Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২

আমার ছেলেবেলা

স্মৃতিকথা পর্ব-২৩

নির্মলেন্দু গুণ
আমার ছেলেবেলা

সংগৃহীত

যৌবনের প্রথম ধূলিতে পা-রাখার উত্তেজনায় আমার দেহমন তখন শিমুল তুলোর মতো মুক্ত আকাশে ফেটে পড়ার প্রহর গুনছিল। আকাশের নীল, নদীর জল, ফুলের গন্ধ, পাখির গান—সবকিছুর মধ্যেই আমি আবিষ্কার করছিলাম এমন এক আবেগ, যার সঙ্গে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল না।

ক‍্যারলিনের শার্ট তখন সবেমাত্র বাজারে এসেছে। হাইহিলের টেডিজুতো এবং চোঙা-পেন্টের সঙ্গে ক্যারলিনের শার্ট ছিল তখনকার লেটেস্ট ফ্যাশন। উত্তম কুমারের মতো প্রশস্ত ললাট না থাকায় চুলে উত্তমছাট দেয়ার সুযোগ ছিল না—আমাকে মানাতো স্কয়ার কাট্। মানাতো কিনা জানি না, তবে ওটাই ছিল আমার পছন্দ। নেত্রকোণায় ভগিরথদার সেলুনে তখন চুল ছাটা নিয়ে রীতিমত গবেষণা হতো। ভগিরথদা মাথার আকৃতি এবং চুলের প্রকৃতি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ চিন্তাভাবনা করার পর কাকে কোন ছাট মানাবে তা স্থির করতেন। তার দোকানে সর্বদা ফ্যাশনদুরস্ত যুবকদের ভিড় লেগেই থাকতো। ভগিরথদা ছিলেন খেলাঘরের একজন একনিষ্ঠ কর্মী ও পৃষ্ঠপোষক। কবি আল আজাদ খেলাঘরের নেতা, তার মাধ্যমেই ভগিরথদার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। উত্তর আকাশে কবিতা ছাপা হওয়াতে তিনি আমাকে বেশ গুরুত্ব দেন, ফলে আমার মস্তকটিও তার কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। যদিও আধুনিক ফ্যাশনের প্রতি আমার দুর্বলতাকে বিবেচনায় রেখেই তিনি আমার জন্য স্কয়ার ছাট বরাদ্দ করেন, কিন্তু তিনি আমাকে বলেছিলেন : ‘আপনার চুলের ধরন এবং মুখের আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য দেখে আমার মনে হয় ঝাঁকড়া চুলেই আপনাকে মানাবে।’

তার সিদ্ধান্তটি যে আমার মনঃপুত হয় নি, তা বুঝতে পেরেই পরে তিনি বললেন : ‘তবে আপাতত আপনি স্কয়ার ছাট চালিয়ে যেতে পারেন।’ আমাকে যাতে খুব স্মার্ট দেখায় সেদিকেই তখন আমার লক্ষ্য ছিল; মানানো না-মানানোর ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিতাম না। আমি ছিলাম আমাদের পূর্ব নেত্রকোণার ক‍্যারলিন শার্ট, চোঙাপ্যান্ট এবং হাইহিল টেডি-জুতো পরা হাতেগোনা জনকয়েকের একজন।


আনন্দের মুহূর্তে মানুষ তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মরণ করে। বাবা কী যেন ভাবছেন। যা ভাবছেন তা বলছেন না— যা বলছেন তা ভাবছেন না। তার চোখের দৃষ্টি অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়েছে; সেই দিগন্তগামী দৃষ্টিকে সঙ্গ দিচ্ছে অশ্রু।


পোশাকের পেছনে এতো অর্থ, এতো উদ্যম ব্যয় করেও আমার উদ্দেশ্য শেষপর্যন্ত হাসিল হয় নি। বাড়িতে ‘বেগম’ পত্রিকাটি আমিই কিনে নিয়ে যেতাম বোনদের জন্যে। একদিন দুপুরে বাড়ি ফিরে দেখি আমার বোনরা হুমরি খেয়ে পড়ে আছে বেগম পত্রিকার পাতায়। আমি যখন আমার প্রতি তাদের প্রশংসাসূচক মন্তব্য প্রত্যাশা করছি, তখন আমাকে দেখে ওরা হেসে কুটিকুটি। কী ব্যাপার, এতো হাসির কী হলো? কাছে গিয়ে দেখি, বেগম পত্রিকার এক জায়গায় জনৈক টেডি-যুবকের ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়েছে। আমার পিঠাপিঠি খুড়তুতো বোন শীলার নেতৃত্বে অন্যান্য বোনরা মিলে আমাকে জব্দ করার জন্যই বেগমের ঐ ব্যঙ্গচিত্রটি সামনে নিয়ে আমার অপেক্ষা করছিল। ওরা যখন আমার আগমনের প্রত্যাশা করছিল, তখনই আমি ফিরেছি—সুতরাং মনে হলো যেন আমার আগমনে ঐ ব্যঙ্গচিত্রে প্রাণের সঞ্চার হয়েছে। বোনদের বিদ্রূপবাণে জর্জরিত হয়ে আমি খুবই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিলাম—কিন্তু ব্যঙ্গচিত্রটি দেখামাত্র দমে গেলাম। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলাম ঐ ব্যঙ্গচিত্রটির সঙ্গে আমার মিল আছে বটে। বুঝলাম এ পোশাক আমার নয়— এ পোশাক ছাড়তে হবে।

সুধীর ডাক্তারের একটা ছোট্ট আগফা বাক্স-ক্যামেরা ছিল। মনে হয় ওটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে স্বল্পমূল্যের ক্যামেরা—কিন্তু ছবি উঠতো চমৎকার। সুধির ডাক্তারকে আমরা সুধীরদা বলেই ডাকতাম। আমার বড়বোন রূপুদির চিকিৎসা উপলক্ষে আমাদের পরিবারে তার আগমন— পরে তার সঙ্গে আমাদের খুব অন্তরঙ্গ সম্পর্কে গড়ে ওঠে। তিনি প্রায়ই আমাদের ছবি তুলতেন। ছবি তোলার প্রতি আমার আগ্রহ দেখে সুধীরদা তার ক্যামেরাটা আমাকে কিছুদিনের জন্য ধার দেন। তখন এক একটা ফিল্মের দাম ছিল যতদূর মনে পড়ে তিনচার টাকার মতো। প্রতিটি ফিল্ম থেকে প্রায় পয়ত্রিশটির মতো ছবি তোলা যেত। ক্যামেরা হাতে পেয়ে মনে হলো আলোকচিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারলে মন্দ হয় না। এলোপাতাড়ি ছবি তুলতে শুরু করলাম। শুধু সাদামাটা ছবি নয়, ছবি নিয়ে নানারকমের এক্সপেরিমেন্টও করতাম। তাতে কি কিম্ভুকিমাকার ছবিও উঠতো।

ক্যামেরা নিয়ে শিকারির মতো আমি ঘুরে বেড়াতাম আশেপাশের গ্রামগুলোতে। ফুলে ফুলে ছাওয়া শিমুলগাছের তলায় দাঁড়ানো এক চঞ্চলা-কিশোরীর ছবি তুলে আমি খুব মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রিন্ট করার পর ঐ ছবির একটি কপি আমি উপহার দিয়েছিলাম ঐ কিশোরীকে। চিত্রশিল্পীর কম্পিত হাতের উপহার গ্রহণ করার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া সেই কিশোরীর আনত মুখশ্রী আগফা ক্যামেরায় বন্দি হয় নি— সে বন্দি হয়েছিল আমার মনের মধ্যে। কিছুদিন পরে ঐ মেয়েটি পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে যায়। তার ঐ আকস্মিক অন্তর্ধানের বেদনায় পত্রপুষ্পপল্লবিত শিমুল বৃক্ষটি এক ন‍্যাড়া-অনাথ বৃক্ষে পরিণত হয়। আমি তখন পত্রপুষ্পরিক্ত শিমুল গাছের একটি ছবি তুলে আগের ছবিটির পাশে সাজিয়ে রাখি।

মাধ্যমটি নিত্যান্ত ব্যয়বহুল না হলে হয়তো ঐ লাইনে বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতাম। ব্যয়বহুল মাধ্যম বলেই বাবার শিল্পী হওয়ার স্বপ্ন সফল হয় নি। কবি হওয়া যায় বিনা খরচে। এতো কম-খরচে পৃথিবীতে আর কিছুই হওয়া যায় না। সুধীর ডাক্তার গোয়ালপাড়ায় বাড়ি-জমি বিনিময় করে ভারতে চলে যাবার সময় তার ক্যামেরাটি নিয়ে যান। ক্যামেরাটি হারিয়ে আমি খুব একা হয়ে যাই। সুধীরদার চাইতে তার ক্যামেরাটির কথাই আমার মনে পড়তে থাকে।

* *

আমার পরীক্ষার ফল নিয়ে আমার চাইতে বাবারই উদ্বেগ ছিল বেশি। পরীক্ষার ফল সংগ্রহের দায়িত্বটা বাবার উপর ছেড়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছিলাম। একদিন আমাদের বহুপ্রত্যাশিত ফল বেরূল। ডাক-যোগে বোর্ড থেকে ফল পাঠানো হয়েছে, রেক্টর সাহেবের বাসায় গিয়ে বাবা নিজের চোখে সেই ফল দেখে এসেছেন : আমি ফার্স্ট ডিভিশন উইথ টু লেটার্স। আমাদের স্কুল থেকে মতি, হেলাল এবং আমি—মোট তিনজন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছি। এর আগে আমাদের স্কুল থেকে একসঙ্গে তিনজন প্রথম বিভাগ আর কখনো পায় নি। আনন্দের বন্যায় স্কুল ছুটি হয়ে গেলো।

ঐ অনাস্বাদিত আনন্দের উৎসবিন্দুতে বসে থাকতে আমার বেশ লজ্জা লাগছিল। দাবানলের মতো আমার কৃতিত্বের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লো। ভাইবোন এবং গ্রামের কৌতুহলী প্রিয়জনদের রচিত বৃত্তের কেন্দ্রে নিজেকে আবিষ্কার করে অনুভব করলাম, ব্যর্থতার বেদনার চাইতে কৃতিত্বের বিড়ম্বনাও কম যন্ত্রণার নয়। মা এসে আমার মাথায় হাত রাখলেন, বললেন : ‘যা তোর বাবাকে প্রনাম কর। তোর পড়াশোনার জন্য তোর বাবা কি কষ্টটাই না করেছেন।’

আমি প্রথমে মাকে প্রণাম করলাম, তার হাতেই তো আমার হাতে-খড়ি—তারপর বাবাকে। বাবা হঠাৎ কেমন যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন। অত্যান্ত সাদামাটা ভাষায় বললেন : ‘তোর উপর কৃষ্ণের কৃপা হোক। কৃষ্ণ কৃপাহি কেবলম্।’ আনন্দের মুহূর্তে মানুষ তার হারিয়ে যাওয়া প্রিয়জনদের স্মরণ করে। মনে হলো বাবা কী যেন ভাবছেন। যা ভাবছেন তা বলছেন না— যা বলছেন তা ভাবছেন না। তার চোখের দৃষ্টি অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়েছে; সেই দিগন্তগামী দৃষ্টিকে সঙ্গ দিচ্ছে অশ্রু।

ছিন্নকুটিরে ওটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের দিন। ভোরের দিকে আমি একটা স্বপ্ন দেখলাম : মা বিছানায় শুয়ে আছেন পশ্চিম দিকে শিয়র দিয়ে। তার শীর্ণ দীর্ঘ শরীরটা একটা নকসী কাঁথা দিয়ে জড়ানো। আমি তার বুকে মাথা রেখে কাঁদছি… সেই কান্নায় কোনো শব্দ নেই।

♦সমাপ্ত♦


❤ Support Us
error: Content is protected !!