- ধা | রা | বা | হি | ক
- জানুয়ারি ৩০, ২০২২
কয়েকটি প্রেমের গল্প: |পর্ব ৩৪|
জীবনের রোজনামচায় আকস্মিক তার আগমন। স্থায়িত্বে কোথাও সে পূর্ণাঙ্গ, আবার কোথাও অসম্পূর্ণ। রূপক এ নয়, নানান জীবনচর্যায়, সেই পূর্ণ অপূর্ণের রূপ নিয়ে দেবপ্রিয় চক্রবর্তীর ধারাবাহিক কথামালা...
অলঙ্করণ: দেব সরকার
অজানা অতীত ও নতুন সহধর্মিনী ।
একটু গভীর রাতে বিছানায় আধশোয়া হয়ে হাতে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে স্ত্রীর অপেক্ষা করছিলেন বিমানবাবু । মাথার মধ্যে বেশ কিছু চিন্তা আর প্রশ্ন চলছিল তাঁর সন্ধ্যা থেকে । স্ত্রীকে ঘরে ঢুকতে দেখে ম্যাগাজিনটা বন্ধ করে রিডিং গ্লাসটা খুলে পাশে নামিয়ে রাখলেন । চুপচাপ অপেক্ষা করলেন প্রতিমার নৈশ প্রসাধন শেষ হবার ।
পুরনো আমলের কাঠের বড় ড্রেসিং টেবিলের নতুন লাগানো আয়নার কাঁচে স্বামীর প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে হাতে ক্রীম মাখতে মাখতে, পেছন না ফিরেই প্রশ্ন করলেন প্রতিমা, -‘কিগো কি ভাবছো ?’
অন্যমনস্ক ভাবে উত্তর দিলেন বিমান,-‘ভাবছি জয়িতা মেয়েটার কথা। মনে হচ্ছে ওর একটা অতীত আছে সেটা আমাদের জানা দরকার ।’
ঘুরে বসলেন প্রতিমা। স্বামীর দিকে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করলেন, তিনি কি বলতে চাইছেন। মুখে বললেন, -‘কি মনে হয় তোমার ?’
-‘আমার জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে ওর অতীতে এমন কিছু আঘাত আছে, যার ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে মেয়েটা । অরুর সঙ্গে জীবন জড়ায় যদি, তবে সেটা আমাদের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখলে চলবে না। একটু কথা বলো তো মেয়েটার সঙ্গে। অরুকেও সাবধান করে দিও।’
-‘কথা বলার কিছু নেই।’ উঠে এসে বিছানায় বসে বললেন প্রতিমা। -‘অতীতে কি হয়েছে তার সঙ্গে ওর ভবিষ্যৎ বা অরুর ভবিষ্যৎ – এর কি সম্পর্ক ?’
-‘এ কেমন কথা ? অতীত বাদ দিয়ে মানুষের জীবন হয় নাকি ? আজ একটা মানুষ কী সেটা তো তার অতীতেরই ফল। তুমি কথা বলো ওর সঙ্গে ।’ নিজের সিদ্ধান্ত জানালেন বিমানবাবু ।
-‘বলে নিয়েছি।’ মনে মনে স্বামীর কাছে সব খুলে বলার সাহস সঞ্চয় করে উত্তর দিলেন প্রতিমা।
-‘মানে ? তুমি জানো ওর কি হয়েছে ?
-‘জানি। প্রথমদিনই বলেছে আমাকে। অরুকেও বলেছে ।’
-‘কি বলেছে ?’
একটু সময় নিয়ে স্বামীর চোখের দিকে তাকিয়ে স্থির গলায় বললেন প্রতিমা, -‘ওর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল ।’
-‘হোয়াট !’ উত্তেজিত হয়ে বিছানায় সোজা হয়ে বসলেন বিমান । জয়িতার আগের বিয়ের খবরটা থেকেও তিনি আশ্চর্য হয়েছেন স্ত্রী সেটা আগেই জানেন বুঝতে পেরে । -‘তুমি জানতে ?’
-‘হ্যাঁ জানতাম ।’
-‘তবু ওকে বাড়িতে নিয়ে এলে ? আর অরুর সঙ্গে মেলামেশায় বাধাও দাওনি ?
-‘অরু ওকে ভালোবাসে। বিয়ে করতে চায় ।’
-‘চাইলেই হলো ? বিয়ে কি ছেলেখেলা ? অরু জীবনের কি বোঝে ?’
-‘অরু বড় হয়েছে । নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে গেছে । বিয়ের বয়সটাও হয়ে গেছে । অসুবিধেটা কোথায় ?’ বললেন প্রতিমা । অসুবিধে কোথায় তা ভালই জানেন তিনি, কিন্তু আজ যে একটা বোঝাপড়া এড়ানো যাবে না, সেটা বুঝতে পারছিলেন । এর জন্য তৈরি ছিলেন । কিন্তু সময়টা যে আজই সেটা জানতেন না ।
-‘একটা ডিভোর্সড মেয়ের সঙ্গে ওর বিয়ে কি করে মেনে নিচ্ছ তুমি ?’
-‘আচ্ছা গো তুমি তো মেয়েটাকে দেখছো ক’দিন ধরে । আমাকে বল তো, ওর জীবনের দুর্ঘটনাটাটা বাদ দিয়ে আর কি দোষ তুমি দেখেছ মেয়েটার মধ্যে ? বাড়ির সবাই পছন্দ করে ওকে । দেখতে শুনতেও ভালো। শিক্ষিত, স্বাধীন মেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা অরুকে সত্যিই ভালোবাসে ।’
-‘সেটা কি করে বলছো ?’
-‘কারণ অরু বিয়ে করতে চায় । ও রাজি নয় । ওর মতে এতে আমাদের বাড়ি নিয়ে লোকেরা সমালোচনা করবে । সেটা ও চায়না ।’
একটু নরম হল বিমানের সুর, -‘ঠিকই তো বলেছে । অরুর মতো যোগ্য একটা ভালো ছেলে । ওর জন্য অন্য ভালো মেয়ে কত পাওয়া যাবে ।’
বিমানের দিকে একটু সময় চুপ করে চেয়ে রইলেন প্রতিমা । তারপর ধীরে ধীরে বললেন –‘নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে । কিন্তু জয়িতা কি খারাপ মেয়ে ?’
– ‘আহা আমি তা বলছি না । কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারছো না একটা বিবাহিত মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক জড়ানটা ঠিক নয় ।’
-‘বিবাহিত নয় । ডিভোর্সড । ছেলেটার নিজের আগে একটা বিয়ে ছিল । সেটা লুকিয়ে বিয়ে করে । তাই ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে । এতে জয়িতার দোষটা কি ?’
স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে এক অচেনা দৃঢ়তা শুনতে পাচ্ছিলেন বিমান । জীবনে কখনো স্ত্রীকে তার বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনেননি । আজ কি হলো ? যেন তার মনের কথা বুঝতে পেরেই আবার বললেন প্রতিমা –‘হ্যাঁগো । আমি জীবনে কখনো তোমার কথার প্রতিবাদ করিনি । কেন জানো ? কারণ আমি জীবনে কখনো তোমাকে আমি ভুল বলতে শুনিনি । আমার তোমাকে নিয়ে এটা একটা বিরাট গর্ব ।’
কথাটা যে সত্যি সেটা বিমান ও ভালো করে জানেন। নিজের জীবনে কখনো বিবেকের সঙ্গে আপস করেননি তিনি । তা সে পারিবারিক বা পেশাদারী যে কোন ক্ষেত্রেই হোক না কেন । পৈতৃক ব্যবসা ছেড়ে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি আমলা হবার পরও কোন রকম অন্যায় নির্দেশের বা ওপর তলার চাপের তোয়াক্কা করেননি । তার ফলে চারপাশের লোকেদের কাছ থেকে প্রতিবাদ শুনে অভ্যস্ত নন তিনি, আর আজ হঠাৎ তার একান্ত অনুগত সহধর্মিণীর কাছে মতবিরোধের ভাষা শুনে অবাক হয়ে গেলেন ।
কিন্তু তা বলে গোঁয়ার্তুমি করার লোক নন তিনি । ঠান্ডা মাথায় ভেবে নিয়ে বললেন, -‘তুমি কি বলতে চাইছো খুলে বলো ।’
প্রতিমা বললেন, -‘আমি তোমাকে কিছুই কোনদিন শেখাতে চেষ্টা করি নি গো । আজো করবো না । কারণ আমার বিশ্বাস তুমি যদি নিজেই ভেবে দেখো তবে বুঝবে একটা দুর্ঘটনার শিকার মেয়েকে তোমার ছেলে যদি ভালবাসতে পারে তবে সেই মেয়েটা খুব সাধারণ মেয়ে নয় । ওর আমাদের পরিবারে আসার যোগ্যতা আছে সেটা তুমিও জানো । সুশিক্ষিত, নিজের পায়ে দাঁড়ানো ভালো পরিবারের মেয়ে । ওর বাবা হাইকোর্টের বড় উকিল । মা নামকরা গায়িকা । এখনো রেডিওতে প্রোগ্রাম করেন । তাছাড়া মেয়েটাকে তো দেখেছো । কিভাবে সবাইকে আপন করে নিয়েছে । যে ভুল বিয়েতে ওর কোনো অপরাধ নেই, সে জন্য শাস্তি তার প্রাপ্য কি ?’
অবাক হয়ে স্ত্রীর কথা শুনছিলেন বিমান । ছেলের পছন্দ করা মেয়ের জীবনের সমস্যার চেয়েও তার কাছে এখন বড় সমস্যা হল গভীর রাতে এত বছর এক সঙ্গে ঘর করা প্রিয়তমা সমর্পিত প্রাণ স্ত্রীর জায়গায় এ কোন মানুষ ? একে তো দেখেননি আগে ।
প্রতিমা আরো বলছেন, -‘আমি তো তোমার কাছে কখনো কিছু চাইনি, তার কারণ আমি না চাইতেই তুমি আমার সব চাওয়া পূরণ করেছ । এবার কি আমার ছেলের সুখের জন্য জেদ করতে হবে ? তুমি আমাকে বুঝিয়ে দাও, কোথায় তোমার আপত্তি ? কেন তোমার অমত ? যদি সেটা লোকনিন্দার ভয় হয় তবে সেটার তোয়াক্কা তুমি নিজের জীবনে তো কখনো করোনি । ছেলের জীবনে কেন ? আর কারণটা যদি হয় সাবেকী চিন্তার গোঁড়ামি তবে সেটা ঝেড়ে ফেলতে তোমার এক রাতের বেশি লাগবে না বলেই আমার বিশ্বাস । তুমি ভেবে দ্যাখো । কাল কথা বলব । ভোরবেলা উঠতে হবে, এখন ঘুমোও । কাল অনেক কাজ । বিসর্জনের পর বাড়িতে সবকিছু গোছাতে যা ঝামেলা সে তো জানোই । চল শুয়ে পড়ি ।’
স্ত্রীর ব্যবহারে নতুন ধরনের চমক কাটলো না বিমানের । আলো নিভিয়ে দুজনে শুয়ে পড়লেন । কিন্তু অনেক রাত পর্যন্ত ঘুম এলো না কারোই ।
❤ Support Us