- খাস-কলম প্রচ্ছদ রচনা
- জুন ৪, ২০২৪
দেশজুড়ে নাকচ মোদির বিঘোষিত আমিত্বের দম্ভ। মমতার উচ্চতা আরও বাড়ল, বাড়বে জনমুখী উত্তরণের খরস্রোত। শীর্ষে অখিলেশ– রাহুলের প্রত্যাবর্তন

গেরুয়া হাওয়া, বাংলার চিরায়ত সবুজের দাপটে তছনছ হয়ে উড়ছে। ভোটের সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলাফল প্রমাণ করছে, জনমুখী নেত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় আর তাঁর দলের প্রধান সেনাপতি অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের প্রত্যাশিত– অপ্রত্যাশিত স্বপ্নকে সমস্ত আবেগ দিয়ে স্বাগত জানাল বঙ্গীয় জাতিসত্তা।এও আরেক সদর্থক বিস্ফোরণ। গণ ভাবাবেগ আমল দেয়নি নরেন্দ্র মোদি, ক্ষমতামত্ত অমিত শাহ এর হুমকি, হুঙ্কার আর ঘৃণা ভাষণকে। বিজেপি উত্তর থেকে দক্ষিণে ৪২ আসনের মধ্যে পেয়েছে কুল্লে ১২। পদ্মের গেরুয়া আরো গাঢ় হল।আর ঘাসফুলের আয়তন বাড়ল ঝড়ের মতো, প্রবল বর্ষণের মতো ২৯ আসনের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে।
মহামতি বিদ্যাসাগরের বাংলা, রবীন্দ্রনাথের স্বর্ণজয়ী বাংলা, কাজী নজুরুলের বিদ্রোহী বাংলার রায় গণভোটের শক্তি দেখল মূঢ়, বিষাক্ত ঔদ্বত্যবাদীদের।ভারত যে বহুত্বের স্বপ্ন দেখিয়েছে, তার গার্হস্থ্যে, তার মিলনাত্মক অভিপ্রায় আর মেলাবে মিশিবের সমূহ প্রবণতায়, তারই অপরাজেয়, অপ্রতিরোধ্য দৃষ্টান্ত প্রদর্শন করল বঙ্গের লোকসত্ত্বা।১৮তম লোকসভা নির্বাচন শুধু জাতীয় সংসদ দখলের ভোট ছিল না। ছিল দেশের ঐক্য, দেশের সংবিধান, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিত্ রক্ষার লড়াই। নির্বাচনের রায় প্রমাণ করল, জনগণ স্বচ্ছ, ধর্ম নিরপেক্ষ, বিদ্বেষহীন, পক্ষপাতহীন দেশের ঐতিহ্যরক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ। নিলর্জের মতো, যে সব ক্ষমতামত্ত ভারতের গণতান্ত্রিক ভীতকে সমূলে উপড়ে ফেলতে চাইছে, তাদের প্রতি যে মুষ্ঠিবদ্ধ বাহু দেখাল ভারতীয় সত্তা, তার অভুতপূর্ব নজির স্থাপিত হল সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে। পশ্চিমবঙ্গের জননেত্রী ছিলেন ইন্ডিয়া জোটের প্রবক্তা আর প্রধানতম সংগঠকদের অন্যতম। কখনো সশরীরে বৈঠকে উপস্থিত হয়েছেন, ব্যস্ততার কারণে, কোথাও কোথাও যেতে না পারলেও, সব সময়ে বলেছেন, দেশকে বাঁচাতে হলে বিজেপিকে হটাতে হবে। ভোটের দিন দয়েক আগে, দিল্লি থেকে বাংলায় কী দেখলাম আমরা ? ষড়যন্ত্রের পর ষড়যন্ত্র। সন্দেশখালিতে সরাসরি প্রায় পৌঁছে গেলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। কয়েকমাইল দূরের বারাসতে ডেকে নিলেন এমন কিছু অচেনা মুখকে, পরে দেখা গেল, যাঁদের অভিমুখ স্বচ্ছ নয়। তখনই আরম্ভ ডিজিটাল, তার সমস্ত নৈর্ব্যক্তিক আর নিরপেক্ষতা বজায় রেখে বারবার বলেছে, ষড়যন্ত্র জাল ছড়াচ্ছে। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভষ্ম করে দিতে চাইছে বিদ্রোহী বাংলার উজ্জ্বল নির্মাণকে। মমতার ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে আমল দেননি প্রদেশ কংগ্রেসের নেতৃত্ব। গুরুত্ব দেয়নি অন্ধ তৃণমূল বিদ্বেষী বামপন্থীদের কেউ কেউ। বাংলায় ইন্ডিয়া জোট গড়ে উঠলে বিজেপির আসন সংখ্যা ১২ নয়, ১এ এসে দাঁড়াত। কেবল দার্জিলিং নিয়েই তাঁদের সন্তুষ্ট থাকতে হত। গ্রামীণ কৃষক , নগরবাসী মধ্য–নিম্নবিত্ত আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হত না। কংগ্রেস আর সিপিএমএর আরোপিত ভুলের জন্যই মমতাকে বলতে হল, বাংলায় আমরা একাই লড়ব। লড়লেন স্বস্ফূর্ত আবেগে শান দিয়ে। আর কংগ্রেস ও বাম নেতৃত্বকে বিভ্রান্তির খেসারত দিতে হল। কংগ্রেস জিতল ১ আসনে। সিপিএম পেল মহাশূণ্য। বিদ্বেষের লাগাতার প্রচারের ওপর দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে বিজেপি ১২ আসন জিতেও প্রায় মুখ থুবড়ে পড়ে গেল। রাজ্যে বিজেপির এ বিপর্যয়ের কারিগর কে ? অবশ্যই মমতা বন্দোপাধ্যায়ের সম্মোহনী, গঠনশীল নেতৃত্ব। তাঁর গ্রহণযোগ্যতা, জনপ্রিয়তা ভবিষ্যতে আরো বাড়বে । বাংলায় ২৯ আসনের জয়ী প্রার্থীকে স্বীকার করতেই হবে, নেত্রীর খুঁটির জোরেই তাঁরা জিতেছেন।
এবারের ভোট প্রমাণ করল, ভারতীয় রাজনীতির সমুচ্চারিত কন্ঠের আরেক অনন্যা হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। ইন্দিরা গান্ধির তখনকার স্নেহধন্যা তরুণী তাঁর আজকের পরিণত, তারুণ্যময় মধ্য বয়সে উজ্জলতম নক্ষত্র। ইতিহাস তাঁকে স্থায়ী আসনে বসাতে প্রস্তুত
সর্বভারতীয় স্তরেও বিজেপির ডবল ইঞ্জিনতত্ত্ব ফানুস।বিজেপি শাসিত প্রধান রাজ্য উত্তরপ্রদেশে গেরুয়া রং হঠাৎ ফিকে। অপ্রত্যাশিত দুঃস্বপ্ন হানা দিয়েছে যোগীর চোখে। তাঁর দল ৮০ আসনের মধ্যে মাত্র ৩২। অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী ৩৮৭। কংগ্রেস ৬। ২০১৯এ তারা জিতেছিল ১ আসনে। বিজেপির আড়ালের মিত্র বহুজন সমাজবাদী পার্টি শূণ্য। গুজরাটে অন্য কোনো দলের অস্তিত্ব ছিল না। এবার ১ আসন জিতে হাত শিবির ঢুকে পড়ল সেরাজ্যে। হরিয়ানায়তে পাঁচটি করে আসন পেয়ে কংগ্রেস এবং তার প্রধান প্রতিপক্ষ দু দলই এবার সমান সমান। রাজস্থানে কংগ্রেসের ৮, ছত্তিশগড়ে ১, অসমে ৩। মণিপুরে শূণ্য। ডবল ইঞ্জিনের মুখরক্ষা করেছে ছত্তিশগড়, খানিকটা অসম, অরুণাচল।
এবারের নির্বাচনের প্রধান বৈশিষ্ট, (ক) উত্তরপূর্বের মণিপুর থেকে দক্ষিণের কেরল, পশ্চিমের মহারাষ্ট্র, মধ্য আর উত্তর ভারতের উত্তরপ্রদেশ সহ প্রতিটি রাজ্যেই বিজেপির স্বপ্ন আর প্রত্যাশাকে বৃহৎঅর্থে নাকচ করল ভারত। (খ) ক্ষমতার কেন্দ্রের দিকে আবার প্রত্যাবর্তন শুরু হল কংগ্রেসের। ১ কম ১০০ আসনে জয়ী হল তাঁদের সমবেত নেতৃত্ব। (গ) উত্তরপ্রদেশে বুলডোজারের চালক যোগীর যোগ্যতা আর ক্ষমতামত্ততার দর্প চূর্ণ। অখিলেশ নিঃসন্দেহে (৩৭) আসন পেয়ে, স্বপ্নলালিত ইন্ডিয়ার অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠলেন। (ঘ) কে সরকার গড়বে, ইন্ডিয়া না এনডিএ, অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও, কংগ্রেস সহজে হাল ছাড়বে না, ইন্ডিয়া ২৩২ আসন নিয়েও বৃহত্তর সমর্থন খুঁজবে। (ঙ) আসন সংখ্যায় (২৯২) কেন্দ্রে জয়ী হলেও, ঘোড়া কেনার রাজনীতিতে তাদের আস্থা রাখতে হবে। ভারী পাল্লার দিকে অনেকেই ছুটবে। নীতিশের পোয়া বারো। দাম বাড়বে তার আয়া–গয়া রাজনীতির। (চ) টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু বিজেপির স্বাভাবিক মিত্র নন, এবারের ভোটে তাঁর দলের ১৬ আসন যে কোনো মুহূর্তে ইন্ডিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়তে পারে।
(ছ) বামপন্থীদের ৪, মুসলিম লিগও তাদের সহযোগীদের ৪ সদস্য, অকালী দলের ১ নির্বাচিত সদস্য এনডিএর দিকে পা বাড়াবেন না। (ঝ) ৫২ থেকে ৯৯ এ কংগ্রেসের উর্ধ্বারোহন তার নেতৃত্ব ও কর্মীদের মনোবল বাড়িয়ে তুলবে। (ঞ) অধিকতর শক্তি সঞ্চয় করবে আঁতাতে রাজনীতি। অবিলম্বে সরকার গঠন সহজ হবে না। যারাই সরকার গড়ুক কেন্দ্রে, অনেক কাঠ তেল সময় খরচ করতে হবে।(ট) নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র, দলীয় ক্ষমতামত্ততা, সরকারি সংস্থার বেসরকারি হাতে অর্ননের দাপট হ্রাস পাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, গণদৃষ্টির আড়ালে বিচারব্যবস্থা, বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা এবং সংবিধান বদলের প্রবণতা( এসব অভিযোগের বাস্তবতা যদি আদৌ থেকে থাকে) থমকে যাবে । ঘটনাচক্রে, ইন্ডিয়া যদি সরকার গড়ে, ঘৃণার রাজনীতির ভিতে আঘাত পড়বে সজোরে। আর তার স্বাভাবিক ছলচাতুরি সাজিয়ে আবার সরকার গড়ে সুশাসনের বিভিন্ন স্তম্ভে আঘাত হানে, পার পাবে না। হট্টোগোলের উৎস হয়ে উঠবে জাতীয় সংসদ। তার মানে, বারবার সংসদ মুলতুবি, বারবার অসহিষ্ণুতার বাহুপ্রদর্শন।
শেষকথা, এবারের ভোট প্রমাণ করল, ভারতীয় রাজনীতির সমুচ্চারিত কন্ঠের আরেক অনন্যা হয়ে উঠেছেন মমতা বন্দোপাধ্যায়। ইন্দিরা গান্ধির তখনকার স্নেহধন্যা তরুণী তাঁর আজকের পরিণত, তারুণ্যময় মধ্য বয়সে উজ্জলতম নক্ষত্র। ইতিহাস তাঁকে স্থায়ী আসনে বসাতে প্রস্তুত। প্রাদেশিক রাজনীতিকে ঘিরে এরকম উত্তরণের দৃষ্টান্ত বেনজির। বিলকুল নবাগত।
❤ Support Us