Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • মার্চ ১২, ২০২২

আয় সখি, ঘুরি ঘুরি বইয়ের বাগানে নাচি

এক লহমায় চারপাশ বদলে গেল। ঝলমলে আলো। লোকজন। হৈ-চৈ। কথাবার্তা। মাইকের আওয়াজ আর সারি সারি বইয়ের স্টল।

পিঙ্কি ঘোষ
আয় সখি, ঘুরি ঘুরি বইয়ের বাগানে নাচি

আমি বইপোকা নই । তবে সময় পেলে চোখের সামনে দুই মলাট খুলে ধরি । ধীরে ধীরে বুদ হয়ে যাই। এবার একটু সুযোগ পেয়েই বেরিয়ে পড়লাম ৪৫ তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলার দিকে ।
আমাদের স্যার, বাহারউদ্দিনের নামে দুদিন আগে ইনভিটেশন কার্ড এসেছে, আরম্ভে । এবারের বইমেলায় আমাদের হাউজের বেশ কয়েকটি নতুন বই বের হচ্ছে। এ কদিন আমরা সকলেই ব্যস্ত। স্যার, একটু দেরি করে অফিসে এলেন। কয়েকটা পাণ্ডুলিপি হাতে ওনার কেবিনের দিকে এগোলাম। দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলাম, লেখালেখিতে মগ্ন। দরজার আওয়াজ পেয়ে চোখ তুলে তাকালেন। ইশারায় দাঁড়াতে বললেন। কিছুক্ষণ পর ফাইলটা মেলে ধরলাম। প্রয়োজনীয় কারেকশন করে দিলেন । ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগে বললাম, আজ আপনাকে বইমেলায় পৌঁছতে হবে, বিকেল ৫ টায়।

নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আমি আমার কাজ শেষ করলাম। সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে ভাবছি, স্যারের সঙ্গে যাওয়া মানেই ভারী মজা । এক. দুই বাংলার কবি, লেখক, সাহিত্যিকসহ একাধিক গণ্যমান্যদের সামনাসামনি দেখার সুযোগ। দুই. বিস্তার।

বাইপাসের ওপর দিযে ছুটে গাড়ি ছুটছে । ফুরফুরে হাওয়ায় চুল উড়ছে। স্যারকে বেশ আনমনা দেখাচ্ছে। কখনও জানলা দিয়ে দেখছেন, কখনও ফোনে নিউজ আপডেটে চোখ রাখছেন। মিষ্টি ধুনে রিংটোন বেজে উঠল । স্যার ফোনটা ধরেই বললেন, এই তো এসে গেছি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। একে একে জ্বলে উঠছে আলো। পার্কিং প্লেস থেকে এগিয়ে চলেছি। স্যার আগে, আমি পেছনে। একবার পেছন ফিরে বললেন, গাড়িটা আর একটু এগিয়ে রাখলে ভাল হত। আমরা হাঁটছি। কয়েক পা এগোতেই দেখলাম যাত্রী শূন্য চার-পাঁচটা বাস রাস্তার ওপর খাখা করছে । সামনে ময়ূখ ভবনের হোর্ডিং চোখে পড়ল। এককোণে চোঙা মাইক । সারিবদ্ধ কয়েকটা চেয়ারের সাদা ধবধবে কাপড় দিয়ে সাজান লম্বা টেবিল । জনা পাঁচেক ভলেনটিয়ার বসে আছেন। একজন কাগজ পেন নিয়ে কিছু নোট করছেন । আরেকজন টিকিটের থোকা সাজাচ্ছেন। দেখেই বুঝলাম—বইমেলায় আগত যাত্রীদের সুবিধা দিতে পরিবহণ দপ্তরের ব্যবস্থা । সামান্য দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন অল্পবয়েসি ভলেন্টিয়ার। পরনে খাকি পোশাক। হাতে সান্ধ্য চায়ের কাপ। টানা ডিউটির ফাঁকে একটু গলা ভিজিয়ে নিচ্ছেন। স্যারকে দেখে হাসি ছড়িয়ে জানতে চাইলেন, ভালো আছেন । প্রত্যুত্তরে হাতটা নেড়ে এগিয়ে চললেন উনি। সামনে লম্বা গেট । এক নম্বর, সম্প্রীতির গেট দিয়ে বইমেলার ভেতর ঢুকে পড়লাম । এবছর বইমেলার নটি গেট। দুই, চার, পাঁচ, ছয় নম্বরে বাংলাদেশের, তিন সিইএসসি, সাতে জিআইসি আর আটে এসএনইউ অরবিন্দনাথ গেট।

এক লহমায় চারপাশ বদলে গেল। ঝলমলে আলো। লোকজন। হৈ-চৈ। কথাবার্তা। মাইকের আওয়াজ আর সারি সারি বইয়ের স্টল। ভাবলাম, টেলিভিশনের কার্টুন চ্যানেলে মাঝেমাঝে ছোটোদের আনন্দ দিতে আইসক্রিম, চকোলেটের পৃথিবীর খোঁজ মেলে। আমার মনে হল, তেমনই এক দুনিয়ায় আমি হঠাৎ ঢুকে পড়েছি । আমার চারপাশে কেবল বই আর বই। ক্রেতাদের ভিড় উপচে পড়ছে স্টল থেকে স্টলে। বেচাকেনা, বইপড়া, আবৃত্তি পাঠ, আলোচনা সভা আর গান। সুর দূর থেকে ভেসে আসছে— হৃদয়েরও বাগিচাই নাচি নাচি, ঘুরি ঘুরি,উড়ি উড়ি, উড়ে যায় মন হারানোর …আমারই মন হারিয়ে যাচ্ছে। এখানে কোমর না দুলিয়ে উপায় আছে! হালকা হাওয়ায় ভেসে যাওয়া চুল, হাতের ওপর আলতো স্পর্শ, চোখে প্রিয়জনের প্রতিচ্ছবি। আহা, এই না হলে বইমেলা। দারুন, দারুন । ছোটো-বড় সবাই মেতে উঠেছে হৃদয় মেলায়। বাবা-মায়ের হাত ধরে মুখে মুখবন্ধ, পরনে সুন্দর জামা পায়ে জুতো দিয়ে বইমেলা চত্বরে অনায়াসে ঘুরে বেড়াচ্ছে ক্ষুদেরা। শিশুমেলা। সূষ্টিসুখ স্টলের পাশে এক পুচকের তারস্মরে চিৎকার শুনে পিছন ফিরে তাকালাম । ওমা এ কী! মা-বাবা তো সঙ্গেই আছে, কাঁদছে কেন! ব্যাপারটা বুঝতে এগিয়ে এলাম। দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়ালাম এক কোণে। দেখি ছোটো ছেলেটির হাতে বাটুল দি গ্রেট । হাফুস নয়নে কাঁদছে, তাঁর চোখের কাজল তখন জলে মিশে আলপনা দিচ্ছে। সে বলছে, আমি এখুনি বাটুলের সঙ্গে দেখা করতে চাই। বই আঙ্কেল তাকে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। কিছুতেই তার কান্না থামে না। শেষে খাবারের স্টল দেখিয়ে শান্ত করা গেল তাকে। বইমেলায় ফুড স্টলে কমিকসের জাদুরক নারায়ণ দেবনাথ। কেক, পেস্টির দোকানের বাইরে বাটুলের হাতে ইয়া বড় কেক। ছেলেটির কান্না বন্ধ। আমি খুশি। যে কোনো সন্তানকে খুশি দেখতে আমার ভালো লাগে ।

বইমেলা চত্বরে , বইয়ের বাগানে, বইপ্রেমীদের ভিড়ে বেচা-কেনার গুঞ্জন ।

শিশুমেলা স্টলের দিকে এগিয়ে গেলাম, স্যারও ততক্ষণে এসে পড়েছেন। ডিসনির বইয়ের পাতা উল্টেপাল্টে দেখছি। মনে হচ্ছে সব বইগুলো কিনে ফেলি। পাড়া-প্রতিবেশি সব শিশুর হাতেই তুলে দিই একটা করে বই। এদিকে পকেটে টান। আমার মুখের দিকে স্যার শান্তভাবে তাকালেন। কী বুঝলেন জানি নিা। সঙ্গে সঙ্গে খান পাঁচেক বই কিনে ব্যাগটা হাতে দিয়ে বললেন–এই নিন রবার্ট আর আপনার পরিচিতদের দেবেন। খুশিতে ঝলঝল করে উঠল আমার প্রাঙ্গন, আমার বইমেলা । মনে হল ঝট করে একটা প্রনাম করি স্যারকে ।  পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিলাম ।

লিটল ম্যাগাজিনের প্যাভিলিয়ন ঘেঁষে এগোচ্ছি। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নামাঙ্কিত মুক্তমঞ্চ। মঞ্চ আলোকিত করে বসে আছেন কবি-লেখকসহ বিশিষ্টরা। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। স্যার তাঁর পরিচিত এক সাহিত্যিকের সঙ্গে আলাপ সারছেন। মিনিট পাঁচ পর ফিরে এলেন। বললেন চলুন ।
ইতালি, আমেরিকা ছাড়িয়ে এগোতেই বিশাল বঙ্গবন্ধুর কাটআউট। হ্যাঁ, এটাই বাংলাদেশ পাভেলিয়ন। এখানে মুক্তিযুদ্ধের একাধিক ঐতিহাসিক কাটআউট ছড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের বই চত্বর। সঙ্গে জাগ্রত বঙ্গবন্ধু । আলোক উজ্জ্বল গোটা প্যাভেলিয়ন অপ্রতিরোধ্য ভালবাসায় হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রবেশপথেই বঙ্গবন্ধুর জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের ইতিহাসিক ছবি, এবারের সংগ্রাম…

বাংলাদেশের ডেপুটি হাই কমিশনের আয়োজনে কলকাতা বইমেলায় দুই দিন ‘বাংলাদেশ দিবস’ উদযাপন হল। আজও আয়োজিত আলোচনা সভা হচ্ছে। সভায় উপস্থিত হয়েছেন দুই বাংলার বিশিষ্টরা। বাইরে থেকেই কানে ভেসে আসছে মহিলা কণ্ঠ। স্যার আর আমি ভিতরে প্রবেশ করলাম। বিশাল আয়োজন। অডিটোরিয়ামের মতো বিশাল জায়গা জুড়ে বাংলাদেশের সাজানো বই বাগিচা । কোভিড প্রোটোকল মেনেই তিন চারটে গেট। ভিতরে ঢুকেই চোখ ছুটল মঞ্চে। স্টেজের এককোণে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোনে হাতে একজন মহিলা। তাঁর লম্বা চুল ছড়িয়ে পড়ছে পিঠে । পরণে সাধারণ শাড়ি, ব্লেজার টাইপের লম্বা হাতা লাল ব্লাউজ। হাতে বই । কণ্ঠে তখন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। বাক্ ভঙ্গিমা আর শব্দ চয়নের দৃঢ়তায় আমি মুগ্ধ। আমার চোখের সামনে একাত্তরের গণহত্যা ভেসে উঠছে । হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষের আর্তনাদ উপলব্ধি করতে পারছি । হঠাৎ ছন্দপতন, স্যার সামনে এগিয়ে এসে বললেন, জানেন উনি কে? মাথা নাড়লাম। বললেন, বাংলাদেশের শিক্ষামন্ত্রী। দীপু মণি। অত্যন্ত গুণী মহিলা। সংগ্রাম, সিদ্ধি, মুক্তি নামক বহরে চওড়া বইটির পাতা খুলে দীপু মুণি কবিতা পড়ে শোনাচ্ছেন—
শৈয়দ শামসুল হক-এর লেখা সেই বিখ্যাত লাইন—আমি জন্মেছি বাংলায়/ আমি বাংলায় কথা বলি/আমি বাংলার আলপথ দিয়ে, হাজার বছর চলি…এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান?/ যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান/ তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলার পথ চলি/ চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি। হলে পিনড্রপ সাইলেন্স।আবৃত্তি শেষ হতেই সভায় উপস্থিত সবাই উঠে দাঁড়ালেন। হাততালির শব্দে খান খান হয়ে গেল নীরবতা। ইতিউতি ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট ঝলকে উঠল।

কবি কামাল চৌধুরী এগিয়ে এলেন মাইক্রোফোনের সামনে, সংক্ষেপে দু-চার কথা বললেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তিনটি বইয়ের ওপর আলোচনা করলেন কবি তারিক সুজাত, বিশিষ্ট সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক চিন্ময় গুহ। সেমিনারে সভাপতি বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ও বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন।দূর থেকেই স্যার আমাকে সবার পরিচয় দিচ্ছিলেন। এ এক অন্যরকম অনুভূতি । বইমেলায় আগেও এসেছি, কিন্তু এইভাবে উজ্জ্বল পরিমণ্ডলে আসার উপস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা অভিজ্ঞতা।

ইতিমধ্যে প্রথম দফার অনুষ্ঠান শেষ। মঞ্চ থেকে নেমে এসেছেন গুণীজনেরা। স্যারকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন পবিত্র সরকার। কবি কামাল চৌধুরী, মিনার মনসুর, শ্যামা রহমান, দীপু মনি আমার সামনে । আমার মনে হচ্ছে, বিশাল আকাশ নেমে এসেছে আজ একসঙ্গে এক মঞ্চে । একই সদনে একরাশ উজ্জ্বল নক্ষত্রম ।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ান ছেড়ে বাইরে এলাম। একদল স্কুল পড়ুয়া, পড়নে স্কুল ড্রেস। এরা একটা টক সো করছে। মোবাইলে ও সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ে নানা প্রশ্নোত্তরের পালা চলছে। ডানদিকে মোড় ঘুরতেই একরাশ পাতাবাহারি গাছ, আর বেশ কিছু ফুল হাওয়ায় মাথা দোলাচ্ছে। চারদিক থেকে সুগন্ধি ভাসছে বাতাসে। মাঝে মাঝেই পুলিস কর্মীরা টহল দিচ্ছেন। বেশ কিছু মহিলা পুলিস কর্মীকেও চোখে পড়ল । একটার পর একটা স্টলে ঢু মারছি। বই আর বই। যেদিকে তাকাই সমুদ্রের রাশি রাশি ঢেউয়ের মতো বই । পত্রভারতী, আনন্দ পাবলিশার্স, মননশীল পাঠকের প্রকাশনা ও পত্রিকা, আজকাল, ৩৬৫ দিন প্রকাশন আরও কত স্টল চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে। আমি বই দেখছি আর খুঁজছি আমাদের প্রকাশনা হাউজের রাখা বইয়ের স্টলগুটি। এবার আমরা স্টল দিইনি। ৩৯১ ধ্যানবিন্দু, ২৮৪ নম্বর আমাদের বই সাজিয়ে রেখেছে ।

স্যার তখন বন্ধুবেষ্ঠিত। গল্পে মশগুল। আমি আসছি বলে বেরিয়ে পড়লাম। হাঁটছি, চারপাশটা ঘুরে দেখছি। খুঁজছি ধ্যানবিন্দু স্টলটা। ইতিমধ্যে থমকে দাঁড়ালাম। ক্যানভাসে পেনসিলের স্ট্রোকে ফুটে উঠছে জীবন্ত নারী। আহা।থমকে দাঁড়ালাম। সামনে বসে আছেন মডেল। বছর কুড়ির এক যুবতী। পাশেই কাগজের পোস্টারে ভাসছে ‘এখানে মুখের অববয় আঁকা হয়।’ হাতে সময় কম ইচ্ছা থাকলেও আর দাঁড়াতে পারলাম না। খুঁজতে খুঁজতে পৌঁছে গেলাম ধ্যানবিন্দুতে। গোছানো, সুন্দর । ছোটো স্টল হলেও ক্রেতাদের আসা-যাওয়া লেগে আছে । আমি আমাদের প্রকাশনার বইগুলোর উপর চোখ বুলিয়ে নিলাম। সব ঠিক আছে । বাইরে স্টলে লাগোয়া চেয়ারে বসে পড়লাম। মিনিট পাঁচেক পরেই একযুগল এলেন বই কিনতে। একটার পর একটা বই নেড়ে চেড়ে দেখছে । সুচিত্রা ভট্টাচার্যের ‘শুধু প্রেম’ বইটি কিনে বিল মিটিয়ে দোকান ছাড়ল ওরা। বাইরে বেরিয়েই ছেলেটি হঠাৎ হাঁটু মুড়ে বসল, মেয়েটির সামনে বইটি মেলে ধরে বলল, ‘শুধু প্রেম’ নিবেদন করলাম। গ্রহণ করে ধন্য করো । মেয়েটি লাজুক হাসি ছড়িয়ে দিয়ে বলল, কী হচ্ছে, সবাই দেখছে তো, ছেলেটি বলল, কুছ পরবা নেহি । ওদের রকম দেখে আমারও ঠোঁটের কোনে ভেসে উঠল তরঙ্গ ।

মেলার শেষপ্রান্তে এসে পড়েছি । বাইরের দিকে এক গাছের তলায় দুই কন্যে বসে আছে বহু ছবি নিয়ে। ছবিগুলো বেশ সুন্দর। কয়েকটি অ্যাক্রেলিকে, কোনটা আবার পেনসিল স্কেচ কোনটায় চারকোল, আবার কিছু পোস্টার মোমরঙে সজ্জিত। একজন খাকি পোশাক পড়া যুবকও এগিয়ে এলেন ছবি দেখতে। এক কোনাচি করে রাখা দুর্গার একটা রুদ্রমূর্তির ছবি, যার ত্রিনয়ন থেকে সিঁদুর গোলা আগুন বেরচ্ছে, তার তেজে ঝলকে যাচ্ছে দুষ্টুরা। হাতে তুলে নিলাম। জানতে চাইলাম এ ছবির প্রেরণার কথা । মিহিকা নামক মেয়েটি বললে, দিদি চারপাশে মেয়েরা আজ দুর্বল নয়। তাঁদের শুধু লাস্যময়ী রূপ নয়, আমি ক্যানভাসে মেয়েদের অন্তর শক্তিকে জাগাতে চেয়েছি । এ ছবি সেই চিন্তাভাবনারই ফসল। পাশের মেয়েটি বলল, আমি অনন্যা। কলকাতা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। প্রতিদিন বারুইপুর থেকে যাতায়াত করি। লেখাপড়া, ছবি আঁকা, গান এমনকি স্টেশনে বাবার চায়ের দোকানেও বসি। আমি বললাম এত কাজ কখন করো? দুজনেই হাসিমুখে জবাব দেয়, মেয়েরা সব পারে দিদি। পাশের খাকি পোশাকের ভদ্রলোকও মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ মেয়েরা আজ ঘরে-বাইরে সমান তালে দৌঁড়চ্ছে। দুই বন্ধুকে টাটা করে ফিরে এলান জাগো বাংলার স্টেজের কাছে । মুঠোফোন বেজে উঠল। হ্যালো, ওপার থেকে স্যারের গলা ভেসে এল, আপনি কোথায়? তাড়াতাড়ি আসুন। আসছি বলে লাইনটা কেটে দিলাম । দ্রুত পাযে এগিয়ে এসে দেখি। ফুড স্টলে স্যারের পরিচিত দুই বন্ধু ফ্রিস ফ্রাইয়ে কামড় দিতে দিতে গত দুই বছরের অভিজ্ঞতার সানাই বাজাচ্ছেন। আমায় দেখেই স্যার খাবার অফার করলেন। বললাম খিদে নেই। জল খাব। স্যার বললেন কোল্ড ড্রিঙ্কস খান। ঠাণ্ডা খাওয়ার ইচ্ছা হল কিন্তু গলাটা কেমন খুশখুশ করছে । শরীরের কথা ভেবে খেলাম না।

রাত বাড়ছে। এবার ফেরার পালা। বাড়ির পথে পা বাড়াব, এমন সময় আরও একবার বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নে যেতে হবে বলে স্যার এগোলেন । আমি পিছু নিলাম। ভিতরে তখন গান গাইছেন বাংলাদেশের খ্যাতানামা শিল্পী শ্যামা রহমান—ও আমার দেশের মাটি তোমার পায়ে ঠেঁকাই মাথা… ভারি মিষ্টি গলা। সেই গানের কলি গাইতে গাইতে ফিরছি। রাস্তায় বিস্তর জ্যাম। গাড়ি এগোচ্ছে না। গরম লাগছে। উসখুস করছি। মনে এখনও বই মেলার সুর আর স্পর্শ, না চাহিতে যারে পাওয়া যায়। পেলাম কি, পেলেও না পাওয়ার আনন্দে ডুবে যাই, ভেসে যাই ।


❤ Support Us
error: Content is protected !!