- খাস-কলম
- জুলাই ১৯, ২০২১
অসমের বন্ধ কাগজকলে সর্বজয়ার আর্তনাদ

এটা অনেকটা সুকুমার রায়ের ‘খুড়োর কলে’র মতোই ঘটনা। কল চালু হবে, কল চালু হবে— এই প্রতিশ্রুতির পেছনে ছুটে আসামবাসী দুটো নির্বাচনের অন্তর্বর্তী সময় বেশ কাটিয়ে দিলেন। কল আর চালু হচ্ছে না। আর নিলামে বিক্রি হয়ে গেলেও হতভাগ্য কর্মীদের ন্যায্য বকেয়া পাওনার কোনও কথা নেই। অনশন, অপুষ্টি, চিকিৎসার অভাবে কাছাড় আর নগাঁওর কর্মীদের মধ্যে পঁচাশি জনের অকালমৃত্যু এ রাজ্যে অনেকের চোখে জল ঝরালেও যাঁদের একফোঁটা জলের জন্য অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারত, সে নেতা মন্ত্রীদের চোখ অদ্যাবধি শুষ্ক। এরা এত আস্ফালন করেন, এত প্রতিশ্রুতি দেন, নির্বাচনের আগে মানুষের সেবা করার এত আকুতি প্রদর্শন করেন, কিন্তু যেই না জনসেবার অঙ্গীকার ইত্যাদির কথা বলে ঈশ্বরের নামে শপথ গ্রহণ করে গলায় উত্তরীয়টি তুলে নেন, এরা হয়ে যান ভিন্ন জগতের মানুষ। তখন এরা না দেখেন দেওয়াল লিপি, না পড়েন খবরকাগজ, না শোনেন আর্তের কান্না। আমরা সাধারণমানুষের শত সহস্র আর্তনাদের বিরুদ্ধে আছে ওদের ‘এক পরমাশ্চর্য না-শোনা’।
ক’দিন আগে নগাঁও কাগজকলের উপর একটা তথ্যচিত্র দেখানো হয়েছিল গৌহাটির এক চ্যানেলে। কর্মী আবাসনের এক পরিত্যক্ত এলাকায় গজিয়ে ওঠা বনের ঝোপে এক গৃহবধুকে দেখা গেল, কী যেন খুঁজছেন। দুশ্চিন্তাগ্রস্থ, অপুষ্ঠিতে আক্রান্ত এ মহিলা যে কয়েকবছর আগেও এক সুখী পরিবারের কর্তৃত্বে ছিলেন তা বেশ বোঝা যায়, আজ হয়ত অভাবক্লিষ্ট পরিবারের সন্তাসন্ততির পাতে একমুঠো শাক তুলে দেবার জন্য সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে শাককুড়ুনিয়া হয়েছেন। চোখের সামনে ভেসে উঠল সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’র দৃশ্য— বর্ষণক্লান্ত দুপুরে এক আটি মানকচু কুড়িয়ে (আসলে চুরি করেই) সর্বজয়া পাশের বাড়ির সবজিবাগানে লাউটা দেখেই মাটিতে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঢেকে নিলেন। ছেলে মেয়েদের বাঁচাতে হবে তো। ওই গৃহবধু আর সর্বজয়ার এখানে একসূত্রে বাঁধা পড়ে গেলেন। সেদিন টিভিতে এ দৃশ্য দেখে যাঁদের চোখে যদি জল আসেনি, এরা অতি নিশ্চিত আমাদের জনপ্রতিনিধি হবার যোগ্য।
INSERT PIC
গত ডিসেম্বর গিয়েছিলাম পাঁচগ্রামে। পরিত্যক্ত, ভঙ্গুর, বিবর্ণ টাউনশিপে ঢুকে এবং বেরিয়ে আসা অবধি একটা মুখও দেখিনি যেখানে দীর্ঘ বিষাদের ছায়া নেই। এদের দুর্দশা চোখে দেখার নয়। একসময়ের এত যত্ন করে পরিকল্পিত কোয়ার্টাসগুলো রক্ষাণাবেক্ষণের অভাবে ভেঙে পড়ছে। নিজেদের সুরক্ষার জন্য কোনক্রমে ভেঙে পড়া খিড়কি দরজাগুলো নিজেরাই মেরমত করছেন। যাঁরা নিরূপায় তাদের তো এ অবস্থায়ই থাকতে হবে। ব্যবহারের অযোগ্য আবাসনগুলো ছেড়ে নিজেদের সুরক্ষার কথা ভেবে ওরা একটি বিশেষ টিলায় এসে গেছেন, যখন কেউ এদের নিরাপত্তার কথা ভাবছে না অখন বিপদ আপদ মোকাবিলা করার জন্য এরা কাছাকাছি চলে আসছেন। নিজেরাই ঘন্টাখানেকের জন্য কলে জল সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা করেন; হয়তো চাঁদা করে ডিজেল কিনে আনেন। এখনও সন্ধ্যার পর ঘরে যে দু’একটা বিদ্যুতের বাতি জ্বলছে সেটাও আর বেশি দিন নয়। সন্ধ্যা হলে চারিদিকে অন্ধকার, চোরের আতঙ্ক, এমনকি ডাকাতির ভয়ও এদের গ্রাস করে। পাঁচগ্রাম টাউনশিপে যে যখন ঢুকতে পারে বেরোতে পারে, কোন পাহারার ব্যবস্থা নেই। মেশিন ঘরে ঢাই করে আছে কোটি টাকার তৈরি-কাগজ (এখনও নষ্ট হয়নি), জং ধরা লোহার মেশিনের গা বেয়ে উঠেছে বুনো লতা, কী জানি নতুন কেনা একটা রেলওয়ে ইঞ্জিনের কী অবস্থা, কী অবস্থায় আছে সেই অন্তর্জাতিক মানের গেস্ট হাউস যেখানে দেশ বিদেশের কত বিরাট বিরাট চাঁইদের পদধুলি পড়ত। পাঁচগ্রাম সংলগ্ন একটি স্কুলটি ছিল বাচ্চাদের জন্য, এটিও বন্ধ। যাঁরা বাইরের স্কুল-কলেজে যেত এদের জন্য করোনা একটা আশীর্বাদ হিসেবেই এসেছে। এদের কোথাও যেতে হচ্ছে না। যথাসময়ে স্কুল ফি না দিলে অবশ্য নাম কাটা যাবে।
এক সময়ে যে টিলাগুলো ঝলমলে ছেলেমেয়েদের কলতানে মুখরিত থাকত, প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা যে শিশুপার্কে কচিকাচাদের আনন্দের মেলা জমত, সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে যে-ঘরগুলো থেকে ছেলেমেয়েদের উচ্চকণ্ঠে পড়ার শব্দ ভেসে আসত, যে সুখী গৃহকোণ থেকে ভেসে আসত গানের সুর, যে-টিলার সিঁড়ি বেয়ে গৃহবধুরা নিচে বাজার করতে আসতেন দলবদ্ধ হয়ে, যে-পাহাড়ি নিসর্গে ক্যামেরা হাতে ঘুরে বেড়াতেন উদীয়মান চিত্রশিল্পী, যেখানে যুবক এবং প্রৌঢ়ের দল অবসর সময়ে মেতে উঠতেন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে, যেখানে সময়ে সময়ে দেখা যেত পথের জটলা, উঠত সাম্যতন্ত্রের আওয়াজ, দুর্নীতিবাজদের মুণ্ডপাত, যেখানে সকাল হতে না হতেই রান্নাঘরে প্রেসার কুকার চিৎকার করে জানান দিত আমরা সবাই ব্যস্ত, আমরা কাজে বেরিয়ে পড়ছি, সেই পরিত্যক্ত টাউনশিপে ভর দুপুরবেলা দুরন্ত বাঁদরের দল রাস্তা আটকে বসে থাকে, বর্ষায় সন্ধ্যার পর আতঙ্ক, ওই বুঝি বিষধর সাপ ঘরে ঢুকল, প্রহরে প্রহরে শেয়ালের চিৎকার পরিবেশকে করে তোলে আরও বিভীষিকাময়, মাথার উপর যে একটুকরা আচ্ছাদন তা-ও ভেঙে পড়ে যখন তখন। এর চাইতেও বড় আশঙ্কা, হঠাৎই বিদ্যুৎ সংযোগ ছিন্ন করে দেওয়া হবে, কারখানা নিলামে বিক্রি হয়ে গেলে বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করতে আসবে পুলিশবাহিনী, এরা হয়ে যাবে বরাকের রাস্তাঘাটে বিচরণশীল ‘সন্দেহজনক নাগরিক’।
প্রশ্ন হল, আমরা কি এটাই চাই? বরাকবাসী কি এত কিছুর পরও নির্লিপ্ত হয়ে থাকবে? নগাঁওবাসীও কি তাঁদের মা-বোনদের এমনি পরিত্যক্ত বনে জঙ্গলে বুনো শাকের সন্ধানে ঘুরতে দেখে চুপ করে বসে থাকবে? আমরা যে কী এক নেশার ঘোরে আছি কে জানে? বিপন্ন এ সময়ের কোনও প্রতিক্রিয়াই নেই আমাদের আচার আচরণে। লক্ষ লক্ষ মানুষের দুবেলা অন্ন সংস্থানের ক্ষেত্রটি স্রেফ উদাসীনতায় বিনষ্ট হয়ে যেতে দেখছি।
বরাকের পনেরোজন বিধায়ক এই একটি ইস্যুতে কি একযোগে স্বোচ্চার হতে পারবেন না? আমরা আর কিছুই চাই না, শুধু কাগজকলটি আবার চালু হোক্, সামান্য কয়েক হাজার কোটি না হয় আরও নষ্ট হবে, (সরকারি টাকা তো অহরহ নষ্টই হচ্ছে বিভিন্ন খাতে)। এটুকু ঝুকি নিলে আর যাই হোক্ কেউ নিন্দা করবে না, একটি ভোটও কম পড়বে না। থাকুক না নিজস্ব দলীয় অ্যাজেন্ডা তার স্বস্থানেই, এই একটি ইস্যুতে একবার বিধানসভায় হাতে হাত মিলিয়ে কি দাঁড়াতে পারবেন না আমাদের প্রতিনিধিরা? দলীয় উর্ধ্বতন নেতৃত্বকে জবাব দেবার মতো যুক্তি তো আছে, একটা শিল্পের পুনরুজ্জীবন কোন ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডাও নয়। প্রচণ্ড বদরাগী বাবার মতের বিরুদ্ধেও তো ছেলেমেয়েরা প্রয়োজনে একযোগে অনুযোগ ওঠায়।
এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে বরাক উপত্যকা এবং নগাঁও জেলা হাতে হাত মিলিয়ে মৈত্রীর সম্পর্কও গড়ে তুলতে পারে নিজেদের মধ্যে। সুখের দিন ফিরে এলে না হয় পুনরায় ঝগড়ার ঝাঁপিটি খোলা যাবে। আপাতত দুটো কাগজকলের কর্মীদের চরম বিপন্নতার মুহূর্তে কাছাড় এবং নগাঁও আর সন্নিহিত অঞ্চলের বিধায়ক এবং সাংসদকে নিয়ে একটা যৌথ কর্মসূচি গ্রহণ করা যায় কি না বিবেচনা করুন।আমি হলফ করে বলতে পারি যদি এ দুটো কাগজকল পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে একটা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ ওঠানো যায় বিধানসভা কক্ষে, নিশ্চিত সারা আসামের সংবেদনশীল জনগণ এর পেছনে দাঁড়াবেন। আর কে জানে এ থেকে নতুন নেতৃত্বও উঠে আসতে পারে যাঁরা এর রাজ্যে সংসদীয় রাজনীতিতে মোড় ঘুরিয়েও দিতে পারেন।
আর এত কিছু করেও যদি ব্যর্থ হন, তবে বলে রাখি দলীয় বিধাতাদের বিরাগভাজন হলেও আপনাদের পাঁচবছরের আসন কেউ টলাতে পারবে না। সারাজীবন পেনসন তো থাকলই।আর সৎকর্ম করলে কাগজকলের কর্মীদের আশীর্বাদে পরবর্তী নির্বাচনে আপনাদের আসন শুধু যথাস্থানেই থাকবে তাই নয়, নিজস্ব দলেও আপনাদের প্রতিপত্তি বাড়বে বই কমবে না। কথাটা পছন্দ হলে তো সারা রাজ্যই বুঝতে পারবে, আর যদি অপছন্দ হয়, তবে এই কলামেই আমাকে না হয় দুটো কথা শুনিয়ে দিন। কিন্তু দোহাই আমাদের সম্মানিত প্রতিনিধিরা! আপনারা কাগজকল ইস্যুতে আর চুপ করে থাকবেন না। পঁচাশি জন শহিদের মৃত্যুতেই যেন আমাদের কাগজকল দুটোর অভিশপ্ত অন্ধকার অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটে।