- ব | ই | চ | র্যা
- আগস্ট ৩, ২০১৯
মুক্তমনার ঋদ্ধ পৃথিবী
অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত বিষয়ও যে পাঠকের কাছে মনোগ্রাহী ও তার মননকে সমৃদ্ধ করে তোলে, তার সাম্প্রতিক একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত তানভীর মোকাম্মেলের ‘বাঙালির মেধা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি
স্বচ্ছ দৃষ্টি, জ্ঞানের গভীরতা ও বিস্তৃতি, বিশ্লেষনী ক্ষমতা ও ভাষার প্রাঞ্জলতার গুণে অত্যন্ত জটিল ও বিতর্কিত বিষয়ও যে পাঠকের কাছে মনোগ্রাহী ও তার মননকে সমৃদ্ধ করে তোলে, তার সাম্প্রতিক একটি উজ্বল দৃষ্টান্ত তানভীর মোকাম্মেলের ‘বাঙালির মেধা ও অন্যান্য প্রবন্ধ’ গ্রন্থটি। প্রগতিশীলতা ও মানবিক চেতনার কাছে দায়বদ্ধ লেখক তাঁর গ্রন্থটির এগারোটি প্রবন্ধে যেসব বিষয় যেভাবে আলোচনা-বিশ্লেষণ করেছেন তা নিঃসন্দেহে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে।
এই গ্রন্থের প্রথম দুটি প্রবন্ধের বিষয় অত্যন্ত সংবেদনশীল, বলিষ্ঠ যুক্তি, ভরপুর আত্মবিশ্বাস ও জাতিসত্তার প্রতি সত্যিকারের সংস্কারমুক্ত প্রীতিবশে যেভাবে আমাদের সীমাবদ্ধতাকে চুলচেরা বিশ্লেষণে স্পষ্ট করেছেন,তা এই সময়ের পক্ষে অত্যন্ত জরুরী। তাঁর মতে, একদিকে ‘ব্রাক্ষ্মণ্যমেধা’ বাঙালির সামাজিক ঐক্যকে ভেতর থেকে যেমন দুর্বল করে তুলেছে, তেমনি উত্তর ও পশ্চিম ভারতের রাজনৈতিক নেতারা চূড়ান্ত অন্ধতায় মেধাকে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দিয়েছেন বাঙালি সমাজে। আজ এই উগ্রতার দিনে এরকম কঠিন সত্য কোনো দিক তোয়াক্কা না করে উচ্চারণের সাহস এই বইটিতে নানাসূত্রে নানা স্থানে দেখিয়েছেন তানভীর।
প্রগতিশীলতা ও মানবিক চেতনার কাছে দায়বদ্ধ লেখক তাঁর গ্রন্থটির এগারোটি প্রবন্ধে যেসব বিষয় আলোচনা-বিশ্লেষণ করেছেন তা নিঃসন্দেহে বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে
দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্তের চেতনার বিকাশ প্রসঙ্গে’ লেখক আরও বিস্ফোরক। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে বাঙালি জাতিসত্তা থেকে ‘মুসলিমরা’ কীভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক সীমাবদ্ধতার দিকেই আঙুল তুলেছেন -‘ইরানের জনগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করলেও তাদের জাতীয় মহাকাব্য ও পূরাণ কাহিনি সমূহ, ফিরদৌসির ‘শাহনামা’ বা নিজামীর ‘সিকান্দরনামা’ ত্যাগ করেনি। কিন্তু বাংলার মুসলমান ইসলাম ধর্মগ্রহণের পর তার পূর্বপুরুষদের পূরাণকে ত্যাগ করল, বা বলা যায়, ‘ওয়াহবী-ফারায়েজী’ মৌলাদীদের কারণে ত্যাগ করতে বাধ্য হল।’
আক্ষেপ করেছেন তানভীর,‘ রামমোহন রায়ের উপনিষদীয় মানতাবাদকে ব্রাক্ষধর্মে সংস্থাপন করে প্রাচীন হিন্দু সংস্কৃতিকে নবজীবন দান করলেন। ইসলামের ক্ষেত্রে বাংলায় সেরকম কিছু ঘটলো না। ঘটেনি কোনো ‘রিফরমেশন’, বিজাতীয় আরবী ভাষায় লেখা ধর্মগ্রন্থ কোনো পথ দেখাতে পারেনি।’
এই পসঙ্গে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে দেখতে চেয়েছেন প্রচলিত আবেগময় দৃষ্টিভঙ্গিকে সরিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীর আর্থ-সামাজিক-দার্শনিক দৃষ্টিতে।
সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধেও তানভীরের বক্তব্য ও বিশ্লেষণ শুধু বৈদগ্ধ্যেই নয় মৌলিকতা ও প্রগতিশীলতার দিক থেকেও প্রশংসনীয়। মার্ক্সসিস্ট আলোয় যেভাবে শেক্সপিয়রের সাহিত্য রচনাকে লেখক বিশ্লেষণ করেছেন তা যেকোনো প্রথানুসারী সমালোচকের কাছে নতুন দিগন্তের দিশা দেখাতে পারে।
তাঁর আলোচনায় হ্যামলেট, কিংলিয়রেরা নতুনতর মাত্রা লাভ করেছে। দেখিয়েছেন, গভীর সমাজদৃষ্টি না থাকলে বলা যায় না,-‘ঝলমলে পোশাক ঢেকে রাখে সব কিছু।’ শেক্সপিয়রের লোকপ্রিয়তার কারণ হিসাবে সামনে এনেছেন সাধারণ দর্শকদের সঙ্গে তাঁর হার্দিক সম্পর্ক— মেঠো দর্শকের সঙ্গে শেক্সপিয়রের হার্দিক সম্পর্কটা বুঝতে হলে, কৃষিজীবনের সঙ্গে মেঠো দর্শকদের ও শেক্সপিয়রের, উভয়েই যে গভীর একটা আত্মিক সংযোগ ছিল, সে ব্যাপারটি বুঝতে হবে।
আরেকটি প্রবন্ধে পুরাণ থেকে শুরু করে আমাদের সাহিত্যে নারীর ভূমিকার ঐতিহ্যবাহী বিবর্তনটি তানভীর তাঁর নিজস্বভঙ্গিতে ব্যাখ্যা করেছেন। এখানে বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা ও আনন্দমঠের ‘বন্দেমাতরম’ এক চমকপদ মাত্রা পেয়েছে। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, শরত্চন্দ্র, তিন বন্দোপাধ্যায়ের নারীরাও অনুপস্থিত থাকেনি। এসেছেন সতীনাথ ভাদুড়ী, মহাশ্বেতা দেবী,সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। এই আলোচনার মধ্য দিয়ে লেখক অনেক কিছুর সঙ্গে আর্কিটাইপের সক্রিয়তাও প্রমাণ করতে চেয়েছেন, বিভিন্ন চরিত্রকে সামনে রেখে। শুধু তাই নয় বেগম রোকেয়া সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রমাণ করেছেন -(রোকেয়া) ‘…পরিণত বয়সে দেখি কেবল পুরুষকে শোষণের মূল উত্স হিসেবে না ধরে অন্যত্র, সমাজ ব্যবস্থাতেই, তিনি শোষণের উত্সটাকে খুঁজেছেন।’
‘তারাশঙ্কর, গান্ধীবাদ এবং বীরভূমের লাল মাটি’ প্রবন্ধে তানভীর তারাশঙ্করের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক উপন্যাসগুলির আলোচনায় এক অন্য তারাশঙ্করকে আবিষ্কার করেছেন। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক ঘরণায় তারাশঙ্কর ‘উদার গান্ধীবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত; তানভীর এই মূল্যায়নকে খণ্ডন করেছেন। ভূমিহীন কৃষক, শ্রমিক আন্দোলন, গ্রামীণ শোষণকে তিনি যেভাবে তুলে এনেছেন তাঁর সৃষ্টিতে তা তানভীরের কাছে মনে হয়েছে সম্পূর্ণ গান্ধীবাদী আদর্শের অনুসারী নয়; মার্কসাদী না হয়ে তারাশঙ্করের গভীর শ্রেণী চেতনা ও প্রগতিশীল মানসিকতা তাঁর সৃষ্টির প্রেক্ষিতে ব্যাখ্যা করে শিল্প-সাহিত্যের সৃষ্টির ক্ষেত্রে বামপন্থার সীমাবদ্ধতাও তুলে ধরেছেন তানভীর মূল্যবান প্রবন্ধে।
একজন সময়সচেতন মানুষ হিসেবে প্রাবন্ধিক বিশ্বায়ন-কে এড়াতে পারেন নি। এই বিশ্বায়নের ফলে শিক্ষাক্ষেত্রের সংকট যে আরও ঘনীভূত হচ্ছে তা রবীন্দ্রনাথের শিক্ষা চিন্তার প্রেক্ষিতে বিশদ আলোচনা করেছেন। সমকালীন শিক্ষাব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয়।
‘লালন ফকিরের ওপর সুফীবাদের প্রভাব’ ‘পথের দাবী’ রাজনীতি ও শরত্চন্দ্র’, ‘এলিয়েনেশন, মার্কসবাদ ও প্রসঙ্গ সাহিত্য’ প্রবন্ধ তিনটিতে প্রাবন্ধিকের বিপুল পান্ডিত্যের সঙ্গে সঙ্গে যে ভাবগভীরতা ধরা পড়ছে তা পাঠককে ঋদ্ধ করে, একই সঙ্গে সাবলীলতার কারণে মুগ্ধও করে।
বইটির প্রান্তিক প্রবন্ধটি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক-সামাজিক মতবাদ নিয়ে আলোচিত একটি সুলিখিত তাত্ত্বিক রচনা। এখানে ইতালিয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা আন্তোনিও গ্রামসির রাজনৈতিক সামাজিক মতবাদের অংশবিশেষ অত্যন্ত মননশীল ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই বিশ্লেষনের মধ্য দিয়ে বিপ্লব-সমাজ-সাংস্কৃতির প্রতি গ্রামসির মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি পূর্ণায়ত রূপরেখা মেলে।
তানভীর আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। শুধু বাংলাদেশের নন, সামাজিক ভাবেই তিনি বিশ্ব নাগরিক এং সেকারণেই এত যুক্তিবাদী। মুক্তমনা আর অসম্ভব বলিষ্ঠ। তাঁর বহুমুখি প্রতিভা সম্বন্ধে কমবেশি ওয়াকিবহাল থাকলেও এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি পড়ে তাঁর প্রতি আমার বিষ্ময় মিশ্রিত শ্রদ্ধা জেগেছে। বিপুল পড়াশোনা, বিশ্লেষণী ক্ষমতা ও সংস্কার মুক্ত বাস্তববাদী, মানবতাবাদী মানুষটির আলোচ্য গ্রন্থটি সৎ পাঠকের কাছে নিবিড় আত্মীয়ের মতোই মূল্যবান।
❤ Support Us