Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • এপ্রিল ৩, ২০২২

অন্য ভাষা ভিন্ন স্বর

পর্ব ৯

অংশুমান কর
অন্য ভাষা ভিন্ন স্বর

annya-bhasa-bhinnya-swr


গত শতাব্দীর ত্রিশের দশক থেকে, বিদেশি ভাষার বহু স্বর, বহু সুর, নানা রকম ভাষাভঙ্গি আর বহুমাত্রিক বিষয়ের সংযোজনে ঋদ্ধ হয়েছে আমাদের কবিতা পাঠের মগ্ন চেতনা। কিন্তু এই উপমহাদেশের উত্তর আর দক্ষিণ, পূর্ব আর পশ্চিমের কবিতা, কবিতা ভাবনা দূরে পড়ে রইল এখনও । কেন ? ভারতীয় ভাষাচর্চায় অনীহা, না এক প্রতিবেশীর সঙ্গে আরেক প্রতিবেশীর, আরোপিত প্রকান্তরে অনুশাসিত দূরত্বই তৈরি করেছে অপরিচিতির চৌহদ্দি ? যুক্তিপ্রসূত জিজ্ঞাসা নিয়ে উপমহাদেশের বিভিন্ন ভাষার কবিতার ধারাবাহিক তরজমায় প্রতিস্পর্ধী, সমান্তরাল চিন্তার বিশিষ্ট সহযোগী অংশুমান কর


র মা কা ন্ত  র থ

আধুনিক ওড়িয়া কবিতার অন্যতম প্রধান এই কবির জন্ম ১৯৩৪ সালে, কটকে। এলিয়ট এবং পাউন্ডের প্রভাব তাঁর কবিতায় পড়েছিল। ভারতীয় পুরাণ ও ইতিহাসকে নানাভাবে তাঁর কবিতায় ব্যবহার করেছেন রমাকান্ত রথ। বেদনা এক ফল্গুধারার মতো তাঁর কবিতার তলদেশ দিয়ে প্রবাহিত৷ সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, সরস্বতী সম্মান ও পদ্মভূষণ সম্মানে তিনি ভূষিত৷ পেয়েছেন সাহিত্য অকাদেমি কর্তৃক প্রদত্ত সর্বোচ্চ সম্মান সাহিত্য অকাদেমি ফেলোশিপ। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সাহিত্য অকাদেমির সভাপতি। পেশায় আইএএস অফিসার রমাকান্ত রথ ওড়িশা সরকারের মুখ্যসচিব হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন।

শ্রীরাধা

যখন আমি খবরটা পেলাম যে,
তুমি এসেছ
তখন বেলা অনেক।

আমাদের গাভীগুলিকে ততক্ষণে আমরা মাঠে
পাঠিয়েছিলাম
পুরুষেরা অনেক আগেই কাজে গিয়েছিল
মেয়েরা তৈরি হচ্ছিল নদীতে স্নান করতে যাবে বলে।
কোনও এক অজ্ঞাত কারণে পুরুষেরা ছিল
অস্বাভাবিক রকমের নীরব
আর মেয়েরা স্নানে যাওয়ার জন্য অনেক বেশি সময় নিচ্ছিল।
তারা কি, পথ হারিয়ে ফেলে আর নিজেদের শরীরের ভেতরেই পথভ্রষ্ট হয়ে, একটি বিদেশি আবাসে
বেঁচে থাকবার একটা পদ্ধতি খুঁজে পাওয়ার
চেষ্টা করছিল?
নাকি তারা, যারা নিজেরাই নিজেদের কাছে ছিল অচেনা,
খবরটা পাওয়ার আগেই জেনে গিয়েছিল যে,
তুমি আসছ?

সেদিন সকালবেলা আমি যখন স্নান করছিলাম,
আমি আমার পায়ের ভেতর দিয়ে জলের দিকে তাকিয়েছিলাম আর ভেবেছিলাম:
এই পাগুলো আমার নয়,
কিছুই আমার নয়, এই শরীরটাও আমার নয়,
আমার সমস্ত আশা আর হতাশার ইতিহাসটাও
আমার নয়।
আর আমার স্বামী, আমার ঘর, বেঁচে থাকবার অবলম্বন আমার গরু-বাছুর–
এরা কেউ আমার নয়। এমনকি এই জীবন বা
একদিন যা নিশ্চিতভাবেই যা আসবে সেই মৃত্যুও
আমার নয়। আমি
চিরকালের এক ভিখারি মহিলা, বাইরের পৃথিবীতে যা পৌঁছে যায় সেই বাহুদু’টির মধ্যে
বন্দি এক উপদ্রুত শূন্যতা।

চিরকাল এক শূন্যতা হিসেবে বেঁচে থাকাই
সম্ভবত কারও কারও অদৃষ্ট।

ওদের ঠোঁটে সারাক্ষণ তোমার নাম।
স্বাভাবিক, কারণ তুমিই ওদের শহরকে রক্ষা করেছিলে
যখন অবিশ্রান্ত বর্ষণ শহরটাকে প্রায় ভাসিয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলছিল একটা নদীতে
যে-নদী তাকে নিয়ে গিয়ে ফেলত আর একটা নদীতে
এবং, শেষ পর্যন্ত, সমুদ্রে।

এখন, ওদের গবাদি পশুগুলি, গোধূলিতে,
সংখ্যায় না-কমেই ফিরে আসে
আর ওদের শিশুরা একটুও ভয় না-পেয়ে
বনভোজনে যায়, দিঘিতে সাঁতার কাটে।

মাঝে মাঝে খবর পাওয়া যায়
পঙ্গু গিরি লঙ্ঘন করেছে।

দৈত্যদের বাহিনী তাদের ছায়া দিয়ে আর
দিনের আলোকে নিভিয়ে দেয় না।
মৃত্যুও আর শোক বা আঘাতের উদ্রেক করে না
কারণ বহুবছর ধরেই মৃতরা তাদের অবস্থান নিয়েছে
জীবনের সীমানার বাইরে।

কিন্তু যখনই আমি তোমার নাম উচ্চারণ করতে চাই
আমার জিভ শুকিয়ে আসে কেন?
কেন আর আমি পরিবার-পালনে
কিংবা গবাদিপশুর মালকিন হওয়ার মধ্যে
কোনও অর্থই খুঁজে পাই না?
আমি কখনওই নিজেকে বোঝাতে পারিনি যে,
চিরকালের জন্য এই শহরটার টিকে যাওয়া উচিত।

আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সেই পঙ্গুরা যারা আজ হাঁটতে পারে
তাদের থেকে তাদের অতীতকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবে কে?
যারা এখনও জন্মায়নি তাদের আর সুপ্রাচীন মৃত মানুষগুলির অশ্রু
মুছিয়ে দেবে কে?

আমি, এক বোকা মহিলা,
নিজেকে এইসব প্রশ্ন করি,
আর অপেক্ষা করি সেই মুহূর্তের
যখন এই কৃতজ্ঞ সুবিধাভোগীদের ভিড় মিলিয়ে যাবার পরে,
তুমি আমার পেছনে এসে দাঁড়াবে আর ফিশফিশ করে বলবে, কেবল আমার কানে কানে, সেই উত্তরগুলো
যা আমি চিরকাল শুনতে চেয়েছি,
আর সেই কল্পনাতীত শব্দ যা
এক কাল থেকে আর এক কালে ব্যাপ্ত হয়।

আর যখন আমি তোমার কথা শুনব, তখন
সন্দেহ করার, আরও একটি প্রশ্ন ধারণ করে থাকবে এইরকম একটি বাক্য নির্মাণ করার সময়
বয়ে যাবে।

চিত্র: দেব সরকার

  ওরা সবাই শুনেছিল, তুমি বাঁশি বাজাচ্ছিলে।
প্রতিটি গোপিনী ভাবছিল তুমি তাকেই ডাকছিলে।
ওদের প্রত্যেকেই পরেছিল নিজের যত গয়না আছে
আর যত রেশমের কাপড় এক একজন এই পৃথিবী থেকে জোগাড় করেছিল, সেই সব।
ওরা সবাই ফুল আটকেছিল চুলে,
চন্দনবাটা দিয়ে ছবি এঁকেছিল কপালে আর স্তনে,
চোখের পাতায় লাগিয়েছিল সুর্মা, সুগন্ধি মেখেছিল শরীরে,
আর তারপর, এটা বুঝতে না-পেরেই যে, তুমি আসলে নিখাদ শূন্য,
যে তুমি নিজে ছাড়া তোমার আর কোনওদিন কোনও সঙ্গী ছিল না,
নিজেদের ছুড়ে দিয়েছিল তোমার আলিঙ্গনে।
শরীরহীন এক প্রেমিক হিসেবে, রাত্রির মতো,
তুমি মুছে দিয়েছিলে
আসা আর যাওয়ার সমস্ত পথগুলো।

আমি তোমাকে চিনি,
আমার অসুখী, চঞ্চল প্রেমিক,
আমি তাই এসেছি সম্পূর্ণ শূন্যহাতে।

আমি তোমাকে স্পর্শ করব না,
তোমাকে দেখবও না।
যারা ঘুমোচ্ছে আর তারা যারা জেগে রয়েছে সদাসতর্ক
তাদের সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না।

যখন দুঃখ তোমার দমবন্ধ করে দেয়
আর তুমি বাঁশি বাজানো থামিয়ে দাও
আমি তোমার শব্দহীন ডাক শুনতে পাই
আর, বিশুদ্ধ নীরবতার মতো
তোমার কাছে আসি।

আমি কি জানি না যখন এই রাত্রি শেষ হবে তখন
আমি ঘরে ফিরে যাব? ফিরে যাব আমার মৃত্যুর কাছে?
আমি তবুও তোমার কাছে ফিরে আসব
কাল রাতে এবং তারপরের প্রতিটি রাতেই।
এবং ততক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে আসা বন্ধ করব না
যতক্ষণ না, আমাদের দুজনেরই মৃত্যুর অনেক দিন পরে,
তুমি আমাকে তোমার বাহুবন্ধনীতে আঁকড়ে ধরো
আর আমি সম্পূর্ণ ভাবে বিলীন হয়ে যাই
সেই শূন্যতায় যে শূন্যতা দিয়ে তুমি নির্মিত।

আমাদের প্রথম দেখা হওয়াটা ছিল এক স্বপ্নের ভেতরে:
তারপর পথের ওপর দিয়ে এই যাত্রা
যা কোথাও শুরু হয় না আর কোথাও শেষও হয় না।

আমি কিছু লক্ষ না-করেই হাঁটতে থাকি, আমার আর মনেই নেই
কতগুলো বাড়ি আর মানুষ আমি পেরিয়েছি।
কত ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছে আমি জানতামই না।
আমি নিজেকে নিজের থেকে লুকিয়েছিলাম।
যখনই আমি দেখেছি কোনও এক আশা এগিয়ে আসছে
অনেকগুলো বছর আর হতাশার ভার বহন করে,
আমি পথ বদলে নিয়েছি।

আমি গাছেদের থেকেও নিজেকে লুকিয়েছি।
তারা যদি আমাকে দেখতে পেত তাহলে তারা আমার পথের ওপর
স্তূপাকারে সুগন্ধি জমা করে
আমাকে থামিয়ে দিত।
যদি এক রাজপ্রাসাদে চিরকাল বন্দি থাকা এক রাজকুমারী হয়ে যাই, এই ভয়ে
আমি নদীর থেকে দূরে থেকেছি
দূরে থেকেছি যে-গল্পগুলো তার বলার ছিল
সেই গল্পগুলোর থেকেও ।

আমি নিজের রক্তের থেকেও নিজেকে লুকিয়ে থেকেছি ।
যখন যে-জীবন আমি বেঁচেছি সেই জীবন
আমার কাছে ভিক্ষা চেয়েছে, মিনতি করেছে,
আমি ভান করেছি যে, আমি তা শুনতেই পাইনি ।
আমি এগিয়ে গেছি, স্মৃতিহীন এক মানুষের মতো,
যখন স্মৃতি আর অনিঃশেষ অনুশোচনা
আনন্দের পোশাকের মধ্যে তাদের ভাররক্ষা করেছে ।

এই পথের ওপর আমি কী দেখি?
যা কিছুই দেখি তা মৃত্যুপথযাত্রী, যেন জরাগ্রস্ত অবস্থায় একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা ধ্বংসাবশেষগুলির ওপরে
বিচ্ছিন্ন অশ্রুকণাগুলি জমা হচ্ছে ।
আমার মনে হয় কিছু সময়ের জন্য
সবকিছু নিয়ে আমার থেমে যাওয়া উচিত
এবং এই মৃত্যুপথযাত্রীকে আদর করা উচিত
আমার কোমলতম দুঃখ দিয়ে ।
কিন্তু যে-স্থান এবং পথগুলি আমি নির্বাচন করেছি
সেগুলি দিয়ে যাওয়ার স্বাধীনতা ও সময়
তুমি আমাকে দাও না ।
আমার ক্ষতবিক্ষত শরীর, আমি সন্দেহ করি,
তোমার নির্দয় অভিলাষকে আনন্দ দেয় ।

তুমি কী চাও–
আমার আত্মা শতচ্ছিন্ন হোক
কারণ তা মনে রেখেছে আনুগত্যহীনতার
প্রতিটি মুহূর্তকে?
মৃত্যুপথযাত্রী চাঁদ আর বৃদ্ধদের মতো দেখতে হয়ে-যাওয়া শিশুদের জন্য
যে-সুদূর তমা একটি অশ্রুবিন্দুকে রক্ষা করে
তার ধ্বংসের জন্য:
তামাদি হয়ে যাওয়া ঔজ্জ্বল্যের স্মৃতির সঙ্গে
লড়াই করতে থাকা ফুলের জন্য,
অস্থির জন্য, অস্থির ওপরের মাংসের জন্য,
সেই ত্বক যা মাংসকে ঢেকে রাখে আর তুমি আসতে যে-সময় নিয়েছ তা অন্তহীন বলে
যা বিবর্ণ হয়ে যায়, তার জন্য?

সমস্ত কিছুর ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে
তুমি প্রতিটি ঘটনাকে অস্বীকার করো ।
জীবনে কখনও কাঁদোনি বলে, তুমি কোনওদিন বুঝতেই পারবে না
একটি অশ্রুবিন্দুর ভার মাথায় নিয়ে
আমার আজীবন তোমার দিকে এই যাত্রার অর্থ ।
তুমি এটাও কোনওদিন বুঝতে পারবে না যে,
হৃদয় কতখানি আনন্দিত হয় যখন সমস্ত অশ্রু মুছে যায়
ধীরে ধীরে
ফোঁটায়, ফোঁটায় ।

 

♦—♦—♦

যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে গত রবিবার রোব-e-বর্ণ প্রকাশ করা যায়নি, এজন্য আমরা দুঃখিত। আগামী ১৫ তারিখ থেকে অন্যভাষায় অন্যস্বর ধারাবাহিকটি প্রকাশিত হবে ১৫দিন অন্তর।

 


❤ Support Us
error: Content is protected !!