Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২২

কয়েকটি প্রেমের গল্প

|পর্ব ৩৭|

দেবপ্রিয় চক্রবর্তী
কয়েকটি প্রেমের গল্প

চিত্র: দেব সরকার ।

জীবনের রোজনামচায় আকস্মিক তার আগমন। স্থায়িত্বে কোথাও সে পূর্ণাঙ্গ, আবার কোথাও অসম্পূর্ণ। রূপক এ নয়, নানান জীবনচর্যায়, সেই পূর্ণ অপূর্ণের রূপ নিয়ে দেবপ্রিয় চক্রবর্তীর ধারাবাহিক কথামালা…

আপত্তি ও রাজকুমারী

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠবার পর দালানের উঠোনে রোজকার মতো জমায়েত হয়েছে সবাই। রান্না ঘরে মেয়েদের সঙ্গে মিলে, সবার জন্য প্রাতরাশ এবং চায়ের তদারক করায় ব্যস্ত ছিল জয়িতা। তারই মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলেন বিমান – শুভস্য শীঘ্রম্‌। যদি বিয়েটা হতেই হয় তবে দেরি করার কোন মানে নেই। এই ভেবে দুই ছোট ভাই, এবং খুড়তুতো ভাইকে বললেন, -‘একটা আলোচনা ছিল তোদের সঙ্গে। বৌমাদেরও ডেকে নে। আমার কিছু বলার আছে তোদের সবাইকে।’
উঠোনে চার ভাই এবং তাদের স্ত্রীরা এসে জমায়েত হলে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললেন বিমান, -‘অরুণের স্ত্রী হিসেবে জয়িতাকে কেমন লাগে তোমাদের সবার?’
অরুণের ছোট কাকা বিভাস বলল, -‘ওতে আর লাগালাগির কি আছে বড়দা। সবকিছু তো স্থির করেই নিয়েছে ওরা দুজনে।’
-‘ওরা করলেই হবে না। বিয়েটা পুরো পরিবারের ব্যাপার। আমি সবার মতামত শুনতে চাই।’
যেন এতে আপত্তির প্রশ্ন নেই ধরে নিয়ে সবাই স্বল্প কথায় সম্মতি জানিয়ে দিল। জয়িতার মাবাবাকে যোগাযোগ করে আশীর্বাদের দিন পাকা করার কথাও বললেন অরুণের বড়কাকু। স্ত্রীয়েরাও খুশি মনে মত দিলেন সবাই। বিষয়টা খুব সহজেই হয়ে গেল।
সহজ যা ছিল না এবার বিমান প্রস্তুত হলেন সেটা জানানোর জন্য। আলোচনা যখন বিয়ের দিন আর আয়োজন এর দিকে মোড় নিয়েছে তখন বিমান বললেন, -‘এ বিষয়ে একটা কথা তোমাদের জানা প্রয়োজন। অবশ্য আমি মনে করি না তাতে বিয়েতে কোন প্রভাব পড়া উচিত। কিন্তু ব্যাপারটা সবার জানা দরকার।’
দালানের আশেপাশে কান খাড়া করে ঘুরঘুর করছিল সোনু এবং অরুণের বড়কাকার ছেলে সিদ্ধান্ত। এবার তারাও সচকিত হয়ে একটু কাছে এগিয়ে এলো। প্রতিমা ত্রস্ত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন বিমানের বক্তব্যের।
-‘জয়িতার এর আগে একটা জালিয়াতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল। সেটা বিচ্ছেদ হয়ে গেছে।’
প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হলো না।


তোর কান্নার দিন শেষ। এখন তো আর তুই আঁধার রাতের রাজকুমারী নোস। এখন তুই সেনগুপ্ত বাড়ির রাজকুমারী।


সেকি! ওমা কি বলছো দাদা? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন এবং স্বগতোক্তির মধ্যে এক হাত তুলে চুপ করাবার ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন বিমান। নিজের স্বভাবজ কর্তৃত্বের স্বরে বললেন, -‘এ ব্যাপারে কার কী বলার আছে বল। কিন্তু তার আগে আমি বলতে চাই। আমার মনে হয় এতে আশা করি আমার ভাবি পুত্রবধূকে অসম্মান করে কিছু বলার মত মানসিকতা তোমাদের কারো নেই।’
ছোট কাকা বিভাস বলল, -‘দেখো দাদা, তুমি যখন এখনই ওকে ভাবী পুত্রবধূ বলছো তার মানে তুমি মনস্থির করেই নিয়েছো। আমাদের জয়িতাকে অপমান করার প্রশ্নই ওঠে না। সেন বাড়ির অতিথি ও। কিন্তু ঘরের বউ করে তোলার আগে দশটা কথা ভেবে নেওয়া ভাল নয় কি?’
-‘এ ব্যাপারে আমার উত্তর শোনার আগে বাকিদের বক্তব্য শুনতে চাই আমি।’ বললেন বিমান।
প্রত্যেকেই নিজের নিজের দ্বিধার কথা বলল। তবে সামাজিক সংস্কারের বাধা ছাড়া কারোই অন্য কোনো কারণ নেই।
-‘তোমাদের সবার যা বক্তব্য সবই একই বিষয়। লোকে কি বলবে। বিভাস যা বলল তা ছাড়া আর কোন কিছু কারো যোগ করার আছে কি?’
ততক্ষণে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে পরিবারের সকলে। সবাই বুঝতে পারছে আজ সেন বাড়ির এক গুরুতর সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে এই দালানের উঠোনে। স্পষ্টতই জয়িতার প্রতি ব্যক্তিগত বিরূপতা কারো নেই। সেটা সবাই একমত।
বিমান বললেন, – ‘আমি অনেক ভেবেছি। অতীতের একটা ঘটনার জন্য এত ভালো একটা ভবিষ্যত নষ্ট হওয়ার কোন যুক্তি নেই। আশা করব ঠান্ডা মাথায় ভাবলে তোমরাও সেটা বুঝবে।’
-‘বোঝাবুঝির কি আছে বড়দা । আমাদের তো একটা পজিশন আছে। লোকে কি বলবে?’
-‘লোকের কথায় কোন অন্যায় না করেও যে পজিশন বিপন্ন হয় সেটার মূল্য কি বিভু?’ গম্ভির গলায় বললেন বিমান, -‘আমাদের যদি সত্যিই পজিশন থাকে তবে আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হওয়া উচিত।’
বিভাস তবু বলল, -‘বুঝতে পারছি না তুমি এটা এত লাইটলি কি করে নিচ্ছ বড়দা? মা এখনো বেঁচে আছেন। তাকে কি বলবে? কত দুঃখ পাবেন ভেবেছ? আর তুমিই বা কি বৌদি? এই সম্পর্কটার অনুমতি কি করে দিলে তুমি বলতো? সমাজের কথা, আমাদের পরিবারের কথা, আমাদের সারা শহরে এত নামডাক। সেসব কিছু ভাবলে না?’ -উষ্ণ স্বরে বৌদিকে বলল সে।

-‘ও সবই ভেবেছে। অনুমতিটা আমি দিয়েছি।’ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত কথাটা দালানে জমায়েত পরিবারের সব সদস্যদের স্তম্ভিত করে দিল।
একসঙ্গে ঘুরে তাকিয়ে সবাই দেখলো – বয়সের ভারে সামান্য ঝুঁকে দরজার চৌকাঠে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন পরিবারের কর্ত্রী মল্লিকা।
আশ্চর্য হওয়া স্বরে প্রশ্ন করলেন বিমান, -‘এ কি? মা, তুমি?’
-‘হ্যাঁ প্রথম দিনই এসে আমাকে সব বলেছে পুতু। আমিই বলেছি মেয়েটা আসুক। দেখি, বুঝি, যদি ঠিক মনে হয় আমি মত দেব। আমি তখন থেকে তোদের চেঁচামেচি শুনছি। আমার ঘর থেকে সবই শোনা যায়।’
মাকে ধরতে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বিমান। হাত তুলে তাকে ইশাররায় থামিয়ে দিলেন মল্লিকা। বললেন, – ‘এবার তোরা আমাকে বল মেয়েটার মধ্যে খারাপ কি আছে। আর দেখেশুনে খোঁজখবর নিয়ে তো অনেক বিয়ে হয়েছে এই বাড়িতে। কোথায় কার ঘরে কি হয় সব খবর আছে আমার কাছে।
কে কখন, কোথায় কী বলছে, সেই ভয়ে অরুর জীবনটা নষ্ট করার কি মানে হয়?
তাছাড়া গত ক’দিন ধরে তো ওকে মাথায় করে নাচ্ছিলি সবাই। জয়িতা এই, জয়িতা ঐ। বাচ্চা গুলো কেমন নেওটা হয়েছে দেখেছিস? আর তোরাই বা কি খারাপ দেখেছিস ওর মধ্যে? কোন একটা পাষণ্ডের হাতে জীবনে একটা দুর্ঘটনা না হয় ঘটেই গেছে মেয়েটার। তাই বলে মেয়েটা কি বদলে গেল? মানুষটা অন্য হয়ে গেল? শোন আমি বলে দিচ্ছি – যদি অরু বিয়ে করতে চায় আর ঐ ছুঁড়ী যদি রাজি হয় তবে এই বাড়িতে আমি দাঁড়িয়ে বিয়েটা দেব। যদি কারোর পছন্দ না হয় তবে আসিস না বিয়েতে।’
নিজের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে দিয়ে ঘুরে নিজের ঘরে ঢুকতে গিয়ে আবার ফিরে দাঁড়িয়ে জয়িতার উদ্দেশ্যে বললেন, -‘এই মেয়েটা চটপট আমাকে মিহি করে সুপুরি কাটা একটা পান সেজে দিয়ে যা তো এখুনি।’ বলে আস্তে আস্তে নিজের ঘরে ঢুকে পড়লেন সেন পরিবারের জমিদারবাড়ির প্রথম কলেজে পড়া গৃহবধূ মল্লিকা রানি দেবী।
এক ধারে মাথা নিচু করে নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকা জয়িতার কাছে এসে তার পিঠে হাত রেখে বললেন প্রতিমা, -যা ঠাম্মা ডাকছেন পানটা সেজে দিয়ে আয়।’
অনেক কষ্টে আটকে রাখা চোখের জলটুকু সামলে জয়িতা মল্লিকার ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। খাটে বসতে বসতে তাকে দেখতে পেয়ে সেই কাঠখোট্টা স্বরে বললেন বৃদ্ধা, -‘কিরে মেয়ে সারাদিন লাগিয়ে দিবি নাকি? চটপট পানটা সাজ। আর হ্যাঁ এবার যদি কিপ্টের মতো জর্দা দিবি তো বিয়েটা আবার নাকচ করে দেব।’
দেরাজের ওপর থেকে পানের বাটা নিয়ে বিছানায় রাখতে রাখতে এতক্ষণ ধরে চেপে রাখা কান্নাটাকে আর আটকাতে পারলোনা জয়িতা। ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে ফেলল।
-এখন আবার কাঁদিস কেন। তোর কান্নার দিন শেষ। এখন তো আর তুই আঁধার রাতের রাজকুমারী নোস। এখন তুই সেনগুপ্ত বাড়ির রাজকুমারী। আমার অরুকে সুখী রাখবি তো?’
– ‘প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করব ঠাম্মা । তুমি আশীর্বাদ করো যেন পারি।’ ভাঙা গলায় বলল জয়িতা ।
-‘আমি জানি তুই পারবি।’ জয়িতার মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে সজল চোখে হাসিমুখে বললেন মল্লিকাদেবী।

♦সমাপ্ত♦

 


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!