- দে । শ ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
- মে ২৭, ২০২৫
স্মৃতির আলোর বিশ্বজোড়া বিচ্ছুরণ

‘জন্মেছি নারীরূপে, প্রভু, একবার তুমি নারী হয়ে এসো !’ — এ আহ্বান শুধু ব্যক্তিগত আকুলতা নয়, সাংস্কৃতিক বিপর্যয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিবাদ, ঘুরে দাঁড়ানোর কথন, এক অস্তিত্ববাদী শূন্যতার প্রতিধ্বনি। লিঙ্গ, ভাষা আর সমাজ-রাজনীতির জটিল ভূবনে নারী মন-মননের সমূহ বিস্তার। বানু মুশতাকের ‘হার্ট ল্যাম্প’, কন্নড় ভাষায় রচিত ১২টি ছোটগল্পের এক সংকলন, দীপা ভাস্থির প্রাঞ্জল আর তুখোড় ইংরেজি অনুবাদে এক নতুন পাঠ-ভূগোল সৃষ্টি করেছে। আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারে এই প্রথম কন্নড় ভাষার বই এবং প্রথম ছোটগল্প সংকলন হিসেবে পুরস্কার প্রাপ্তি, শুধুমাত্র এক সাহিত্যিকের বিজয় রথ কিংবা কন্নড় ভাষার সাহিত্যে নতুন মিনার নয়, বরং ভাষা, লিঙ্গ এবং ক্ষমতার আন্তঃসংলাপের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা।
বাংলা, কন্নড়, তামিল, তেলেগু,ওড়িয়া, উর্দু, সাঁওতালি—এই সব ভাষার মধ্যে কি কখনো সত্যিকার সংলাপ গড়ে উঠেছে ? ভারতীয় সাহিত্যের তুল্যমূল্য আলোচনায় যেসব প্রধানধারার কথা বারবার বলা হয়, তা আসলে কতটা উত্তর ভারত-কেন্দ্রিক, হিন্দি-ইংরেজি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ! শুধু সাহিত্য কেন, ভাষা, সংস্কৃতি, রাজনীতির ভূবনেও আগ্রাসনের ভয়ঙ্কর নখ-থাবার আঁচড়। ‘হার্ট ল্যাম্প’ আমাদের সেই অস্বস্তিকর প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি দাঁড় করায়। মুশতাক বলেন, ‘লিখি কন্নড়ে, কারণ এই ভাষাই আমার অভিব্যক্তির শেষ আশ্রয়।’ এখানে ভাষা শুধুমাত্র একটি মাধ্যম নয়, অস্তিত্বগত আশ্রয়স্থল। যে সমাজ তাকে মৌলবাদী কাঠামোয় বেঁধে রাখতে চায়, সেই সমাজকেই প্রতিরোধ করতে ভাষাই হয়ে ওঠে তাঁর অস্ত্র, তাঁর অভিঘাত আর প্রতিরোধ।
মুশতাকের গল্পগুলো স্বতন্ত্র— সেখানে সময় রেখার সরলতা নেই, নায়ক-নায়িকার নিজস্ব জগৎ নয়বরং ভেঙে-পড়া সমাজ, ক্রমাগত পচনের দিকে এগিয়ে চলা মানুষের চেতনা, সাম্প্রদায়িক বিষে আচ্ছন্ন দিনের কথা শোনায়। সোচ্চারে প্রতিরোধ তোলে— কেবল যৌনতা নয় বরং নিঃস্বতা, পরিণতি নয় বরং চিরন্তন অনির্দিষ্টতা চাই। ‘বী অ্যা ওম্যান ওয়ান্স, ও লর্ড !’ গল্পে ঈশ্বরকে ‘নারীজন্ম’ নেবার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয় প্রোটাগনিস্ট, যা পোস্ট-স্ট্রাকচারাল নারীবাদের এক নিখুঁত রাজনৈতিক বক্তব্য। ‘স্টোন স্ল্যাবস ফর শাইস্তা মহল’-এ এক পুরুষের চূড়ান্ত রোমান্টিক প্রতিশ্রুতি কেমন করে মহিলার মৃত্যুর পর ধসে পড়ে, সে প্রেম নয়, যেন সম্পত্তির ভাষ্য। একটিতে দেখা যায়, পাঁচ সন্তানের মা, মেহরুন, আত্মহননের প্রান্তে দাঁড়িয়ে মেয়ের ভালোবাসায় ফিরে পান জীবনের আলো— ‘হার্ট ল্যাম্প’। নিষ্ঠুর বাস্তবতা আর মমতার কোমলতা একসঙ্গে বুনে তৈরি হয় লাঞ্ছিত, যন্ত্রণাকাতর, অবহেলিত মানুষের নিজস্ব কাহিনীপথ, মহাকালে জমা হয় ভাষার প্রত্যাঘাত।
লন্ডনের টেট মডার্ন-এ, ২০ মে-র সন্ধ্যায় পুরস্কার গ্রহণ করে বানু মুশতাক বলেন, ‘এ মুহূর্ত যেন হাজারো জোনাকি এক আকাশে জ্বলছে—অল্প সময়ের জন্য হলেও জ্বলছে। উজ্জ্বল, সমবেত। এ জয় শুধু আমার একার নয়, সীমানা ছাড়িয়ে গল্প বলার শক্তির জয়।’ ৭৭ বছরের লেখিকা, আইনজীবী ও সমাজকর্মী প্রায় ৩ দশক ধরে লিখেছেন সমাজে নারীর অবস্থান, ধর্মীয় অনুশাসন, আর পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কন্নড় সাহিত্যে তিনি অন্যতম প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। ২৬ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা—সবই করেছিলেন নিজের শর্তে। অথচ বিয়ের পর সমাজ তাঁকে শুধুই একজন বোরখা-পরিহিতা গৃহিণীতে রূপান্তরিত করতে চেয়েছিল। হতাশায় আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিলেন একবার। তিনি বলেন, ‘আমার হৃদয়ই আমার গবেষণাক্ষেত্র। নারীদের কষ্ট, তাদের গল্পই আমাকে লেখায় টেনে এনেছে।’ ১৯৯০ থেকে ২০২৩-এর মধ্যে লেখা ১২ টি গল্প গড়ে তুলেছে এক নারীকেন্দ্রিক সাহিত্যের বিশাল ক্যানভাস। কন্নড় সাহিত্যে ৬টি গল্পসংকলন, একটি উপন্যাস, একটি প্রবন্ধসংকলন আর একটি কবিতার বই লিখে বানু তাঁর জমিনের ছাপ রেখে দিয়েছেন। পেয়েছেন ‘কর্নাটক সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার’-সহ বহু সম্মান।
ভূ-খণ্ডের আমূল শিকড়, ভাষার জমিন কন্নড় থেকে ইংরেজিতে নিয়ে এসেছেন অনুবাদক, সাহিত্যকর্মী ও গবেষক দীপা ভাস্তি। তাঁর কথায় — ‘আমি কন্নড়ের ঘ্রাণ-স্বাদ-মাটির গন্ধ রেখেই অনুবাদ করেছি। এটাকে আমি বলি ‘অ্যাকসেন্টেড ট্রান্সলেশন’। ম্যান বুকার পুরস্কারের বিচারকমণ্ডলীর প্রধান, লেখক ম্যাক্স পোর্টার একে বলেছেন ‘এটি একটি র্যাডিকাল পুনর্নির্মাণ।’ —শুধু অনুবাদ নয়, ভাষার নবনির্মাণ। যেখানে ইংরেজির একাধিক উচ্চারণ, একাধিক গড়ন, একাধিক ভূগোল যেখানে পাশাপাশি চলে। দীপা ভাস্থির অনুবাদ ‘বহুস্বরের পাঠ’ দেয়, কন্নড়, উর্দু, দখনি, তথা ভারতীয় উপমহাদেশীয় নারী-স্মৃতির যৌথ চিৎকার এক কণ্ঠে ধ্বনিত হয়। ভাস্থি বলেন, ‘অনুবাদ করেছি অন্য এক উচ্চারণের স্পর্ধা নিয়ে, ইংরেজির তথাকথিত শুদ্ধতার বিপরীতে প্রাঞ্জল বয়ান তৈরি করে, এটা একধরনের ভাষাগত অবাধ্যতা।’ তিনি বলেন, ‘এই পুরস্কার কেবল আমাদের জয় নয়, আঞ্চলিক ভাষার লেখকদের জন্য একটি পথ খুলে দিল। কন্নড়, বাংলা, ওড়িয়া, তেলুগু থেকে আরো অনুবাদ হোক। অমূল্য পাঠের আশায় বিশ্বসাহিত্য অধীর অপেক্ষা করে আছে।’
পোস্ট-মডার্ন চিন্তায় ইতিহাস নয়, বরং ‘মেমোরি’ বা স্মৃতি, ‘সাইলেন্স’ বা নীরবতা, এবং ‘এরেজার’ বা মুছে ফেলার প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ। ‘হার্ট’ ল্যাম্প’ সেই মুছে যাওয়া স্মৃতিগুলোকে নক্ষত্রলোক থেকে ফিরিয়ে আনে। যে নারীরা কিছু বলতে পারে না, যারা ঘরে বন্দি হয়ে থাকে, যারা মুখর হয় না—তাদের হয়ে মুশতাক কথা বলেন। একটি সমাজ যেখানে মেয়েদের গল্প বলা মানে নিজেকে উলঙ্গ করে তোলা। সেখানে বানুর লেখনি ‘আলো দিয়ে লেখা প্রতিরোধ’—যেখানে গৃহস্থালির কাজ, ধর্মীয় অনুশাসন, আর সংসারের যন্ত্রণা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। গল্প বলার ধরণ না-বলা কথার মধ্যে নিহিত।
‘হার্ট ল্যাম্প’-এর বুকার জয় কেবল কন্নড় সাহিত্যের নয়, বরং আঞ্চলিক ভাষা ও নারীকথনের জয়। একইসাথে ইতিহাস, রাজনীতি,সমাজ, ভাষাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করানো। এই বই পড়ে বোঝা যায়—ভাষা যখন সীমান্ত পেরোয়, তখন তা কেবল অনুবাদ হয় না; বরং প্রতিরোধ, পুনর্নির্মাণ, আর পুনর্জন্ম ঘটে। এর আগে গীতাঞ্জলি শ্রী ও ডেইজি রকওয়েল ‘টোম্ব অফ স্যান্ড’-এর জন্য ২০২২-এ বুকার পুরস্কার পেয়েছিলেন। বানু মুশতাক সেই উত্তরাধিকারকে আরো জোরালো, সমুজ্জ্বল করলেন, জ্বলে উঠলো — ‘হার্ট ল্যাম্প’। গভীর উচ্চারণে তিনি বলে উঠলেন, ‘তুমি লিখতে শুরু করো। লেখো, লেখো, আর লেখো—এই লেখা, এই গল্পই তোমার মৃত্যু পর্যন্ত বন্ধু, সহযাত্রী।’
❤ Support Us