Advertisement
  • দে । শ প্রচ্ছদ রচনা
  • অক্টোবর ৭, ২০২৫

বিহার ভোট ২০২৫: পুরনো মুখের ক্লান্তি, নতুন মুখের প্রলোভন ! নীতীশ-তেজস্বী লড়াইয়ের মাঝে ইতিহাস গড়বেন প্রশান্ত কিশোর ?

আরম্ভ ওয়েব ডেস্ক
বিহার ভোট ২০২৫: পুরনো মুখের ক্লান্তি, নতুন মুখের প্রলোভন ! নীতীশ-তেজস্বী লড়াইয়ের মাঝে ইতিহাস গড়বেন প্রশান্ত কিশোর ?

সোমবার নির্বাচন কমিশন দুই দফায় বিহারের বিধানসভা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতেই, রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে গণতন্ত্রের মহোৎসবের তোড়জোড়। ছট পুজোর পর ৬ ও ১১ নভেম্বর ভোট দেবেন বিহারের আমজনতা, ফলাফল প্রকাশ পাবে ১৪ তারিখ। এবারের নির্বাচনী লড়াই ভাগ হয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে, একদিকে নীতিশ কুমারের নেতৃত্বে বিজেপি-জেডি(উ)-র এনডিএ জোট, মুখোমুখি তেজস্বী যাদবের আরজেডি নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস জোট ‘মহাগঠবন্ধন’। যারা দুর্নীতি, অপশাসন, বেকারত্ব ইত্যাদি বিষয়কে হাতিয়ার করে নীতিশ কুমারকে পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী পদে ফেরত না আসতে দেওয়ার ব্যাপারে বদ্ধ পরিকর। শাসক-বিরোধী জোটের বাইরে এবারের নতুন ‘খিলাড়ি’ ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোর। রয়েছে আপ, আসাদুদ্দিন ওয়েসির
অল-ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন বা এআইএমআইএম। ভোটের আবহাওয়া যত ঘনীভূত হচ্ছে বিহারভূমে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রশ্ন একটাই: কে বসবেন বিহারের গাদিতে? প্রবীণ প্রশাসক নীতীশ, লালুর উত্তরাধিকারী তেজস্বী, না কি ‘রাজনীতির অঙ্ক মাপা মানুষ’ প্রশান্ত কিশোর?

২ দশকেরও বেশি সময় ধরে বিহারের রাজনীতি যেন এক ব্যক্তির নামেই ঘুরেছে— নীতীশ কুমার। একসময় ‘সুশাসন বাবু’ নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি। বিদ্যুৎ, সড়ক, নারীর স্বনির্ভরতা— এমন বহু প্রকল্প তাঁকে জনপ্রিয় করেছিল। কিন্তু এখন? বদলে গেছে সময়, বদলেছে মনোভাব। জনতার প্রশ্ন— ‘নীতীশবাবু, আপনি আবার কোন জোটে?’ বিজেপি-র হাত ধরা, ছাড়া, আবার ধরা— এই ‘জোটের যাতায়াত’-এ তাঁর ভাবমূর্তি ক্ষয়ে গেছে। ‘পল্টু রাম’ বলে ঠাট্টা এখন আর মজার নয়, তা হয়ে উঠেছে আমজনতার হতাশার প্রতীক। সমীক্ষা বলছে, মাত্র ১৬ শতাংশ ভোটারই তাঁকে আবার মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে চান। বাকি অংশ চাইছেন ‘পরিবর্তন’। তবু নীতীশ লড়াই ছাড়ছেন না। ১২,১০০ কোটি টাকার ‘নারী উদ্যমী’ প্রকল্প, বৃদ্ধভাতা বৃদ্ধি, সরকারি চাকরিতে নতুন পদ— সবই তাঁর প্রচারে কেন্দ্রীয় অস্ত্র। কিন্তু প্রশ্নটা অন্যত্র— এত বছর পরে এই ‘ক্যাশ ও স্কিম’-এর রাজনীতি কি সত্যিই হৃদয়ে পৌঁছচ্ছে?

অন্যদিকে, অন্যদিকে, লালু প্রসাদের পুত্র তেজস্বী যাদব এবার আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী ও সংগঠিত। তরুণ ভোটার, শ্রমিক শ্রেণি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে তাঁর প্রভাব বাড়ছে। গত কয়েক বছরে তাঁর বক্তৃতা ও প্রচারে উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের ইস্যুতে জোর দেওয়া তাঁকে আরও গ্রহণযোগ্য করেছে। তবে তেজস্বীর জন্য চ্যালেঞ্জ হল—আরজেডির পুরনো দুর্নীতির ভাবমূর্তি থেকে মুক্তি পাওয়া এবং পরিবারতন্ত্রের অভিযোগের জবাব দেওয়া। তেজস্বী বলছেন উত্তরাধিকার নয়, এ লড়াই আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, বিহারকে বাঁচানোর লড়াই। এই মুহূর্তে তেজস্বী যাদবই বিহারের রাজনৈতিক মঞ্চে একমাত্র তরুণ মুখ, যাঁকে জনগণ বিকল্প হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। ২০২০-এ তিনি প্রায় সরকার গড়ে ফেলেছিলেন— মাত্র ০.০৩% ভোটের ব্যবধান তাঁকে পিছিয়ে দিয়েছিল। এবার সেই অপূর্ণতা পূরণে তিনি মরিয়া। বেকারত্ব, পরিযায়ী সমস্যা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দুর্নীতি বিরোধী মনোভাব— এসব ইস্যুকেই প্রচারের কেন্দ্র করেছেন তেজস্বী। তিনি বলছেন, বিহারকে শ্রমিক রাজ্য নয়, ছাত্র-শিক্ষকের রাজ্য বানাতে হবে।তবে চ্যালেঞ্জও কম নয়। জোটে কংগ্রেস দুর্বল, বামেরা অসন্তুষ্ট, সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্ক বিভক্ত। লালুর ছায়া এখনও তাঁর কাঁধে ভার— কিন্তু রাজনীতি বদলেছে। মানুষ এখন আর কেবল বংশ পরম্পরা নয়, কাজ চায়, আত্মমর্যাদা চায়।

এসবের মাঝে বিহার রাজনীতির মহাকাশে দুর্বার গতি নিয়ে হাজির হয়েছে প্রশান্ত কিশোরের ‘জনসূর্য পার্টি’। তারা এবার ২৪৩ টি আসনেই প্রার্থী দিচ্ছে এনডিএ বা ‘ইন্ডিয়া’ কোনো জোটের সাথে সমঝোতায় না গিয়েই। একসময় প্রশান্ত ছিলেন মোদি, মমতা, জগন, নীতীশ— সকলের ভোটকৌশল নির্মাতা। ফলে তিনি ভোটকৌশল বোঝেন, হাওয়া বোঝেন, মাটি বোঝেন। দীর্ঘ অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করেই এবার তিনি নিজেই নির্বাচনের ময়দানে। গত ৩ বছর ধরে ঘুরেছেন গ্রাম-গঞ্জে, শুনেছেন মানুষের কথা, গড়েছেন জনসূর্য পার্টি’।তারা ইতিমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছে— ‘আমরা ২৪৩ আসনে লড়ব, কোনো জোট নয়। জিতলে ইতিহাস, হারলে তবুও আলোচনার কেন্দ্রে।’ কিশোরের দাবি, ‘আমাদের ভোট হবে ২৮ শতাংশ। বাকিরা লড়ছে ক্ষমতা বাঁচাতে, আমরা লড়ছি নতুন রাজনীতি গড়তে।’ তাঁর ভরসা শিক্ষিত, শহুরে ও তরুণ ভোটার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন— প্রশান্ত কিশোরই বিহারের তৃতীয় মেরু, যিনি ভোট-পরবর্তী সমীকরণে এনডিএ বা মহাগঠবন্ধন উভয়ের ক্ষেত্রেই ‘কিং মেকার’ হয়ে উঠতে পারেন। যদিও ‘মহাগঠবন্ধন’-এর দলগুলি বলছে তাদের ভোট কেটে এনডিএ জোটকে সহায়তা করবার জন্যই প্রশান্তের এই মরিয়া লড়াই।

লম্ফঝম্প যাই থাকুক রাহুল গান্ধী ও ‘মহাগঠবন্ধন’-এর মুখ আছে, মাটি নেই, এমন মত রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের। তারা বলছেন, রাহুল গান্ধীর ‘ভোটার অধিকার যাত্রা’ বিহারে কিছুটা সাড়া ফেলেছে বটে, কিন্তু সাংগঠনিক ভিত্তি দুর্বল। কংগ্রেসের বহু পুরনো নেতা বিজেপি বা আরজেডি শিবিরে গেছেন। যদিও ১৯% মুসলিম ও ১৪% যাদব ভোট এখনো মহাগঠবন্ধনের মেরুদণ্ড, তবু অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বড়ো সমস্যা। লালু পরিবারের ‘ল্যান্ড ফর জব’ মামলা, দুর্নীতি অভিযোগ, ও আসন বণ্টনের অসন্তোষ তেজস্বীর হাতে জোটকে দুর্বল করেছে। অন্যদিকে, বিজেপি ও জেডি (ইউ) যৌথভাবে প্রচারে নামছে ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’ ইস্যুতে। মোদি-নীতীশ যুগলেই ভরসা রাখছে তারা। কিন্তু বাস্তবটা কিছুটা ভিন্ন। বিজেপি রাজ্যে প্রধান ভূমিকা চাইছে, নীতীশ সেই ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’-এ পরিণত হতে চাইছেন না। চিরাগ পাসওয়ানের এলজেপি (রামবিলাস) এখন এনডিএ শিবিরে, তবে তাঁর ভূমিকা নিয়েও সংশয়। নীতীশের ভোটব্যাঙ্ক মূলত পিছিয়ে পড়া শ্রেণি ও মহিলা ভোটারদের মধ্যে। কিন্তু সেগুলিও এবার দুর্বল হচ্ছে, ‘অতিব্যবহৃত প্রতিশ্রুতি’ নিয়ে ভোটারদের বিরক্তি বাড়ছে।

আপ, আসাদুদ্দিন ওয়েসির এআইএমআইএম, বামদলগুলির শক্তি সীমিত হলেও ভোটের লড়াইয়ে তারাও পিছিয়ে থাকতে চাইছে না। এই দলগুলির মধ্যে বামপন্থী শক্তিগুলি ‘মহাজোট’-এ রয়েছে। স্বাধীনভাবে লড়ছে আপ ও এআইএমআইএম। জোটে থাকলেও এবছর সিপিআই(এম), সিপিআই, সিপিআই (লিবারেশন) এ বছর আরো বেশি আসন দাবি করছে। ২০২০-তে তারা ২৯ আসনে লড়েছিল, এবার দাবি ৭৫। তাদের যুক্তি— ‘মহাজোটে তৃণমূল সংগঠন আমাদেরই।’ এদিকে, ওয়াইসি-র মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে বড়ো প্রভাব ফেলতে পারে। তাঁর বক্তব্য— ‘যদি তেজস্বী সত্যিই মোদি-নীতীশকে হারাতে চান, আমাদের সঙ্গে আসুন।’ এই বক্তব্যেই বোঝা যায়, বিরোধী ঐক্য কাগজে যতটা দৃঢ়, মাটিতে ততটা নয়। অভিজাত রায় ও অজেশ যাদবের নেতৃত্বে আপ ঘোষণা করেছে, তারা ২৪৩টি আসনে এককভাবে লড়বে। ‘আমাদের জোট মানুষের সঙ্গে’ বলছে তারা। ইতিমধ্যেই ১১ টি আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে অরবিন্দ-এর দল। দিল্লি-পঞ্জাবের শিক্ষা-স্বাস্থ্য মডেলকে সামনে রেখে বিহারে উন্নয়নের রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় আম আদমি পার্টি। প্রশ্ন, সেই মডেল কি গঙ্গার পশ্চিম পারে বাস্তবায়ন সম্ভব?

অর্থাৎ, বিহারের নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতিরও প্রভাব স্পষ্ট। বিজেপি এবার নিজের শক্ত ঘাঁটি ধরে রাখতে মরিয়া, বিশেষ করে উত্তর ও মধ্য বিহারে। তারা নীতীশ কুমারের সঙ্গে জোটে থেকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সাফল্যকে ভোটের মুখ্য অস্ত্র করছে। অন্যদিকে, কংগ্রেস রাজ্যে কার্যত অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ে নেমেছে, আর বাম দলগুলি চেষ্টা করছে তেজস্বী যাদবের জোটের অংশ হয়ে তাদের ভোট ব্যাংক পুনরুদ্ধারের। তবে বিহার ভোট আসলে তিনটি গল্পেরই সংমিশ্রণ—

নীতীশ কুমারের শেষ অধ্যায়, তেজস্বীর আত্মপ্রমাণের অধ্যায়, আর প্রশান্ত কিশোরের রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশের অধ্যায়। একদিকে পুরনো মুখের ক্লান্তি, অন্যদিকে নতুন মুখের প্রলোভন। নভেম্বরের ভোটে ঠিক হবে— বিহার পুরনো ‘সুশাসন’-এ ফিরবে, না কি নতুন ‘জনসূর্য’-এর পথে হাঁটবে। ১৪ নভেম্বরের ফলাফল শুধু বিহারের নয়, ভারতের রাজনীতিরও এক গুরুত্বপূর্ণ বাঁক ঘুরিয়ে দিতে পারে। বিহারের ভোট সর্বদা শুধু সংখ্যার লড়াই নয়— তা ভারতীয় গণতন্ত্রের নাড়ি মাপার জায়গা। ঐতিহাসিকভাবে জাতীয় রাজনীতির দিকনির্দেশক রাজ্য বিহার। এখানকার জনমতই অনেক সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ দিক। তবে এই মুহূর্তে জনমত বিভক্ত। কেউ নীতীশের স্থিতিশীলতাকে ভরসা করছে, কেউ তেজস্বীর মধ্যে দেখছে পরিবর্তনের আশ্বাস, আবার কেউ প্রশান্ত কিশোরের নেতৃত্বে নতুন রাজনীতির সম্ভাবনা খুঁজছে। এই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই এবারের নির্বাচনে বিহারকে পরিণত করেছে দেশের সবচেয়ে আলোচিত রাজনৈতিক মঞ্চে।


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!