Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • মার্চ ৬, ২০২২

লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

পর্ব ২০

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার নাড়াজোল রাজবংশ । সেই রাজবাড়ির পরিখায় তরবারি হাতে পাহাড়া দিতেন স্বয়ং দেবী জয়দুর্গা । জনশ্রুতি তাঁর অসির জ্যোতিতে অত্যাচারি ইংরেজরা চোখ ঢাকত। বর্গীরাও এই জনপদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সেই দেবী জয়দুর্গার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এই ধারাবাহিক…

রাতের অন্ধকার যেন আরও বেশি গাঢ় হয়ে নেমে এসেছে নাড়াজোলের বুকে।ঘুম আসছিল না কারও চোখেই।রঙ্গীল আর তিন্নি মাম আর সুনন্দাদিদির সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে নেবার পর বারান্দায় গিয়ে দেখল সেখানে সকলেই তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।একটা কাঠের গোল টেবিল ঘিরে বেতের চেয়ারে বসে আছে সকলে।অমূল্যজ্যেঠু মাথা নীচু করে বসেছিলেন।রঙ্গীলকে দেখামাত্র অমূল্যজ্যেঠু সজল চোখে বলল,”শেষ রক্ষা হলো না রঙ্গীল।নূর আমার আশ্রিত।হতে পারে রাজার শক্তি বা রাজদণ্ড আমার নেই।তবু এই নাড়াজোলে আজ পর্যন্ত এমন ঘটনা কখনও ঘটেনি।”
– পুলিশ তদন্ত করছে তো জ্যেঠু!
– সে হয়তো করছে।কিন্তু ওই বিভীষণ মণ্ডলের ওপর আমার আর ভরসা নেই।এদিকে গোপাল বলছিল চন্দনকেও আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।তবে কি নূরের খুন হবার ঘটনার সঙ্গে চন্দনের নিখোঁজ হবার ঘটনার কোনও  যোগাযোগ রয়েছে?কিছুই যে বুঝতে পারছি না।
– যেই এই চক্রান্তের পিছনে থাকুক,ধরা সে পড়বেই।রঙ্গীল বলে।
বাপি বলল,’নূরচাচা মিজানকে কী বলতে চেয়েছিল জ্যেঠুকে বলেছিস?”
রঙ্গীল মাথা নাড়ে।এইটুকু সময়ে এতো কিছু ঘটে চলেছে  পরপর যে সে সেকথা বলবার সুযোগটাই পায়নি এতক্ষণ।অবশেষে সে বাপি বলার পর ‘কিই’ আর ‘ত্রিশূল’ ছবির কথা বলল।অমূল্যজ্যেঠু শুনে চিন্তিত হয়ে পড়ল।
– এর কি কোনও অর্থ খুঁজে পেলে রঙ্গীল?
– একটা সন্দেহ হচ্ছে জ্যেঠু।মন বলছে এই ‘কি’ শব্দর আগে কিছু একটা নূরচাচা বলতে চেয়েছিল।
তিন্নি লাফিয়ে উঠে বলে,’উল্কি নয় তো!”
সকলে ছোট্ট তিন্নির কথায় চমকে ওঠে।এই উল্কি নিয়ে একটা আলোচনা চন্দন করেছিল।সেই গল্প তিন্নি ঘরে শুনেছে।
– দারুণ তিন্নি।গোয়েন্দাগিরিতে তুমিও দেখছি পিছিয়ে নেই।সুনন্দাদিদি বলে ওঠে।রঙ্গীল বলতে থাকে।
– ঠিক।তিন্নির কথা ঠিক হলে ত্রিশূল আর উল্কির ইঙ্গিত একসঙ্গে দেওয়া মানে নূরচাচা সেই অদ্ভুত লোকটার কথা বলছে না তো যাকে চন্দন তার বাড়িতে রাতের অন্ধকারে দেখেছিল?সেই লোকটার ডান হাতে একটা ত্রিশূল আঁকা উল্কি দেখতে পেয়েছিল সে।
– তবে কি সেই লোকটাই নূর চাচাকে হত্যা করল?
– হতেই পারে।
– তাহলে বিভীষণকে একথাটা জানানো দরকার।ওর কাজে সুবিধে হবে।
– সেটা ঠিক।তবে আরও একটা খটকা লাগছে আমার।
– কী সেটা?
রথ চলে যাবার পর রাজবাড়ি চত্বর শুনশান।রাতের তারার আলোয় ছায়ানগরীর মতো সিংহতোরণ,মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির আর জয়দুর্গা মন্দিরের অবয়ব যেন রঙ্গীলদের কথোপকথনের নীরব সাক্ষী হয়ে রয়েছে।রঙ্গীলের হঠাৎ বিদ্যুত খেলে গেল মাথায়।
– তিন্নি।বল দেখি,কিই ইংরাজিতে কী হয়?
– চাবি!
– আর আমরা আমাদের সূত্র ধরে শেষ সমাধান পেয়েছিলাম মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির।তাই তো?এর অর্থ কী দাঁড়ায়?
সুনন্দাদিদি বলে ওঠে,”অর্থাৎ আমাদের গুপ্তধনের চাবি রয়েছে মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দিরে!”
– ঠিক তাই।জ্যেঠু।ওই শিবমন্দিরে এখন একবার যাওয়া যাবে?
অমূল্যজ্যেঠুসহ সকলেই রঙ্গীলের প্রস্তাবে তথমত খেয়ে যায়।বাপি বলে।
– এতো রাতে কেন যেতে চাইছ রঙ্গীল?সেটা কি নিরাপদ হবে?বরং কাল সকালেই যাই।ভোর ভোর।
রঙ্গীল একটু চিন্তা করে বলে,”আসলে এখানে আসার পর প্রথম দিন থেকেই আমার মনে হচ্ছিল আমাদের প্রতিটা নড়নচড়ন কেউ একটা চুপিচুপি দেখে চলেছে।প্রথমে ভেবেছিলাম চন্দন।কিন্তু নূরচাচা এইভাবে মারা যাবার পর এখন মনে হচ্ছে চন্দন নয়,এই কাজ অন্য কেউ করছে।”
– অন্য কে?
– তা জানি না।তবে আজ নাড়াজোল জুড়ে কড়া পুলিশ পাহারা।তাই সেই লোক বা লোকগুলো যারাই হোক,আজ তারা সহজে বার হবে না।এতো রাতে আমরা মন্দিরে যাব একথাও হয়তো ভাববে না।এখন জ্যেঠু,তুমি কি একটা ব্যবস্থা করতে পারবে?
অমূল্যজ্যেঠু ঘাড় নাড়ে।শিবমন্দিরের চাবি তার কাছেই থাকে।এখন সমস্যা দুটি।প্রথম রাতের অন্ধকারে মন্দিরের ভিতরে সবকিছু ঠিকঠাক দেখা যাবে কী?আর দ্বিতীয়টি হলো বাদুর।শিবমন্দিরে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ার ফলে আশপাশে বাদুর আর চামচিকের বাসা রয়েছে।তবে সব বাধা অগ্রাহ্য করেই ওরা ঠিক করল রাতেই একবার মৃত্যুঞ্জয় শিবমন্দির দেখতে যাবে।তিন্নি,মাম আর সুনন্দাদিদিদের রাজবাড়িতে রেখে রঙ্গীলরা তিনজন চলল মন্দিরের দিকে।বাদুর এড়াতে জোরালো আলো নেওয়া হলো না।বাপির মোবাইলের আলোই ভরসা।
               প্রাচীন মন্দিরে এই তারা ভরা রাতের অন্ধকারেও উজ্জ্বল পোড়ামাটির কাজ দেখে রঙ্গীল অবাক হয়ে গেল।যদিও অন্ধকারে সেই পোড়ামাটির ভিতর কী আঁকা বা লেখা আছে বোঝার উপায় তেমন নেই।দরজার চাবি অমূল্যজ্যেঠুর হাতেই ছিল।খুব সন্তর্পণে সেই দরজা খোলা হল।রঙ্গীল জানে এই বাদুররা দিনের আলোয় ঘুমোয় আর রাতে জেগে থাকে।মন্দিরে সাদা পাথরের উপর বড় কালো শিবলিঙ্গ ও তার পাশে একটি ছোট ত্রিশূল পোঁতা।রঙ্গীলের মনে হল নূর চাচার সাংকেতিক ত্রিশূল এই শিবমন্দিরে ত্রিশূল নয় তো!কিন্তু সেটা যদি হয়,তাহলে নাড়াজোলের রাজপুরুষেরা নিশ্চিত কোনও সংকেত ছেড়ে গেছেন সেখানে।সেই মতো মন্দিরে ত্রিশূলের চারপাশে মোবাইলের আলো ফেলে বাপি।হঠাৎ রঙ্গীল আনন্দে লাফিয়ে ওঠে।
– বাপি।ওই দেখ!
সকলে চমকে দেখে ত্রিশূলের এক পাশে শ্বেতফলকের উপর রাসমঞ্চর তৃতীয় দরজার উপর আঁকা সেই ‘শ্যাল্যুম্যু’র মতো অবিকল একটা ছবি।এখানেও সাতটি ত্রিশূল আর তফাতে একটি ত্রিশূল আঁকা।সেই ছবি মন দিয়ে দেখতে দেখতে রঙ্গীলের হঠাৎ যেন কী সন্দেহ হয়।সাতটি ত্রিশূলের সঙ্গে অষ্টম ত্রিশূলের সামান্য ফারাক রয়েছে।কিন্তু সেটা কী এই অন্ধকারে দেখা তার মনের ভুল!নিশ্চিত হতে পারে না সে।অমূল্যজ্যেঠু বলেন।
– তাহলে?এইবার রঙ্গীলবাবু?
– এইবার বাপি ওই ত্রিশূলটা খোলবার চেষ্টা করবে।
বাপি মুচকি হেসে ত্রিশূলটি ভালো করে দেখতে থাকে।তারপর বলে।
– আমার ক্রিপ্টোলজি পড়ে যে  অভিজ্ঞতা হয়েছে তার ভিত্তিতে বলতে পারি,এই ত্রিলূল স্ক্রুএর প্যাঁচের মতোই আটকানো আছে মার্বেলে।এখন আমাদের ঠিক করতে হবে কোনদিকে ঘোরাব এই প্যাঁচ?
– ক্লক ওয়াইজ।ঘড়ির কাঁটার মতো।তোমার মনে আছে বাপি প্রথম সূত্রে একটা সূর্যর ছবি ছিল!
– বেশ।
খানিক চেষ্টার পর সত্যিই প্যাঁচের কায়দায় ত্রিশূলটিকে মার্বেল পাথরের বুক থেকে তুলে আনতে পারে বাপি।সকলে দেখে বাইরে থেকে ত্রিশূলটিকে কালো লোহার মনে হলেও তার নীচের অংশটি অবিকল একটি চাবির মতো।আর সেটুকু  জ্বলজ্বল করতে থাকা খাঁটি সোনা।
– ব্রাভো রঙ্গীলবাবু।তুমি তাহলে অবশেষে গুপ্তধনের চাবি খুঁজেই ফেললে।
অমূল্যজ্যেঠু পাঠ চাপড়িয়ে দেয় রঙ্গীলের।ত্রিশূলটি অমূল্যজ্যেঠুর কাছে দিয়ে মন্দিরের দরজায় চাবি লাগাতেই হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝাঁক বাদুর কিচমিচ করে রঙ্গীলদের কানের পাশ দিয়ে উড়ে গেল উপরে।
রাজবাড়ি ফিরতে ফিরতে জ্যেঠু বলল,”চাবি তো পেলে।এইবার নূরের খুনিকে ধরতেই হবে আমাদের।ওই উল্কি ওয়ালা লোকটা।”
কিন্তু কেন যেন রঙ্গীলের মনে হয়,এই গুপ্তধন অনুসন্ধানের একটা ছোট্ট দিক সে এখনও ধরতে পারেনি।কী সেটা?কাল সকালে বাপিদের নিয়ে আর একবার তাকে ওই রাসমঞ্চর তৃতীয় দরজাটা দেখতে যেতেই হবে।ঈশ।চন্দনটা থাকলে কী যে ভালো হত!একসঙ্গে এই রহস্য সমাধানে সময় লাগত না তাদের।কোথায় আছে ছেলেটা?কোনও বিপদ হলো না তো?বাপির মুখে শোনা সেই মনের কম্পাঙ্ক মেলাবার চেষ্টা করে রঙ্গীল।তার মন বলতে থাকে খুব শিগগিরই তার চন্দনের সঙ্গে দেখা হবে।কিন্তু কোথায়?
– কী ভাবছ রঙ্গীল?অমূল্যজ্যেঠু জিজ্ঞেস করে।
– চন্দনের জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব।ওর কিছু হবে না তো জ্যেঠু।
বাপি আর অমূল্যজ্যেঠু,দুজনেই রঙ্গীলের কথায় আবার চিন্তিত হয়ে পড়ে।ত্রিশূল খুঁজে পাবার উত্তেজনা সেই দুশ্চিন্তার অন্ধকারে মিলিয়ে যায় নিমেষেই।
ক্রমশ..

❤ Support Us
error: Content is protected !!