Advertisement
  • গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
  • ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৩

আম কাহিনী

রক্তিম ইসলাম
আম কাহিনী

অলঙ্করণ: দেব সরকার


প্রশ্ন ?

এখনো লেখালেখির অলিন্দে, বিস্তৃত প্রাঙ্গনেও  কেন জেগে ওঠে  এক ধরনের হতাশাব্যঞ্জক প্রশ্ন? কেন, সাম্প্রদায়িক উদাসীনতা আর সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা, মাঝে মাঝে, স্তম্ভিত করে দেয় আমাদের  সৃজন আর দৃষ্টিকে? কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, নাটকে বৃহতের চিত্ররূপ কি উপেক্ষিত হতে থাকবে? স্থবিরতা আর ক্ষুদ্রতাকে ভেদ করে, নির্বিশেষ সাধনার সুস্পষ্ট বীজতলা গড়ে তোলা কি সত্যি অসম্ভব?

সম্পাদক


 

শীতের বিকেল ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। দেখতে দেখতে আর দু’ঘন্টা কেটে যাবে। পাঁচটায় ভোটদান পর্ব শেষ। যা নিয়ম তাই, যদি লাইনে লোক থাকে তো আরো কিছু সময় চলবে। তবে কতখানি সময় যাবে, তা ভোটদাতার সংখ্যার উপর নির্ভর করবে।

ভোটে এখনো কোনো গন্ডগোল হয়নি, না দু’দলের ছেলেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি থেকে মারপিট… হাঁ খবর ছিল, প্রশাসন জানত, স্টার ভালনারেবেল বুথ। দুই দলই রীতিমত তৈরি। দু’দলের ছেলেদের কাছেই রীতিমত মজুত বোম-পাইপগান, না— ছেড়ে কথা কইবে না কেউ। প্রশাসনের বিশেষ নজর আছে মাঝেরআটি বুথটির ওপর। ঘন-ঘন পাক খাচ্ছে সেক্টর অফিসারের গাড়ি, আর প্রতি ঘন্টায় কর্তব্যরত কোনো এক পুলিশ অফিসার রাস্তায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে চারপাশটা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছেন। না, দু’পার্টির যে ক্যাম্প হয়েছে সঠিক দূরত্বের বাইরে। সকালের দিকটা একটু তাড়াতাড়ি দিতে হয়েছে।  রাস্তার ওপরে স্কুল-বুথ। মাঝেরআটি প্রাইমারি স্কুল। তো কিছু উৎসাহী গাঁয়ের পুরুষ ব্যাটারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে, দু’চারজন ভোটের ক্যাডারও ছিল, তো ব্যাটন নিয়ে পুলিশ তাড়া দিলে সব ফাঁকা। আর ভোটের লাইন দুটো, একটা পুরুষ লাইন, অন্যটি মহিলা, ভোট তখনও নির্বিঘ্নে চলছে।

এ বুথে গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্যান্ডিডেট তিনজন। এটি সংরক্ষিত মহিলা সিট। তাই এ বুথের প্রতিযোগীরাও মহিলা। তবে মূলত লড়াই হচ্ছে দু’জনের মধ্যে। ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল বনাম  ওই দলেরই একজন নির্দল প্রার্থী। তিনি দাঁড়িয়েছেন ‘আম’ চিহ্নে। একই পার্টির দুটো পক্ষ। যে পক্ষ দলীয় মনোনয়ন পায়নি, সে পক্ষ তাদের মনোনীত সুফিয়া বিবিকে নির্দলে দাঁড় করিয়েছে। তাদের প্রতীক আম চিহ্ন, আর পার্টির প্রতীকে মনোনয়ন পেয়েছে মোস্তাকিন মস্তানের বউ রিজিয়া বিবি।

বাপের নাম ধরে ছেলের নাম বললে সনাক্তকরণ সহজ। তো ইদ্রিস ভাইয়ের ছেলে আর আব্দুল সামাদের ছেলে কাউয়ুম, এই দু’জন দলের বিদ্রোহী ক্যাডার। রিজিয়া বিবিকে চায় না, তাদের পছন্দের প্রার্থী সুফিয়া বিবি। আর রিজিয়া বিবি মানে ব-কলমে মোস্তাকিন মস্তান। সে আগে অন্য পার্টিতে ছিল, পার্টি যেই ক্ষমতা হারালো মোস্তাকিনও যোগ দিল নতুন পার্টিতে। চারপাশের দু’দশখান গ্রামের মানুষ মোস্তাকিন না, মোস্তাকিনের সঙ্গে মস্তান যোগ করে ডাকলে সবাই চেনে।

আম পার্টির ক্যাডাররা ভোটের দিন স্বাভাবিক কারণে সন্ত্রস্ত ছিল। তবে প্রস্তুতও ছিল, তারাও তৈরি, গোলোযোগ শুরু হলে তারাও ছেড়ে কথা বলবে না। বুথ থেকে বড় জোর একশো গজ দূরে কাসেম আলির বাড়ি। ধুন্ধুমার শুরু হলে কাসেম আলির ঘর থেকে… তাই মালপত্রও হাতের নাগালের মধ্যে। আম পার্টির বুথ এজেন্ট হয়ে বসেছে রফিকুল। ওকে নির্দেশ দেওয়াই আছে, খুব সতর্ক থাকতে হবে, ফলস্ ভোট কিছুতেই এলাউ করা হবে না। বাধা দিতে হবে। তাছাড়া মিছিমিছি কোনো ভোটার অন্ধ সাজলে, তার ভোটটা অন্য কেউ দিতে এলে অবজেকসান দিতেই হবে। যার ভোট সেই দিক, না দিতে পারলে প্রিসাইডিং অফিসার অন্ধ অথবা বয়স্ক ভোটারদের পক্ষ হয়ে ভোট দিলে দিক, আপত্তি নেই। তবে ওদের পক্ষের কেউ আইন ভাঙলে করতে দেওয়া হবে না।

ঠিক-ঠাকই ভোট দান চলছে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে একটা তর্ক শুরু হল, ভোটকেন্দ্রের মধ্যেই। বিকেল পাঁচটা পার হলে, ভোটদাতার লাইনে যথারীতি স্লিপও বিলি হয়েছে। স্লিপ যাদের হাতে ছিল, সব্বাই ভোটও দিল। হাঁ, এবার তাহলে ভোট শেষ-এ আর কেউ বাকি রইল না। কিন্তু বাকি যে থেকে গেল, সে হলো রফিক, আম পার্টির পোলিং এজেন্ট। যেহেতু সে ভিতরেই ছিল, তাই স্লিপ নেয়নি, আর তার ইচ্ছে ছিল ভোট মিটলে তার ভোটটাই হবে শেষ ভোট।

বেঁকে বসল রিজিয়া বিবির এজেন্ট। সে বলল না, রফিক ভোট দিতে পারবে না। কারণটাও সে স্পষ্ট করল, যেহেতু তার হাতে কোনো ভোটার স্লিপ নেই, তাই আর ভোট দেওয়ার অধিকার রফিকের নেই। শুরু হলো বুথের ভিতরেই তুমুল তর্কাতর্কি। হাতাহাতি শুরু হয়েছে। প্রিসাইডিং অফিসার দ্রুত বুথের প্রবেশ পথের দরজা বন্ধ করলেন। সবচেয়ে বোধহয় বেশি বিপদগ্রস্ত প্রিসাইডিং অফিসার সহ পুরো পোলিং পার্টি। একদম শেষ মুহূর্তে এ কী অবস্থা। পি.ওর ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। পি.ও পড়লেন মহা বিপদে। বুথে যিনি ছিলেন অথচ তাঁর কাছে কোনো স্লিপ নেই, এক্ষেত্রে সম্ভবত ইলেকসনের পুরো আইন বই ছুঁড়লেও এর সমাধান কিছুতেই সম্ভব নয়। বুথের বাইরেও দু’দলের তর্কাতর্কি ধ্বস্তাধ্বস্তি শুরু, কেউ-কেউ পালাতে শুরু করেছে, ভোট শেষ হয়েছে, তাঁরা গল্প-গুজবে ব্যস্ত তারা পোঁ-পোঁ দৌড় লাগালো।

মোস্তাকিন মস্তান তখন অকুস্থলে ছিল না। টেলিফোনে খবর দিল পার্টির কেউ। শুধু মুস্তাকিনদার একটা আদেশ চাই— চালিয়ে দেও। শুধু ওইটুকু। ব্যাস্, এক ব্যাটাকেও মা’র কোলে ফেরৎ দেব না, রক্তগঙ্গা— মাঝেরআটিতে যেটা বাকি ছিল, হয়ে যাক।

খবর পেয়ে চিলের মতো ছুটে এল মোস্তাকিন। ভিড় দু’হাতে ঠেলে, সর্-সর্ সরে যা সব বলে জটলা সরিয়ে দেয়। বলা যায় বুথের দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল সে। সে এভাবে ঢুকতেই নিমেষেই তটস্থ সব হৈ-চৈ বন্ধ হলো। সত্যি বলতে কী ভয়ে সব জড়োসড়ো। এই বুঝি সাংঘাতিক কিছু ঘটে যায় !
অত্যন্ত শান্ত গলায় মোস্তাকিন রফিককে বলে দিল— তুমি ভোটটা দিতে পারলেই তো শান্তি। যাও ভোটটা দিয়ে এসো।
একি করল দাদা! দাদার পোলিং এজেন্ট মইন একটুও খুশি হলো না। সে মোস্তাকিনের সামনে এসে অভিযোগ করে বলল – এ কী করলে দাদা! গ্রাম পঞ্চায়েতে তো এক ভোটেও হারজিত হয়, তাহলে!
আমাকে শেখাতে এসো না মইন। বলে মোস্তাকিন বেরিয়ে এল ভোটকেন্দ্র থেকে।
লাষ্ট রফিকের একটিই ভোট কাষ্ট হওয়ার পর পোলিং পার্টি এক বিন্দুও সময় নষ্ট করল না। দ্রুত তাদের অফিসিয়াল কাজ সম্পন্ন করে গালা-সিল দিতে ভুল করলেন না ভোট-বাক্সে। ওঁরা সব কিছু গুটিয়ে ভোট কেন্দ্র ছাড়লেন। এজেন্টদের যে পূরণ করা ফর্ম দিলেন, তাতে ১১৮ নম্বর বিধানসভা কেন্দ্রের মাঝেরআটি গ্রামের মোট ভোটার ১১৮৮ জন, ভোট দিয়েছেন ১০৮৭ জন। এটা দরকার হবে ভোট গণনার দিন।
হুটপাট করে সবাই বাসে উঠে পড়লো। পোলিং-পার্টির গাড়ি স্টার্ট দেওয়াই ছিল, দ্বিতীয়, তৃতীয় গিয়ার বদল করে বাসটা বেরিয়ে গেল দ্রুত।

কিন্তু সেই ভোট গণনার দিন আগামীকাল।
সারা বাংলায় যেমন একদিনে পঞ্চায়েত ভোট হয়েছে তেমনি সর্বত্র তার দু’দিন পর ভোট গণনার দিন আজ। সুতরাং মাঝেরআটি গ্রামের ভোট গণনা কাল। বুধবার। সকাল সাতটায় গণনাকেন্দ্রে পৌঁছতে হবে। ঠিক আটটা থেকে ভোট গণনা শুরু। মাঝেরআটি গ্রামের ভোট বাক্স জমা আছে, রঘুনাথপুর স্কুলে। সেও মাঝেরআটি গ্রাম থেকে দশ-বার কিলোমিটার দূর।
কিছু জরুরি শলা-পরামর্শর জন্য সন্ধ্যেবেলা আম পার্টির নেতা-ক্যাডাররা সব সুফিয়া বিবির বারান্দায় বসেছিল, সালাউদ্দিন-কাইয়ুম সহ দলবল মিলে ষাট-সত্তর হবে। চা-বিস্কুটেরও ব্যবস্থা ছিল। সবার বুকে একশো ভাগ বল আছে আম জিতবেই, জিতবে— সে এক ভোটে হলেও। রাগ সামলাতে পারেনি সালাউদ্দিন, বলে কে-রে ওটা কেরে, মাত্র এক ভোটে জিত! কিছু না হলেও একশোর বেশি ভোটে জিতব আমরা।
কাইয়ুম সালাউদ্দিনের মাথায় একটা চাঁটি দেয়, বলে— কথায়-কথায় তোর চটো যাওয়া অভ্যেস,
মাথা ঠান্ডা রাখতে পারিস নে ! – আরে এক ভোটে জিত শুনলেই রক্ত গরম হয়ে ওঠে।
– আচ্ছা ঠিক আছে ভাই, তোর কথাই ঠিক, কিছু না হলেও সত্তর-আশি ভোটে জিতব আমরা। 1 সত্তর-আশি না, ওটা একশোর ওপর হবে বলে রাখলুম কাইয়ুম!
ইতিমধ্যে চা-বিস্কুট এসে গেছে, প্রত্যেকের হাতে কাগজের কাপে গরম চা, সঙ্গে দুটো হোক তিনটে হোক যে যা পারে বিস্কুট। কাইয়ুম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে বলে, কাল তো এতক্ষণে সব জানা যাবে, কত ভোটে জিতব কালই হাতে গরম টাটকা বোঝা যাবে।

চা পর্ব শেষ। সমবেত ক্যাডারদের মধ্যে গুঞ্জন চলছিল। এবার কাইয়ুম সব্বাইকে চুপ করতে বলল, জরুরি কথা আছে। আর একটু-একটু নীচু গলা করে চুপ সবাই। কাইয়ুম শুরু করল— আশা আছে আগামীকাল জয় আমাদের হবেই, আমাদের এই জয়টাকে কিছুতেই ওরা সহ্য করতে পারবে না। মোস্তাকিনদা পারে না এমন কোনো কাজ, যা নেই। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া লাগাবে। আর আমরা তো জানি প্রসাশনের কোনো সাপোর্ট আমরা পাব না। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে এমন কোনো কাজ করব না যাতে আইনে দোষী হই। ওরা কিন্তু উল্টো ঝামেলা সৃষ্টি করবে, ওদের পাতা ফাঁদে যেন আমরা পা না দিই। ওরা মারপিট করবে, আর পুলিশ এসে আমাদের ছেলেদের ধরে আটকে দেবে, জেলে ভরবে, আর নন্-বেলএবেল ধারায় কেস দিলে সব শেষ। পুলিশ তো এখন পার্টির দলদাস।


অত্যন্ত চুপি-চুপি ওরা প্লানটা বাতলে রেখেছিল, তবে এ প্লান ভেস্তে গেলে সবাই মারা পড়বে। ঠিক তখন ঘড়িতে রাত দুটো। অন্ধকার রাত, সারা গ্রাম নিশুতি। কাইয়ুম তার বৌদির বোরখা এনে চাচিমার হাতে দিল, চাচিমা বোরখায় পুরো অঙ্গ ঢেকে নিল। কেউ যেন চিনতে না পারে। আর ওনার স্বামী আজিজুলবাবু পরনে লুঙি আর একটা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি পরে মোটর সাইকেলে উঠে পড়লো। যেন গাড়ি চালক একজন যেন পরহেজগারি কেউ, আর পিছনে তার হিজাব পরিহিত বউ


আর না, এই পর্যন্ত ইতি ঘোষণা হল। একে একে সব উঠল। তবে আরো কিছুক্ষণ থাকল সালাউদ্দিন-কাইয়ুম। কাইয়ুম সুফিয়া বিবিকে চাচিমা বলে ডাকে। চাচিমাকে ক’বার অনুরোধ করেছে, আগামীকাল গণনা কেন্দ্রে যেতে, অসুবিধে কী, আপনি তো ক্যান্ডিডেট, আপনি থাকুন, আপনার তো কিছু করা লাগবে না। কাউন্টিং-এ দু’জন এলাউ। শোনেন চাচিমা, আমি আর সালাউদ্দিন তো থাকছিই। কথাগুলো চাচিমাকে বুঝিয়ে বলল কাইয়ুম।
কিছুতেই চাচিমা রাজি হল না। বলল – তোমরা দু’জন থাকলেই যথেষ্ট। তোমরা সেদিন রাতে যা করেছ, সে তো এখনও কেউ জানে না। সেদিনের সে কথা জীবনেও ভুলব না।
চাচিমার কথাটা চুপটি করে শুনলো কাইয়ুম। চাচিমার প্রতি আরো একটু শ্রদ্ধা জন্মালো, না, আর কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লো দু’জন।

সত্যিই তো সেদিন সুফিয়া চাচিমা যদি অমন দুঃসাহস না দেখাতো তাহলে তারা কী এই লড়াইয়ে নামতে পারতো ! নমিনেশান পেপার জমা দেবার আর মাত্র একটি দিন বাকি। বিডিও অফিসেই চিরদিন নমিনেশান জমা দেবার রীতি। রীতি মানে এটাই আইন। কিন্তু এই প্রথম সে আইন বহাল রেখে আরো একটা আদেশ জারি হয়েছে। শেষ দু’দিন এস.ডি.ও. অফিসেও নমিনেশান জমা দেবার আদেশ বার হয়েছে।
কাইয়ুমদের নমিনেশন জমা দেবার বোধহয় শেষ সুযোগ এটি। রাত পার হলেই মাত্র হাতে একটা দিন। তাও শেষ দিন দুপুর দুটো অবধি সময়।

অত্যন্ত চুপি-চুপি ওরা প্লানটা বাতলে রেখেছিল, তবে এ প্লান ভেস্তে গেলে সবাই মারা পড়বে। ঠিক তখন ঘড়িতে রাত দুটো। অন্ধকার রাত, সারা গ্রাম নিশুতি। কাইয়ুম তার বৌদির বোরখা এনে চাচিমার হাতে দিল, চাচিমা বোরখায় পুরো অঙ্গ ঢেকে নিল। কেউ যেন চিনতে না পারে। আর ওনার স্বামী আজিজুলবাবু পরনে লুঙি আর একটা পাঞ্জাবী, মাথায় টুপি পরে মোটর সাইকেলে উঠে পড়লো। যেন গাড়ি চালক একজন যেন পরহেজগারি কেউ, আর পিছনে তার হিজাব পরিহিত বউ। সেই নিশুতি রাতে বাইকটা বেরিয়ে গেল এস.ডি.ও. অফিসের উদ্দেশ্যে। মাঝেরআটি থেকে এস.ডি.ও অফিসের দূরত্ব সতেরো-আঠারো কিলোমিটার।
আর একজন যে লাগবে, সুফিয়ার স্বামী তো হল কিন্তু আর একজন সমর্থক দরকার। সদরে যে কাজ আছে কাসেম আলির। ন’টার ট্রেন ধরল, কাঁধে একটা পুরোনো খালি ঝোলা ব্যাগ। কোথাও যাচ্ছে কেনাকাটায়।
কিন্তু ঠিক সাড়ে দশটার মধ্যে ঢুকে গেল কাসেম এস.ডি.ও অফিসে। অপেক্ষা করছিল এক মোল্লা, লুঙি পরা আর তার বউ মোল্লানি, বোরখায় আপদ-মস্তক ঢাকা !
নীরবে, নমিনেশন পেপার জমা দেবার কাজ সম্পন্ন হল।

সকাল আটটা থেকে গণনার কাজ শুরু হল। যে দলের নির্বাচিত কাউন্টিং এজেন্ট, বেঞ্চে বসে গেছে। ঘরের ভেতরের দিকে কাউন্টিং অফিসার, তারজালি দিয়ে ঘেরা, তারজালির এদিকে বেঞ্চে বসা সব দলের কাউন্টিং এজেন্ট। আমের কাউন্টিং এজেন্ট সালাউদ্দিন-কাইয়ুম। মাঝেরআটি গ্রামের ভোটে দুটো ব্যালট-বক্স ব্যবহার করা হয়েছিল। তো প্রতীক ধরে-ধরে, ব্যালট পেপার সাজানো হচ্ছে। প্রতীক অনুযায়ী পঁচিশটা করে বান্ডিল। তো গ্রাম-পঞ্চায়েতের দুটি বক্স। তো দু’রাউন্ডেই শেষ হয়ে যাবে।

তো পঁচিশটার বান্ডল প্রতীক অনুযায়ী একদিকে, অন্য প্রতীক আর একদিকে। আর এজেন্টদের কাজ সরকারি কর্মচারি যাঁরা গণনায় কর্মরত তাদের কোনো ভুল বা পক্ষপাতিত্ব হচ্ছে কী না তা দেখা। যে ভোটপত্রটি ডিফেকটিভ, তা আবার আলাদা করে রাখা।

প্রথম বক্স শেষ হতেই, শুরু থেকে যে দু’দলের লড়াই, সে লড়াই একইরকমভাবে জারি। বান্ডিলগুলো আলাদা-আলাদা রাখলেও মনে হচ্ছে বান্ডিল সমান সমান। দু’দলের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা। গণনাকারীরা পোলিং এজেন্টদের দেখিয়ে আবার দ্বিতীয় বক্সটা গোণা শুরু করেছে। দু’দলের এজেন্টদের কারো মুখে আনন্দের লেশমাত্র নেই। যেন যে কেউ জিততে পারে। তবে বোঝা যাবে শেষে যখন পঁচিশটার বান্ডিল কোন প্রতীকে কটা কাদের পক্ষে, গণনা শেষ হবে তখন। সালাউদ্দিনের টেনশন ক্রমশ বাড়ছিল, তার মাথায় কিছুতেই আসছিল না, কেন এমন তীব্র কনটেষ্ট। সালাউদ্দিন কাইয়ুমের কানে-কানে বলল, যা শোনা গিয়েছিল তা সত্যি। ভোটের আগের রাতে মোস্তাকিনের দলবল কয়েক লক্ষ টাকা ছড়িয়েছে গ্রামে। আর টাকা নিয়ে তাদের গণনায় ধরা ভোট এধার-ওধার হয়েছে। কাইয়ুম সালাউদ্দিনের কানে-কানো বলল, টাকা খেয়ে আমাদের লোকই বেইমানি করেছে, যাদের বাড়িতে পাঁচটা ভোটার তারা এদিকে দুটো, ওদিকে তিনটে, বা এদিক তিনটে ওদিক দুটো করেছে।

একসময় গণনা শেষ হল। তারপর বান্ডিল গোণাও শেষ হলো। শেষে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বীতায় মোট ভোটার কার পক্ষে কত— গণনা শেষ হলো। হাসি ফুটল কাইয়ু-সালাউদ্দিনের মুখে। মাত্র পনের ভোটে জিত। কাইয়ুম সালাউদ্দিনকে বলল, নাও এক গোলে জিতলেও জিত, আর পাঁচ গোলে জিতলেও জিত।

মুহূর্তেই পাল্টে গেল অঙ্ক-ভূগোল-বিজ্ঞান। কোত্থেকে চিলের মতো ছুটে এসে তাগড়াই মার্কা দুটো অচেনা ছেলে, আমের বান্ডিল থেকে একটা বান্ডিল তুলে নিয়ে খপাখপ অই বান্ডিলে আর একটি করে ছাপ মারতে শুরু করল। যাতে আম-মার্কা ভোট বাতিল হয়। কাউন্টিং অফিসার চিৎকার করে বাধা দিয়ে বলছেন, এ কী করছেন আপনারা, কে আপনারা, আরে-আরে বলে তিনি হাত দিয়ে বাধা দিতে গেলেন। একটা আশি ওজনের চড় সোজা অফিসারের গালে। এক চড়ে চেয়ার থেকে উল্টে পড়লেন নীচে। শব্দ শুনে পাশের ঘর থেকে ছুটে এলেন অফিসের লোকজন। ততক্ষণে পঁচিশটি আম নষ্ট, পচা, ওগুলো ফেলে দিতে হবে। দৃশ্য দেখে ফলাফলের অঙ্ক বুঝতে দেরি হল না কাইয়ুমের। সালাউদ্দিনকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে অফিসের বাইরে বেরিয়ে মাথা সমান পাটগাছের ভেতর দিয়ে পালাচ্ছে ওরা। বলা যায় জীবন হাতে করে ঘরে ফিরল ওরা।

পরদিন সকালের কাগজে একটা খবর প্রকাশিত হল। বীরভূম জেলা পরিষদের ফলাফলের খবর। রিটারনিং অফিসার যাঁকে জয়ী বলে সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন পুলিশ রাতারাতি সেই জয়ী ক্যান্ডিডেটকে তুলে নিয়ে এলেন, তাঁর থেকে নিয়ে নেওয়া হলো সার্টিফিকেট। নাকি কোথাও প্রক্রিয়ায় ভুল হয়েছিল, তাই এমন বিপত্তি।
তবে সে জয়ী ক্যান্ডিডেটের প্রতীক অবশ্যই আম ছিল না যে পচে যাবে— হয় পদ্ম, না হয় হাত, অথবা কাস্তে….

♦♦♦♦  ♦♦♦♦  ♦♦♦♦

 

প্রতিষ্ঠিত লেখক। ঠিকানা বারাসাত।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!