Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • মার্চ ২০, ২০২২

লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

পর্ব ২২

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

চিত্র: দেব সরকার

লঙ্কাগড়ের জলহরির পরিখার পিছনের দিকে ঘন বাঁশবাগান । গতকাল রথযাত্রা ও তারপর নূরচাচার খুন ও পুলিশি তল্লাসির পর রাস্তাঘাট সব শুনশান । সেই জঙ্গলের ভিতরেই জয়রাম সিং মাটিতে শুকনো পাতা সরিয়ে একটা ডালার মত দরজা খুলল।সেই ডালার নীচ দিয়ে সিঁড়ি নেমে গেছে নীচে । রঙ্গীল এর আগে বাপির কাছে শুনেছিল । নাড়াজোলের রাজা নরেন্দ্রলাল খানের সময় এমন বহু সুরঙ্গপথ তৈরি করেছিল তৎকালীন রাজারা । ভূগর্ভস্থ এই কুঠুরির ভিতর আটকে রাখা হত বিচারাধীন আসামীদের । তেমনই এক কুঠুরির ভিতর জয়রাম সিং সকলকে যেতে বাধ্য করল । পিছনে অস্ত্রধারী কড়া পাহাড়া । অন্ধকার কুঠুরি দিয়ে নামতে নামতে রঙ্গীলরা দেখল একটা সময় সিঁড়ি মিলিয়ে সমতল হয়ে গেছে । পথের শেষ প্রান্তে একটা বড় ঘর । তার এক কোণে হাত পা বাঁধা অবস্থায় একটি ছেলে মাটিতে পাশ ফিরে শুয়ে আছে । রঙ্গীল বাপি মাম সুনন্দাদিদি এমনকি তিন্নিও । সকলের হাতই শক্ত করে বেঁধে দিল জয়রাম সিং । তারপর বলল ।
-ইস লাড়কাসে বাঁচিয়ে গা । বহত সরারতি বাচ্চা হয় । আজ আপলোগকা ছুট্টি । কাল গ্রহণ কা দিন । শুভদিন । সব মিলকে খাজানা ঢুণ্ডেঙ্গে ।
সুনন্দাদিদি রাগে ফোঁস ফোঁস করে বলল,”কার সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছ জানো না তুমি জয়রাম ।কলকাতায় আমার অনেক চেনা জানা । তোমাকে কেউ বাঁচাতে পারবে না ।
জয়রাম সেকথা শুনে হো হো করে হাসতে থাকে ।
-খুদ বাঁচিয়ে পেহলে ।ফির সবকো বাঁচাইয়ে দিদি ।আপকা বুড়া বাপ রাজঘর মে ইন্তেজার কর রহা হয় । জহর কাম নেহি কিয়া । তো ক্যায়া হুয়া । ইবার ভুল হবে না । আমি অবনীকে বলি দিব ।
অবনী মানে অবনী জ্যেঠু । সে জয়রামের লোক!চন্দনের আশঙ্কা তাহলে ঠিক ছিল!জয়রাম শাসিয়ে চলে যায় ।
-কোঅপারেট না করলে আপনার বাবাকে ভি নূরের মতো মেরি দিব ম্যাডাম । প্লিজ ট্রাই টু আণ্ডারস্ট্যাণ্ড ।
জয়রাম দরজা বন্ধ করে চলে গেল । ঘরে এইবার গুমোট নিস্তব্ধতা চেপে বসল সকলের উপর ।
বেশ কিছুক্ষণ এইভাবে চলবার পর ঘরের আধোআলোতে সকলে হঠাৎ খেয়াল করল তিন্নি তার হাতের বাঁধন খুলে ফেলেছে!কী করে হলো এমন জিজ্ঞেস করতে সে ইশারা করে দেখাল । কোথা থেকে এই ঘরে আর একটি মানুষ এসে বসেছে কেউ খেয়ালই করেনি । সারা রাজবাড়ি দাপিয়ে বেড়ানো দস্যি মেয়ে দুগ্গা এখানে কী করে এল ? তাকেও কি তবে জয়রাম বন্দি করে রেখেছে ? সেই খুলে দিয়েছে তিন্নির বাঁধন । দুগ্গাই একে একে সকলের বাঁধন খুলে দিতেই সকলে এগিয়ে গেল ঘরের একপাশে পড়ে থাকা ছেলেটির দিকে । ছেলেটির মুখ কাপড় দিয়ে বাঁধা । মনে হয় তাকে কোনও মাদক দেওয়া হয়েছে। ছেলেটি অচৈতন্য হয়ে ঘুমোচ্ছে । বাপি তার মুখের বাঁধন আর হাতের দড়ি খুলে দিতেই সকলে একনিমেষে চিনে ফেলল তাকে । এ তো চন্দন ! রঙ্গীলের অবশ্য উত্তেজনার মাত্রা অন্যদের থেকে বেশিই হচ্ছিল একটাই কারণে ।গতকাল রাতেই সে এখন যা ঘটছে তার ট্রেলার দেখেছে স্বপ্নে । এর অর্থ বাপি যা বলেছিল সেটাই ঠিক । সমমাত্রার চিন্তার কম্পাঙ্ক মিলে গেলে ‘টেলিপ্যাথি’ না হোক,কিন্তু ভবিষ্যতদ্রষ্টা হওয়া সম্ভব । চন্দনের মুখ দিয়ে লালা গড়িয়ে পড়ছে । মাম তার আঁচল দিয়ে ওর মুখটা মুছে দিতে দিতে বলল,”আহারে । ছেলেটার মুখটা কেমন শুকিয়ে গেছে । কতোদিন ঠিক মতো খাবার দেয়নি এরা কে জানে !”
-কিন্তু এইবার আমরা কী করব বাপি ?ওই লোকটাকে যে আমার বিশ্বাস হচ্ছে নাও লোকটা সব কিছু করতে পারে ।
-আমারও তাই মনে হয় । আমাদের পালাতে হবে । কিন্তু কীভাবে ? যে পথে এখানে এসেছি,তার বাইরে নিশ্চয়ই কড়া পাহারা বসিয়েছে জয়রাম ।
-আমি পথ জানি ।
সকলে অবাক হয়ে দুগ্গার দিকে তাকায় ।
-কোন পথ ?
-যে পথ দিয়ে আমি এলাম ।আমাকে তো আর জয়রাম বন্দি করেনি ।
এই প্রথম ছোট্ট দুগ্গার মুখে কথা শুনতে পেল ওরা ।কি মিষ্টি কথা বলে মেয়েটা ।
-চলো তোমরা আমার সঙ্গে ।আমার বাড়িতে আজ তোমাদের নেমন্তন্ন ।
সকলেই দুগ্গাকে অনুসরণ করতে থাকে । অচৈতন্য চন্দনকে কোলে তুলে নিল বাপি । দুগ্গা ঘরের অন্যদেওয়ালে থাকা একটি ত্রিভুজে হাত রাখতেই মেঝের ভিতর আরেকটি দরজা খুলে গেল । তার ভিতর সিঁড়ি রয়েছে ।
-চলো আমার পিছুপিছু ।
সকলে দুগ্গাকে অনুসরণ করতে থাকে । নিজের বন্ধুর এই বীরত্বে সবচেয়ে বেশি খুশি যে মানুষটি,তার নাম তিন্নি । তিন্নিই সকলের আগে আগে চলতে থাকে ।সুনন্দাদিদি বলে ।
-বাবার কাছে নাড়াজোলে থাকা এমন অনেক চোরাকুঠুরির কথা শুনেছিলাম আগে । কিন্তু চাক্ষুস করবার সুযোগ আজ পেলাম । এই কুঠুরিগুলো তৈরি হয় রাজা নরেন্দ্রলাল খানের সময় । কুঠুরির সঙ্গে কাঁসাই বা শিলাই নদীর যোগ থাকত সাধারণত । বন্দিদের এই কুঠুরিতে হত্যা করার পর জোয়ারের জল ঢুকে এসে সেই দেহাবশেষ ধুয়ে নিয়ে চলে যেত । হত্যার কোনও চিহ্ন থাকত না ।
সুনন্দাদিদির মুখে এই গল্প শুনে শিউরে উঠল সবাই । রাজবাড়ির জমক জৌলুস দেখতে সকলেই অভ্যস্ত । কিন্তু তার যে একটা নিষ্ঠুর অন্ধকার দিকও রয়েছে,একথা অনেকেরই অজানা ছিল । চোরাপথ প্রথমে ঢাল দিয়ে নেবে আবার উঠতে থাকে উপরের দিকে । দুগ্গা উঠোনে খেলা করার মতোই তিন্নির হাত ধরে দৌড়ে দৌড়ে সবার আগে আগে চলেছে । বাপি সবার শেষে চন্দনকে নিয়ে । মধ্যিখানে রঙ্গীল,রঙ্গীলের মা,আর সুনন্দাদিদি । বেশ কয়েক শো পা যাবার পর সুরঙ্গপথের শেষ দিকে আলোর চিহ্ন দেখা গেল । সবাই আবার দিনের আলোর ভিতর ফিরে এসে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো । যে ঢিবিটায় ওরা সকলে উঠে এল,তার পাশেই কংসাবতী নদী । এই নদীর জলই জোয়ারের সময় তার মানে কুঠুরিতে গিয়ে ঢুকত । এখানে আশপাশে জয়রাম সিং এর লোকজনের দেখা পাবার উপায় নেই । মাটির উপর চন্দনকে শুইয়ে দিল বাপি । আর দুগ্গা নদী থেকে মুঠোভরা জল নিয়ে এসে ছিটিয়ে দিল ওর মুখে । জলের স্পর্শ পেতেই চন্দন এইবার চোখ খুলে তাকাবার চেষ্টা করল ধীরে ধীরে । সুনন্দাদিদি বলল ।
-চলো সবাই । এখনই বাবাকে গিয়ে বলছি সব । দেখাচ্ছি মজা ।
কিন্তু রঙ্গীল ঘাড় নেড়ে দিদিকে বাধা দিল ।
-আমাদের এখন রাজবাড়ি যাওয়া নিরাপদ নয় । কারণ জয়রাম সিং কথা প্রসঙ্গে বলেছে সে অমূল্যজ্যেঠুর ক্ষতি করে দেবে । আমাদের পালিয়ে যাবার খবর পেলে সে সর্বনাশ করে ছাড়বে ।
-তাহলে ?
-একবার যদি বিভীষণকাকুকে জানানো যেত খবরটা । কিন্তু মোবাইলগুলো তো আগেই নিয়ে নিয়েছে লোকটা ।
বাপি মুচকি হেসে বলল,”চিন্তা করো না রঙ্গীল । বিভীষণকাকু ঠিক খবর পেয়ে যাবে ।”
সকলে চমকে ওঠে ।কী করে ? বাপি বলে চলে ।
-যখন ওই লোকগুলো আমাদের মোবাইল চাইছিল,তখনই আমি ওই দারোগাবাবুর ফোন নম্বরের সঙ্গে আমার জিপিএস লোকেশন লাইভ শেয়ার করে রেখেছি । বিভীষণ চাইলেই ওই ট্র্যাকার ট্রেস করতে পারবে । তবে ততোক্ষণ পর্যন্ত আমাদের কোথাও একটা গা ঢাকা দিতে হবে ।
-আমার বাড়ি চলো । ওই যে আমার বাড়ি ।
সকলেই দুগ্গার দিকে তাকায় । দূরে একটা দোতলা মাটির কুঁড়েঘর দেখা যাচ্ছে ।
-আমার বাড়িতে এখন কেউ নেই । মা বাবা মাসির বাড়ি গেছে । মাসির অসুখ হয়েছে ।
-তুমি যাওনি ?
-না । আমাকে নিয়ে যাবে বলেছিল । আমি পথে বাবার পকেট থেকে চাবি চুরি করে পালিয়ে এসেছি ।
-সে কী ? তুমি মাসির বাড়ি গেলে না কেন দুগ্গা ?
-আমার ভালো লাগেনি ।
-কেন ?
-এই মাটি,রাজবাড়ির উঠোন,জলহরি । এসব ছেড়ে আমার কোথাও যেতে ভালো লাগে না ।
কিন্তু মামের গলায় উদ্বিগ্নতা ধরা পড়ল ।
-তুমি এভাবে ওদের না বলে চলে এলে । তোমার বাবা মা যে চিন্তা করবে খুব ।
-কিচ্ছু করবে না ।ওরা জানে ।
-কি জানে ?
-আমার এখানে সবাই চেনা । এখন চলো ।
-বেশ । চলো ।

নদী বরাবর আলপথ দিয়ে সকলে হাঁটতে থাকে । আর সামনে সামনে দস্যি মেয়ে দুগ্গা লাফিয়ে লাফিয়ে চলতে থাকে ।

ক্রমশ..


❤ Support Us
error: Content is protected !!