Advertisement
  • খাস-কলম দে । শ
  • জুন ৮, ২০২৩

শুধু বাহ্যিক নীতি প্রণয়নে শান্তি ফিরবে না। সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির পর্যালোচনা ছাড়া মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ দুষ্কর

মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকা থেকে কুকি এবং পাহাড় থেকে মেইতিরা যেন পরস্পরকে ছুরির ডগায় রেখেছে । রাজ্য সরকার, আমলাতন্ত্র, পুলিশ এবং সমস্ত রাজনীতিবিদ  এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি সবাই জাতিগত ভিত্তিতেই বিভক্ত হয়ে রয়েছে মণিপুরে

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
শুধু বাহ্যিক নীতি প্রণয়নে শান্তি ফিরবে না। সরকারি দৃষ্টিভঙ্গির পর্যালোচনা ছাড়া মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ দুষ্কর

পাঁচ সপ্তাহ ধরে মণিপুরে পারস্পরিক জাতিগত সংঘর্ষ চলার পর আপাতত এই রাজ্যে কিছুটা শান্তি আপাত ভাবে লক্ষ্য করা গেলেও এখনও মণিপুরের ইম্ফল উপত্যকা থেকে কুকি এবং পাহাড় থেকে মেইতিরা যেন পরস্পরকে ছুরির ডগায় রেখেছে । রাজ্য সরকার, আমলাতন্ত্র, পুলিশ এবং সমস্ত রাজনীতিবিদ  এবং ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি সবাই জাতিগত ভিত্তিতেই বিভক্ত হয়ে রয়েছে মণিপুরে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ মণিপুরের এই জাতি হিংসার ঘটনা নিরসনে সমঝোতা খুঁজতে এবং উত্তর পূর্বের এই রাজ্যের স্বাভাবিক অবস্থা পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে ১৫ দিনের হিংসা বন্ধের আর্জি জানিয়েছেন। তবে এখনও গ্রামাঞ্চলে বিক্ষিপ্ত অশান্তি অব্যাহত । রাজ্য সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ।কার্যত মণিপুরের নিরাপত্তা সামলাচ্ছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ ফোর্স প্রধান কুলদীপ সিং, তাঁকে নয়াদিল্লি নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে।

সরকারি পরিসংখ্যান অনুসারে গত এক মাসে মণিপুরে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ৯৮ জন নিহত, আহত ৩১০। রেকর্ড সংখ্যক অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। ৪ হাজার ১৪টি মামলা হয়েছে, এফআইআর নথিভুক্ত হয়েছে  ৪ হাজার ৭৩৪। ৪ হাজার-এরও বেশি অস্ত্র এবং ৫ লক্ষ রাউন্ড গোলাবারুদ লুট করা হয়েছে। এর বেশিরভাগটাই হয়েছে ইম্ফলের বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, সরকারি অস্ত্রাগার থেকে, অথবা মদত জুগিয়েছে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন। এখনও পর্যন্ত মাত্র ৭৯০টি অস্ত্র ও ১০ হাজার ৬৪৮ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। ৪০ হাজার মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তি ত্রাণ শিবিরে রয়েছেন।

এই অস্থির পরিস্থিতিতে সে রাজ্যে নতুন করে মাথাচারা দিচ্ছে পুরনো জঙ্গি সংগঠনগুলি।আগে রাজ্য সরকারের সঙ্গে যারা শান্তি চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বা সুপ্ত অবস্থায় ছিল, তারা আবার সক্রিয়তা বাড়াচ্ছে।এই অচলাবস্থায় ভারতীয় সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। যদিও মণিপুরে সেনার ভূমিকা নিরপেক্ষ নয়, রাজ্য প্রশাসনের তরফে কেউ কেউ এই অভিযোগ তুলছেন। কেউ বলছেন উত্তরপূর্বের এই রাজ্যের মূল সমস্যাকে গুরুত্ব না দিয়ে জঙ্গি দমনেই তৎপর ভারতীয় সেনা। কিন্তু মণিপুরে সাম্প্রদায়িক হানাহানি নিয়ন্ত্রণে ভারতীয় সেনারা ভূমিকা  দীর্ঘকালীন। নয়াদিল্লি১৯৮০ সাল থেকে রাজ্যে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ-বিরোধী ব্যবস্থাপনার জন্য মোতায়েন করে, যা অব্যাহত রয়েছে। গত ৩০ বছর ধরে, সেনাবাহিনী তিনটি জাতিগত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলির সাথে লড়াই করেছে। এই গোষ্ঠগুলি হচ্ছে নাগা, মেইতি এবং কুকি। ১৯৯৮ সালে নাগাল্যান্ডের ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কাউন্সিল – ইসাক-মুইভা (এনএসসিএন-আইএম) এবং ২০০৮ সালে কুকিদের সঙ্গে শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল, বিদ্রোহীরা সেনা ও কেন্দ্রীয় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর (সিএপিএফ) নজরদারিতে রাখা ক্যাম্পে চলে গিয়েছিল। মেইতি বিদ্রোহীরা তখন কোনও চুক্তি স্বাক্ষর করেনি কিন্তু সুপ্ত অবস্থাতে জারি ছিল তাদের বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর বেশিরভাগের হাতেই অস্ত্র  জুগিয়েছে  চিন এবং মায়ানমার।

আসাম রাইফেলসের বিদ্রোহ গ্রিড যা সেনাবাহিনীর ৩ কর্পসের অধীনে কাজ করে তা ভারত-মায়ানমার সীমান্তেও সক্রিয়। ৩ কর্পসের ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন স্থায়ীভাবে মণিপুর এবং নাগাল্যান্ডে অবস্থিত। ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের প্রাথমিক কাজ ভারত-চীন সীমান্তের রিজার্ভ ফোর্স হিসাবে নজরদারি করা।  রাজ্যের ১৬টি জেলার মধ্যে সাতটিতে অবস্থিত ১৯টি থানা বাদে মণিপুরে সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন বা AFSPA চালু রয়েছে।

দীর্ঘ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে, সেনাবাহিনী ১৯ এপ্রিল মণিপুর হাইকোর্টের তফসিলি উপজাতির মর্যাদার আদেশের পরে মণিপুরের উদ্ভুত পরিস্থিতির উপর সজাগ দৃষ্টি রেখেছিল। সেনাবাহিনী এবং ৩ মে হিংসতার বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে আরম্ভ করে। চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ, জেনারেল অনিল চৌহান, দ্ব্যর্থহীন বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, “মণিপুরের পাল্টা-অভ্যুত্থানের পরিস্থিতিতে কিছু করার নেই। প্রাথমিকভাবে দুটি জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষ জনিত ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বজায় রাখতে রাজ্য সরকারকে আমরা সাহায্য করছি।” ১ জুন একটি সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডে মণিপুরে আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারে সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং পদক্ষেপের বিষয়ে বিশদে জানান।

সিওএএস বলেছিলেন যে ৩ মে আশান্তি শুরু হওয়ার পরপরই, আইনশৃঙ্খলা পুনঃস্থাপনের জন্য সেনাবাহিনী এবং আসাম রাইফেলসের ১৩০টি অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্য ৮ থেকে ১০ হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছিল। বায়ুসেনার সহায়তায় অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করা হয়। ৩ থেকে ৫  মে পর্যন্ত অরাজকতা চরমে ছিল, ৬ থেকে ২১ মে-র মধ্যে সহিংসতা হ্রাস পায় এবং তারপরে হঠাৎ করে আবার বেড়ে যায়। মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি স্থিতিশীল নয়, মাঝে মাঝেই শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে।লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারের জন্য সেনাবাহিনী চিরুনি তল্লাশির পরিকল্পনা করছে। সশস্ত্র বাহিনী ৩৬ হাজার বাস্তুচ্যুত মানুষের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছে এবং আর্মি ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া ২১ হাজার মানুষকে পরিসেবা দিচ্ছে। ৩৭ নম্বর  এবং ২ নম্বর জাতীয় সড়ক মণিপুরের দুটি প্রধান জাতীয় সড়ক,  রাজ্যের লাইফলাইন হিসাবে বিবেচিত হয়, এই দুটি জাতীয় সড়ক খোলা রাখা হয়েছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবন সুরক্ষিত করা সেনাবাহিনীর কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মেইতি এবং কুকিদের মধ্যে বড়ো রকমের সংঘাতের পরিস্থিতি এখনও বজায় রয়েছে। এখনও সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে গ্রামে অভিযান চালানো হচ্ছে এবং আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে  বলে খবর পাওয়া হচ্ছে। সিওএএসের জানিয়েছেন, সেনাবাহিনীর কলামগুলি সমস্যাসংকুল স্থানে এগোতে চাইলেই মহিলাদের দিয়ে তাদের অবরুদ্ধ করা হচ্ছে এবং পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্যও সেনাবাহিনীকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।পাশাপাশি রাজ্য পুলিশের একাংশের সঙ্গেও সংঘাতের খবর পাওয়া যাচ্ছে, যদিও সেনাবাহিনী এই খবরের সত্যতা স্বীকার করেনি।

মণিপুরের এই পরিস্থিতিতে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলির জন্য, বিশেষ করে বিজেপির জন্য উত্তর-পূর্বের এই রাজ্যকে নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন৷ এই অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধারণার যুক্তি প্রয়োগ করা উচিত হবে না। উত্তর-পূর্বের এই সমস্যা নিরসনের জন্য প্রয়োজন ধর্মনিরপেক্ষ এবং সাংবিধানিক শাসন, যা জাতিগত ও উপজাতীয় স্বার্থ রক্ষা করতে সহায়ক হবে। বর্তমানে, পরিস্থিতি ১৯৬০  এবং ১৯৭০-এর দশকের সঙ্গে আশ্চর্যজনক ভাবে মিল যাচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে মণিপুরকে উদ্ধার করার একমাত্র উপায় বিচ্ছিন্নতার কারণ অনুসন্ধান করে, আলোচনার মাধ্যমে তার সমাধান সূত্র খুঁজে বের করা। সেনাবাহিনীই এখন এই রাজ্যের মানুষদের ত্রাতা, রাজ্য সরকারের সরকারের ভূমিকা সেই অর্থে নেই বললেন চলে।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!