Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • জুলাই ১৮, ২০২৩

বাঙালি হইয়া থাকিব, না বঙ্গভাষী অসমিয়া হইয়া মরিব ?

সঞ্জীব দেবলস্কর
বাঙালি হইয়া থাকিব, না বঙ্গভাষী অসমিয়া হইয়া মরিব ?

অসমের বহুমাত্রিক সংস্কৃতি আর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর, বিশেষ করে বাঙালির, পরিচিতির সঙ্কট নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। কেউ কেউ পরামর্শ জুড়ে দিচ্ছেন, বঙ্গভাষী অসমিয়া পরিচয় অর্জন ও বহন করে বেঁচে থাক উত্তরপূর্বাঞ্চলের সবচেয়ে বড়ো আর প্রভাবশালী জাতিসত্তা। কোনো কোনো বাঙালিও সায় দিচ্ছেন অদ্ভূত প্রস্তাবে । সংযত ভাষায়, তীক্ষ্ণ যুক্তিতে প্রতিবাদ করলেন প্রাবন্ধিক ও বিদ্যাদাতা

সম্প্রতি আসামের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের আলোচনা আর তর্জায় বাঙালাভাষী অসমিয়া শব্দ বন্ধটির আওয়াজ বড়ো বেশি বাজছে । এটি অবশ্যই নতুন কোনো উদ্ভাবন নয়, বৃহত্তর অসমিয়া জাতি গঠন প্রক্রিয়ারই ধারাবাহিক রাজনৈতিক অনুশীলনের সঙ্গায়িত অভিব্যক্তি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতির চাপে, অসমিয়া সঙ্গায়নের পুরনো বিষয়টি নতুন করে সামনে চলে এল। এ ব্যাপারে আসামের স্বীকৃত পন্ডিত ও নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের মতামত এখনো উহ্য । শুধু কিছু সংখ্যক অসমিয়া নন, সুযোগ সন্ধানী আর বয়ান সর্বস্ব বহু বাঙালি কন্ঠস্বরও উচ্চগ্রামে শোনা যাচ্ছে । তাঁরা কি মনে প্রাণে বঙ্গভাষী অসমিয়া পরিচিতি গ্রহন ও বহন করে বেঁচে থাকতে চাইছেন ? না ক্রমাগত মিশ্রণের অজুহাতে একধরণের আপসপন্থা ?

বিশেষ লক্ষণীয় বিষয়, এই প্রায়াসে নিজের পরিচিতিটি পালটে ফেলার জন্য পরামর্শটি এসেছে কেবল একটি জনগোষ্ঠী বাঙালির জন্যই । আসামে বসবাসকারি অপরাপর ভাষিকগোষ্ঠীর নিজস্ব পরিচিতিতে স্থিত থাকতে বোধহয় কোনও অসুবিধা নেই । বাঙালিকেই নতুন পরিচিতি ধারণ করে জাতে উঠতে হবে, এটাই যেন আপাতত প্রধান দাবি। এ বিষয়ে প্রথমেই বলতে হয়, বাংলাভাষী-অসমিয়া একটি অবাস্তব কষ্টকল্পিত ধারণা। আসামের অনন্দরাম বরুয়া, সূর্যকুমার ভুঁইয়া, হেমচন্দ্র গোস্বামী, বাণীকান্ত কাকতি, বিরিঞ্চিকুমার বরুয়া, কালিরাম মেহেদি, কৃষ্ণকান্ত সন্দিকৈ, পদ্মনাথ বিদ্যাবিনোদ, রাজমোহন নাথ, মহেশ্বর নেওগের মতো বিশিষ্ট পণ্ডিত ও ভারততত্ত্ববিদরা যে সব সমস্যা ইতিহাস-ভাষাতত্ত্ব-প্রত্নতত্ত্ব-নৃতত্ত্বের উপর আলোকপাত করে গেছেন সেখানে এ ধরনের অনুশীলন রাজ্যের বৌদ্ধিক ঔজ্জ্বল্যকে কিঞ্চিৎম্লান করে দেয় বই কি।

বাঙালি বা যে কোনও জাতিই খণ্ডিত পরিচিতি নিয়ে বাঁচতে পারে না। হয় তাঁকে জন্মসূত্রে এবং ঐতিহ্য পরম্পরাসূত্রে প্রাপ্ত পরিচিতি ঘুচিয়ে নতুন পরিচিতি গ্রহণ করতে হবে (এটা কয়েক শত বছরের প্রক্রিয়ায় সম্ভব, এটা বোঝার মতো নৃতাত্ত্বিক জ্ঞান আসামে অপ্রতুল নয়), নয়তো সাংবিধানিক, মানবিক অধিকার অনুযায়ী তাকে নিজস্ব অস্তিত্বে স্থিত হতে হবে। এর কোন মধ্যপন্থা নেই।

মুখের ভাষা বা মাতৃভাষা এমন এক জিনিস যা সচেতন প্রয়াসেও নিশ্চিহ্ন করা যায় না। কোনও না কোনভাবে সংস্কার ও সংস্কৃতির সঙ্গে মুখের ভাষাটিও টিকে থাকে। উদাহরণ সাগরদাড়ির কবি শ্রী মধুসূদন। তিনি দেশবাড়ি, আত্মীয়স্বজন, এবং মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে দৈবের বশে কতই না দেশেপ্রবাসে বিচরণ করেছেন, পৈত্রিক ধর্ম ছেড়ে বাইবেলীয় মাইকেল উপাধিধারী হয়েছেন, কিন্তু এ হেন প্রতিভাশালী ব্যক্তিরও শেষ আশ্রয় মাতৃভাষা । তাঁরও অন্তিম অনুভব ছিল, ‘মাতৃকোষে রতনের রাজি’।

ধর্ম পালটানো যায়, মাতৃভাষা পাল্টে দেওয়া সহজ নয় । প্রমাণের জন্য বেশি দূরে যেতে হয় না । আসামেই দেখেছি গতশতকে পাঁচের দশকে সরকারি খাতায় হাজার হাজার (না লক্ষে লক্ষে) বাঙালি মাতৃভাষা পরিত্যাগ করে ভিন্নতর পরিচিতি লিখিয়েছিলেন, ‘লেইখ্যা লইন আসাইম্যা’। এ কারণে রাজ্যে যে একটা বিস্ময়কর কাগুজে জনস্ফীতি—‘বায়লজিক্যাল মিরাকেল’ ( যেমন বলেছিলেন আর বি ভাগাইওয়ালা, সুপারিনটেন্ড অব সেনসাস অপারেশন, ১৯৫১) দেখা গিয়েছিল, এ নিয়ে সাতকাহনে যাবার প্রয়োজন নেই । নব্য-অসমিয়া হিসেবে এই বাঙালিমূলের অভিবাসীরা দিন কয়েকের জন্য উষ্ণ অভ্যর্থনাও লাভ করেছিলেন তা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি । কিন্তু এদেরই তাজা রক্তে কিছুদিন পরই রচিত হল মর্মান্তিক ইতিহাস। ১৯৬০ সালের ২০ জুন থেকে মরিয়ানি, অতঃপর শিবসাগর, লামডিং, ডিব্রুগড়, গোলাঘাট, তিতাবর, পাণ্ডু, যোরহাট, নাহারকাটিয়া, আমগুড়ি, নওগাঁ, গোরেশ্বরে প্রাণ গেল বাঙালির। ১৯৮৩ সালে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে গোরেশ্বর, খৈরাবাড়ি, শিলাপাথার, চামারিয়া, ধুলা, সিপাহঝার, জামাগুড়িহাটে গণহত্যা এবং ওই সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪ টা পর্যন্ত নওগা জেলার চালখোয়া, নেলি, গহপুর সহ বেশ কয়েকটি গ্রামে শিশু, বৃদ্ধ, নারী পুরুষের ঘাড়ের উপর জাতীয়তাবাদের খড়্গ শতাব্দীর অভাবনীয় গণহত্যার নজির সৃষ্টি করল। শিশু যেমন মা’কে প্রাণভয়ে আঁকড়ে ধরে, তেমনি নতুন ভাষার আশ্রয় নিয়েও এদের নিস্তার হল না । সরকারি খাতায় লেখা নব পরিচিতি কোনও সুরক্ষা দিতে পারল না । শুধু কি তাই ? এর চার দশক পরও এই অত্যাচারিত, ভাষাহারা মানুষগুলোর অবশিষ্ট উত্তরসুরিদের পিঠে জুড়ে বসল কতকগুলো তকমা, ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ ‘বাংলাদেশী’ ইত্যাদি । অরণ্যময় আসামে প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে এঁদের প্রপিতামহের দল যখন অরণ্যাচ্ছাদিত অ-কর্ষিত ভূমি আর জলমগ্ন চর চাপরি অঞ্চলকে কৃষির আওতায় আনলেন, তখন অবশ্য বাংলাদেশ নামক বিদেশি রাষ্ট্রটির কথা কারো কল্পনায়ও আসেনি ।

দুই.

বাঙালির নিজেদের জাতিগত পরিচিতিটি বিকৃত করে ‘বাংলাভাষী অসমিয়াপরিচিতি গ্রহণ করার পরামর্শের পরিপ্রেক্ষিতে বলতে হয়, এ ভূমিতে বাঙালির অস্তিত্ত্বেরও একটা যুক্তিগ্রাহ্য ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে । বিষয়টিকে একটু বড়ো প্রেক্ষাপটে দেখাও বোধহয় প্রয়োজন।

বাংলাভাষার (অসমিয়ারও) উৎপত্তির অনেক আগে থেকে বাংলা বা বঙ্গ-ভূমিতে ভোটব্রহ্ম বা অস্ট্রিক ভাষার ‘হা-বাংলা’ থেকে উৎপন্ন বঙ্গ বা এর সংস্কৃতায়িত রূপ ‘বঙ্গলম’ শব্দটির অর্থ হল পূর্ণতার দেশ– দ্যা ল্যান্ড অব প্লেন্টিফুলনেস; ড. হ্যালজেস্ (Dr.Halzesh) এ দেশকে বলেছেন ‘ দ্যা ল্যান্ড হোয়ার রেইন ফল নেভার এন্ডস’ (দ্রষ্টব্য: হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় , বঙ্গীয় শব্দকোষ, সাহিত্য অকাদেমি ২০১১ সংস্করণ ) কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন মানবপ্রজাতির শাখাপূর্বমুখী প্রব্রজনের (eastern migration) সূত্রে এদিকে এসে বসতি স্থাপন করেছে । এদেরই আরেকটি দল প্রত্যক্ষ রাজানুকূল্যে ‘কামরূপ রাজ্যে’ এসে বসবাস শুরু করে (৩৫০ থেকে ১১৪০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে— তখনও আসাম নামটির উদ্ভব হয়নি। ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় বাংলাভাষা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহকের উত্তরসুরিরা মধ্যযুগ থেকে আধুনিক কালে আসামের বাসিন্দা হয়েছে । বঙ্গীয় ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতায় এদের মুখে উচ্চারিত হয়েছে বাংলাভাষা (প্রাকৃত, সন্ধ্যাভাষার স্তর পেরিয়েই) । পরবর্তী পর্বে আবার এদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কোচ এবং আহোম রাজসভার আনুকূল্যে আগত ব্রাহ্মণ সহ বিভিন্ন বর্গের বাঙালি । এসব আগন্তুকদের সম্বন্ধে ঐতিহাসিক হেড়ম্বকান্ত বরপুজারী মহোদয় লিখেছেন—Brahmins were, however, settled in Assam from very early times, from fifth century if not earlier, and they were imported from time to time not only from Bengal but Upper India also by the Koch and Ahom rulers…(Comprehensive History of Assam, Government of Assam, 2004, p153) । বরপুজারী মহোদয়ের বাক্যটি লক্ষণীয়, তিনি বলছেন খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দীই নয় এরও আগে বাংলার মানুষ আসামে এসেছেন । এরপর আহোম রাজ শিব সিংহের (১৭১৪-৪৪) সময়কালে নবদ্বীপ থেকে আমন্ত্রিত মহন্ত কৃষ্ণরাম ভট্টাচার্য প্রসঙ্গে অধ্যাপক বরপুজারী লিখেছেন, তাঁর মাধ্যমে ষোড়শ শতকে আসামে নৈয়ায়িক স্মার্ত রঘুনন্দনের স্মৃতির প্রচলনও ঘটেছে ।

ত্রয়োদশ শতকে (১২২৮) দক্ষিণপূর্ব এশিয়া থেকে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর আগমনের পূর্বেকারঅর্থাৎ খ্রিস্টিয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক (বা তারও আগে) থেকে আগত বঙ্গদেশীয় অভিবাসীদের স্থানীয় হিসেবে বৈধতা কোনক্রমেই কম হতে পারে না। এরা এসেছে ভারতীয় উপমহাদেশের মূলভূমি থেকে, ভারতীয় মানচিত্র বহির্ভূত কোনও বিদেশ থেকে নয়।

এই দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ায় যারা পূর্বপুরুষের ভাষিক পরিচিতি ঘুচিয়ে অসমিয়া সমাজদেহে লীন হয়ে গেছে, আর যারা বঙ্গীয় উত্তরাধিকার নিয়ে নিজ ভাষায় স্থিত রয়ে গেছে ( অর্থাৎ অসমিয়া জাতিসত্তার সঙ্গে যাদের লীন হয়ে ওঠা হয়নি), এরা সবাই কিন্তু আসামের আদি বাসিন্দা । প্রথমোক্তদের মুখে অসমিয়া বুলি ফুটলেও জিনগত ভাবে (genetically) এরা বাঙালিই । নৃতাত্ত্বিকদিক থেকে এই জনগোষ্ঠীর অন্য কোনো পরিচিতি নেই, থাকতে পারে না।

পরিস্থিতির চাপে বাঙালিকে দেশবিভাজন মেনে নিতে হয়েছে, এবার কি খণ্ডিত জাতিসত্তাও মেনে নিতে হবে ? মনে রাখা প্রয়োজন অখণ্ড ভারতে স্বাধীনতার প্রথম বাণী এই বাঙালির কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছে, জাতীয় সংগীতের সর্বজনগ্রাহ্য বয়ানও এই বাঙালির মানসপ্রসূত। এ জাতির প্রতি কবিগুরুর সম্পর্কধন্য এ হেন আচরণে অতি অবশ্যই রাজ্যের সব মানুষের আন্তরিক সমর্থন থাকবে না

আজ ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে উচ্চারিত হচ্ছে ‘আসামের মাটি থেকে উঠে আসা ভাষা হচ্ছে অসমিয়া’। এতে অবশ্য এতটুকুও অতিশয়োক্তি নেই, এবং এতে কারও দ্বিমতের কারণও নেই । বাংলাও যে আসামের মাটি থেকে উঠে আসা আরেকটি ভাষা, এ কথাটিও উপেক্ষা করা যায় না । গাঙ্গেয় (বঙ্গ) সমভূমিতে (সঙ্গে ঐতিহাসিকভাবে বিলগ্ন নিম্ন এবং দক্ষিণ আসামে) বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপ্রকাশ ও বিবর্তনের যে-প্রক্রিয়াটি অখণ্ড বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলে ক্রিয়াশীল ছিল, ওই একই প্রক্রিয়া প্রাচীন, মধ্যযুগ থেকে প্রাগাধুনিককাল পর্যন্ত সচল ছিল নিম্ন আসাম এবং কাছাড়সহ বিস্তৃত সমভূমিতেও । এই ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার স্বরূপ উপলব্ধির দায় শুধু জাতীয়তাবাদী শিবিরের উপর চাপিয়ে দেওয়া যায় না, বিষয়টিকে উপেক্ষা করা আসামের বাঙালির আত্মঘাতেরই নামান্তর । সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, দীনেশচন্দ্র সেন আর নীহাররঞ্জন রায়ের গ্রহণযোগ্যতা আসামে বেশি বই কম নয়।

বরাক সহ নিম্ন আসামের সঙ্গে সুদূর অতীতকাল থেকে গাঙ্গেয় সমভূমির ভৌগোলিক সম্পর্ক, এবং এ ভূখণ্ডে সমাজ ও জাতিগঠন, জনবিন্যাস এবং রাজনৈতিক সংগঠনেও এর প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদও, সমাজ বিজ্ঞানী অধ্যাপক সুজিৎ চৌধুরী, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য , অধ্যাপক জয়ন্তভূষণ ভট্টাচার্য, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, বিশিষ্ট সমাজ বিজ্ঞানী বাণীপ্রসন্ন মিশ্র ছাড়া আরো অনেকে । প্রাগৈতিহাসিক পর্বে যে-প্রক্রিয়ায় বঙ্গদেশে ইন্দো-মঙ্গোলিয় বা অস্ট্রিক-ভোটব্রহ্ম নবগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙালি জাতিসত্তার উদ্ভব (ও বিকাশ) ঘটেছে—আমাদের বর্ণিত অঞ্চলটি এই প্রক্রিয়ারই অন্তর্গত, তা এঁদের গবেষণায় উঠে এসেছে।

পরিস্থিতির চাপে পড়ে বাঙালিকে দেশবিভাজন মেনে নিতে হয়েছে, এবার কি খণ্ডিত জাতিসত্তাও মেনে নিতে হবে ? মনে রাখা প্রয়োজন অখণ্ড ভারতে স্বাধীনতার প্রথম বাণী এই বাঙালির কণ্ঠেই উচ্চারিত হয়েছে, জাতীয় সংগীতের সর্বজনগ্রাহ্য বয়ানও এই বাঙালির মানসপ্রসূত। এ জাতির প্রতি কবিগুরুর সম্পর্কধন্য এ হেন আচরণে অতি অবশ্যই রাজ্যের সব মানুষের আন্তরিক সমর্থন থাকবে না । বাঙালিকে অস্তিত্ত্বহীন করে দেবার প্রাথমিক প্রয়াস হিসেবে এদের “বাংলাভাষী ‘(তবে)’ অসমিয়া” বলিয়ে নেওয়া্র প্রয়াস অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক ।

বড়ো, মিসিং, কার্বি, মণিপুরি, ডিমাসা কিংবা মাড়োয়ারি, বিহারি, নেপালিদের নিজস্ব ভাষিক পরিচিতি যেমন এক, অখণ্ড এবং অবিভাজ্য, তেমনি বাঙালিরও প্রথম এবং শেষ পরিচয় বাঙালি—তা সে বাঙালি বাংলা, বিহার, ওড়িশা কিংবা ইংল্যন্ড-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-আফ্রিকা বা আসাম– যেখানেই থাকুক না কেন । তার জাতিসত্তার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ঐতিহ্য । এ ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে যারা বেঁচে থাকতে চায় এরা অন্তর দিয়ে যেমন নিজেকেভালোবাসতে পারে না, তেমনি আসামকে ভালোবাসতে পারে না । সুযোগ সন্ধানী, পরগাছা, আত্মপরিচয়বিহীন এই শ্রেণী অসমিয়াদের কাছে কোন সম্ভ্রমও দাবি করতে পারে না । এরা আসামের প্রকৃত সম্পদ নয়, ইতিহাসই একদিন তা প্রমাণ করবে । অসমিয়া প্রতিবেশীর ঐতিহ্য, সাংস্কৃতিক সম্পদ বাঙালি প্রাণের টানেই আত্মস্থ করেছে, ভবিষ্যতেও করবে, যেমন নিজের ভাষিক সত্তাকে খণ্ডিত না করেও এতকাল করে আসছে ।

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন “বাঙ্গালার ইতিহাস চাই । নইলে বাঙ্গালী কখনও মানুষ হইবে না”। এ কথাটি আজ আসামের, বিশেষ করে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির উপলব্ধি করার সময় এসেছে । এদের মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাভাষা এ রাজ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসা বা আকাশ থেকে খসে পড়া কোনও কিছু নয়, এ ভাষাও এ মাটি থেকে উঠে আসা জীবন্তভাষা । এ কথাটি যে-বাঙালি উপলব্ধি করতে পারে না সে দুর্ভাগা ।
আলাদা করে মেঘনা উপত্যকার উত্তরাংশ এবং বরাক-সুরমা উপত্যকার কথা উঠলে, এখানকার সমাজ এবং জনবিন্যাস বিষয়ে কাছাড়ের বিধায়ক রাশিদ আলী লস্করের কথা মনে পড়াবো গত শতকের দুইয়ের দশকে বিধান পরিষদে উত্থিত এক প্রশ্নের উত্তরে যে মন্তব্য তিনি করেছিলেন, সেটাও বিশেষ করে স্মর্তব্য : ‘আপনারা যারা প্রশ্ন তুলেছেন, কাছাড়ে বাঙালি কবে থেকে বাস করছে, তাঁদের আমি একটি পালটা প্রশ্ন করি–রোমক জাতি কবে থেকে রোমের বাসিন্দা হয়েছে’?

(০৭/০১/ ১৯২৬, আসাম বিধান পরিষদ, কার্যবিবরণীদ্রষ্টব্য) । সেদিন তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে রশিদ আলী বলেছিলেন — ‘কাছাড়ে বাঙালিরা আকাশ থেকে নেমে আসেনি, বৃক্ষ থেকেও নয়, নয় আসাম ভ্যালি থেকেও; এরা সিলেট সহ বঙ্গভূমির স্বাভাবিক উত্তরাধিকারী, এ মাটিরই সন্তান । ’
বরাকবাসীর নির্বাচিত ওই জনপ্রতিনিধির কন্ঠের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে আজও বলা যায়, আসামে বাঙালি হিমালয়ের ওপার থেকে আসেনি, ভারত-মহাসাগর পেরিয়েও আসেনি, এরা এসেছে আদি অনাদি ভারতবর্ষের মূলভূমি–গৌড়বঙ্গ, বারেন্দ্রভূমি, উত্তরবঙ্গ কিংবা হরিকেল-সমতট-গঙ্গারিডি-নিধনপুর-ভাটেরার ঐতিহ্য বহন করে । ভারতের মানচিত্র-বহির্ভুত কোনো বিদেশভূমি থেকে কদাপিও নয় ।

তিন.

ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে, সাক্ষীসাবুদ নিয়ে একখানা দলিলে সই দিলে বা কিছু শাস্ত্রীয় আচার আচরণ পালন করলে ধর্মীয় পরিচিতি পালটে যায়—মুসলিম থেকে হিন্দু, হিন্দু থেকে খ্রিস্টান ইত্যাদি । কিন্তু অ্যাফিডেবিট করে একজন ওড়িয়ার বাঙালি হয়ে যাওয়া, অথবা একজন মিজোর বিহারী কিংবা অসমিয়ার বাঙালিতে রূপান্তরের কথা নিতান্তই অবাস্তব, হাস্যকরও বটে । হাজার বছরের বিবর্তনে যদি আসামের সব বাঙালি একদিন অসমিয়া হয়ে যায়, বা সব অসমিয়া হয়ে যায় বড়োতে রূপান্তরিত, সে অন্যকথা । কিন্তু সভা সমিতি করে, আইনি বা প্রাশাসনিক চাপ সৃষ্টি করে বা সাময়িক প্রলোভন দেখিয়ে কোনও জাতির ভাষিক রূপান্তর, এ বিষয়টি আপাতত মহাকালের হাতেই থাকুক ।

ভাষাহারা, আত্মপরিচয় পরিচয়-ত্যাগী অন্তঃসারশূন্য একটা উদ্ভট জনগোষ্ঠী আসামের মতো বহুভাষিক রাজ্যের সম্পদ হয়ে উঠতে পারে না । প্রত্যেকটি জাতির সৃজনশীলতা, বৌদ্ধিক বিকাশ এবং কর্মদক্ষতার প্রাথমিক সোপানই তার মাতৃভাষা ।

বাঙালিত্বে স্থিত থেকেও অসমিয়া কাব্য, সংগীত ও সাম্যবাদী আন্দোলনে প্রগাঢ় সূজনশীলতার আবগ তৈরি করেছিলেন গণসঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস, ভূপেন হাজারিকা অসমিয়া ভাষিক সত্তায় স্থিত থেকেও বাংলা গানের এক যুগান্তকারী স্রষ্টা ।

নিজেদের ভাষিক অস্তিত্বের প্রতি আস্থাশীল হওয়াটা কি দেশদ্রোহিতা ? না, এ নিয়ে অপপ্রচার আর হিংসা ছড়ানোটাই দেশদ্রোহিতা । বাঙালি মনীষীরা উনবিংশ শতাব্দী থেকে আসামের ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ অর্থনীতিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে আসছেন । যারা ‘অসমিয়া-বাঙালির ফারাক করেন’, তাদের উপর শুধু রাজ্যের একজন মাত্র মন্ত্রীর কেন, আসামে বসবাসকারী সব জাতিসত্তার সম্মিলিত ধিক্কার বর্ষিত হোক্ ।

শেষ কথা, বাঙালির পরিচিতির মধ্যে যে-কোন ধরনের অস্পষ্টতা সর্বতোভাবে প্রতিহত করা জরুরি । বাঙালি জাতিবাচক শব্দটির সঙ্গে অতিরিক্ত কতকগুলো সংযোজন-শব্দগুলো আপাতত নির্দোষ মনে হলেও এ শব্দপ্রয়োগের পেছনে দুরভিসন্ধি আজ স্পষ্ট । ‘বাঙালি জনগোষ্ঠী’, ‘ভাষাগোষ্ঠী’, কিংবা ‘বঙ্গীয়সমাজ’ –কর্ণপীড়াদায়ক এসব শব্দ বর্জন করাই প্রয়োজন । বাঙালি তো বাঙালিই, তার সঙ্গে কোন প্রিফিক্স বা সাফিক্স যুক্ত করার প্রয়োজন নেই । নৃতত্ত্ববিদ অতুল সুর, রমাপ্রসাদ চন্দ, হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, অক্ষয়কুমার মিত্র, রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নগেন্দ্রনাথ বসু, দীনেশচন্দ্র সরকার, ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, দীনেশচন্দ্র সেন, সুকুমার সেন থেকে সমসাময়িক বিদ্বজ্জনেরা বাঙালিকে বাঙালি বলেই সংজ্ঞায়িত করেছেন । আজ যদি অন্ধমোহ এবং আত্মবিস্মৃতিতে বাঙালি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নিয়ে উদাসীনতার অবলম্বন করতে থাকে, তাহলে এশুধু দুর্ভাগ্য নয়, বড়ো রকমের সংক্রামক সঙ্কটের পূর্বাভাস ।

♦—♦♦—♦♦—♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!