Advertisement
  • খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
  • নভেম্বর ৩০, ২০২৪

ভারতীয় বহুত্ববাদকে বিভ্রান্তের পথে ঠেলে দেবে ওয়াকফ সংশোধন বিল

ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মস্থান রক্ষণাবেক্ষণ ও ধর্মপ্রচার ধর্মস্থান রক্ষা যে কোন সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার। যেভাবে ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪ কে আনা হয়েছে এবং আইনে পরিনত করার চেষ্টা হচ্ছে তাতে সংবিধানের একাধিক ধারাকে উপেক্ষা করা হবে

ম‌ইনুল হাসান
ভারতীয় বহুত্ববাদকে বিভ্রান্তের পথে ঠেলে দেবে ওয়াকফ সংশোধন বিল

 
লোকসভায় ৮ই আগস্ট ২টি বিল পাশ করা হয়। একটি ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৪, অন্যটি মুসলমান ওয়াকফ (প্রত্যাহার) বিল ২০২৪, সংশোধনী বিলটির উদ্দেশ্য নিয়ে বিরোধীদল গুলি খুবই সন্দিহান ছিলেন । তাঁরা প্রথমে বলেন কেন এই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে ? তারপর সরকারকে বাধ্য করেন বিলটিকে যুগ্ম সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে। যেখানে প্রায় সব দলের সদস্য আছেন। কমিটির সভাতেও উত্তপ্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়। আমাদের দলের সাংসদরা এই বিলের তীব্র বিরোধিতা করেন। বিজেপি একা এই বিলকে আইনে পরিনত করতে চান। কেন ? একটু গোড়ার কথা বলা যাক। ওয়াকফ সম্পর্কে সাধারণের ধারনা খুবই দুর্বল। যা, স্বাভাবিক। কোন ব্যাক্তি তার বৈধ সম্পত্তি ধর্মীয় কাজের ব্যবহারে ও অন্যান্য শুভ সামাজিক কাজে ঈশ্বরের নামে উৎসর্গ করলে সেটা ‘ওয়াকফ’। এই সম্পত্তির গ্রহীতা ঈশ্বর। সুতরাং ফেরত নেবার কোনও সুযোগ নেই। একবার ওয়াকফ মানে চিরদিন ওয়াকফ। ওয়াকফের ২/৩ রকম ভাগ বা রকমফের আছে। কোনটা পুরো ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়। কোনটা ধর্মীয় ও কিছুটা পরিবার এমন ধারা। এই সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ করবেন একজন মোতয়ালি। তাকে ঠিক করবেন ওয়াকফ বোর্ড।
 
ওয়াকফ ব্যাপারটা বহু পুরাতন। কোরানে ওয়াকফ নিয়ে কোন কথা নেই। অন্তত ২০ জায়গায় দান করার কথা বলা হয়েছে। একবার দ্বিতীয় খলিফা হজরত আবু বকর কিছু সম্পত্তি অর্জন করেন। তিনি সেটা হজরত মহম্মদ (সা.) কে দিতে চান । তিনি তো আবু বকরের জামাই ও। হজরত মহম্মদ (সা.) বলেন তাঁর এটা দরকার নেই। তিনি যেন সবার কাজে লাগে এমনভাবে এটা উৎসর্গ করেন ঈশ্বরের নামে। এটাই ওয়াকফ। আমাদের দেশে দিল্লির সুলতানি শাসনের সময় থেকে এটা চালু আছে। সুলতান মইজুদ্দিন সুলতানের জামা মসজিদ সুষ্ঠভাবে পরিচালনার জন্য ২টি গ্রাম ‘ওয়াকফ’ করেন মসজিদের নামে। সুলতানি আমলে ভারতে ওয়াকফ সংখ্যা বাড়তে থাকে । উনবিংশ শতাব্দীতে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে মামলা হয়। তা প্রিভি কাউন্সিল পর্যন্ত গড়ায়। চার জন সাহেব জজ মামলা শোনেন এবং ওয়াকফ বাতিল ঘোষণা করেন। ভারত সেটা গ্রহন করেনি। ১৯২৩ সালে মুসলমান ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। ওয়াকফ সম্পত্তি যাতে ভালভাবে রক্ষণাবেক্ষণ হয়, মুসলমানদের সার্বিক উন্নয়নে ব্যবহার করা হয় তার জন্য মাঝে মাঝে ওয়াকফ আইন পাল্টানো হয়েছে। ১৯৫৪, ১৯৯৫, ২০১৩ এবং ২০২৩ সালে। প্রত্যেকটা পরিবর্তনে মুসলমানরা খুশি হয়েছে। মুলত ১৯৯৫ সালে ওয়াকফ আইন মান্য হয়। সেটা পরিবর্তন করা হচ্ছে ২০২৪ সালে। মোট ৪৪টা সংশোধনী আনা হয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটি সমর্থন যোগ্য। কয়েকটি ইতিমধ্যে পুরনো আইনে আছে। বেশিরভাগ সংশোধনী শুধু মুসলমানদের আঘাত করবে তাই না দেশের গনতন্ত্র ও বহুত্ববাদের ওপর চরম আঘাত নিয়ে আসবে।
 

ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম মসজিদ, দরগা, ইদগাহ, কবরস্থান, খানকা, ইমামবাড়া, মাকবারা, আঞ্জুমান ইত্যাদি। তাছাড়া ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। শিক্ষা উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। শিক্ষা প্রসারে উৎসাহ দানে স্টাইপেণ্ড বা স্কলারশিপ দেওয়া হয়।প্রত্যেকটা রাজ্যেই ওয়াকফ বোর্ড পরিচালনার আইন ও কার্যাবলী আছে। যা কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইন ১৯৯৫ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৩৬ সালে বাংলায় প্রথম ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। তার প্রভাব কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইনের উপরে আছে। সারা দেশে মোট ৩২টি ওয়াকফ বোর্ড আছে।

 
ওয়াকফ মুখে ঘোষণা করেও করা হয় আবার দলিল তৈরি করেও। যিনি ওয়াকফ করবেন তিনি ওয়াকিফ।দান করা সম্পত্তি আইনত বৈধ হতে হবে। নতুন সংশোধনীতে সেটা উল্লেখ করা হয়েছে।এর কোন প্রয়োজন ছিল ? ওয়াকফ চারটি মাত্র শব্দ।ওয়াকফের অর্থ বোঝাতে কেন এই সংশোধনী বিল আনা হচ্ছে তার জন্য ৫০টি শব্দ ব্যয় করা হয়েছে। নতুন কথা হচ্ছে কার্যকারিতা বাড়ানো। কিন্তু শুধু নাম পালটালে তা সম্ভব নয়।
 
মুসলমানদের ব্যাক্তিগত আইনের সঙ্গে ওয়াকফ যুক্ত আছে। আবার ধর্মের স্বাধীনতা ও ধর্মস্থান রক্ষণাবেক্ষণ ও ধর্মপ্রচার ধর্মস্থান রক্ষা যে কোন সম্প্রদায়ের সাংবিধানিক অধিকার। যেভাবে ওয়াকফ সংশোধনী বিল ২০২৪ কে আনা হয়েছে এবং আইনে পরিনত করার চেষ্টা হচ্ছে তাতে সংবিধানের একাধিক ধারাকে উপেক্ষা করা হবে। সেই অর্থে একটি অসাংবিধানিক বিল আনা হয়েছে। ওয়াকফ সম্পত্তির আয় থেকে যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম মসজিদ, দরগা, ইদগাহ, কবরস্থান, খানকা, ইমামবাড়া, মাকবারা, আঞ্জুমান ইত্যাদি। তাছাড়া ইমাম ও মুয়াজ্জিনদের মাসিক ভাতা দেওয়া হয়। শিক্ষা উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। শিক্ষা প্রসারে উৎসাহ দানে স্টাইপেণ্ড বা স্কলারশিপ দেওয়া হয়। রাজ্য ওয়াকফ বোর্ডগুলি এমন পরিকল্পনা নেন। প্রত্যেকটা রাজ্যেই ওয়াকফ বোর্ড পরিচালনার আইন ও কার্যাবলী আছে। যা কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইন ১৯৯৫ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ১৯৩৬ সালে বাংলায় প্রথম ওয়াকফ আইন তৈরি হয়। তার প্রভাব কেন্দ্রীয় ওয়াকফ আইনের উপরে আছে। সারা দেশে মোট ৩২টি ওয়াকফ বোর্ড আছে।
 
একটি অসত্য প্রচার সরকারের পক্ষ থেকে নির্বিচারে করা হচ্ছে যে দেশে প্রতিরক্ষা ও রেলের পরে সব চাইতে বেশী সম্পত্তির মালিক ওয়াকফ বোর্ডগুলি। ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসের হিসাব অনুযায়ী ভারতের ৮.৭ লক্ষ স্থাবর ওয়াকফ সম্পত্তি আছে। ভারতে সারাবিশ্বের মধ্যে সব চাইতে বেশী ওয়াকফ সম্পত্তির দেশ। ২০০৬ সালে সাচার কমিটির হিসাবমতে এই সম্পত্তির মূল্য ১.২ লক্ষ কোটি টাকা। সম্পত্তি কিন্তু ওয়াকফ বোর্ডের নয়, সম্পত্তি ঈশ্বরের। ওয়াকফ বোর্ড দেখাশোনা করার দায়িত্বে। ২০০৫ সালে সম্পত্তিগুলি ডিজিটাইজ করার ব্যবস্থা হয়। ২০০৯-১০ সাল পর্যন্ত মাত্র ৪২% হয়েছে। সাড়ে ৩ লক্ষের কিছু বেশী। দেখা গেছে ৫৮৮৭৮টি সম্পত্তি বেদখল আছে। নতুন বিলে ৩(বি) (১)-এ ৬ মাসের মধ্যে পুরো ডিজিটাইজ করার কথা বলা হয়েছে।হলে ভাল। দেশে হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তির একটা উদাহরণ দিই। তামিলনাড়ু ৪৭,৮০০ একর। অন্ধ্রপ্রদেশ ৪,৬৫,০০০ একর। তেলেঙ্গানা ৮৭,২১৫ একর। মাত্র ৩টি রাজ্যে এই অবস্থা। বাকি দেশের খবর নিলে কত হবে ? প্রকৃত অর্থে ওয়াকফ সম্পর্কে মানুষের ভুল ও খারাপ ধারনা করার জন্য এটা করছে কেন্দ্রীয় সরকার। ওয়াকফ সম্পত্তির কোন গ্রহণযোগ্য দলিল কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে নেই। যা বলা হচ্ছে তা সাচার কমিটির রিপোর্ট থেকে অথবা প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর তথ্য থেকে।
 
আর একটি অসত্য কথা প্রচার করা হচ্ছে। মানুষের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বাড়িয়ে দেবার জন্য। যেটা বিজেপির বরাবরের কৌশল। ওয়াকফ বোর্ড যেকোনো সম্পত্তিকে ওয়াকফ সম্পত্তি বলে সহজেই ঘোষণা করে দিতে পারে, এটা একেবারেই সত্য নয়।সমস্ত ওয়াকফ সম্পত্তি বৈধ ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যা ঈশ্বরের নামে মানুষের সেবার জন্য দান করা হয়েছে। এই বিলের ৩এ ধারায় কারো বৈধ সম্পত্তি ওয়াকফ করা যাবে বলা হয়েছে। অধিকিন্তু ন দশায়। ইসলামের এটাই নির্দেশ। এই বিলে অযথা বাড়তি কথা বলা হয়েছে। ৩ (আর) (৪)-এ বলা হচ্ছে বিধবা, স্বামী পরিতক্তা ও এতিমদের সাহায্য করতে হবে ওয়াকফ সম্পত্তি থেকে। ইতিমধ্যে পুরনো ১৯৯৫-র আইনে বলা আছে মুসলমান আইন অনুযায়ী এই সব অংশের জন্য ইতিবাচক ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।
 
ওয়াকফ সম্পত্তি বেদখল হয়ে আছে প্রচুর। তা উদ্ধার ও সেই সম্পত্তি থেকে যে অর্থ উপার্জন হয়, তা সঠিকভাবে ব্যয় করার কথা সাচার কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল। তার কি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে ? সে সম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকার উদাসীন। দিল্লি স্টেশনের ৩ ও ৪ নম্বর স্টেশনের মধ্যে একটি মসজিদ আছে তা তুলে ফেলার জন্য তৎপরতা আছে। বেদখল ওয়াকফ সম্পত্তি উদ্ধারের পরিকল্পনা নেই।কলকাতা বিমানবন্দরের শেষপ্রান্তে ওয়াকফ সম্পত্তি ও মসজিদ নিয়ে বিতর্ক সবসময় আছে। কিন্তু সুস্থ সমাধানের রাস্তা নেই। কলকাতার টলিক্লাব, গল্ফক্লাব সহ বহু ওয়াকফ সম্পত্তি নামমাত্র ভাড়ায় কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ীকে দেওয়া হয়েছে যা অকল্পনীয়। এসব নিয়ে ভাবার সময় এসেছে। তা না করে ওয়াকফ সম্পত্তিকে সরকারি কুক্ষিগত করার প্রক্রিয়া চালু করা হয়েছে। তাই এমন বিল। যা আইন হতে যাচ্ছে। শুধুমাত্র মুসলমান নয় সব মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ধ্বংস হবে।
 
ওয়াকফে একজন সার্ভে কমিশনার থাকেন। সরকারই তার নিয়োগকর্তা। কোন সম্পত্তি ওয়াকফ তাতে তার মতামত ও পর্যবেক্ষণ জরুরি। কিন্তু সেটা চূড়ান্ত নয়। আরও অনেক মাধ্যম দিয়ে যেতে হয়। এবার এই পদ হটিয়ে জেলাশাসককে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে এই কাজের। শুধু স্মরন করিয়ে দিই কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্বিন্যাস কমিটি বলেছে জেলাশাসকদের ৬০ থেকে ৭০টি দায়িত্ব তা থেকে তাদের অব্যাহতি দেওয়া দরকার। এরপর যদি ওয়াকফের দায়িত্ব পড়ে তাহলে সোনায় সোহাগা। তিনি নিচুস্তরের কাউকে দায়িত্ব সঁপে কাজ শেষ করবেন সেটা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়।
 

১৯৯৭ সালে কর্ণাটক হিন্দু রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউট এ্যান্ড চ্যারিটেবেল এ্যাক্ট-এ বলা হয়েছে বোর্ডের সমস্ত সদস্য হিন্দু হতে হবে। কমিশনার, সরকারি আধিকারিক, মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক সকলেই হিন্দু। সরকার কোন অহিন্দুকে মনোনীত করতে পারবেন না। শুধু শিখ গুরুদ্বারার এক্ট ১৯২৫-এ বলা হয়েছে তাদের বোর্ডের সদস্য তো বটেই মুখ্য নির্বাহী আধিকারিককেও শিখ হতে হবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা হচ্ছে কেন ?

 
আগেই ছিল সংখ্যালঘু দফতরের মন্ত্রী। তিনি যেই হোন কেন কেন্দ্রীয় ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন। নতুন কিছু নয়। এই বিলে আবার নতুন করে বলা হয়েছে। কমিটি গঠনে বড় পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৫ এর আইনে ছিল নির্বাচিত ও মনোনীত মিলিয়ে ৮ থেকে ১২ জন সদস্য হবেন। তার মধ্যে মুসলমান এমপি ২জন, এমএলএ বা এমএলসি দুজন। আদালত থেকে একজন। মতোয়ালী। এখন এমপি ও এমএলএ একজন করে। দুজন ব্যবহারজীবী। রাজ্যসরকারের একজন অফিসার। বার কাউন্সিলে একজন। চেয়াপারসন ১ জন। হিসাব করে দেখা যাচ্ছে এগারো জনের মধ্যে ৭ জন অমুসলিম হতে পারে। বিলে বলা হয়েছে যে, যারা প্রফেশনাল আইনজ্ঞ এবং বার কাউন্সিলের প্রতিনিধি এবং মুখ্য আধিকারিক মুসলমান না হলেও চলবে। নতুন করে বলা হয়েছে মহিলা ২ জন থাকতে হবে। এটা আগের আইনে ছিল কমপক্ষে ২জন মহিলা। বেশি হতে কোন অসুবিধা ছিল না। এখন ২ জন নির্দিষ্ট করা হল। বোর্ডে অফিসার নিয়োগ সম্পর্কে সাচার কমিটির পর্যবেক্ষণ ছিল ওয়াকফ বোর্ডে এমন আধিকারিক যুক্ত করতে হবে যার ইসলামিক আইন সম্পর্কে যথাযোগ্য জ্ঞান আছে। যাতে সে ওয়াকফের বিষয়গুলো ভালকরে দেখাশোনা করতে পারে।
 
এবার একটু অন্যকথা বলি। ১৯৯৭ সালে কর্ণাটক হিন্দু রিলিজিয়াস ইন্সটিটিউট এ্যান্ড চ্যারিটেবেল এ্যাক্ট-এ বলা হয়েছে বোর্ডের সমস্ত সদস্য হিন্দু হতে হবে। কমিশনার, সরকারি আধিকারিক, মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক সকলেই হিন্দু। সরকার কোন অহিন্দুকে মনোনীত করতে পারবেন না। শুধু শিখ গুরুদ্বারার এক্ট ১৯২৫-এ বলা হয়েছে তাদের বোর্ডের সদস্য তো বটেই মুখ্য নির্বাহী আধিকারিককেও শিখ হতে হবে। মুসলমানদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা হচ্ছে কেন ? স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে যে এর পিছনে বিজেপির নিশ্চয়ই কোন বদ উদ্দেশ্য আছে। এবং আছেই।
 
অমুসলমানরা ওয়াকফ করতে পারে কিনা ? নিশ্চয় পারে। ১৯৯৫ সালের আইনে সেটার কোন ব্যবস্থা ছিল না। কিন্তু ২০১৩ সালে ওয়াকফ আইনে সামান্য পরিবর্তন ঘটিয়ে সেটা অনুমোদিত হয়েছে। কেন এটা করা হল ? অনেক হিন্দু রাজা বা অন্যান্যরা কবরস্থানের জন্য জমি দিয়েছেন। মাদ্রাসা পরিচালনার জন্য জমি দিয়েছেন বা অন্যান্য সম্পদ দিয়েছেন। সেটা কিভাবে বিবেচিত হবে ? এটা নিয়ে ২০১৯ সালে মামলা হয়। মহামান্য আদালত রায় দেন ইতিবাচক। সরকারের মনে কি এটাই আছে ? যে একারনে ওয়াকফ বোর্ডে অমুসলমানরাও থাকবেন। সবার প্রতি সম্মান রেখে বলছি এমন উদ্ভট চিন্তা কেবলমাত্র বিজেপি সরকারই করতে পারে। যাদের হাতে দেশ আর নিরাপদ নয়।
 

ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোন সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্য ৩ সদস্যের ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় । তাঁরা হবেন একজন বিচারপতি। তিনি প্রথন শ্রেণীর জেলা সেশন বা সিভিল জজ (সভাপতি)। একজন অতিরিক্ত জেলাশাসক পদের অধিকারী আর ইসলামি আইনের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। নতুন সংশোধনী বিলে ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞও রাখা হয়নি

 
আর একটি বিষয় খুব গুরুত্বপূর্ণ- এই বিলে যে সম্পত্তিগুলি ওয়াকফ হিসাবে ব্যবহার হয়ে আসছে কিন্তু দলিলপত্র নেই সেগুলোকে ওয়াকফ তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হবে। বাবরি মসজিদ সম্পর্কে রায় দেবার সময় বিচারকরা বলেছিলেন আমাদের বিচারব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ হিসাবে ব্যবহার করা সম্পত্তিকে মান্যতা দিয়েছে যদিও তাদের হাতে লিখিত কোন কাগজ নেই। দীর্ঘদিন ধরে ওয়াকফ সম্পত্তি হিসাবে ব্যবহার হওয়াটাকে প্রমান হিসাবে ধরতে হবে। যদি এই বিল পাশ হয়ে আইন হয় তাহলে জামা মসজিদের কাগজ বা দলিল চাওয়া হবে। দিল্লি রেল লাইনের মসজিদটির দলিল দেখতে চাওয়া হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের এটাই কি প্রকৃত উদ্দেশ্য ? বাবরি মসজিদ সম্পর্কে রায় দেবার সময় প্রধান বিচারপতি সমস্ত যুক্তি মুসলমানদের পক্ষে দিয়ে বলেছিলেন বহু বহুদিন ধরে হিন্দুরা ওখানে পূজাঅর্চনা করছে। আজ সেখানে রাম মন্দির হয়েছে। মুসলমানরা সেটা মেনে নিয়েছে। তাহলে নতুন ওয়াকফ আইন হলে সেই বাবরি মসজিদ কেস বিচার তো উল্টে যাবে। দেশের পরিস্থিতি কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বিজেপি সেটা সবাই বুঝতে পারছেন।
 
ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে কোন সমস্যা হলে তার সমাধানের জন্য ৩ সদস্যের ওয়াকফ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয় । তাঁরা হবেন একজন বিচারপতি। তিনি প্রথন শ্রেণীর জেলা সেশন বা সিভিল জজ (সভাপতি)। একজন অতিরিক্ত জেলাশাসক পদের অধিকারী আর ইসলামি আইনের বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি। নতুন সংশোধনী বিলে ধর্মীয় আইন বিশেষজ্ঞও রাখা হয়নি। সরকারের মনের ইচ্ছা বুঝতে বোধ হয় আমাদের অসুবিধা হচ্ছে না।
 
আর একটা বিষয় বলা অত্যন্ত জরুরি, নতুন বিলের ১৯ নম্বর ধারাতে একটা প্রস্তাব করা হয়েছে। যাতে ওয়াকফ সংক্রান্ত ব্যাপারে ওয়াকফ বোর্ডের ক্ষমতাকে কমানো হয়নি শুধু। রাজ্য সরকারের ক্ষমতাও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৯৫ এর আইনের ৩৭ নম্বর ধারা সংশোধন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তারা ভুলে গেছেন যে আমাদের সংবিধান জমি সংক্রান্ত বিষয়কে রাজ্যের এক্তিয়ারের অন্তর্ভূক্ত করে রেখেছে। জোরের সঙ্গে বলব যে, ওয়াকফ (সংশোধনী) বিল ২০২৪ একটি সংবিধান বিরোধী পরিকল্পিত হস্তক্ষেপ।
 
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতে মুসলমান শাসকদের সময় থেকেই ওয়াকফ সম্পত্তি বাড়তে থাকে। আবার এটাও সত্য যে ওয়াকফ সম্পত্তি নিয়ে অনেক দুর্নীতি হয়েছে। বিজেপি সেটাই বলছে আসল কথা বাদ দিয়ে। আলাউদ্দিন খিলজি (১২৯৬-১৩১৬) দুর্নীতিগ্রস্ত মোতোয়ালিদের চরম শাস্তি দিয়েছিলেন। মানুষের লোভ সমাজে আছে। তার শাস্তির নিয়ম ও আছে। আকবরের আমলেও এমন ঘটনায় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। সুতরাং এসবকে অজুহাত করে এমন একটা কালা বিল আনা যায় না।
 
আমাদের পার্টি সর্বভারতীয় তৃনমূল কংগ্রেস প্রথম থেকেই এই বিলের প্রতিবাদ করে আসছে। নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার কড়া মনোভাব ব্যক্ত করেছেন। সংসদীয় কমিটিতে ২ জন সাংসদ শ্রী কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায় ও নাদিমুল হক তাদের যোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। দেশের কোটি কোটি মানুষের মধ্যে বিভেদ ও হিংসা সৃষ্টি করার জন্য নরেন্দ্র মোদি সরকার এসব করছে। প্রথমেই বলেছি এই আইন চালু হলে দেশের গনতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুত্ববাদকে দূষিত হবার পক্ষে যথেষ্ট হবে। অপমানিত হবে আমাদের শ্রদ্ধার সংবিধান। আসুন, প্রতিবাদের মিছিলে শরিক হই।দেশের মহৎ কাঠামোর ইজ্জত রক্ষা করি।
 

♦⋅⋅♦♦⋅⋅♦♦⋅⋅♦

 
ড. মইনুল হাসান, প্রাক্তন সাংসদ এবং পশ্চিমবঙ্গ পরিবহন নিগমের চেয়ারম্যান


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!