- খাস-কলম
- জানুয়ারি ২৫, ২০২৪
একটা স্নানের কাহিনী
৯৩ সাল থেকে দেখেই চলেছি। কত বই। স্টল। দুপুর। বিকেল। রাত।
৯৩ সাল থেকে দেখেই চলেছি। সেসব ইতিহাস হয় না। আবার দিনগুলো ইতিহাসই হয়। তার মানে দুটো ইতিহাস। হয় এরকম? একটা বই। একটা সময়। তিনটে ইতিহাস হয়? সময়ের বই। বইমেলা পালনকালের আগে পরে যেসব বই জন্মায়, সেগুলো সময়ের বই। তাতে লেখা থাকে প্রথম প্রকাশ, জানুয়ারি…বইমেলা।
বই জন্ম নেয়। লেখক,কবিদের প্রসবকাল। প্রদোষকালে। বইমেলার সমস্ত সকাল প্রসব-সকাল। পুরুষের গর্ভযন্ত্রণা এক আশ্চর্য ও অলৌকিক সময়কাল। নারীদের আরো আকাশপ্রমাণ সেই গর্ভসময়। বইমেলা এক নিবিড় মাতৃসদন। সেখানে পুরুষ,নারী এইসব ভেদ নেই। শরীরী ও ক্লান্তি। আকাঙ্খা ও মুক্তি। ভাবনা ও প্রকাশ। কত কি।
মাতৃসদনে সদ্যোজাত শিশুর লিঙ্গভেদ থাকে,সদ্যোজাত কী বোঝে,এসবের?
নতুন বই কত যুগযুগান্ত পার হয়ে একজন পাঠকের হাতে আসে,বই নিজেও কি জানে?
বইমেলা হয়তো জানে। তাই সে সর্বংসহা। মাতৃপ্রতিম।
একজন কবি। একজন গদ্যকার। একজন শিল্পী.. তার ভাবনাগর্ভে এক আলোছায়া একদিন আসে। সে কথা বলতে শুরু করে। মগজে ঠোকরায়। এই তো কত দিন কেটে গেল। একটা উপন্যাসের চরিত্র। কবে জন্মেছে মনের গভীরে। সে বড় হচ্ছে। আসছে,মিলিয়ে যাচ্ছে। বাইরের ধুলো, ধোঁয়া,হাওয়া,ঋতুকাল পেরিয়ে সে আসছে। এসেছে। বড় হচ্ছে। একদিন।
সে বলল,আমাকে বাইরে আনো। আমি এই লঘু,গুরু,স্মৃতির মস্তিষ্ক বৃত্তে আর পাক খেয়ে বাঁচতে পারছি না। আমাকে মুক্তি দাও। লেখক কলম,ল্যাপটপ,ডেস্কটপ.. একটা প্রসবপথ খোঁজে। লিখতে লিখতে তৃতীয় পর্বে উপন্যাসের মূল চরিত্রের জন্ম হয়। সে কী দীর্ঘর্জীবী হবে? নাকি ক্ষণজন্মা।
এই কবিতার বেঁচে থাকার আয়ু কতদিন? একমাস,নাকি যুগের পর যুগ? কে জানে ,কে বলতে পারে এই গুপ্তকথা?
এই তুলির টানে যে কথা ক্যানভাসে বলা হল,কী লাভ হল? কে বুঝল? এত যে মাথা ঠুকতে ঠুকতে আঁকা হল,বাঁচবে ওই ডিঙ্গি নৌকায় ধূসর আলোয় বসে থাকা যাত্রী? কে জানে? কে জানে গুপ্তকথা।
বইমেলা চুপ করে শোনে। আর জানে। ঐ যে বর্ধমানের এক গ্ৰাম থেকে যে ছেলেটি বলল,বইমেলা কোন বাস যাবে ,বলেন?
তার আকুতি,আমি দেখেছি। তার আকাঙ্খা দেখেছি। সে খুঁজতে এসেছে এক আলো। সে চিনেছে দূরে বসে। তার আলোকিত আকাঙ্খা খন্ড হয়ে পড়ে আছে শহরের এক মাতৃসদনে। সে তাকে কোলে তুলে নেবে। জড়িয়ে ধরবে।
পেয়েছি,পেয়েছি.. একা একা ফিসফিস করে বলবে। এখনি কাউকে বলবে না। পরে বলবে। সে পেরেছে, যা চেয়েছিল। তার গর্ভে পৌঁছেছে এক আলো। সেই আলো টেনে নিয়ে গেছে যোজন যোজন পথ। সেই নারী, খুঁজেছিল,একটা কবিতার লাইন। কে লিখেছে এইসব? ” আমার নিহিত দুঃখ/ শীতের লোকালে চলে যায়”? ধরো তাকে। তাকে চাই একবার। আমার জন্য কেন লিখেছে এইসব কথা। ভুল করেছে। সে কী করে বুঝল,আমি শীতের লোকালের নিহিত দুঃখ বুঝি?
বইমেলা বাউল। সে গলির ভেতর ঘুরে ঘুরে গান করে। বইমেলা এক প্রাক্তন প্রেমিক। সে খোঁজে কেমন আছে প্রেমিকা। বইমেলা নিজে এক উদাসী গাছের মত।
এইসব লক্ষ লক্ষ নারী পুরুষের মনের একটা গোপন আকাঙ্খায় বিরাজমান বইমেলা। একটা গল্পের জন্য অখ্যাত লেখককে দেখতে আসা। আপনি লিখেছেন। এই সেই লোক?
আপনি এই কবিতার বই লিখেছেন?
তাই দেখতে আসা। আর লেখেননি কিছু। সারাবছরের কোটি কোটি কথার পরেও অনেক কথা বলা যায় না। অক্ষর,শব্দ,রং,ছাপা, বাঁধাই,গন্ধ, স্পর্শ.. এক একটা উত্তেজক ওষুধের মতো। ওই গর্ভ যন্ত্রণা শুরু হয়, পৌষের মাঝ সময় থেকে। হাওয়া বয়ে যায়। আর পাগল হতে থাকে,লোকজন। আমার কথা বলার বইটাই আমার। আমার শোক বোঝার কবিতাগুলো আমার। সে যেই লিখুক। আমার কথাই তো লিখেছে। আমি সেই মহাসাগরে যাবো,নিজেকে মেলাতে। আমি আর কিছু চাই না। আমাকে বলতে দাও। আমাকে শুনতে দাও। আমার কথা বাজুক মাঠজুড়ে। বাজতেই থাকুক।
বইমেলা,এইসব মোহের গল্প শুনিয়ে যায় প্রতিবছর। কয়েকদিন।
❤ Support Us