Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • জুন ২৬, ২০২৩

অমূল্য রতন

সাধারণ সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনের ফর্মূলা আবিষ্কারেই ছিল সিলভেস্টর ডাকুনহার মুন্সিয়ানা

নীল গোস্বামী
অমূল্য রতন

সৃষ্টি এবং স্রষ্টা। সিলেভেস্টারের প্রয়াণে আমূলের শ্রদ্ধার্ঘ্য

সম্মান ও পুরস্কারের খিদে প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষেরই সহজাত। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি কিংবা কোনো বিশেষ ব্যক্তির থেকে পাওয়া “বাহবা”, এই সব কিছুই কাম্য ও উপভোগ্য। কিন্তু তা বলে এক কাল্পনিক চরিত্রের থেকে পাওয়া সম্মান বা স্বীকৃতির খিদে? হ্যাঁ, এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয়, সব সত্যি।

দর্শন শাস্ত্র বলে, সব কিছুই সৃষ্টি হওয়ার পর এক সময় তা আবার তার মূলে ফিরে যায়, সেই ঘটনাই ঘটেছে “আমূল” সংস্থার সাথে। সংস্কৃত শব্দ “অমূল্য” থেকে এই আমূল শব্দের জন্ম আর এই সংস্থা সময়ের তালে তাল মিলিয়ে আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছে “অমূল্য”। কিন্তু এই সংস্থা একাই কি এই সফলতার স্বাদ পেয়েছে ! অবশ্যই না, সঙ্গে প্রতিটি ভারতবাসীর ঘরের মেয়ে হয়ে উঠেছে “আমূল গার্ল”, যে সব্বার চোখে ও মনে “আমূল” – এর স্বাদ মাখিয়ে চলেছে দশকের পর দশক। আর “আমূল” – এর বিজ্ঞাপনে আমূল গার্লের পাশে নিজেকে যে মানুষই দেখেছেন, তিনিই মনের কোনায় সফলতার স্বাদ অনুভব করেছেন খবরের কাগজের পাতায় পাতায় আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে প্রতিটি হোর্ডিঙে বা আজকের দিনে সোশ্যাল মিডিয়ায় মোবাইল ফোনের প্রতি ছোঁয়ায়।

 

স্রষ্টার সাথে পরিচয়

কিন্তু এতো হলো সৃষ্টির কথা, কিন্তু স্রষ্টার কথা না বললে তো নোটে গাছ মুড়োবে না।সিলভেস্টর ডাকুনহা (Sylvester daCunha), হ্যাঁ ইনিই সেই আমূল গার্লের স্রষ্টা। সকল সৃষ্টি কর্তারই চারটে মাথা না থাকলেও, এমন এক চরিত্রের জন্ম দেওয়া চারটিখানি কথা না মোটেই।
নামে বিদেশী হলেও , জন্ম ও কম্ম সবই এই ভারতে, তবে অবশ্যই তখন তা ব্রিটিশ শাসিত ভারত। সালটা ১৯১৮ আর দিনটা ৩১শে মে, বোম্বাইয়ে জন্ম নিলেন ডাকুনহা। এরপর সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে প্রথাগত পড়াশোনার পাঠ শেষ করে সোজাসুজি বিজ্ঞাপনের কাজে ঝাঁপ। ১৯৬৬ সালে তৈরি করেন বিজ্ঞাপন সংস্থা, ডাকুনহা কমুইনিকেশনস, সঙ্গে ছিলেন তাঁর ভাই, উসটেস।

 

অর্টালি বাটার্লি ডেলিশাস

বিংশ শতক তখন ষাট উর্ধ প্রবীণ, আর সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া “আমূল” তখন বেশ কিছুটা চাপের মুখে পড়েছে দুনিয়া কাঁপানো দুগ্দ্ধ জাত পণ্য বিক্রেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে। এমন সময় “আমূল” – এর তরফ থেকে  ডাকুনহা কমুইনিকেশনস- এর দ্বারস্থ হলেন আমাদের “সাদা বিপলবের জনক”, ভার্গিস কুরিয়ান। শ্রী কুরিয়ানের শ্যালকের পরামর্শে একটি পেশাদারি বিজ্ঞাপন সংস্থার হাতে “আমূল” ব্র্যান্ডের মার্কেটিংয়ের কাজের ভার তুলে দেওয়ার উদ্যোগ চলছিল বেশ কিছু সময় ধরে।
খাতায় কলমে “আমূল”-এর জন্ম ১৯৫৭ সালে কিন্তু তার বিজ্ঞাপনী প্রচারের কাজ শুরু হয় বেশ পরে, ১৯৬৬-৬৭ সাল নাগাদ।

“আমূল” যখন বছর দশেকের কিশোর তখন তার প্রচারের ভার হাতে তুলে নিলেন সিলভেস্টর। তাঁর দরকার ছিল একটি মন মাতানো ট্যাগলাইন – এর। সেই মুহূর্তে “আমূল” এর ট্যাগলাইন ছিল “Purely The Best “। এ বিষয়ে সাহায্যের ঝোলা নিয়ে হাজির হন স্ত্রী নিশার কাছে , এবং তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন – “Utterly Amul “। এরপর নানান কাটাছেঁড়ার পর সিলভেস্টর থামলেন – “Utterly Butterly Delicious” – এ।

সিলভেস্টর ডাকুনহা স্বপ্ন দেখেন এক মিষ্টি – মায়া মাখা বাচ্চার মুখের, যাকে তুলির টানে বাস্তবে রূপ দেন উসটেস ফার্নানডেস । আজ গোটা দেশ সেই মায়া মাখা মুখের মায়ায় মাতোয়ারা।

 

ছোট মুখে বড় কথা

না, বেমানান মোটেই নয় এই ছোট্ট আমূল গার্লের মুখের বড়ো বড়ো কথাগুলো, বরং সময় উপযোগী ও নানান ঘটনার ন্যায্য মূল্যানের জন্যই আজ আমূল গার্লের এই সফলতা। কিন্তু এই ঠোঁট কাটা বিজ্ঞাপনী প্রচারের ঘরানা তৈরি করার সিদ্ধান্ত মোটেই সহজ ছিল না। সিলভেস্টর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন ভার্গিস কুরিয়ান প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তিনি কোনো সময়ই প্রচার পন্থা নিয়ে কথা বলবেন না বা কোনো রকম নাক গলাবেন না, কিন্তু কোনো প্রকারের সমস্যা যদি এই ঠোঁট কাটা বাচ্চা সৃষ্টি করে তখন তার দায় নিতে হবে ডাকুনহা- কেই। যদিও প্রয়োজনে সবসময়েই তাঁর পাশে থেকেছেন “মিল্ক ম্যান”।

সেই একই সাক্ষাৎকারে তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন আমাদের এই কলকাতা শহরকে ঘিরে তৈরি তাঁর এক “আমূল” বিজ্ঞাপনের স্লোগানের। সময়টা সেই ১৯৬০ এর দশক। শহরের হর হর তখন হরতাল। আর স্লোগান চলছে “চলবে না, চলবে না”। সিলভেস্টর লিখে ফেললেন – “Bread Without Amul – Cholbe Na, Cholbe Na!” (আমূল ছাড়া পাঁউরুটি – চলবে না, চলবে না!)। আবার হরে রাম, হরে কৃষ্ণ হয়ে উঠেছে তাঁর কলমে – “Hurry Amul, Hurry Butter – Hurry! Hurry!” আবার আমূল গার্লের মুখে ফুটে উঠেছে নানান দুর্নীতির বিরুদ্ধে যেমন প্রিতবাদ, তেমনই আবার প্রতিভাবানের প্রতি স্তুতি।

 

একই অঙ্গে এতো রূপ

না, আমূল গার্লকে সময়ের মাধ্যাকর্ষণ আটকে রাখতে পারেনি। ডাকুনহা কমুইনিকেশনসের নিপুণতায় এবং সিলভেস্টরের দূরদর্শিতায়, সময়ের সঙ্গে বহু বার রূপ বদলেছে ছোট্ট ডটেড ফ্রক পড়া আর পনিটেলের সাথে রিবন আটকানো মিষ্টি মেয়েটি। আমূল গার্ল আজ আর কেবল এক কাল্পনিক বিজ্ঞাপনী ম্যাসকট না, সে সাধারণ মানুষের মুখপাত্র। সে সব বলতে পারে যা আমরা সবাই বলতে চাই কিন্তু পেরে উঠি না। সাধারণ মানুষের সাথে যোগসূত্র স্থাপনের এই ফর্মূলা আবিষ্কারেই ছিল সিলভেস্টর ডাকুনহার মুন্সিয়ানা।

 

মিষ্টি মুখে কান্না

আমূল গার্লের মিষ্টি মুখ আজ কান্না ভেজা। প্রবাদকে সত্যি হতেই হয়, কারণ তা বহু যুগের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লেখা। “স্রষ্টা চলে যান, সৃষ্টি থেকে যায় “। মানুষ বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে। আমূল গার্ল থেকে যাবে মানুষের অস্তিত্বের শেষ দিন অবধি হয়তো কিন্তু তার স্রষ্টা চলে গেলেন গত মঙ্গলবার, মুম্বাইতে।

সাদা বিপ্লবের বিপ্লবীর হাত ধরে যে যাত্রা “আমূল” শুরু করেছিল, সেই বিপ্লবকে সফলতার চরম শিখরে এনে দিয়েছেন সিলভেস্টর, যাঁকে বিনা দ্বিধায় বিজ্ঞাপন জগতের বিপ্লবী আখ্যা দেওয়াই যায়। এমন সৃষ্টি মূলক “বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক”। ​​


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!