাথিং’। সেদিন শোক প্রকাশ করার অবস্থায় আমরাই কি আর ছিলাম? আমাদের তো অসহায়ের মতো দেখে যাওয়া মহাবৃক্ষের পতন (মহাগুরু নিপাত)।
ব্যক্তিটি তো কেবলমাত্র উত্তর-পূর্বের ছিলেন না, তাঁর কর্মক্ষেত্রের বিস্তার ছিল দেশব্যাপী, আর খ্যাতি ছিল দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও। খ্যাতিমান শেক্সপিয়ার স্কলার জি. উইলসন নাইট, ই. এম.ডবলিউ টি লিয়ার্ড ছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধদের তালিকায়।আর পূর্বোত্তর ভারতের হাজার হাজার ছেলেমেয়েরা তো আছেই।বিশ্ববিদ্যালয়ে (গৌহাটি এবং ডিব্রুগড়) তাঁর বিশেষ পক্ষপাত ছিল জন জাতীয় ছেলে মেয়েদের প্রতি। অসমিয়া আর বাঙালিদের তিনি কারণে অকারণে ভর্ৎসনা করতে ছাড়তেন না।কী অপূর্ব ছিল তাঁর ভর্ৎসনার বয়ান! যার উদ্দেশ্যে এগুলো বর্ষিত হত এরাও কান ভরে শুনে যেত কথাগুলো। তাঁর মুখের স্বতঃউৎসারিত বাক্যগুলো একটি প্রজন্মের মুখে মুখে আপ্তবাক্যের মতো ফিরত।
আশী বছর বয়সে পৌঁছে তিনি হাত দিলেন উপন্যাস রচনায়। তাইতো আমরা পেলাম ‘বানপ্রস্থ’(২০০৮)। গদ্যসাহিত্যের অন্যতম ফর্ম, উপন্যাস সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা ছিল, এখন মহাকাব্যের যুগ বিগত, উপন্যাসই এর স্থান নিয়েছে। এ মাধ্যমটিই আধুনিক পৃথিবীতে মহাকাব্যের প্রয়োজন মেটাচ্ছে।
তাঁর জন্মশতবর্ষে আমরা কতিপয় ছাত্র প্রণাম করতে গিয়েছিলাম ডিব্রুগড়ে। সেদিন অন্তরঙ্গ আলাপে তিনি গভীর আত্মতৃপ্তির সঙ্গেই বলেছিলেন কথাটি, সংবাদমাধ্যমে নাকি অদ্যাবধি তিনি কোন দেশবিরোধী, অমানবিক কাজ, পারিবারিক বা ব্যক্তিগত কেলেঙ্কারিতে তাঁর কোন ছাত্রছাত্রীর জড়িত হবার খবরাখবরও নেই। কী সাহসী প্রত্যয়! শেষপর্যন্ত তাঁর এ বিশ্বাস যে কেউ ভঙ্গ করেনি এটা কার কৃতিত্ব কে জানে।এ দুঃসময়ে দীর্ঘ পরমায়ু যে বৃদ্ধ মানুষটির স্বপ্নভঙ্গের কারণ হয়ে ওঠেনি অর্থাৎ তাঁর ছাত্রছাত্রীরা তাঁর এ বিশ্বাস অটুট রাখতে পেরেছে এটা তাঁর যেমন সৌভাগ্য তেমনি তাঁর ছাত্রছাত্রীদেরও। এ দৃপ্ত উচ্চারণের লক্ষ বুঝি ছাত্রছাত্রীদের উপর ইচ্ছাকৃত ভাবেই একটি দায়িত্ব চাপিয়ে যাওয়া? কি জানি পরবর্তী প্রজন্ম বৃদ্ধ এ ব্যক্তিটির বিশ্বাসের দায়ভার বহন করতে পারবে কিনা?
মৃত্যুর মাস দুয়েক আগেও টেলিফোনে তাঁকে সরাসরি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন যে, সামাজিক বিষয়, ইতিহাস রাজনীতি নিয়ে জ্ঞানগর্ভ রচনার সঙ্গে সঙ্গে সৃজনশীল রচনা, গল্প উপন্যাসও লেখা খুব প্রয়োজন। এর মাধ্যমেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বৃহৎ সংখ্যক পাঠকের মনের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, এটা তাঁর অভিমত। একজন আদ্যপান্ত অ্যাকাডেমিকসের লোক হয়েও তিনি দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলেন, কঠিন তাত্ত্বিক, ফুটনোট-কণ্টকিত লেখা নেহাৎ প্রয়োজন ছাড়া, কেবল পাঠসুখের জন্য কি কেউ পড়ে! আসলে অমরেশ দত্তের ভেতরে যে একজন কবির বসতি ছিল (যে কবিতার স্বীকৃতি দেশে তো বটেই, বিদেশ থেকেও এসেছে) এ খবর ক’জনেই বা রাখে? নিজের প্রসঙ্গ টেনেই তিনি বলেছিলেন, আশী বছর বয়সে পৌঁছে তিনি হাত দিলেন উপন্যাস রচনায়। তাইতো আমরা পেলাম ‘বানপ্রস্থ’(২০০৮)। গদ্যসাহিত্যের অন্যতম ফর্ম, উপন্যাস সম্বন্ধে তাঁর ভাবনা ছিল, এখন মহাকাব্যের যুগ বিগত, উপন্যাসই এর স্থান নিয়েছে। এ মাধ্যমটিই আধুনিক পৃথিবীতে মহাকাব্যের প্রয়োজন মেটাচ্ছে। উপন্যাসের জনপ্রিয়তা কখনওই শেষ হবেনা। শুনেছি দ্বিতীয় আরেকটি উপন্যাসও তিনি শেষ করে গেছেন। কী জানি এখন পাণ্ডুলিপিটি কোথায়!
শিলচর শহরের অভয়াচরণ পাঠশালা, কাছাড় হাইস্কুল, গুরুচরণ কলেজ হয়ে পশ্চিমবঙ্গ, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের সাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখে অবশেষে আবার ফিরে এসেছিলেন নিজ জন্মভূমিতে। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং অতঃপর ডিব্রুগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে অধ্যাপনার দায়িত্ব গ্রহণ, এবং সে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় দুটোকে সময়ের উপযোগী ভাবে গড়ে তোলার কাজেও তাঁর আত্মনিয়োগ। মধ্যিখানে আরও এক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। দেশের অন্যতম সারস্বত প্রতিষ্ঠান ‘সাহিত্য অকাদেমি’র বিশেষ প্রকল্প, যাঁর পেছনে ছিল পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরুর দীর্ঘলালিত স্বপ্ন, সেই ‘ভারতীয় সাহিত্যের কোষগ্রন্থ’ (Encyclopaedia of Indian Literature) সমাপ্ত করে একটি বহুপ্রতীক্ষিত জাতীয় কর্তব্য সম্পাদন করে এসেছেন। ১৯৮৪ সালে গৃহীত প্রকল্পটিতে ছিল ২২ টি ভারতীয় ভাষার সাহিত্যস্রষ্টা ও তাদের সাহিত্যকৃতি নিয়ে সাতহাজার পাঁচশোটি অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে প্রাচীন, মধ্যযুগ এবং বর্তমানকালের জাতীয় সাহিত্যের আত্মপ্রকাশ এবং বিবর্তনের রূপরেখা তুলে ধরার প্রয়াস। অধ্যাপক অমরেশ দত্তের সু্যোগ্য নেতৃত্বে ১৯৮৭, ১৯৮৮ এবং ১৯৮৯ সালে এ প্রকল্পের তিনটিখণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এর পরবর্তী আরও তিনটিখণ্ড নিয়ে স্বাধীনতা-উত্তরকালে এত ভাষা, এত সংস্কৃতি, এত বিদ্বজ্জন এবং অসংখ্যকর্মীর সমন্বয়ে মহাকাব্যিক পরিসরে এ মহাগ্রন্থ বিশ্বের দরবারে ভারতবর্ষকে বিশেষভাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
আসামের অন্যতম শিক্ষাবিদ সমাজচিন্তক, গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহকর্মী ড. হীরেন গোঁহাই গতবছর তাঁর প্রতিভার মূল্যায়ন করে বলেছিলেন, অমরেশ দত্তের মধ্যে একজন পণ্ডিত, শিক্ষক এবং ‘কবি’র সমন্বয় ঘটেছিল। ইংরেজি সাহিত্যের উপর তাঁর মৌলিক চিন্তাগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারতীয়ত্বের স্বাক্ষর। কয়েকটি প্রজন্মের ছাত্রতো বটেই, এ সময়ের বিশিষ্ট বিদ্বজ্জনের উপরও অধ্যাপক অমরেশ দত্তের প্রভাব অপরিসীম।
জাতীয় জীবনের বড় দুর্দিনেই এ শিক্ষাগুরু আমাদের থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের আক্ষেপ, বিগত একটি দশক তাঁকে জনসমক্ষে দেখা যায়নি, যদিও নীরবে নিভৃতে তিনি বিদ্যাচর্চা চালিয়ে যেতে থাকেন। নিয়ম করে পাঠ, গবেষণা এবং লেখালিখি তিনি চালিয়ে গেছেন। কিন্তু এত কৃতিত্বের অধিকারি নীরব এ ব্যক্তিটির কোনও খবরই রাখলেন না দেশের পদ্মশ্রী, অকাদেমি, জ্ঞানপীঠ সম্মান প্রদানকারীরা। রাখলে এ হেন ব্যক্তির শতবর্ষ হয়ে উঠতে পারত একটি জাতীয় উৎসব।
❤ Support Us