Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • জানুয়ারি ২৮, ২০২৪

পেট-কাটা-‘র’ বনাম নিচে ফুটকি দেওয়া ‘র’

যারা ভাষাতত্ত্ব বোঝেন না, ভাষা চর্চার ধারে কাছে যান না, তাঁরাই তৈরি করেন 'ভাষানিতি'। বাংলা আর অসমিয়ার প্ররোচিত সঙ্ঘাত নিয়ে এই কঠোর কটাক্ষ করলেন বহুমাত্রিক বিদ্যাদাতা

সঞ্জীব দেবলস্কর
পেট-কাটা-‘র’ বনাম নিচে ফুটকি দেওয়া ‘র’

সম্প্রতি রাজ্যে বাংলা হরফে বয়ের নিচে বিন্দু দিয়ে ‘র’ এবং অসমিয়া ‘পেটকাটা র’ নিয়ে অস্বাস্থকর চর্চা শুরু হয়েছে। এ অবশ্য নতুন কিছু নয়, আশির দশকে কাছাড়ে অনুষ্ঠিত এক বিরাট সাহিত্য অধিবেশনের মঞ্চ থেকেই নবপর্যায়ে এ দ্বন্দ্বের শুরু। ইতিপূর্বে বেণুধর রাজখোয়া প্রণীত Notes on the Sylhetee Dialect–কে ভিত্তি করে সিলেটি উপভাষা নিয়ে বাংলা ভাষার মধ্যে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হওয়ার সূচনা হয়েছিল, অতি উৎসাহী কিছু সিলেটি এ উপভাষাকে স্বতন্ত্র একটি ভাষা হিসেবে দেখা শুরু করেন। অবশ্য সিলেটিকে বাংলার উপভাষা নয় একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দেখার একটা প্রবণতা দেখা গেছে বেশ দীর্ঘদিন পূর্বেই। বলা বাহুল্য, এর সঙ্গে একটা আত্মঘাতী ভাষা-রাজনীতিও ক্রিয়াশীল যার উৎস সিলেট, কাছাড়ের প্রান্তিকভূমি ছাড়িয়ে বিলাত এবং ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় বিস্তৃত । তবে এ নিয়ে আলোচনার পরিসর এখানে নেই।

বলছিলাম, পেটকাটা-র দেখে মধ্যযুগে বরাকের লিপি এবং সঙ্গে বরাকে প্রচলিত বাংলা ভাষাকে অসমিয়া বলে প্রচার করার একটি প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। ভাষিক-সম্প্রসারণবাদীর সঙ্গে অবশ্য বরাকের কিছু সুযোগ সন্ধানীরও এ কর্মে সহযোগীর ভূমিকায় দেখা গেছিল। তবে যথাসময়েই যুক্তি তথ্য সহ এর উত্তরও দেওয়া হয়েছিল। এসব যুক্তি তর্ক তথ্য কি আর বেশিদিন জনগণের স্মৃতিতে থাকে? বিশেষ করে যে-সবের পেছনে থাকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা্র অভাব। এই তো ১৯৯৫ সালে শিলচরে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘উত্তর-পূর্ব ভারত ইতিহাস সমিতি’র ষোড়শ অধিবেশনে সভানেত্রীর আসন থেকেও ইতিহাসবিদ স্বর্ণলতা বরুয়া মাইবং প্রস্তর লিপিতে পেটকাটা র’র উদাহরণ দিয়ে এটাকে অসমিয়া বলে প্রচার করার প্রয়াস পেছিলেন।

সম্প্রতি একটি চক্রের প্রয়াসে বিষয়টি আবার মাথা চাড়া দিচ্ছে, এসবের সমর্থকদের মধ্যে জুটেছেন কতিপয় বঙ্গভাষীও। এরা মুখে মিলন আর সম্প্রীতির বুলি আউড়ে উপর থেকে ছিটিয়ে দেওয়া কাঁচা পয়সা, পুরষ্কার, খেতাব, এবং সরকারি বেসরকারি কমিটির লাভজনক মেম্বারশিপ ইত্যাদি কুড়ানোর জন্য হাত পেতে আছেন। এদের কেউ গড়ে তুলছেন সাহিত্য সভা, সমিতি, কেউ বা আয়োজন করছেন নিত্য নতুন উৎসব, কেউ রয়েছেন সম্মাননা-প্রদান ব্যবসাকে আরো সুসংঘটিত করার চেষ্টায়।

সেই উননব্বইতে বরাক উপত্যকার অর্থাৎ সাবেক কাছাড়, বা হেড়ম্ব রাজ্য/ডিমাসা রাজ্যত্বকালীন প্রস্তরলিপি, রাজকীয় আদেশপত্র, সনন্দ, রাজসভাশ্রিত সাহিত্যকৃতির ভাষার বাঙালিত্বকেও খারিজ করে দিতে ওরা প্রয়াসী হয়ছিলেন। একটা ভাষার গোত্র সনাক্ত করতে হলে শুধুমাত্র লিপি নয়, বাক্য প্রকরণ (syntax), বা বাক্য গঠনের পদ্ধতি, ক্রিয়াপদ, ধাতু, অব্যয়, প্রত্যয়, পদ, পদান্তর, শব্দ এবং পরিভাষার প্রয়োগ এবং আরও অনেক কিছু বিচার করা প্রয়োজন। তা না করে এ সব কিছুকে উপেক্ষা করেই তাদের এ প্রয়াস। ওই পেটকাটা র-কে একান্তভাবে অসমিয়া লিপির একমাত্র নির্ণায়ক ধরে একদেশদর্শী বিদ্বজ্জনেরা ডিমাসা-কাছাড়ি রাজ্যের প্রস্তরফলক এবং দলিলের ভাষাকে অসমিয়া বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন, আর এতে সায় দিয়েছেন আরও কয়েকজনও (এর মধ্যে বলা বাহুল্য জনা কয়েক বঙ্গভাষীও সামিল হয়েছিলেন, দ্রষ্টব্য, স্মারকগ্রন্থ, অসম সাহিত্যসভা, হাইলাকান্দি অধিবেশন, ১৯৮৯)।

এটা ভুলে যাওয়া যায় না, আগে খোদ অসমিয়ারা তাঁদের লিপিকে ‘বাংলা আখর’ই বলে অভিহিত করতেন। ‘অসমিয়া লিপি’ পরিভাষাটির প্রচলন একেবারে সাম্প্রতিক। ‘অসমিয়া লিপির’ এ সার্বজনিক ব্যবহার অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। আধুনিক এক অসমিয়া গল্পে ব্যবহৃত সংলাপে ‘বাংলা লিপি’ বলার উদাহরণটি ইতিপূর্বে চর্চায় এসেছে। অসমিয়া কথাকার মহিম বরার গল্প ‘তিনির তিনি গল’–এতে একটি সংলাপ আছে: ‘ইংরেজি স্কুলর দুটামান শ্রেণী তাহানি পড়িছিল। অবশ্য এতিয়া ইংরেজি কিয়, বাঙলা আখরো জোটাই পড়িব পারে’ । এই যে ‘বাংলা আখর’ বানান করে পড়ার কথা বলা হয়েছে এটা কোনও আরোপিত কিছু নয় বলাই বাহুল্য। অতএব লিপি নিয়ে অযথা বিবাদ করছেন যাঁরা এদের উদ্দেশ্য সন্দেহাতীত নয়।

এখানে কথাটি মনে রাখা প্রয়োজন, লিপি আর ভাষা কিন্তু এক বিষয় নয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইংরেজি লিপিতে (রোমান লিপিতে) যে-সমস্ত জনজাতীয় ভাষার বইপত্র লিখিত হয়েছে, লিপির সাক্ষ্য দিয়ে এগুলোর ভাষিক স্বাতন্ত্র খারিজ করা কি যায়? রোমান লিপিতে প্রকাশিত মিজো, খাসি, গারো, নাগা প্রভৃতি ভাষার গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা ইত্যাদিতে সেই ভাষাগুলো নিজস্বতায় ভাস্বর হয়ে আছে।

ইদানীং যেমন মাতৃভাষা-ছুট বাঙালি বা অসমিয়ারা সামাজিক মাধ্যমে নিরন্তর ইংরেজি হরফে স্টেটাস বা বয়ান দেন এগুলোকে কেউই ইংরেজি বলবেন না। এগুলো বাংলা বা অসমিয়াই থাকে।

বলছি পেটকাটা র নিয়ে যে সমস্ত দলিল, দস্তাবেজ, আদেশনামা (ভূর্জপত্র, তাম্রপত্র কিংবা প্রস্তরগাত্রে খোদিত) আবিষ্কৃত হয়েছে—এগুলোর লিপি বা হরফ নয়, ভাষাটা কী সেটাই বিবেচ্য।

আসা যাক কাছাড় প্রসঙ্গে। রাজধানী শহর খাসপুরে প্রস্তরলিপিতে পেটকাটা-‘র’ নিয়ে সর্বজনমান্য ঐতিহাসিক দেবব্রত দত্ত লিখেছিলেন—‘খাসপুরে প্রাপ্ত শিলালিপির পেটকাটা র–কে অসমিয়া কৃষ্টির নিদর্শন বলে গ্রহণ করা হাস্যকর, প্রাচীন বাংলাতেও পেটকাটা র-এর প্রচলন ছিল’। এ কথাটির বিরুদ্ধাচরণ করতে গিয়ে সাহিত্য সভার স্মরণিকাতে ড. রামচরণ ঠাকুরীয়া বলেন, ‘শ্রীদত্তের এই মন্তব্য কতখানি চিন্তাপ্রসূত, তা ভেবে দেখার বিষয়, কেন না প্রাচীন বাংলা লিপিতে র-এর ব্যবহার সম্পর্কে কিছুটা আলোচনার সুযোগ থাকলেও ওই শিলালিপি খোদিত হওয়ার সময় যে বাংলা বাংলা ভাষায় পেটকাটা ‘র’-এর প্রচলন ছিল না, তা ধ্রুব সত্য’।

এবারে বিতর্কে অবতীর্ণ হলেন ঐতিহাসিক সুজিৎ চৌধুরী (বরাক উপত্যকা প্রসঙ্গ: সত্য তথ্য, ১৯৯০)। তিনি লিপিগুলোর ঐতিহাসিক এবং ভাষিক চরিত্রলক্ষণ বিশ্লেষণ করে এ প্রচারের বিরুদ্ধে যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য উপস্থাপন করেন।

মনে রাখা প্রয়োজন, খাসপুরের প্রাপ্ত শিলালিপিগুলো অষ্টাদশ শতকের। শুধু খাসপুর কেন সোনাই বা স্বর্ণপুর চন্দ্রগিরিতে ভুবনেশ্বর শিব মন্দিরগাত্রে দুটো প্রস্তরলিপিতেও (১৭৮৫) পেটকাটা –র এর উজ্জ্বল উপস্থিতি।
আর পূর্ববঙ্গে (এবং পশ্চিমবঙ্গেও) প্রাপ্ত মধ্যযুগের শত শত পুথি– যা এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রহশালা এবং শিলচর নর্মাল স্কুল সংগ্রহশালায়ও রক্ষিত আছে এতে পেটকাটা র ছাড়া নিচে ফুটকি দেওয়া কোন র-অস্তিত্বই নেই। এ সবই যদি অসমিয়া বলে দাবি করা হয় তবে উত্তরে মৌন থাকাই শ্রেয়।
ডিমাসা রাজ্যের মুদ্রা ছাড়াও দানপত্র নিয়োগপত্রেও পেটকাটা-র বিদ্যমান। কাছাড়ের বড়খলার মণিরামকে ১৬৫৮ অর্থাৎ ১৭৩৬ খ্রিস্টাব্দে উজির নিযুক্ত করে মাইবং রাজসভা থেকে মহারাজ কীর্তিচন্দ্র প্রদত্ত বাংলা সনন্দে পেটকাটা র–এর উজ্জ্বল উপস্থিতি। এই মণিরামের অধস্তন পঞ্চম পুরুষ (বর্তমান লেখকের পিতামহ) জগমোহন দেবলস্কর এবং তস্য ভ্রাতা জীবনকৃষ্ণ নিজ হাতে ১৩৭ পৃষ্ঠার একটি ‘পদ্মপুরাণ’ গ্রন্থের নকল (সঙ্গে নিজস্ব সংযোজনও) করেছেন ১২৮৫ বঙ্গাব্দে (১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে), এতে সব র-ই পেটকাটা।

১৪৯৮ শকাব্দ অর্থাৎ ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে মাইবাং পাষাণপ্রাচীরে যে লিপির কথা স্বর্ণলতা বরুয়া মহোদয়া বলেছেন, মহারাজ মেঘনারায়ণ স্থাপিত সিংদ্বারে খোদিত লিপির রয়ের পেট কাটা: “শুভমস্তু শ্রীযুত মেঘনারায়ণ দেব হাচেঙ্গসা বংশতঃ জাত (ৰ) রাজা হৈ মাইবাঙ্গ ৰ(আ) জ্যত পাথরে(ৰ) সিঙ্গদ্বার বন্ধাইলেন শকাব্দাঃ ১৪৯৮ বিতেরী (ৰ )খ আষাঢ় ২৪”।

পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের রাধাশ্যাম মন্দিরগাত্রের লিপিতে (১৭৫৮), বর্ধমানের শ্যামচাঁদ মন্দির গাত্রে (১৭৬৫), মুর্শিদাবাদে শিবমন্দির এবং অষ্টভূজা গণেশমন্দির গাত্রে খোদিত (১৭৭২) প্রস্তরলিপিতে এই পেট কাটা-র রয়েছে। এর চিত্রের প্রতিলিপি এখানে দেওয়া হল।

বাংলা ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ পুথির (বাঁকুড়ায় প্রাপ্ত)-রও পেটকাটা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস গ্রন্থে প্রাচীন বাংলা লিপির ফটো কপি রয়েছে। এসব বিবেচনায় বলা যায় অষ্টাদশ শতকে কেন, এর পূর্বে এবং অব্যবহিত পরেও বাংলা পেটকাটা র-এর প্রচলন ছিল-না বলে যে দাবি করা হয়েছে তা কোন অ্যাকাডেমিক বা বৈজ্ঞানিক উপস্থাপনা নয়, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপপ্রচার মাত্র।

কাছাড়ের প্রস্তরলিপি, দানপত্রে পেটকাটা-র বড়াইল পাহাড়ের ওপার থেকে নয়, এসেছে পূর্ববঙ্গের উত্তরাধিকার সূত্রে, যে পূর্ববঙ্গে –‘র’ -প্রথমাবধি পেট-কাটা বই আর কিছুই নয়। আর কে না জানে কাছাড় যে ভৌগোলিক ভাবে গাঙ্গেয় সমভূমির সংযুক্ত। ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায়ের কথায়—‘বরাক ও সুরমা নদীর উপত্যকা তো মেঘনা-উপত্যকারই (মৈমনসিং-ত্রিপুরা-ঢাকা) উত্তরাংশ মাত্র। এই দুই উপত্যকার মধ্যে প্রাকৃতিক সীমা কিছু নাই বলিলেই চলে’ (বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদি পর্ব, প্রথম প্রকাশ ১৩৫৬ বঙ্গাব্দ, খ্রি: ১৯৪৯)।

এ জন্যেই কাছাড়ে নিজস্ব ভাষা, লিপি, সংস্কৃতি নিয়েই বাঙালি জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক বিস্তার।
এত কথা বলা এজন্যেই যে শুধু পেটকাটা–র এর উপর ভিত্তি করে একটা লিপির অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কোনমতেই যুক্তিযুক্ত হতে পারে না। ডিমাসা রাজসভা থেকে ব্রিটিশ রেসিডেন্সকে যে চিঠিগুলো লেখা হয়েছে অষ্টাদশ শতকে এতে পেটকাটা র থাকলেও এর ভাষা পরীক্ষিত ভাবেই বাংলা। এ রাজসভা থেকে আহোম রাজদরবারে প্রেরিত পত্রগুলোর ভাষাও যেমন বাংলা, তেমনি আহোম রাজসভা প্রেরিত চিঠিগুলোর ভাষাও আংশিকভাবে বাংলা– এটা ঐতিহাসিক সূর্যকুমার ভুঁইয়াই লিখে গেছেন—…‘the business portion of the letter is Bengali’। এ নিয়ে বিবাদের তো কোন কারণই হতে পারে না। যা হতে পারে তা হল এর মধ্যে নিহিত পাঠসুখ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। এসব বাদ দিয়ে জাতি বিদ্বেষ, অসুস্থ ভাষাবিদ্বেষের অনুশীলন আর কাঁহাতক চলবে?
আপাতত কয়েকটি ঐতিহাসিক পত্রের পাঠসুখ উপভোগ করা যাক। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে আহোম রাজ কমলেশ্বর সিংহ কাছাড়ের মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রকে কী লিখেছেন দেখুন…

বিশেষ সমাচার এহি, আমার দেশবিভ্রাট কালে শত্রু-পরাভত থাকি দেশস্থ প্রাণি সকল ভাগি গৈয়া বরমুরা এবং ভগনীয়। প্রজা ও মোয়ামারিয়া আপন দেশত সোমাই আসীল। ইত্যাদি …(তুংখঙ্গিয়া বুরঞ্জী, পৃ.১৩৭)
ঘটনাটি হল, আহোম রাজ্যের কিছু বিদ্রোহী কাছাড়ে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছে– এই সাদা কথাটি মহারাজের গোচরে এনে পত্র মারফত এদের হস্তান্তর করতে অনুরোধ করা হচ্ছে …‘তেবেতো পূর্ব্ব পিতা-পুত্র সম্বন্ধ রক্ষা হয়, সকল ধর্মে রক্ষা পায়’। এর পরের বাক্যগুলো লক্ষণীয়-‘যদিস্যাৎ সেই বরমুরা এবং ভগনীয়া ও মোয়ামারীয়া ছাড়ি দেয়না অবে যি হবে তাহা আপনে চাক্ষু দেখিবেন। আর পত্র-চিহ্ন দিতেছি পশ্যিবেন’। বিদ্রোহীদের ফেরৎ না দিলে পরিণাম যে ভালো হবে না, আহোম রাজের পক্ষ্য থেকে এ হুমকিটা অবশ্য বাংলাতেই বলা হল।

মধ্যযুগে, বিশেষ করে আহোম রাজত্বকালে কাছাড়, জয়ন্তীয়া, কোচ, ত্রিপুরা রাজসভা এবং ইংরেজ প্রশাসকদের চিঠিপত্র, সন্দিপত্র, চুক্তি, দানপত্র ইত্যাদিতে বাংলা ভাষা একটি লিঙ্গা ফ্রাঙ্কা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। পণ্ডিতপ্রবর সূর্যকুমার ভুঁইয়া ‘তুংখঙ্গীয়া বুরঞ্জী’র ভূমিকায় এ প্রসঙ্গে লিখেছেন—
The business portion of the letters is in Bengali, mutilated to a great extent by the influence of Assamese syntax and vocabulary. Anyhow, they are good specimen of Bengali as it was used for court purposes outside Bengal.

এমতাবস্থায় পেট কাটা র-এর দৃষ্টান্ত দেখিয়ে এ লিপির বাংলা স্বকীয় চরিত্রলক্ষণকে অস্বীকার করা হাস্যকরই বটেই, আর এসব নিয়ে বাদানুবাদ নিতান্তই অস্বাস্থকর অনুশীলন।
বড়খলার মনিরামকে উজির নিযুক্তির সনন্দের ভাষাও লক্ষণীয়—(১) ‘আর বড়খলার চান্দলস্করের বেটা মনিরামরে আমি জানিয়া কাচারির নিয়মে উজির পাতিলাম—এতে অখন অবধি তুমার উজিরর বেটা অ নাতি ও পরিনাতি তার ধারাসূত্রক্রমে উজির হইয়া যাইব…এতদর্থে অভয় দিলাম…আর রাজ্যের মনুশ্য যে জনে উজিরর বাক্যের না চলে মেল দেওনে হেলা করিয়া দেয়রঙ্গ করে…তারে সর্বদণ্ড করিমু… ইতি শক ১৬৫৮ তারিখ ২৯ ভাদ্রশ্য।
সনন্দ- (২) আমার বংশে তুমার বংশরে পালন করিব মহা২ অপরাধ পাইলে ৭ শাঠ অপরাধ খেমিয়া উচিত দণ্ড করিমু …এই খাতিলজমা না ডুলিমু শত্য ৭…ইতি ১৬৫৮ তারিক ২৯ ভাদ্র অস্য– (হেড়ম্ব রাজ্যের দণ্ডবিধি, ১৯১০, গৌহাটি; দ্বিতীয় সংস্করণ বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন ২০০৬, তৃতীয় অসম প্রকাশন পরিষদ প্রকাশ ২০২২)।

ডিমাসা রাজার আরেকটা নালিশের বয়ান দেখুন —‘আমার মুলুকের লুক তোমার মুলুকে জাইতে পারে না তুমার মুল…আমার মুকুকে আসিতে না পারে এই বিসয়ে গরিব লোকের নালিশ নিমিত্যে আমার উকিল শ্রী খুসারাম দত্তকে পত্র দিয়া তুমার নিকট পাঠাইতেছি’। (গভর্নর জেনারেল সমীপে খাসপুর থেকে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, ১৭৯৬)
যে রাজসভার চিঠিপত্রের ভাষা বাংলা, স্বাভাবিক ভাবে বাংলাই এ রাজ্যের স্বীকৃত ভাষা বাংলাই, আর রাজ্যে বাঙালিদের বসতির প্রাচীনত্বও সন্দেহাতীত। লিপি নিয়ে অস্বাস্থকর সন্দেহের পরিপ্রেক্ষিতেই এত সব কথা বলা আরকি।

দু

আসলে বাংলা এবং অসমিয়া উভয় ভাষাই মূলত এক সূত্র থেকে উৎসারিত। বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যদের রচিত দশম শতকের ‘চর্যাপদ’ শুধুমাত্র বাংলা বা অসমিয়া নয়, ওড়িয়া-হিন্দি-মৈথিলি ভাষারও পূর্বসুরিও বটে। এ ভাষাগুলোর মধ্যে বাংলা এবং অসমিয়া লিপির মধ্যে তেমন কোন মৌলিক পার্থক্য নেই। এদের মধ্যে ঘনিষ্ট আত্মীয়তা বিদ্যমান।
আসল কথাটি হল, যুগের (প্রযুক্তিরও) বিবর্তনে অসমিয়া লিপিতে আদি পেটকাটা (মধ্যাংশে রেখা টানা) ‘র’- অক্ষরটি অপরিবর্তিত রয়েছে, কিন্তু বাংলায় ত্রিকোণাকৃতি ব-এর নিচে কালো ফুটকিটি এসে সূচিত করেছে একটি পার্থক্য। ঘটনাটি কবে, কী করে হল এ নিয়ে একটু আলোচনা করলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে। নিচে ফুটিকি দেওয়া র-এর ইতিহাসে একটু যেতে হচ্ছে। প্রথমেই বলে নিই র এর এ ফর্মটি একান্তভাবে মুদ্রণ প্রযুক্তির দান। শ্রীরামপুর খ্রিস্টান মুদ্রণালয়ে কাষ্ঠ এবং অতঃপর ধাতু দিয়ে হরফ তৈরির কাজে নিযুক্ত হয়েছিলেন পঞ্চানন কর্মকার (১৮০০খ্রিঃ)। এ মুদ্রণালয়ের সঙ্গে জড়িত ছিলেন (স্বত্বাধিকারীও ছিলেন হয়ত বা) ভাষাতাত্ত্বিক মিশনারি উইলিয়াম কেরি (১৭৬১-১৮৩৪)। পঞ্চানন অবশ্য আরেক মুদ্রণ বিশেষজ্ঞ, ভাষাতাত্ত্বিক স্যার উইলকিনসের ( ১৭৪৯-১৮৩৬) কাছেও ইতিপূর্বে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।

এই ছাপাখানার প্রয়োজনে নিজস্ব ফাউন্ড্রিতে হরফ তৈরির বরাত নিয়ে পঞ্চানন ত্রিকোণাকৃতি ফিগারের নিচে একটা ফুটকি লাগিয়ে কাজটি সহজ করে নিলেন। আর এমন সময়েই বাংলায় মুদ্রণযন্ত্রের ব্যাপক ব্যাবহার, মুদ্রণ শিল্পের বিস্ফার, নানা ধরনের বইপত্রের প্রকাশনার জোয়ারও আসে, নিচে ফুটকি দেওয়া র পূর্বের পেটকাটা রয়ের স্থলাভিষিক্ত হয়ে যায়। অপরদিকে কিন্তু অসমিয়া বইপত্রের মুদ্রণ সেই পূর্বের ধারাবাহিকতায় পেট কাটা র-তে স্থিত থাকে। এই হল দুটি ভাষার লিপির মধ্যে দৃশ্যগত মৌলিক পার্থক্য।

ক্রমে রাজা রামমোহন রায়, পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের আত্মপ্রকাশ কে কেন্দ্র করে বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগতে বিশেষ অগ্রগতি হয়, আমরা এদিকে আর না এগিয়ে স্মরণ করি বিদ্যাসাগর ১৮৫৫ সালে প্রকাশ করলেন ’বর্ণপরিচয়’। এ বইটির আখ্যাপত্রের ফ্যাক্সিমিলি কপির চিত্র এখন সহজলভ্য, দেখুন এখানে ব্যবহার হয়েছে নিচে ফুটকি দেওয়া র। বইটিতে বিদ্যাসাগর বর্ণমালার ক্রম যুক্তিসঙ্গত ভাবে সাজিয়েছেন যা আজও প্রায় অপরিবর্তিত রয়েছে। বলা প্রয়োজন এখানে এই ‘র’-এর রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতিও।

ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছিলাম বর্তমান লেখকের পিতামহ ১২৮৫ বাংলা, ৩১ জৈষ্ঠ্য (১৮৭৮ খ্রিঃ) পেটকাটা রই লিখেছেন ( দ্রষ্টব্য, Padmapuran: A Case study of a Manuscript of 1878 in Barak Valley in South Assam, by Sanjib Deblaskar, Manuscript and Manuscriptology in India, Kaveri Books, New Delhi, 2010)। বিশ শতকেও কিছুদিন এই ধারাটি বজায় রেখেছিলেন কাছাড়ে গ্রহাচার্যরা (যারা হাতে লিখে কোষ্ঠী তুলতেন), আদালতের মুহুরি আর পল্লিকবিরাও। এমতাবস্থায় শিলচর আদালতের মোহর লাগানো পুরনো জমির দলিলে ‘মুলুক কাছার’, ‘খরিদ’ ইত্যাদি শব্দে সাবেক র-এর উপস্থিতি দেখে কেউ যদি ভিরমি খান, আর পেট কাটা র- দোহাই দিয়ে বরাকের বাংলার বৈধতাকে কাঠগড়ায় খাড়া করান তবে আমাদের আর কী’ই বা বলার থাকতে পারে?

ভাষা নিয়ে এ দ্বন্দ্বের নিরসন কোন রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রী বা সরকারি আমলার কর্ম নয়। এ জন্যই চাই ভাষাতাত্ত্বিকের সাহায্য। আসলে আমাদের দেশে যাঁরা ভাষাতত্ত্ব বোঝেন না এরাই প্রণয়ন করেন ভাষানীতি। এখানেই সমস্যা। এ সমস্যার নিরসন করতে ভাষাপ্রেমী সবাইকেই বর্ণমালার বিবর্তন প্রক্রিয়াটি সম্বন্ধে প্রাথমিক কিছুটা ধারণা রাখতে হবে। নইলে মিথ্যা প্রচার আর উস্কানি মূলক তথ্য মানুষকে বিপথে চালনা করবে। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে একটা ছোট্ট বিন্দু থেকে সৃষ্টি হতে পারে একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। উত্তপূর্বাঞ্চল যে ভাষা, বর্ণমালা বিষয়ে বড্ড স্পর্শকাতর, এর প্রমাণ তো এই গত দুর্গাপূজার ব্যানার কাণ্ডেই পাওয়া গেল। পেটকাটা ‘–র’ এর হরফে প্রকট না হলে স্বয়ং বাবা কেদার নাথও নিরাপদ নয় এ রাজ্যে।

♦–♦♦–♦♦–♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!