Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২২

আমার ছেলেবেলা

স্মৃতিকথা পর্ব-২২

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

ছবি: সৌজন্যে ফেসবুক ।

ঢাকা থেকে ফিরে নবোদ্যমে মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার জন্য তৈরী হচ্ছিলাম। বাবা আমাকে প্রথমে আমতলার অরুণমামার কাছে পাঠালেন। সদ্য বি.এ পাস করে তিনি তখন সান্দিকোণা স্কুলে মাস্টারিতে ঢুকেছেন। আমি কিছুদিন অরুণমামাদের বাড়িতে থেকে তার কাছে পরীক্ষার প্রস্তুতি নিলাম। ওখান থেকে ফিরে এলে বাবা আমাকে পাঠালেন মোহনগঞ্জের অতুলবাবুর কাছে। আমি প্রতিদিন সকালের ট্রেনে মোহনগঞ্জে যেতাম, মোহনগঞ্জ স্কুলের নামকরা শিক্ষক অতুলবাবু ছিলেন বারহাট্টার মানুষ— তিনি মোহনগঞ্জে বাড়ি তৈরি করে ওখানেই থাকতেন। বাবার সঙ্গে তার খুব ভালো সম্পর্ক ছিল— আমার বাবা ভালো শিক্ষকের সন্ধান পেলেই আমাকে তার কাছে পাঠাতেন জ্ঞানার্জনের জন্য। ভয় দেখিয়ে নয়, আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে তিনি আমাকে বুঝাতেন— ফলে তাঁকে অমান্য করার সুযোগ থাকতো না। সকালের ট্রেনে মোহনগঞ্জ যেতাম, দুপুরে ঝুমুরলাল কাইয়ার ঘরে আমার দ্বিপ্রাহরিক আহারের ব্যবস্থা ছিল। ঝুমুরলাল কাইয়া ছিলেন একজন ভারতীয় মাড়োয়ারি— বারহাট্টা এবং মোহনগঞ্জে তার বেশ কয়েকটি পাটের গুদাম ছিল। একজন পশ্চিমা পাচক রান্না করতো। আতপ চালের গরম ভাত ঘি ও নিরামিষ তরকারি সহযোগে খাওয়াটা বেশ ভালোই হতো। আমাকে বেশ যত্নসহকারেই খাওয়ানো হতো– ঝুমুরলালবাবু নিজেও মাঝে মাঝে আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে খোঁজখবর নিতেন। অতুলবাবুও বেশ যত্নসহকারে আমাকে পড়াতেন। প্রায় মাসখানেক এই ব্যবস্থাটি চালু ছিল।

পরীক্ষা কাছে চলে আসছিল, সেই সঙ্গে আমার পড়াশোনার চাপও বাড়ছিল। কবিতার কথা ভাববার মতো কোনো অবকাশই ছিল না। কিন্তু আমার ভবিতব্য ছিল অন্যরকম— সে আমাকে নানা ছলে যেন কবিতার দিকেই ঠেলে দিচ্ছিল। একদিন মোহনগঞ্জ থেকে ফিরছিলাম, ট্রেনে জনেক হকার তখন একটি পত্রিকা বিক্রি করছিল। পত্রিকাটি নেত্রকোণা থেকে প্রকাশিত— এই কথা শুনে আমি এক কপি পত্রিকা কিনে ফেলি। পত্রিকার নাম ‘উত্তর আকাশ’। সম্পাদক প্রবীণ সাহিত্যিক খালেকদাদ চৌধুরী। পত্রিকার প্রধান পৃষ্ঠপোষক নেত্রকোণার নবাগত এস.ডি.ও জনাব নুবুল ইসলাম খান। পত্রিকার নামটি আমার খুব পছন্দ হলো। দেখলাম পত্রিকাটিতে কবিতারই প্রাধান্য। ওই সংখ্যায় কবি রফিক আজাদের একটি কবিতা ছাপা হয়েছিল— তাছাড়া আল আজাদ, শান্তিময় বিশ্বাস, দিলীপ দত্ত, খালেদ বিন আস্কার, সুকোমল বল— এদের কবিতাও ছিল। বিশেষ করে রফিক আজাদের কবিতাটি আমার বেশ পছন্দ হয়– কবিতাটি ছিল গদ্যছন্দে এবং অন্ত‍্যমিলবর্জিত। এর আগে রফিক আজাদের কবিতা ইত্তেফাকে ছাপা হয়েছে, সুতরাং আমি তার কবিতাটি দ্বারা প্রভাবিত হলাম। পত্রিকার পক্ষ থেকে নবীন লেখকদের লেখা আহ্বান করা হয়েছে— আমি সেই আহ্বানে প্ররোচিত হয়ে বাড়ি ফিরেই নেত্রকোণায় নবাগত এস.ডি.ওকে উদ্দেশ্য করে একটি কবিতা রচনা করে ফেললাম। কবিতাটি ছিল ছন্দমিল বর্জিত একটি আধুনিক কবিতা। কবিতার নাম রাখলাম ‘নতুন কান্ডারী’। কান্ডারী শব্দটা নিলাম নজরুলের কবিতা থেকে। পরদিন আর মোহনগঞ্জ গেলাম না, গেলাম নেত্রকোণায় একেবারে ‘উত্তর আকাশ’ কার্যালয়ে, সিদ্দিক প্রেসে। সম্পাদকের দেখা পেলাম না, পত্রিকার মুদ্রক জনাব আলী ওসমান সিদ্দিকী সাহেব আমার পদবী দেখেই আমাকে চিনলেন। তার বাড়ি আমাদেরই পার্শ্ববর্তী ডেমুরা গ্রামে, তিনি বাবার বন্ধু। সিদ্দিকী সাহেব আমাকে উৎসাহ দিলেন। বুঝলাম পরের সংখ্যাতেই কবিতাটি ছাপা হবে। পত্রিকাটি ছিল পাক্ষিক—সুতরাং বেশ কয়েকটি দিন ধৈর্য ধরে থাকতে হলো পরবর্তী সংখ্যার জন্য।

কবি রফিক আজাদ, আল আজাদ, শান্তিময় বিশ্বাস

উত্তর আকাশের পরবর্তী সংখ্যায় আমার কবিতাটি ছাপা হয়ে গেলো। ভেবেছিলাম নবীনদের আসরে ছাপা হবে, কিন্তু না, ছাপা হলো বড়দের আসরে। আধুনিক কবিতা তো, তাই। নীল রঙের মলাট ছিল সেই সংখ্যার। উত্তর আকাশ এবং নীল রঙ দুটোই আমার প্রিয় হয়ে উঠলো। আমি পাঁচ কপি উত্তর আকাশ কিনে ফেললাম এবং বিভিন্নজনকে উপহার দিলাম। মেট্রিক পরীক্ষাটা কাছাকাছি থাকায় আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হওয়ার ঘটনাটাকে নিয়ে যতটা উন্মত্ততা প্রকাশ করা উচিত ছিল, তা করা সম্ভব হলো না। বাবা আমার কবিতাটি পড়লেন এবং কাউকে কাউকে ডেকে এনে আবৃত্তি করেও শোনালেন। তিনি খুশি হলেন বটে কিন্তু খুশির চোটে পরীক্ষার প্রস্তুতিপর্বটা যাতে বিঘ্নিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমাকে নতুন করে তার প্রিয় ইংরেজি প্রবাদটি আবারও শুনিয়ে দিলেন : Life is mathematics, not poetry. পরীক্ষায় ভালো ফল করতে হলে কবিতা নয়, অংকে ভালো করতে হবে; সুতরাং আপাতত আমিও বাবার উপদেশ শিরোধার্য করে, আমার দিকে ছুটে আসা কবিতাগুলোকে পরে দেখা করতে বলে, অংক শাস্ত্রেই মন দিলাম।

* *

আমাকে ঢাকায় যেতে দিয়ে বাবা তার সঙ্গে আমার সম্পাদিত চুক্তির একটি শর্ত পালন করেছিলেন। দ্বিতীয় শর্তটি ছিল আমার জন্য একটি হাত-ঘড়ি, বাবা তা আমাকে কিনে দিচ্ছিলেন না। ঐ শর্তটির কথা যে বাবার মনে ছিল না তা নয়, অর্থাভাবের কারণেই বাবা ভুলে যাবার ভান করছিলেন। বাবার ওপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আমি পড়াশোনা বন্ধ করে কবিতা লেখার ভান করতে লাগলাম। চুলে তেল না দিয়ে চেহারার মধ্যে একটা উদাসী উদাসী কবির ভাব সৃষ্টি করে ফেললাম। বাবা বললেন : ‘কী ব্যাপার পরীক্ষা দিবি না?’

আমি বললাম : ‘ঘড়ি কিনে না দিলে আমি পরীক্ষা দেবো না।’

ছোটবেলায় আমার খুব জেদ ছিল। বাবা জানতেন সে কথা। তিনি দেখলেন বিপদ। তিনি মায়ের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। বাবার হাতে টাকা ছিল না। বাবা তখন আমার ঘড়ির টাকা সংগ্রহ করার জন্য একটা ধানীজমি বন্ধক রাখলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে সকালের ট্রেনে ময়মনসিংহ একশ পঁচিশ টাকা দিয়ে আমাকে একটি ফ্ল্যাট সাইজের ক্যাভালরি ঘড়ি কিনে দিলেন। সেই ঘড়ি পেয়ে আমার খুশির অন্ত নেই। আমার খুশি দেখে বাবা তার অর্থ সংগ্রহের যাবতীয় যাতনা ভুলে গেলেন। আমার বাঁ-হাতের শীর্ণ কব্জিতে ঘড়িটা খুব যে একটা মানাচ্ছিল না, তা আমি বুঝতে পারছিলাম। বাবা আমার মনের সেই খুত-খুতে ভাবটা দূর করে দিলেন। বললেন : ‘তোকে কিন্তু বেশ মানিয়েছে।’ রাতের ট্রেনে আমরা ফিরে আসি। ফেরার পথে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বাবা আমার কাছে সময় জানতে চেয়ে ঘড়ির গুরুত্বটাকে চাঙ্গা করে রাখলেন। আমার বাবার কোনো তুলনা হয় না।

* *

আমাদের সময় নেত্রকোণার অন্তর্গত সব স্কুলের পরীক্ষাকেন্দ্র ছিল নেত্রকোণায়। পরীক্ষার সময় নেত্রকোণায় থাকা নিয়ে একটা সমস্যা দেখা দিলো। শেষ পর্যন্ত শ্রীশ মোক্তার মহাশয়ের বাসায় থাকার বন্দোবস্ত হলো। তিনি বারহাট্টার লোক ছিলেন। নেত্রকোণা কোর্টে মুক্তারি করতেন। বাবার বয়সী, চমৎকার হৃদয়বান মানুষ। প্রচুর উপার্জন করতেন, প্রচুর খরচও করতেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা তার মক্কেলদের রাত্রিবাসের সুবিধার কথা বিবেচনা করে তিনি তার বাইরের ঘরে বেশ কয়েকটি চকির ব্যবস্থা রেখেছিলেন। তল্লাবাঁশের বেড়া দিয়ে বাইরের ঘরটা দু’ভাগে ভাগ করা ছিল। এর একটা অংশ ছিল মক্কেলদের জন্য— বাকি ছোট অংশটা ছিল একটু প্রাইভেট ধরনের। সেখানে দিনের বেলাতেও আলো জ্বালিয়ে রাখতে হতো। ওই কোঠাটাই আমার থাকবার জন্য বরাদ্দ করা হয়। শ্রীশ বাবুর ছেলে এবং শ‍্যালকও আমাদের সঙ্গে পরীক্ষা দিচ্ছিল। ফলে একই বাসায় তিনজন পরীক্ষার্থী। শ্রীশ বাবুকে আমি মেশোমশাই এবং উনার স্ত্রীকে মাসিমা বলে ডাকতাম। ওদের এক মেয়ে দেবী, তখন ফাইভ সিক্স-এ পড়ে। আমরা একসঙ্গে খেতে বসি। মাসিমা বসে আমাদের খাওয়ার তদারকি করেন। পাশের রান্নাঘরে পাচক সুনীল রান্না করে। সুনীল ছিল খুব রসিক মানুষ। ছোট্ট মুখের সঙ্গে বেমানান দুটো ভাসা ভাসা চোখের জন্য মনে হতো সবসময়ই সে যেন কী বলতে চায়। চোখের জন্য সে কখনো তার চেহারায় গম্ভীর ভাবটা আনতেই পারতো না। তার সঙ্গে বাসার সবারই ছিল হাসি-ঠাট্টার সম্পর্ক। সেও নানা কথা বলে আমাদের খুব হাসাতো। প্রথম দিনেই তার সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে যায়। তার হাতের রান্না মুশূরির ডাল ছিল বিখ্যাত। সে অবশ্য ডাল বলতো না, বলতো মগরা নদীর জল। বলতো, আমার ডাইল খাইলে পরীক্ষায় একেবারে লাস্ট ডিভিশনে ফার্স্ট। ডালের বালতি থেকে পিতলের হাতা ভর্তি ডাল ঢেলে দিয়ে আমাদের পাতের সব ভাত দিত ভিজিয়ে। ডাল দিয়েই সে আমাদের অনেকটা ভাত খেতে বাধ্য করতো—তাতে অন্যান্য তরকারির উপর চাপ কমতো। সে আমার নাম দিয়েছিল বারহাট্টার বাবু। আমি তাকে সুনীলদা বলে ডাকতাম।

বাইরের ঘরের মক্কেলদের কমতে কমতে রাত প্রায় দশটা বেজে যেতো। মেশোমশাই খেতেন সবার পরে। মাঝখানে হঠাৎ এসে আমাদের খাওয়ার তদারকি করে যেতেন। আমাকে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে সহজ হওয়ার জন্য নানাভাবে সাহায্য করতেন। শুরুতে নিজেকে ঐ পরিবারের গলগ্রহ ভেবে ভিতরে ভিতরে একটু সংকুচিত ছিলাম। কিন্তু বাসার সকলের আন্তরিকতায় সেই আস্থাটার দ্রুত অবসান হয়। অল্প সময়ের মধ্যেই আমি শ্রীশ বাবুর পরিবারের একজন হয়ে গেলাম। আপন করে নিতে পারার এই কৃতিত্ব আমার চাইতে ওদেরই ছিল বেশি। অপরের মধ্যে এমন আপনতা আমি পরবর্তী জীবনেও খুব পাই নি। কয়েকদিনের মধ্যেই দেবী আমার বিশেষ ভক্ত হয়ে গেলো। পরীক্ষা দিয়ে ফিরে এসে আমরা পরীক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করতাম, দেবী আমাদের পাশে বসে আমাদের অগ্নি-পরীক্ষার গল্প শুনতো।

হঠাৎ অংক পরীক্ষার আগের রাতে খবর বেরুল, অংকের প্রশ্ন ফাঁস হয়ে গেছে। ফাঁস প্রশ্নপত্র টাকার বিনিময়ে শহরের কোথাও কোথাও বিক্রি হচ্ছিল। দেবী ছুটে এসে আমাকে সে-খবর জানালো। আমি ব্যাপারটাকে সত্য বলে ভাবতে পারলাম না। কেননা এমন গুজব আগেও শোনা গেছে, কিন্তু পরে মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়েছে। আর দরকারই বা কী– অংকটা মোটামুটি আমার জানাই আছে। পরে অবশ্য রেডিওর রাতের সংবাদে অংকপ্রশ্ন ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঘটনাটা সত্য বলেই জানা যায়, এবং পরদিনের অংক পরীক্ষাটি স্থগিত রাখার কথা ঘোষণা করা হয়। স্থির হয় সব পরীক্ষার শেষে অংক পরীক্ষাটা হবে। ইতিমধ্যে যারা টাকা দিয়ে প্রশ্নপত্র কিনেছিল, তাদের তখন মাথায় হাত।

দেখতে দেখতে আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো। নিজের ঘড়ি দেখে পরীক্ষা দেয়ার ফলে পরীক্ষার হলে আমার স্মৃতিশক্তি আমার সঙ্গে খুবই সহযোগিতা করলো। পরীক্ষা-শেষে হিসেব করে দেখলাম, তিনটি লেটার সহ প্রথম বিভাগে পাশ করা যাবে। মনটা খুশিতে ভরে উঠলো। মনে হলো কৈশোরের শেষ সিড়িটিও আমার পায়ের তলা থেকে সরে গেছে। আমি এক ধরনের মুক্তির স্বাদ অনুভব করলাম। মনে হলো আমার চারপাশে রঙ-বেরঙের প্রজাপতিরা উড়ে বেড়াচ্ছে; তাদের তুলতুলে আদুরে ডানার রেণুস্পর্শে চঞ্চল হয়ে উঠছে আমার চিত্তলোক– আমার হৃৎপিণ্ড থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে…

ক্রমশ …


❤ Support Us
error: Content is protected !!