Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২২

কয়েকটি প্রেমের গল্প: |পর্ব ৩৬|

জীবনের রোজনামচায় আকস্মিক তার আগমন। স্থায়িত্বে কোথাও সে পূর্ণাঙ্গ, আবার কোথাও অসম্পূর্ণ। রূপক এ নয়, নানান জীবনচর্যায়, সেই পূর্ণ অপূর্ণের রূপ নিয়ে দেবপ্রিয় চক্রবর্তীর ধারাবাহিক কথামালা...

দেবপ্রিয় চক্রবর্তী
কয়েকটি প্রেমের গল্প: |পর্ব ৩৬|

চিত্র : দেব সরকার ।

রাতের ছাত ও যোগ্য সহধর্মিনি

বিমান

কিছুক্ষন এপাশ ওপাশ করে বিছানা থেকে উঠে পড়লেন বিমান । সরল জীবনে হঠাৎ চলে আসা এই টানাপোড়েনে অভ্যস্ত নন তিনি । ঘুম আসছে না । টেবিলের ওপর থেকে জাগটা নিয়ে গ্লাসে জল ঢেলে গ্লাসটা নিয়ে ঠোঁটে তুলতে তুলতে শুনলেন প্রতিমার প্রশ্ন, -’কি হলো গো? ঘুম আসছে না ?’
-‘নাঃ তুমি ঘুমোও। আমি একটু বাইরে থেকে আসছি ।’
-‘এত রাতে কোথায় যাবে ?’ উঠে বসে বললেন প্রতিমা ।
আজ দিনটা আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মত নয় তাঁদের স্বামী- স্ত্রীর জীবনে সেটা তিনি ভালই বুঝতে পারছেন । স্বামীর মানসিক অবস্থা সামলানোর তার কাছে কোনো উপায় নেই । তিনি এও বুঝতে পারছেন যে, এটা তাঁর স্বামীকে নিজেই মীমাংসা করতে হবে ।
– ‘দেখি ছাতে একটু পায়চারি করে আসি, মাথাটা একটু ঠাণ্ডা হয় কিনা ।’
বাধা দিলেন না প্রতিমা কেবল বললেন, – ‘শালটা নিয়ে যাও। ঠান্ডা লাগিও না ।’
-’হুম ।’ বলে আলনা থেকে শালটা টেনে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন বিমান ।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাতের দরজাটা খোলা দেখে একটু অবাক হয়ে ছাতে উঠতে গিয়ে থমকে গেলেন । ছাতের ধারে অস্পষ্ট আলোয় দুটো অবয়ব, পাশাপাশি পেছন করে দাঁড়ানো । চোখ কুঁচকে ভাল করে দেখতে গিয়ে আন্দাজ করলেন নিজের ছেলে দাঁড়িয়ে এবং সঙ্গে নিশ্চয়ই সেই হঠাৎ অবাঞ্ছিত হয়ে যাওয়া তার সম্ভাব্য পুত্রবধূ । শহরতলীর রাতের নিস্তব্ধতার মধ্যে কথা শোনা যাচ্ছিল দুজনের । আড়ি পেতে কিছু শুনতে রুচিতে বাধল তাঁর । সাবধানে ওদের মনোযোগ আকর্ষণ না করে ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়িয়ে থেমে গেলেন তিনি ।
অরুণের গলা ।
—‘কিন্তু কেন এখনো তোমার এত ভয় জয়িতা ? সবাই তো পছন্দ করেছে তোমাকে । তুমি চাও না আমাদের বাড়ি আসতে ?’
উত্তরে জয়িতা বলছে, -‘তুমি ভুল বুঝো না অরুণ । আমার মনে পড়ে না জীবনে এর চেয়ে বেশী তীব্র ভাবে আমি আর কিছু চেয়েছি । তোমার বাবা- মা, পরিবার, পিউ, সোনু, কাকারা সবাই এত ভাল । এর বেশি কী চাইতে পারে একটা মেয়ে । কিন্তু যখনই আমার অতীত এঁরা জানতে পারবেন আমার পরিচয়টাই অস্পৃশ্য হয়ে যাবে এদের জন্যে । আর তোমাকে আমি আগেও বলেছি আমাদের বিয়ে তখনই সম্ভব যখন আমার এবং তোমার মা বাবা আশীর্বাদ করে এ বিয়ে দেবেন । তখন তো জানতাম না সেই লিস্টে ঠাকুমা আর কাকারাও আছেন । এখন জানি আর জানি বলেই বলছি আমার ভাগ্যে হয়ত এটা নেই । ওদের অমতে আমি তোমার স্ত্রী হতে চাই না ।’
অনুনয়ের স্বরে বলল অরুণ –‘আমি বোঝাবো সবাইকে। মা বাবা আমাকে খুব ভালোবাসেন । মা নিশ্চয়ই বাবাকে রাজী করাবেন। তুমি হাল ছেড়ো না প্লিজ ।’
বিমানের কানে এল ধরা গলায় বলা জয়িতার উত্তর –‘তুমি বুঝতে পারছ না অরুণ । এটা রাজি করানোর ব্যাপার নয় । আমি তোমার হয়েই গেছি । কিন্তু তোমাদের বাড়ির বউ আমি তখনই হতে পারব যখন ওরা বুঝতে পারবেন, আমার কোন অপরাধ নেই । যেমন প্রতিমা আন্টি বুঝেছেন। সারা জীবন দয়া বা করুণার ওপর একটা বিয়ে টিকতে পারে না । যদি আমি তোমাদের বাড়ির বউয়ের যোগ্যতা এবং সম্মান না পাই তবে মুখে বলা আশীর্বাদে যথেষ্ট হবে না । ওরা যদি আমাকে মন থেকে গ্রহণ করতে না পারেন তবে তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ রাখা সম্ভব নয় । আমাকে ক্ষমা করে দাও অরুণ। শুধু এইটুকু জেনো – আমি তোমারি থাকবো ।’
স্তম্ভিত বিমানের আর শোনার প্রয়োজন নেই ধীরে ধীরে নেমে এলেন তিনি । মনের অস্থিরতা অনেকটা কমে গেছে তাঁর ।
সাবধানে শব্দ না করে দরজা খুলে শোবার ঘরে ঢুকলেন । অন্ধকারে স্ত্রীর কণ্ঠস্বর শুনলেন ।
—‘কি হলো মাথা শান্ত হলো ?’
—‘ঘুমোওনি এখনও ?’ নরম গলায় প্রশ্ন করলেন বিমান ।
—‘মাথা কি আমারও শান্ত আছে গো ?’
ঘরের আলোর সুইচটা অন করে খাটে প্রতিমার দিকটায় এসে বসলেন বিমান । বললেন, –‘প্রতিমা তুমি জানো একটা পুরুষের জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য কি ?’
উঠে বসে খাটের মাথায় হেলান দিয়ে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চুপ করে চেয়ে রইলেন প্রতিমা ।
—‘সেটা হচ্ছে এমন একজন সহধর্মিণী পাওয়া যে শক্ত হাতে স্বামীকে ভুল রাস্তা থেকে ঠিক রাস্তায় নিয়ে আসতে পারে । আমাদের ছেলে খুব নরম ধাতের। ওর জন্য এমন একটা মেয়েই প্রয়োজন । তুমি ঠিকই বেছেছো ।’
হাসি ফুটল প্রতিমার মুখে । স্বামীর মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে স্বামীর মনে যে অশান্তির সৃষ্টি করেছিলেন তা তাঁকে ব্যথা দিচ্ছিল । বুকের ভারটা হালকা হয়ে গেল তাঁর ।
—‘আজ আমি ভগবান কে ধন্যবাদ দিচ্ছি প্রতিমা । একটা অজানা সৌভাগ্যের আশীর্বাদ আমাকে দেবার জন্য ।’
ছাতের ব্যাপারটা স্ত্রীকে বললেন বিমান । শুনে প্রতিমার মন্তব্য, -‘মেয়েটা সাধারণ নয়, সে আমি বুঝেছিলাম । ভগবান তোমাকেও দেখিয়ে দিলেন ।’
বিমান বললেন, -‘আজ এই সৌভাগ্যটার জন্য আমি ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ ।’
—‘ছেলের বউ পেয়ে গেছো বলে ?’
—‘না প্রতিমা । আমি ভগবানের কাছে কৃতজ্ঞ কারণ আমাকেও জীবনে সেই রকমই অসাধারণ একটা মেয়েকে দিয়েছেন বলে । তোমার চরিত্রের এই দিকটা আমি জানতেই পারতাম না যদি এই মেয়েটা না আসতো । আমি আমার নিজের ভাগ্যের কথা বলছি ।’
নববিবাহিতা বধূর মতো লজ্জায়, সুখে রাঙা হয়ে গেলেন প্রতিমা । সিকি শতাব্দি কেটে যাওয়া আটপৌরে হয়ে যাওয়া বিয়ের অনেকদিন পর । আজ আবার স্বামীর বাড়িয়ে ধরা হাতের আলিঙ্গনে ধরা দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হল তার ।

ক্রমশ..


❤ Support Us
error: Content is protected !!