Advertisement
  • প্রচ্ছদ রচনা
  • সেপ্টেম্বর ৭, ২০২২

সম্পর্কে দরকার প্রেম-ছোঁওয়া যুক্তি

দেবে আর নেবে, এটাই হয়ে উঠুক দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের নতুন নির্মান আর পুর্ন বিন্যাসের বাস্তব ভিত্তি। বন্ধুত্বে প্রেমের আবেগ অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তা যুক্তিরহিত, বিবেকহীন, হীনমন্যতা কিংবা অহমিকাবাহি হওয়া অবাস্তব এবং ভবিষ্যতহীন।

বাহার উদ্দিন
সম্পর্কে দরকার প্রেম-ছোঁওয়া যুক্তি

মঙ্গলবার, রাষ্ট্রপতি ভবনে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অফ অনার দেওয়া হয়। অত্যন্ত সম্মানজনক অভ্যর্থনা। নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার আমলকে দুই প্রতিবেশী দেশই বার কয়েক সম্পর্কের সোনালী অধ্যায় বলে অভিহিত করেছে। এটা শুধু, কূটনৈতিক অভিধা নয়। বাস্তবেও, ঢাকা আর দিল্লির মৈত্রী বেড়েছে। ভারতের স্বাধীনতার ৫৩ বছর পূর্তি উৎসব অন্তত ২৫ টি দেশে সাড়ম্বরে পালিত হয়েছে। এই আবহেই, চারদিনের ভারত সফরে এসেছেন শেখ হাসিনা। দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্ক আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা, ভারতীয় সেনার আত্মদান ও ভারতীয় নাগরিকদের সাহায্য বরাবর কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করে ঢাকা। পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁর প্রথম ভারত সফরে, শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সামনেই বিনম্র ভঙ্গিতে, দৃঢ়তার সঙ্গে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সামরিক শাসক, পরে ভোটে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে, ফারাক্কা বাঁধ ও গঙ্গার জল বণ্টন নিয়ে সম্পর্কে খানিকটা ভাঙন ধরে। সামরিক শাসক হুসেইন মহম্মদ এরশাদ যথাসম্ভব ভারসাম্য বজায় রেখে চলতেন। বুদ্ধিমান, বাস্তববাদী, স্বঘোষিত জননেতা। জানতেন, চিন, আমেরিকা, রাশিয়া ও পশ্চিম এশিয়া ও নিকটতম প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সমসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। সংবিধানে বদল ঘটিয়ে, ইসলামকে তাঁর রাষ্ট্রধর্ম করার ঝুঁকিকে ভারত সহজভাবে দেখেনি। আবার ভিন্ন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপও করেনি। বাবরি মসজিদের ধ্বংসকাণ্ডের আগে-পরে, বাংলাদেশেও বহু অপ্রীতিকর ঘটনায় ভারত তাঁর মৌখিক অসন্তোষ চেপে রাখতে পারেনি। আবার, এরশাদের আমলেই গঙ্গার জলবন্টন নিয়ে ঢাকা দিল্লির চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বেগম জিয়ার আমলে, দু’দেশের সম্পর্ক যতটা মসৃণ থাকার কথা, থাকেন নি। ভারতীয় সন্ত্রাসবাদীদের ঢাকায় আশ্রয়, জামাত ও ছাত্র শিবিরের ক্ষমতাবৃদ্ধিতে ভারতের উদ্বেগ বেরে যায়। বেগম জিয়া দিল্লি সফর করেছেন, সাদর অভ্যর্থনা পেয়েছেন। কিন্তু তাঁর আমলেই উত্তর পূর্বাঞ্চলে বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর সক্রিয়তায় ঢাকার ইন্ধনকে ভারত বিলকুল মেনে নেয়নি। বেগম জিয়ার প্রথম ক্ষমতাচ্যুতির পর সম্পর্কের ঐতিহ্য আবার ফিরে আসে। শেখ হাসিনা, সুকৌশলে, দৃঢ়চিত্তে বাংলাদেশে অবস্থানরত ভারতীয় জঙ্গি গোষ্ঠীদের সব শিবির গুঁড়িয়ে দেন। সন্ত্রাসবাদী নেতাদের জেলেও আটকে রাখেন। তখন থেকেই ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলে সামাজিক স্থিতির প্রত্যাবর্তন শুরু হয়। এখানেই দিল্লির সঙ্গে ঢাকার সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস নতুন মোড় নেয়। মাঝখানে, জাতীয় সংসদীয় ভোটে আওয়ামি লিগে পরাজয় আর বি এন পি -জামাতের পুনরায় ক্ষমতা দখলে বেশ কিছু সমস্যা তৈরি হয়। সীমান্ত হত্যা, চোরাকারবার, গোরুপাচার বড়োরকমের ইস্যু হয়ে ওঠে। বি এন পি – পাঁচ বছরের বেশি ক্ষমতায় টেকেনি, নিজের তৈরি ফাঁদেই পা ফেলে দেয়। দুর্নীতি, মৌলবাদ, সাম্রাজ্যদায়িকতা আর সন্ত্রাসবাদ সমাজের নানা স্তরে ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় দিল্লির শাসক আর বিরোধীরা বলতেন, আওয়ামি লিগ ছাড়া বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি কোথায়? এর পরের দুই নির্বাচনে শেখ হাসিনা জয়ী হন। ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের ক্রমোন্নতি দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অনুকরণ যোগ্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ভারতীয় পণ্যের অবাধ যাতায়াত, রেল ও সড়ক যোগাযোগের পুর্নস্থাপনে উপকৃত হয় দুই দেশ। ইতিমধ্যে দিল্লিতে ক্ষমতা বদল ঘটে যায়। বাংলাদেশের কোনও কোনও মহলে উদ্বেগ দেখা দেয়। সব কল্পিত দুর্ভাগ্যচিহ্নকে নাকচ করে করিডর বিনিময় ও সীমান্তে বহু সমস্যার সমাধান ঘটে। পুরনো কাঁটা যেমন খানাখন্দে আটকে থাকে, তেমনি ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী মনমোহন-জমানার তিস্তার জলকাঁটা দুদেশের মৈত্রী পথে ঝুলে রইল। মনমোহন সরকার ভুল করেছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতার সম্মতি নেয়নি, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর শর্তকে অবজ্ঞা করে তিস্তা চুক্তির আনুষ্ঠানিকতা পূর্ণ করতে চাইল। তীব্র আপত্তি জানালেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী । চুক্তি আজও ঝুলছে। এ ব্যাপারে, মমতার আগ্রহ-অনাগ্রহ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। জনমুখী নেত্রী। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর মধুর। জ্যোতি বসু, প্রণব মুখোপাধ্যায় ছাড়া অন্য কোনও বাঙালি রাজনৈতিক নেই, যিনি বাংলাদেশেও সমানভাবে চিত্তজয়ী। মমতা সবসময় বাংলাদেশের হিতাকাঙ্খী। ভাষা সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের অভিন্নতার প্রশ্নে, ঢাকা-কলকাতাকে আলাদাভাবে দেখতে অভ্যস্ত নন। আবার, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা ও দেশের স্বার্থ নিয়ে তাঁকে ভাবতে হয়। এ বিষয়ে, তাঁকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা অন্যায়। জয়-বাংলার পাশাপাশি জয় ভারতও তাঁর প্রিয় স্লোগান। তাঁর সঙ্গত অবস্থান নিয়ে বিভেদপন্থী প্রতিদ্বন্দ্বীরা প্রায়ই বলাবলি করে থাকেন, মমতা তোষণ নীতির পৃষ্ঠপোষক। এটি আদপে একটি অবাস্তব অভিযোগ। ঘৃণ্য অপবাধ। এ নিয়ে ভোটের মেরুকরণ হতে পারে, রাজনীতির সাম্প্রদায়িকতা খানিকটা জমি পেতে পারে, কিন্তু বাংলা দখল সম্ভব নয়। কখনও নয়। বাঙালির রাজনৈতিক সঙ্গা, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থেকে জাতিকে বিচ্যুত করা কঠিন। মমতার উদ্দেশ্য সৎ আর নিখুঁত। ভারতে এমন কোনও রাজ্য নেই, যেখানে প্রশাসনে, মন্ত্রিসভায় জনবিন্যাসের যথাসম্ভব প্রতিনিধিত্ব বিরাজমান। বাংলাদেশের প্রতি, শেখ হাসিনার প্রতি প্রবল টান থাকা সত্ত্বেও, তিস্তার জলভাগ বাংলাদেশকে পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। তিস্তা নিজেই ধুঁকছে। উপর দিকে, সিকিম একাধিক বাঁধ বসিয়ে রেখেছে। বর্ষায় যখন ওরা জল ছাড়ে, প্লাবনে উত্তর বঙ্গ ভেসে যায়। শুখা মরসুমে সে শুকিয়ে কোথাও কোথাও লেজের আকার নেয়। অবাধে জল ছাড়ার বদলে বিকল্প স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। তাহলে দুদেশেরই মঙ্গল। বাংলাদেশেও তিস্তা ইস্যুতে মরচা পড়বে। ভারতেও অতি উৎসাহীদের ইস্যুটি জিইয়ে রাখার পরমানন্দে ভাঁটা আসবে।

হাসিনার সাম্প্রতিক সফরে তিস্তা ইস্যু অনালোচিত থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো বা বেশি। দু’দেশের মুখে কুলুপ। ভারত সফরের আগে, দেখা করার আগ্রহ জানিয়ে মমতাকে চিঠি লিখেছেন শেখ হাসিনা। মমতা প্রত্যাখ্যান করেননি। দেখা করবেন, একথাও বলেননি। পূর্ব নির্ধারিত সূচি নিয়ে ব্যস্ত, জানিয়েছেন খোলাখুলি। শেখ হাসিনাকে জানাতেও ভোলেননি, তাঁর এ সফর ফলপ্রসূ হোক। এই যে শুভেচ্ছা, তার নিহিত অর্থ কী? কালক্রমে তিস্তাজনিত সমস্যার নিরসন? বিষয়টি সামান্য। আবার অসামান্য। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে রাজ্যের স্বার্থ, বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের এবং রাজনৈতিক প্রয়োজনকে গুরুতে দিতে হচ্ছে। কেন্দ্রের এরকম সরাসরি বাধ্যবাধকতা নেই। চাইলেই মোদি সরকার তিস্তার জলভাগ বাংলাদেশকে দিয়ে দেবে, দিতে পারবে, বিষয়টি এত সহজ নয়, অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। ৫৪ টি নদী নিয়ে দু’দেশের কিছু কিছু সমস্যা আছে। হাসিনার সফরকালে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে এসব নদীকাহিনীও উঠে আসবে। আরেকটি কথা, তিস্তাই সম্পর্কের অধিকতর উন্নয়নে, বানিজ্যিক লেনদেনের একমাত্র কাঁটা নয়। কোথাও ভূস্থল, কোথাও জলসীমা, কোথাও পাহাড়ের চড়াই উতরাই পথে ছড়িয়ে রয়েছে জটিল সীমান্ত রেখা। ক্ষমতা হস্তান্তরের তড়িঘড়িতে, অবাস্তব রাষ্ট্রসীমা এঁকে গেছে ব্রিটিশরা। আজ দুদেশকে, দুদেশের মানুষকে খেসারত দিতে হচ্ছে। কাঁটাতার সমাধান নয়। নিশ্চিদ্র প্রহরাও সীমান্তকে উপদ্রবহীন করতে পারে না। অর্থনৈতিক পরস্পর নির্ভরতা যত বাড়বে, সম্পর্কের শ্রীবৃদ্ধি ততই বিস্তৃত হবে। উত্তরপূর্বের ৭ রাজ্যে, বাংলাদেশ দিয়ে, পন্যবাহী যানচলাচল বানিজ্যিক লেনদেনকে আগের চেয়ে বহু বেশি মসৃন করে তুলেছে। সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুষম আধিকার স্থাপিত হওয়া জরুরি। জরুরি বানিজ্যিক ঘাটতি কমিয়ে আনা। এখানে দিল্লিকে সুবিচার বাড়াতে হবে। ভারতীয় পন্য সরবরাহকারীদের আর্থিক নিরাপত্তার সুনিশ্চিত ব্যবস্থা গড়ে তোলা দরকার। এ দায়িত্ব বাংলাদেশের। দেবে আর নেবে, এটাই হয়ে উঠুক দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কের নতুন নির্মান আর পুর্ন বিন্যাসের বাস্তব ভিত্তি। বন্ধুত্বে প্রেমের আবেগ অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তা যুক্তিরহিত, বিবেকহীন, হীনমন্যতা কিংবা অহমিকাবাহি হওয়া অবাস্তব এবং ভবিষ্যতহীন।


❤ Support Us
গুম গ | ল্প রোব-e-বর্ণ
ধারাবাহিক: একদিন প্রতিদিন । পর্ব ৫ পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
পথ ভুবনের দিনলিপি । পর্ব এক ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
error: Content is protected !!