Advertisement
  • ধা | রা | বা | হি | ক
  • ফেব্রুয়ারি ৬, ২০২২

লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

পর্ব- ১৬

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী
লঙ্কাগড়ের লঙ্কাকাণ্ড

চিত্র: দেব সরকার

 

ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল বাংলার নাড়াজোল রাজবংশ । সেই রাজবাড়ির পরিখায় তরবারি হাতে পাহাড়া দিতেন স্বয়ং দেবী জয়দুর্গা । জনশ্রুতি তাঁর অসির জ্যোতিতে অত্যাচারি ইংরেজরা চোখ ঢাকত। বর্গীরাও এই জনপদের ধারেকাছে ঘেঁষতে পারতো না। সেই দেবী জয়দুর্গার অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে এই ধারাবাহিক…


 

আগে যা ঘটেছে:

ঠিক যখন অতিমারীর থাবা শহর কলকাতায় জাঁকিয়ে বসছে, সেই সময় রঙ্গীলের বাবা শতানীকের কাছে এল সুপ্রাচীন রাজপরিবার নাড়াজোলের বড়কুমার অমূল্যনারায়ণ খানের চিঠি । সেখানে রয়েছে রাজামশাইয়ের উদ্বেগের কথাও । চিঠিতে রহস্যর গন্ধ ম ম করছে। শুধুই কী রহস্য ? রয়েছে রীতিমতো গুপ্তধনের খবরও । রাণী শিরোমণি,কর্ণগড়,মোহনলাল খান,ও রাজবাড়ি ঘিরে থাকা নানান গল্পকথা যার নখদর্পণে,একমাত্র সেইই পারবে এই রহস্যের কিনারা করতে । এদিকে নাড়াজোল রাজবাড়ি ঘিরে এমন সব ঘটনা ঘটছে যা আগে কখনও ঘটেনি । রঙ্গীলরা সপরিবার নাড়াজোলে পৌছোল রহস্য সন্ধানে । এরই মাঝে রাজবাড়িতেই রঙ্গীলের সঙ্গে আলাপ হয়ে গেল সমবয়সী চন্দনের । চন্দন গ্রামের গরীব অথচ অত্যন্ত মেধাবী ছেলে । অতিমারীর জেরে স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে যাবার ফলে তারও স্কুল যাওয়া বন্ধ । সেই কারণে রঙ্গীলের মতো শহরের ছেলেদের ওপর তার খুব রাগ । অথচ নাড়াজোলের চারপাশে ঘনীভূত অস্বাভাবিক ঘটনার পিছনে কে রয়েছে জানতে গেলে রঙ্গীলকে চন্দনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই হবে । কীভাবে ? রঙ্গীল কী পারবে নাড়াজোলের গুপ্তধন উদ্ধার করতে ? চন্দন কি বন্ধু হতে পারবে রঙ্গীলের? আর সেই অজানা রহস্যময় মানুষটি কে যে শান্ত এই জনপদে নতুন করে অশান্ত করে তুলছে ? কী তার আসল পরিচয় ?


 

প্রথমে সকলে মিলে এগিয়ে গেল দোলমঞ্চর দিকে । দোলমঞ্চটি বেশ খানিকটা উঁচু।তবে তার একদিক অযত্নে ও রক্ষণাবক্ষেণের অভাবে ভেঙে পড়েছিল। রঙ্গীল আর চন্দন ওই ভাঙা অংশটাই বেছে নিল মন্দিরচাতালে ওঠার জন্য । বাকিরা সবাই অনুসরণ করতে থাকল।রঙ্গীল চন্দনকে যতো দেখছে,ততো যেন বিস্ময়ে তার মন ভরে যাচ্ছে । চন্দনের ট্যাব নেই । স্কুল বন্ধ । পড়াশোনার উপায় নেই । অথচ কী ক্ষুরধার তার বুদ্ধি।ওর ধাঁধাগুলোর গোলকধাঁধায় পড়ে স্বয়ং অমূল্যজ্যেঠুও নাস্তানাবুদ হয়ে গিয়েছিল । ওই ঢিলটা ঠিক মতো ছুঁড়লে অবশ্য ওই কারিগরদুটোকে এভাবে বিপদে পড়তে হতো না । সে হোক । কিন্তু এরপর কী সত্যিই তারা গুপ্তধনের কাছে পৌছোতে পারবে ? কে জানে মন্দিরের দরজার উপর কোন সংকেত রেখে গেছেন মথুরামোহন ।
-তুমি কী বাকি সূত্রগুলোও জানো চন্দন ?
-না।আমি দেখিছি।কিন্তু বুঝে পারিনি ।এমনকি নূরচাচাও বলতি পারেনি ।
-বেশ ।
বাপির মোবাইলের আলো বেশ জোরালো ।এই সকালবেলার আলোতেও দোলমঞ্চর ভিতরটা বেশ অন্ধকার ।বাপির মোবাইলের আলো মন্দিরের ছাদের দিকে পড়তেই সেই ছাদে লুকিয়ে থাকা অপূর্ব পোড়ামাটির কারুকাজ স্পষ্ট হয়ে উঠল । রঙ্গীল বলল ।
-এখন আমাদের এক নম্বর,তিন নম্বর আর পাঁচ নম্বর দরজা দেখতে হবে ।
যেহেতু নূরচাচার বংশানুক্রমে পাওয়া সংখ্যাটি ‘একশো তিপান্ন’,তাই ওরা প্রথমে প্রথম দরজা,তারপর পাঁচ ও তারপর তিন নম্বর দরজায় যাবে ঠিক করল । প্রথম দরজার উপরে টেরাকোটার স্ল্যাবে একটি ছবি রয়েছে । একটা চাঁদ । তার পাশে একটি ঘোড়া একটি সূর্যের দিকে তাকিয়ে।তার পাশে পরপর তিনটি বাণ সাজানো । সে ছবি দেখে রঙ্গীলের মাম মধুমিতা বলে উঠল ।
-ঠিক যেন গরুরপুরাণের গল্পটা । গরুরের মাতা বিনতাকে দাসী বানানোর জন্য তার সতীন ছল করেছিল । রাজা শর্ত রেখেছিলেন।সূর্যোদয়ের সময় বিনতার কথা মতো ঘোড়ার লেজ সাদা হলে তার শাস্তি মুকুব হবে । তার সতীন তার নাগসন্তানদের দিয়ে ঘোড়ার ল্যাজ ছলনা করে কালো করে দেয় । বিনতা শর্তে হেরে যায় ।
সে কথা শুনে সুনন্দাদিদি খুবই চিন্তিত হয়ে বলল,”কিন্তু এর সঙ্গে গুপ্তধনের সম্পর্ক কোথায়?” সেই ফলকটির
ছবি তুলে নিল বাপি । এরপর পঞ্চম দরজা । সেখানে পোড়ামাটির ফলকে একটি হাতির ছবি । তার পায়ে শিকল পরানো । পাশেই দুটি কলস । তার ভিতর বিন্দু এঁকে বোঝানো হয়েছে কলসগুলি জলে ভর্তি । তার পাশে একটি ত্রিশুল আঁকা । নিচে আটখানা ফুল । এই ছবিরও কিছু মাথামুণ্ডু বুঝলো না কেউই । তৃতীয় দরজার উপরে পাশাপাশি খোদাই করা হনুমানদেব ও গণেশঠাকুর । আশ্চর্যের বিষয়, তাদের প্রত্যেকেরই পাঁচটি করে মাথা । গণেশের পাশেই একটি জলাশয় আঁকা । আর তারপর ক্রিকেট খেলার উইকেটের মতো একটা কিছু । সেই ছবি দেখে তিন্নি হাততালি দিয়ে উঠল ।
-দাভাই । আজ বিকেলে ক্রিকেট খেলবে ?
-হ্যাঁ ।হতেই পারে । চন্দন খেলবে তো?
চন্দন মাথা নাড়ে । মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগেকার সেই উত্তেজনা আর কারো চোখেমুখে নেই । বরং সেখানে ফিরে এসেছে রহস্য উদঘাটনের রোমাঞ্চকর অনুভূতি । যদিও এতক্ষণ পর্যন্ত পাওয়া ছবিগুলোর কোনও আদি অন্ত খুঁজে পাচ্ছিল না ওরা ।
এরপরে ওরা চলল রাসমঞ্চর দিকে । পঞ্চম আর তৃতীয় ফটকের উপর আলো ফেলতেই ফুটে উঠল আরো দুটি ছবি । প্রথম ছবিতে একটা সিংহাসন আঁকা । তার উপর ইংরাজিতে ‘ইউ’ শব্দ আঁকা । দ্বিতীয় ছবিতে এক অদ্ভুত যন্ত্র বাজাচ্ছেন শ্রীকৃষ্ণ । সেই যন্ত্রটি বাঁশির মতো দেখতে হলেও বাঁশি কখনোই নয় । সামনের দিকটা বেশ সানাইয়ের মতো চোঙা ফোলানো । উপরে পর পর ছিদ্রর মতো সাতটি ত্রিশুল ও একটি ত্রিশুল আঁকা রয়েছে । রঙ্গীল কখনো কৃষ্ণর হাতে এমন আজব যন্ত্র দেখেনি । তাই বাপির দিকে তাকাতেই বাপি বলে উঠল ।
-ভেরি ইন্টারেস্টিং ।
-কী বাপি?
-ওই যন্ত্রটা!
-ওটা কী সানাই ? চন্দন জিজ্ঞেস করে।
-খুব সম্ভব নয়।ওই যন্ত্রর উৎস ফরাসী দেশে । নাম ‘শ্যাল্যুম্যু’। প্রাচীন ফরাসী সঙ্গীতজ্ঞরা ওটি ব্যবহার করত। পরবর্তীতে ওই যন্ত্র থেকে জন্ম নেয় যে যন্ত্রটি,তার নাম ক্ল্যারিওনেট । কিন্তু খটকা অন্যখানে!
সকলে জিজ্ঞাসু নজরে তাকিয়ে থাকে রঙ্গীলের বাপি শতানিকের দিকে । তিন্নি বলে।
-কী খটকা মেসো?
-এই মঞ্চ যে সময় তৈরি,সে সময় অনুসরণ করলে এই অঞ্চলে ফরাসীদের থেকে ব্রিটিশদের আধিপত্যই বেশি থাকা উচিত । তাহলে মথুরামোহন ও যন্ত্রর সন্ধান পেলেন কীকরে ?
সুনন্দাদিদি অবশ্য এইবার নিশ্চিন্তে বলে উঠল,”সেটা সম্ভব । রাণী শিরোমণির সময়কার গুপ্তধন যদি আমাদের এই অভিযানের মূল প্রাণকেন্দ্র হয়,তাহলে ধরে নিতে হবে এই মথুরামোহন কর্ণগড় রাজপরিবারের সংস্কৃতির সঙ্গে অবগত ছিলেন।রাণি শিরোমণির রাজদরবারে শোনা যায় মাদ্রাজ থেকে আগত একদল ফরাসী ব্যবসায়ী প্রায়ই আসতেন।ফরাসীরা ব্রিটিশদের মতো বর্বর ছিল না।তাই তাদের দলে সবসময় একদল শিল্পীও থাকত।এমনকি রাণির একটি ছবিও এঁকেছিলেন সেই শিল্পীদের একজন বলে শোনা যায়।তাদের কারো হাতে হয়তো এই শ্যাল্যম্যু দেখেছিলেন মথুরামোহন।

রাসমঞ্চ দোলমঞ্চ ছেড়ে বেরিয়ে আসে সকলে।বেলা বাড়ছে।রথ বের হবার সময় হয়ে গেছে।তাছাড়া জয়দুর্গা মূর্তিটি যে অবশেষে উদ্ধার করা গেছে,সে কথা অমূল্যজ্যেঠুকে জানানো দরকার।অথচ সকাল থেকে জ্যেঠুর ফোন বন্ধ। চন্দনকে কিছুতেই ছাড়তে ইচ্ছে করছিল না রঙ্গীলের।মনে হচ্ছিল যেন ও কতোদিনের চেনা তার।চন্দনও যেতে চাইছিল না।কিন্তু ঘরে ফিরতে দেরি হলে বাবার মনে সন্দেহ জাগতে পারে।
-তুই চিন্তা করিস না রঙ্গীল।বিকেলেই আবার আমাদের দেখা হবে।একসঙ্গে ওই ধাঁধার সমাধান করব আমরা।
-একদম।আর চন্দন।সাবধানে থাকবি কিন্তু।

ঝোপের আড়ালে চন্দন দৌড়ে হারিয়ে গেল নিমেষেই।চাঁপাবাগানের পথে ফিরতে ফিরতে রঙ্গীল সুনন্দাদিদিকে বলল।
-কিছু বুঝতে পারলে দিদি?
-কিছুই না তেমন।তবে ওই হাতিটা নির্ঘাত লক্ষ্মী হাতি?
সকলে বেশ কৌতূহলী হয়।লক্ষ্মী হাতি আবার কে?সুনন্দাদিদি বলে চলে।
-রাজা মোহনলাল খাঁর সময় একটি সুরম্য হাতি বাঁধা থাকত রাজবাড়ির বাইরে।সেই হাতি বড়োই লক্ষ্মীমন্ত।তাই তার নামই হলো ‘লক্ষ্মীহাতি’।একদিন কী হলো।রাজামশাই রাজ্যপরিক্রমায় বের হতে যাবেন,তার পথ আটকে দাঁড়িয়ে পড়ল ওই লক্ষ্মী হাতি।শত চেষ্টা করেও তাকে পথ থেকে হটানো যায় না।শেষমেশ হাতিটি বেমালুম পথজুড়ে বসেই পড়ল সেখানে।বোঝো কাণ্ড।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে সকলেই যেন নিজের অজান্তে তিন্নির বয়সী হয়ে ওঠে । রঙ্গীল বলল ।
-তারপর?
সুনন্দাদিদি বলে চলে।
-সেদিন আর রাজামশাইয়ের রাজপরিগ্রহে যাওয়াই হলো না । পরদিন সকালে রাজা মোহনলাল খান প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে দেখেন ঠিক যেখানে লক্ষ্মী হাতি আগের দিন বসেছিল,সেইখানে একটি লক্ষ্মীর পদচিহ্ন আঁকা । রাজামশাই তার শ্রমিকদের ওই জায়গাটি খনন করতে নির্দিশ দিলেন । বেলা বাড়তে থাকে । অবশেষে মাটির ভিতর থেকে উঠে এল সোনার মোহর ভর্তি পাঁচটি সোনার ঘড়া । সেই ধনরাশি দিয়েই রাজা মোহনলাল তৈরি করলেন লঙ্কাগড়।
সুনন্দাদিদির কাছে লক্ষ্মীহাতির গল্প শুনতে শুনতে সকলে কখন যে রাজবাড়ির চত্বরে এসে পড়েছে খেয়ালই করেনি । সেখানে এই অতিমারীর ভিতরেও বেশ লোকসমাগম ঘটেছে । রথ সেজে উঠেছে ফুলের সাজে । এতো সবকিছুর ভিতরেও রঙ্গীল ভাবতে থাকে । লক্ষ্মী হাতির সঙ্গে ওই জল ভর্তি জোড়া কলসের সম্পর্ক কি ? কে জানে ? বেশ কয়েকটি প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে থাকে তার মাথায় । সে বাপির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে এখন বাপিও বোধহয় ভেবেই চলেছে ওই ছবিগুলোর মানে । এমনটা ভাবতে ভাবতেই ওরা রাজবাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়ল । সেখানে অবনীকাকু আর গোপালকাকুও ছিল । রঙ্গীল লক্ষ্য করল কেউই চন্দনের কথা কাউকে বলছে না । ঠিক করেছে । চন্দনের বিপদ হোক সে চায় না । ওর সঙ্গে বুদ্ধির লড়াইয়ে বেশ মজা আছে । এমন বন্ধু তার কলকাতার স্কুলে একটাও নেই । কিন্তু বারবার তার মন বলছে হাতে সময় নেই । এই রহস্যর সমাধান তাকে পড়শু সূর্যগ্রহণের আগে করতেই হবে ।

ক্রমশ…


❤ Support Us
error: Content is protected !!