- প্রচ্ছদ রচনা
- এপ্রিল ১৩, ২০২২
বর্ষবরণে কাল কলকাতায় পান্তাভাতের মহাভোজ । উত্তর থেকে দক্ষিণে তুমুল উচ্ছ্বাস । ‘জয়বাংলা’-র জয়ধ্বনি অন্য এক উদয়ের পথে । ত্রিধারায় লৌকিকের বৈচিত্র্য ।
বর্ষবরণে দ্বারে দ্বারে জাগ্রত সংস্কৃতি । নিশ্চিত অভিজ্ঞানের সন্ধানে জাতিসত্তা ।
বঙ্গীয় সমতটে নববর্ষ বরণের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ। বৃহস্পতিবার রাত ফুরোলেই পশ্চিমবঙ্গে পয়লা বৈশাখ, আর বাংলাদেশে আজ। রাজধানী ঢাকা সহ প্রতিটি বড়ো শহর সেজে উঠছে । কোথাও চড়ক মেলা, কোথাও চৈত্র আসর বসেছে রাস্তায়, রাস্তার বাইরে। ঢাকার শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে, একইভাবে দেশের সর্বত্র মুখরিত শিল্পিত উৎসব । গত দু’বছর করোনা-কারণে উৎসাহ থমকে যায়। কড়া বিধিনিষেধ এড়িয়ে নবীন-প্রবীণেরা বাড়ির বাইরে বের হননি। এবার গত দু’বছরের ঘাটতি পূর্ণ করতে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ। রমজান আর বৈশাখি কেনাকাটা যেন হাত ধরাধরি করে ছুটছে । বাইরের টুরিস্টদের একাংশ তুমুল আনন্দে আজ ঢাকামুখী। ঢাকা শহরের সব প্রান্তে বহুমুখের ঘোরাফেরা, ভিন্নতর মেজাজ তৈরি করছে । নিরাপত্তা রক্ষায় প্রশাসন দূঢ়প্রতিজ্ঞ।
জামাত আর অন্যান্য মৌলবাদী সংগঠন নানা কৌশলে বর্ষবরণ উৎসবের উদ্দীপনা রুখতে, বহু বছর থেকে মরিয়া । কিন্তু জনউচ্ছ্বাস আর প্রশাসনিক ব্যবস্থার সামনে তাঁদের প্রতিরোধ তুচ্ছ। আবেগের খরস্রোত ভাসিয়ে নেয়, ভাসিয়ে দেয় মৌলচিন্তার শক্তিকে । নববর্ষ উদযাপনে বাংলাদেশ, গোটা বিশ্বে আজ এক প্রাকাণ্ড বিস্ময়। ক্রমাগত উচ্ছ্বাস বাড়ছে । প্রকৃতির সঙ্গে মানব প্রকৃতি জড়ো হয়ে চিরায়ত সাধনার গান গাইছে ।পাকিস্তানি আমলে নববর্ষ যাপনের ভাবাবেগে এমন প্রাবল্য দেখা যেত না । লোক সংস্কৃতির গ্রামীণ বাংলা মূলত হৃদয়ের এই আকুতিকে টিকিয়ে রাখে । আর তার সংহত, সংযত ব্যপ্তি ক্রমশ দীপ্তিমান, লক্ষ্যযুক্ত আর সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে একাত্তরের বিজয়ের পর থেকে । বাংলাদেশের অঙ্গীকারে যেমন জড়িয়ে আছে বাহান্নর ভাষা অন্দোলন, তেমনি তার শ্বাস আর অনুপ্রাসে পয়লা বৈশাখ উদযাপনের যুক্তি আর আবেগের বিস্তার তার ঘোষিত সঙ্কল্পেরই আরেক সুদূঢ় অভিজ্ঞান । এখানে অখণ্ড বঙ্গসংস্কূতির ঐক্যের জয় সুনিশ্চিত। অপরাজেয়। যতদিন বাঙালি ও বাংলা ভাষা থাকবে ততদিন বৈশাখের পঙতিমালার উচ্ছ্বাশা ও অভিমুখ টিকে থাকবে। ধর্ম থেকে সংস্কৃতির দূরত্ব আর নৈকট্য যে ভাবে, যতটা থাকা জরুরি, সে ব্যাপারে বাংলাদেশের জেদ সংশয়হীন। প্রতিজ্ঞা তার অনিঃশেষ। অন্তরের এই বার্তাকেই ঋতুময়, পরিবর্তনময় প্রকৃতিতে ছড়িয়ে দিয়ে সে তার শ্বাশত রূপকে নবঅঙ্গে, নবীণরঙে সাজাতে চায়।
ইরানের নওরোজ, ইংরেজি নববর্ষ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের বিষেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বহুরূপী বহাগ- বিহু পালনের রীতি ও প্রচলিত আবেগ থেকে বাংলার অনানুশাসিত পর্ব পালনের স্বতঃস্ফূর্ত আবেদন অনেকটাই স্বতন্ত্র । যেখানে বাঙালি সেখানে তো বটে, বিশেষ করে উভয় বঙ্গের ধ্যান আর ধারণে পয়লা বৈশাখের পর্বপালনে প্রকৃতিমগ্নতা ও স্বাধীনতাবোধ মূখ্য হয়ে ওঠে । ব্যক্তিকে ছাড়িয়ে নির্বিশেষের ইচ্ছা যখন উর্বরাশক্তির সঙ্গে মিশে যায়, তখনই উৎসব শাস্ত্রসম্মতির তোয়াক্কা করে না । শাস্ত্রকে শাস্ত্রের জায়গায় রেখে দিয়ে অন্তর বেরিয়ে আসে বাইরে, বৃহতের প্রাঙ্গনে। বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখের প্রভাতে বর্ণবহুল, শুভ মঙ্গলযাত্রার যে ছবি আমরা দেখি এবং এবারও দেখলাম তা শুধু ওদেশের নয়, আমাদের সকলের ঐতিহ্যের অঙ্গ।
ঢাকায় এবার পয়লা বৈশাখের মিছিলের উজ্জীবিত মুখোশে বহুরকমের মোটিভ দেখা গেল— ঘোড়া, পাখি, পুতুল, হাতপাখা ও চড়কি ইত্যাদির। পাশাপাশি স্ট্রাকচার, পাখির অরিগামি, সরাচিত্র আর চিত্রকর্মের । কলকাতার আয়োজনও এবার অপেক্ষাকৃত চওড়া । চিরায়ত বাংলা নিজ ভাষায় বলবে । গাইবে এবং নাচবে। শুক্রবার কয়েক হাজার লোকের আসন্ন সমাগমে বাইপাশ সংলগ্ন এলাকায় প্রভাতফেরি আর পান্তা ভাতের অভিনব উদ্যোগের প্রস্তুতিতে শহর আলোড়িত, নবীন উৎসাহে প্রদীপ্ত । বলতে আর ভাবতে ভালো লাগছে, এই উদযাপনের রূপকার তরুণ পৌরপিতা সুশান্ত কুমার ঘোষ এবং রাজডাঙ্গা নব উদয় সঙ্ঘের সদস্যরা। দক্ষিণ কলকাতায়ও আনন্দের ত্রিধারা বইবে । এই নিয়ে ব্যস্ত বিধায়ক দেবাশিস কুমার । পাশাপাশি ছুটছেন তাঁর সহযোগীরা। অক্লান্ত । জয়বাংলার জয়ধ্বনিতে মুখরিত ।
❤ Support Us