- খাস-কলম
- ফেব্রুয়ারি ১, ২০২৪
দাবি উঠুক অসম চরপরিষদের মঞ্চে, ফিরিয়ে দাও বহুভাষিকের ইমারত
অসম চর পরিষদ, দীর্ঘ দিন জুড়ে, ব্রক্ষ্মপুত্র ও তার শাখা প্রশাখার তীরবর্তী অঞ্চলের বিশাল জনপদের আর্থ সামাজিক সমস্যা নিয়ে লাগাতার লড়াই করেছে । এ এমন এক জনভিত্তিক গণসংগঠন, যার ছত্রছায়ায় সমবেত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন উজান অসম, মধ্য অসমের দেড় থেকে দু কোটি বাসিন্দা, যাঁদের নাগরিকত্ব, আত্মপরিচিতি আর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের অভিমুখ স্বাধীনতাত্তোর অসমে বারবার গুরুতর সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছে, ইদানীং এনআরসি তার নাগরিকত্বের বৈষম্যমূলক দৃষ্টিপাতে এ সঙ্কট তীব্রতর আকার ধারণ করেছে । এরকম পরিপ্রেক্ষিতকে সামনে রেখে, দুই আর তিন ফেব্রুয়ারি, ২০২৪, চতুর্থ মুক্ত অধিবেশনের আয়োজন করেছে গোয়ালপাড়া জেলার চুনারী মহাবিদ্যালয় প্রাঙ্গনে, প্রয়াত কংগ্রেস নেতা ব্যারিস্টার এম এফ গোলাম ওসমানি সমন্বয় মঞ্চে ।
রাষ্ট্র যখন কল্যানবোধ হারিয়ে ফেলে, তার জননির্বাচিত কিংবা মনোনীত প্রতিনিধিরা স্বৈরতন্ত্রের পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ অংশীদার হয়ে ওঠার লজ্জা হারিয়ে ফেলেন, তখন ধেয়ে আসে দেশের সমূহ অমঙ্গল, ধাওয়া করে দুর্বোধ্য হাওয়া, যা ঝড়ের পূর্বাভাস এবং মানব প্রকৃতিকে প্রতিবন্ধী করে তুলবার নগ্ন প্রচেষ্টা । এরকম সঙ্কটে ব্যক্তিপ্রতিভা অথবা বিশুদ্ধ সামাজিক সংগঠন দুর্বোধ্য রহস্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ আর প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলে, সদর্থক, নিরস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়
ওসমানি ছিলেন শাণিত বুদ্ধির উচ্চশিক্ষিত মণীষা, জন্ম শিলচরে । লেখাপড়া স্বশহরে । পরে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে । বিদেশ থেকে ফিরে শিলচরে আইন প্র্যাকটিস আর সামাজিক আন্দোলনের হাতখড়ি হয়েছিল তাঁর । পরে জয়প্রকাশ নারয়ণের গণ আন্দোলনে যোগ দিয়ে আইন প্র্যাকটিস থেকে অনেকটাই সরে গেলেন, প্রবেশ করলেন সরাসরি রাজনীতিতে, ভোটে দাঁড়িয়ে জিতলেন, মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব দেওয়া হল তাঁকে গোলাপ বরবরা মন্ত্রীসভায় । জনতা দলের অবসান ঘটে কেন্দ্রে ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যাবর্তনে, অসমেও ফিরল কংগ্রেস, ইতিমধ্যে ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে হঠাৎ, আসুর নেতৃত্বে ছড়িয়ে পড়ল বিদেশি খেদাও আন্দোলন । ওসমানি আর আইনজীবী কালি দাশগুপ্ত ভাষিক ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষায় সরব হয়ে উঠলেন, গড়ে তুললেন ইউ এম এফ (ইউনাইটেড মাইনোরিটি ফ্রন্ট), তাদের নেতৃত্বকে প্রায় প্রশ্নহীন মাণ্যতা দেয় বহুভাষিক অসমের গ্রামীণ কৃষিজীবী আর মধ্যশ্রেণীর শহুরে সংখ্যালঘুরা, গুপ্ত ঘাতকের গুলিত গুয়াহাটিতে প্রাণ হারালেন কালীদাশ, নেতৃত্বের হাল ধরলেন একাই ওসমানি, তাঁকে সমর্থন জোগায় উদীয়মান তারুণ্য, অসমচুক্তির পর অন্তবর্তী ভোটে নতুন পার্টি হলেও ২০টির কাছাকাছি আসন দখল করে অসম রাজনীতির আলোচিত ফ্যাক্টর হয়ে উঠল ইউএসএফ । সমাজমুখী রাজনীতির সংগঠনটি পরে অকেজো হয়ে যায়, কিছু সংখ্যক উচ্চাকাঙ্খীর জন্য, ওসমানিও হাল ছেড়ে দিলেন, রাজনীতি ছাড়লেন না, সামাজিক চাপে লোকসভা ভোটে দাঁড়ালেন কংগ্রেসের টিকিটে, নির্বাচিত হলেন বরপেটা থেকে, জয়ী হলেন বিপুল ভোটে । দুবারের সাংসদ ওসমানির মৃত্যুতে যে শূণ্যতা দেখা দেয়, তা পূর্ণ করার দায়িত্ব নিতে হল প্রবাদপ্রতিম সম্পাদক ও অসমিয়া লেখক হোমেন বরগোহাঞির অভিনব যোগ্য আবিষ্কার আবদুল খালেককে । হোমেনের সঙ্গে কাজ করেছেন একই সংবাদপত্রে শক্তিমান সাংবাদিক খালেক । সমাজনিষ্ঠ আর বহুত্ববাদে বিশ্বাসী ‘নওজওয়ান’ । ওসমানির মতো তিনিও সমাজের অভিপ্রেত নেতা । এখন লোকসভার কংগ্রেস সদস্য । আব্দুল খালেক অসম চরপরিষদেরও অন্যতম কারিগর এবং কৃষিজীবী পরিবারের সন্তান সন্ততিদের আর বেশি গ্রন্থমুখী করে তোলবার আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত । এক্ষেত্রে ভূমিকা তাঁর অনেকটাই ম্যাগসেসাই জয়ী, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো গ্রামমুখী, জনমুখী । এতটাই সক্রিয় তাঁর নেতৃত্ব যে, বরপেটা সংলগ্ন প্রান্তিক শহরে, গত কয়েকবছর ধরে, এক সপ্তাহ জুড়ে বইমেলা হয়েছে, মেলার বৈশিষ্ট্য আলাদা । তার গতিমুখের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে সামাজিক পছন্দ এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র । বহুভাষিকতা, নৃপরিচিতি আর তারুণ্য একাকার হয়ে যায় বইমেলায়, খালেকের আকর্ষণে আর আমন্ত্রণে যোগ দেন অসমের, অন্যান রাজ্যের, বিদেশেরও বহু সাংবাদিক ও লেখকরা । বছর তিনেক আগে, কলকাতায় হঠাৎ এই যৎসামান্য লেখকের সঙ্গে খালেকের কলকাতায় দেখা হল । কিছুক্ষণ আলাপের পর মনে পড়ল, দুদশক আগে, খালেকের সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিয়ে তাঁকে নিয়ে যে প্রত্যাশা শুনিয়েছিলেন হোমেন দা, তা নির্ভুল, সংশয়াতীত বাস্তব হয়ে উঠছে, খালেকের জনমুখী রাজনীতিতে, তাঁর ফলিত বিশ্বাসে এবং অবশ্যই তাঁর ইহজাগতিকতার শর্তপালনে । অসম চরপরিষদের চতুর্থ প্রকাশ্য অধিবেশনে খালেক সম্ভবত উপস্থিত থাকবেন, বলবেন । এটা বড়ো বিষয় নয়, বিস্ময় তো বটে, সাংসদীয় ব্যস্ততা অতিক্রম করে যেভাবে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে বিশদ অনুষ্ঠানসূচি সাজিয়েছেন, তাতে তাঁর মুক্ত চিন্তা, তাঁর সবগ্রাহ্যতা সুপ্রতিষ্ঠিত । অক্ষরে অক্ষরে স্থাপিত হয়েছে চরপরিষদের আগাম গন্তব্য ।
রাষ্ট্র যখন কল্যানবোধ হারিয়ে ফেলে, যখন তার জননির্বাচিত কিংবা মনোনীত প্রতিনিধিরা স্বৈরতন্ত্রের পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ অংশীদার হয়ে ওঠার লজ্জা হারিয়ে ফেলেন, তখন ধেয়ে আসে দেশের সমূহ অমঙ্গল, ধাওয়া করে দুর্বোধ্য হাওয়া, যা ঝড়ের পূর্বাভাস এবং মানব প্রকৃতিকে প্রতিবন্ধী করে তুলবার নগ্ন প্রচেষ্টা । এরকম সঙ্কটে ব্যক্তিপ্রতিভা অথবা বিশুদ্ধ সামাজিক সংগঠন দুর্বোধ্য রহস্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিরোধ আর প্রতিস্পর্ধা গড়ে তোলে, সদর্থক, নিরস্ত্র বিদ্রোহ ঘোষণা করতে বাধ্য হয় । সমাজতত্ত্বের জনক আর ১৪ শতকের আরব মণীষা— ইবনে খালদুনের এরকমই এক ঐতিহাসিক ইঙ্গিতের প্রত্যাবর্তন অনিবার্য হয়ে উঠেছে নানা দেশে । ব্যতিক্রম নয় ভারতও ।
আমাদের অনুমান, যোগ্য নেতৃত্বের আবহ আর স্পর্শে, বহুভাষা, বহু সংস্কৃতির অসম ও পূর্বাঞ্চলের অন্য ৬ রাজ্যকে নবীন সাহস জোগাবে, ভরসা দেবে অসম চর পরিষদ । প্রকাশ্যে ঘোষণা করবে, আমাদের বলতে দাও । ফিরিয়ে দাও অধিকারবোধের ইজ্জত ।
আজ সর্বত্র বহু ভাষিকতা, বহু সংস্কৃতিকতা আর নরগোষ্ঠীর বহুমাত্রিক অবস্থানকে বিপন্ন, বিপন্নতর করে তুলতে করে তুলতে চাইছে রাষ্ট্র । তাকে অহর্নিশ উৎসাহ জোগাচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক আধিপত্যবোধ । অসমও তার সহজ শিকার । তাদের বিরুদ্ধে লড়তে হলে জরুরি যে ঐক্য, যে সহিষ্ণুতা, তার ভিত্ আর পুরনো ইমারতের চুন-সুরকি খসে পড়েছে; প্রতিকুল হাওয়া বইছে চারদিকে । ঘুণপোকারা দানবীয় মূর্তি ধারণ করছে । এরকম বিপজ্জনক মুহূর্তে আমরা ‘বাংলার নবজাগরণ’ কিংবা গ্রামীণ কৃষকের প্রতিনিধি অসম চরপরিষদ এর তর্জনীর স্পষ্ট, লক্ষ্যযুক্ত উচ্চারণ দাবি করছি । সঙ্কট শুধু অসম কিংবা বাংলার নয়, মহা ভারতের, মহা জনতার বিপদ বাড়ছে ক্রমশ, বাড়িয়ে তুলছে রাষ্ট্রনামক ক্ষমতামত্ততার যন্ত্র । তাকে রুখতে হলে দেশপ্রেম, জীবপ্রেম, প্রকৃতি প্রেমের নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ দরকার, দরকার মহামানবিক সাধনা ও একতার । সমবেত কন্ঠে বলা উচিত… আগুন আমার ভাই । আমি তোমারই জয় গাই…
❤ Support Us