- ধা | রা | বা | হি | ক রোব-e-বর্ণ
- জুন ১৯, ২০২২
দশ ইঞ্চি প্রজাপতি
পর্ব ৮

অলঙ্করণ: দেব সরকার
উ।প। ন্যা।স
বেণু!
ক্রীড়াসরঞ্জামের মস্ত দোকানটা থেকে, টাকপড়া আধাবুড়ো লোকটা ডাকে। তাকিয়েই উৎপলা বিবাহপূর্ব পরিচিতির পথ ধরে হেসে ফেলে।
লোকটা ফের রসিয়ে বলে, মাছ ধরতে বেরুলি?
মানে?
যা বোঝার বুঝে নে তুই!
হেসে হেসে উৎপলা বলে, সান্তা কাকু, বাজে কথা ছাড়তে পাল্লেনা?
সান্তা নামক লোকটা বলে, ছুড়ে মাল্লুম কথাটা/ যে যার করে মানেটা! তোকে তো বলিনি, গায়ে টানছিস
কেন!
কথাটা ছুড়ে মাল্লে, আমি টানব না?
হো হো হাসিতে মান্তা বলে, পাগলই রয়ে গেলি ছেলেবেলার মতো!
মেয়েবেলা বলো!
ওই হোলো রে ! …সব পাগলের আমদানি…রাস্তা দিয়ে কি তুই একাই হাঁটছিস ? ছাড়!
শুনে যা !
বেনু এগিয়ে এসে বলে, ফুটের দোকানে সব সংসার পেতে বসেছে?
দেকনা ! রাতটা নামতে দে ! …বড় বুলডোজার দেখিস নি ?
খেয়াল পল্ল না !
‘খেলার দুনিয়া’ এলাকায় খুবই পুরনো ক্রীড়াসরঞ্জামের দোকান। উৎপলা কিশোরী বয়সেও দেখেছে।বেড়া আর টিনের চালের নীচে ব্যাট-বল, রেকেট-ফেদার ক্যারাম, ফুটবল—তিননম্বর, পাঁচনম্বর, সাইজ থাকত তখন। ব্লাডার, পাম্মার, লেস— খেলার আগে ফুটবলকে তৈরি করতে হত। তখন তো শখেরপুর মফঃস্বল শহর। ক্রিকেট খেলা আজকের মতো জনপ্রিয় হয়নি। নানা এলাকার ছোট ছোট মাঠে ফুটবল হোত। প্রতিযোগিতা ছিল। প্রতিযোগিতায় খেলোয়াড়দের উচ্চতার মাপ হত। কলকাতার প্রথম ডিভিশন ফুটবলে এ অঞ্চলে অনেকেই সুযোগ পেত। সে তখন ছেলেপিলেদের কাছে হিরো। এরিয়ান্স, উয়াড়ি, খিদিরপুর— ছোট ছোট টিমে নামকরা খেলোয়াড় থাকত। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান তো স্বপ্নের টিম।
গঙ্গার ধারের পুরনো অঞ্চলের বিনয়দা—বিনয় শেঠ তখন এরিয়েন্সে খেললেও, বাংলা সন্তোষট্রফির গোলকিপার। একবার থেকে অন্য বার উড়ন্ত পাখির মতো বল রুখে দিত। শখের পুরের গর্ব তিনি। তারই ভাই মান্তা— ভালো নাম অরুণ শেঠ। অঞ্চলের একটা সুতো কলে ক্লার্কের চাকরিতে ঢুকেছিল। হঠাৎ মিল বন্ধ। বনেদি শেঠ পরিবার, নানা প্রকারের কারবার আছে। মান্তা সব চেয়ে ছোট। ওদের এক কাকা বল্লেন, মিল কারখানায় কাজে যাবে কলোনির বাঙাল ছেলেরা…তুই কেন জুটমিলে খোঁজ নিচ্ছিস। বিনয়দা পরামর্শ দিয়েছিল পারিবারিক কারবারে কেন ঢুকবি মান্তা, স্টেশন রোডে স্পোর্টস-এর দোকান দে। তবে উড়ু উড়ু মন, তেমন গা করত না।
যুগ বদলাতেই দেখে বছরে কয়েক লাখ টাকার ক্রিকেট ব্যাটই বিক্রি হচ্ছে।
মান্তা ছিল একটু ফান্টুস প্রকৃতির। চুলে ‘অ্যালবাই’ কাটত। আর সকালে মেয়েদের স্কুলটা ছুটি হলে, পেছনে লাগত।
আজ সে হাফ বৃদ্ধ হয়ে গেছে । স্টেশন রোডের বহু উত্থানপতনের সাক্ষি মান্তা শেঠ। ও-ই দুপুরে বাড়িতে খেতে আনার পথে গণশার মার্ডারের খবরটা পেয়েছিল প্রথম। তবে, এতটা বয়সে এসেও মেয়েদের নিয়ে খুনসুটির স্বভাব যায়নি। বিনয় শেঠ-বিনু দা আজও বেঁচে। শয্যাশায়ী।কিছুদিন আগেও স্টিলের স্টিক হাতে কোট প্যান্ট পরে শখের পুরের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সম্বর্ধনা নিয়েছেন অতীতের কীর্তিমান ব্যক্তিত্ব। হাঁটু ভর দিয়ে ফ্লাই ক্যাচার হিসেবে। গোল রক্ষা করার কত স্মৃতি আছে বিনুদার । আজ সেই হাঁটুজোড়া বড় কষ্টে ভাঁজ করতে হয়। যেন ঢালাই সিমেন্টের একটি খণ্ড। বিনুদা এখন দিনরাত শুয়ে থাকে। তাঁর সময়ের একমাত্র কন্ঠিদা বেঁচে আছে। — সুকণ্ঠ দত্ত। ঐ এলাকারই। জেলা ফুটবলে নান করে, একবারই রাজস্থান টিম-য়ে ফরোয়ার্ড পজিশনে খেলেছিল। বিনু শেঠেরই পুশব্যাকে। চোট পেয়ে আর এগুতে পারেনি।
‘খেলার দুনিয়া’ পুরণ কালের কোনো খদ্দের এলে, কালে ভদ্রে কথা উঠলে মান্তা শেঠ শোনায়। দাদা এখন বিছানায়। …দিনরাত শুয়া থাকে! কারো সঙ্গে কথা বলতে চান না।
কন্ঠিদা বেঁচে আছেন?
ওই একজনই…কন্ঠি দাকে কচিৎ দেখতে পাই… কালই শুনছিলাম, কন্ঠিদা বলছিল দাদাকে, বিনু ঐ হাঁটু ভর দিয়ে উড়ে যেতিস! …এখন তাকালে কষ্ট হয় না?
খদ্দেরটি বিস্ময়ে হাসে। বিনুদা শুনে কি বলে?
দাদা বল্লে, না রে কন্ঠি, আমি হাঁটুজোড়ার দিকে তাকিয়ে হাসি!
কন্ঠিদা তো অবাক। আমি ও ঘর থেকে শুনছি, দাদা বল্লে, ও দুটো আমার লেডইয়াসিনের স্বপ্ন রে, কন্ঠি!
মান্তা শেঠ টের পায়না পুরনো খদ্দেরটি, নাতির জন্য ক্যারাম বোর্ডটি কিনতে এসে, কতখানি স্বপ্ন শেয়ার করে গেল।
শখেরপুর স্টেশন রোডে আজ ক্রীড়াসরঞ্জামের তিন তিনটে বড় দোকান। মান্তা শেঠের পরের দোকানটা বাসনের । স্টেনলেস নানা প্রকারের বাসন থেকে চায়না কাপ, ডিস, প্লেট । নিত্যগোপাল সূত্রধর বুড়ো হয়ে গেছে। বউ মারা যাওয়ার পর মাথাটা কাঁপে সর্বদা। তবু বুড়োর কোনো আস্থা নেই ছেলেদের ওপর।দুই ছেলে।পালা করে বসে।বুড়োর চোখ সর্বদা ক্যাশবাক্সের দিকে ঘোরাপেরা করে।
ন্যাপা জেঠু কেমন আছ? বেণু উঁকি দিয়ে জানতে চাইল। আজ দুপুর থেকেই স্টেশনের ব্যবসা কেন্দ্রে গন্ডগোলের বাতাস বইতে, কোথাও তেমন খদ্দেরের চাপ নেই—এই সব নিরাপদ দোকাগুলোতেও নয়, এমন কি!
তুই কে মা? চিনতে পাল্লাম না?
ছেলে ধমকায়, যদু কাকার মেয়ে বেণুরে চিনলা না? চোখের মাথা খাইছ? প্রবাল সূত্রধর এবার বেণুর উদ্দেশে, বসবি? চেয়ার দেব?
বুড়ো মানুষটারে দেখতে আইলি? …ছাই ভস্ম ছাড়া এখন ব্যবসায়ি সমিতিতে কিছু নাই…ফুটে ছেলেমেয়েরা কিছু কইরা খেত…হয়ে গেল। …ওরা মার খাইলে, আমাগো ব্যবসা করতে দেবে? ছিনতাই করব আমাগো ক্যাশবাক্স!
বেণু চেঁচিয়ে বলে, সমিতিগুলো আজ কী করছে?
কলা চুষছে। বুড়ো সোজাসাপটা বলে ওঠে। …এই ধাক্কা ঠেকানো তাদের কম্ম নয়…আমগো হয়েছে যন্ত্রণা …ওরা থাকলেও জ্বালা, না থাকলেও জ্বালা! …যখন তর বাবা সমিতির লিডার ছিলো, কয়খানা ফুটের দোকান বসতে দিত? …এখন তো বসাতে পাল্লেই…। বুড়ো আঙুলবাজিয়ে টাকার ইঙ্গিত করে।…খাউকগুলা এখন! …আমরা সব জমি কিনা নিছিলাম…যেন আমগো গিলতে পাল্লে বাচে। …কোনো কিছুই জবরদস্তি ভালো না!
এই জ্যাঠার কথাবার্তা বরাবরই হেঁয়ালিপূর্ণ। কোন পদকে সমর্থন করে— বুঝে ওঠা ভার। চিরকালই গোঁয়ার প্রকৃতির, কিছুটা উলটাসোজা যুক্তির এলোমেলো কথা। বউ চলে যাবার পর মাথাটা আবার বিগড়েছে একটু। অথচ ‘অন্নপূর্ণা বাসনালয়’ বাসনকোসনের পূরণ, নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান। কাঁসা-পিতলের ঘটিবাটি, গেলাস থালার একচেটিয়া ছিল।
বাল্যে উৎপলারা যে কলোনিটায় মানুষ— নিত্যগোপাল সূত্রধর ছিল নিকট পড়শি। তখনও ব্যবসার বর্তমান অবস্থা নয়। একজন মুটের মাথায় বাসনের ঝাঁকা চাপিয়ে দিয়ে নিত্যগোপাল — বেঁটেখাট, স্থূলশরীরের মানুষটি — ছোট্ট কাঁসর নিয়ে টং টং আওয়াজ করে রোদজলে বিভিন্ন পাড়ায় ধুরে বেড়াত। স্ত্রী অন্নপূর্ণা জেঠির বুদ্ধি ও ভাগ্যবলে, যদুনাথের সহায়তায়, ধৈপে ধাপে উন্নতি। নিত্যগোপাল কোনো কালেই কাউকে বিশ্বাস করেনি। এমনকি সংসারে বউ, ছেলেমেয়েদের অবধি। মেয়েটি ছিল খোঁড়া। অথচ, বিয়ের পর রাজরানী হয়েছে কমলাদি— বেণু শুনেছে।
তবে নিত্যগোপাল সমিতির একজন নিষ্ঠাবান সদস্য ; নিয়মিত চাঁদার সঙ্গে যে-কোনো ঝড় ঝাপটায় যদুনাথের প্রতি নিষ্ঠাবান।
তবে, যদুনাথ ঘরোয়া আলোচনায় মাঝেমধ্যে বলত, ন্যাতাদার জন্মের সময় ভগবানের হিসাবে একটু ভুল ছিল।
যেমন?
মায়ের গর্ভে থাকতেই আমাদের যা যা স্বভাব হবে ভবিষ্যতে — লোভ, ক্রোধ, দয়া, বদরাগ, কিপটামি, অবিশ্বাস — সক্কলের একএকজন দেবতা থাকে— ভূমিষ্ঠ হইলেই যে-যার টিপ দিয়া যায়—বিশ্বাসের দেবতা টিপখান রাখতে ভুইলা গেছন ন্যাতাদের!
বৃদ্ধ হঠাৎ বলে, দেখতে তো তুই লক্ষ্ণী প্রতিমা! …শুনছিলাম পশ্চিমদেশে বিয়া হইছিল তোর? এখন তো শুনছি বাপের বাড়ির কাছেই…!
বেণু লঘু স্বভাবে বলে ওঠে, পশ্চিম দেশে না জ্যাঠা, যমের দুয়ারে?
ধ্যাৎ! ধমক দিতে গিয়ে নিত্যগোপাল গলা শুকিয়ে খক্ খক্ কাশতে থাকে।
ছ’বছর হল ফ্ল্যাটে আছি, জান না?
নিত্য গোপাল হাসি হাসি তাকিয়ে থাকে।
কমলা দি এখন কোথায়?
তার তো ভাগলপুর রিয়া হইছে! …এখন নাতি-নাতনিও হইয়া গেছে!
শুনেই উৎপলার বুকের মধ্যে ধক্ ধক্ করে ওঠে। কমলাদি ভাগলপুরে থাকে? কই, কোনো দিন তো পথেঘাটে দেখা হয়নি? বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে ওঠে! মেয়েরা জন্মসংসার ছেড়ে কে কোথায় যাবে, কার অধীনে থাকবে— সিদ্ধান্তের ভার মেয়েদের নেই। কমলাদি নিশ্চয়ই সুখে আছে! শখের পুর ভুলে গেছে! অথচ, বেণু শখের পুরকে ভুলতেই পারে না। কেন? সংসারের সমস্ত সনাতন নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণ শুধু মেয়েদেরই বইতে হবে কেন? ন্যাতাজ্যাঠা বিস্ময়ে টালটুল দৃষ্টিতে কী যেন খুঁজতে থাকে বেণুর শরীরে!
কী দেখছ আমার মধ্যে?
কাউন্টারের পেচন থেকে প্রবাল ইঙ্গিতে মাথাটা দেখিয়ে বোঝায় বোঝায় গ্যাছে!
কাল দেখা হলে, ফের তোকে এ-কথাগুলোই জিজ্ঞেস করবে! বাবা ভাবে, চার পাশটা থেমেই থাকে। বদলায় না।
পুরনো দিনের কাঁসা-পেতল -তামা পুরোটাই তুলে দিয়েছ?
রেখে হবে কিরে? প্রবাল বলে, যুগ বদলে গেছে বেণু!… স্টেনলেস এর চল এখন… বাবা ফালতু পরাগ করলে তো হবে না!…বাজার বুঝে তো ব্যবসা বদলাতে হবে!
ভালো চায়নাবোনের ডিস কী দর চলছে?
তোর সংসারের জন্য?
ধরো—!
যখন নিবি বলব! …তোর সঙ্গে তো জেনারেল দাম চলবে না!
কাপড় পেতে, কোথাও কোথাও বউ ছেলেমেয়েরা শুয়ে আছে। নানা কিসিমের প্রতিবাদের পতাকা টাঙানো। দু-দুটো পুলিশ ভ্যান নজর রাখছে সব প্রকার পরিস্থিতির ওপর। উঁচু অফিসারদের সঙ্গে যন্ত্রে বিবরণের যোগাযোগ চলছে।কিছু আরক্ষকের কাঁধে আধুনিক অস্ত্র
আজ আর চত্বরটায় বেণুর তেমন আকর্ষণ বোধ হচ্ছেনা। কেমন প্রাণহীন, মেপে কথাবার্তা বলা। বিশৃঙ্খলা, আশঙ্কার একটি পরিবেশ। কী হয়, কী হয়-— উৎকন্ঠা! সামাজিক বোধ ও উন্নয়নের চেতনার মধ্যে একটা নীরব ঠোকাঠুকি চলছে। এই সব পরিবেশে উৎপলা চাপা অসহায় বোধ করে। কোনো কালেই সে সুনীতি, ন্যায় ইত্যাদির পাশে জোরালো ছিল না। মানুষ আর দেবতা নইরে বাপু! ভুলচুক, খারাপ হওয়া, হৈ চৈ —এসব ছাড়া চলে? বরাবরই সে মনের ইচ্ছেয় সাড়া দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিসের ন্যায়, কী অন্যায়— অত মাথা গলিয়ে লাভ নেই। উৎপলার বিশ্বাস, জীবন আসলে অনেকগুলো পাতায় গাঁথা একটা খাতা। আমরা জ্ঞান হলেই এক একটি পাতা উল্টে যাব। আঁকিবুঁকি কাটব, রঙ লাগাব— খুশি মতো। মনের ইচ্ছে যা হবে। যদি খুব ভুল হয়, পাতাটা ছিঁড়ে ফেললেই হবে। তারপর পাতা ফুরিয়ে গেলে স্বর্গ-নরক যে যার খুশি, সেখানে যাক।
উৎপলার মাঝে মাঝে হাসি পায়। যারা কথায় কথায় নীতি ও মূল্যবোধের দোহাই পাড়ে — আসলে তাদের রসবোধ নেই। বেঁচে থাকার রস আস্বাদ করতে জানে না। বেণুর স্বপ্লকালীন লেখাপড়া ইংলিসমিডিয়ামে, তখন এলাকায়, গঙ্গার কাছাকাছি পুরনো পাড়ায় সেন্ট অগাস্টিন স্কুলটা সবে স্টেশনের ধারের শতবর্ষের পুরনো স্কুলটাকে টেক্কা দিতে শুরু করেছে। বর্তমানের মতো বিদ্যা ব্যবসায়ে পুঁজির রমরমা শুরু হয়নি। তো, বেণু রাজা ট্যান্টেলামের কাহিনিটা জানত—ওদের রেপিড রিডিং—দ্রুত পঠনে এক ম্যাডাম পড়াতেন। সাধারণত, বিকেলের দিকে এই ক্লাশটা থাকত। যত দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় ঘুরপাক খেলেও— বেণুর ঐ বয়সে এ ক্লাশটিতে মজা লাগত। গ্রীক ট্রাজিক চরিত্র ট্যান্টেলাস —যার ঠোঁট অবঠি জল উঠে গড়িয়ে যায়। কণ্ঠনালিতে প্রবেশ করতে পারেনা। রাজা চির পিপাসায় কাতর হয়ে থাকেন। কিছু মানুষের জীবনরস পান কণ্ঠনালিতে পৌঁছনোর আগেই ভালোমন্দ নীতির টানে গড়িয়ে যায়। অথচ, ভেতরে তৃষ্ণার আগুন।
মাঝে মাঝে রবিশেখরকে উৎপলা বলত, তুমি একটা ট্যান্টেলাস গো!
মানে?

অলঙ্করণ: দেব সরকার
হাঁদা কেবল মানেটাই খুঁজছে! …গন্ধটা জানতে চাইছনা।
আঁতে লেখে রবিশেখর বলত, কলকাতার মেয়ে বলে, অপমান করে মজা পেতে চাও না?
থুতনিতে আদরের ছোঁয়া দিয়ে উৎপলা নিরালায় রবিশেখরের ভুঁড়িতে ছোট্ট একটা চুমু দেয়। তারপর, মুখের কাছে মুখ এনে ঘন রহস্যে বলে, পু-রু-ষ আমার।
রবিশেখরের সমস্ত পুরুষ ইগো গলে জল।
উৎপলা এরপর পুষ্পদির ফুটের দোকানটা খোঁজ করে। নাইটিটা ওখান থেকেই কিনবো।
উৎপলা দুর্বলতা ছোট ছোট ফুটের দোকানগুলোর প্রতি— যাদের সঙ্গে পুরনো শখের পুরের শিকড়ের সম্পর্ক একটু উত্তাপ ছড়ায়।
এসে দেখতে চায়, পুষ্পদি নেই, কোথায় বেরিয়ে গেছে, ছেলের বউটা আর নাতি -নাতনিগুলো বলতে পারছে না। অসহায় ভাবে তাকায়। চারদিক ভাঙার চিহ্ন, শব্দের ধোমধুমি চলছে। দুপুরের বাতাসে চোরাগোপ্তা একটি গন্ধ ছড়াচ্ছিল । এ-ব্যাপারেই কি রবিশেখরবেরুরুবার সময়ে সমাধান করতে চাইছিল? বরাবরই লক্ষ করেছে, ঘ্রাণের ব্যাপারে রবির ইন্দ্রিয় শক্তিটি বড্ড ধারালো। যদিও সে মুখোমুখি ব্যঙ্গ করে, হ্যাটা করতে চায় লোকটাকে।
বেণু দেখল, পুষ্পদির দোকানের নাতি-নাতনিগুলো কেমন কষ্টে ফ্যালফ্যাল তাকাচ্ছে। যেমন ব্যাঙদের মুঠোয় পুরে চাপ দিলে নিরীহ ও নির্বাক চাউনি দিয়ে থাকে।
উপরন্ত বাচ্ছাগুলোর চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। আজ দুপুরে এখানেই রান্নাবান্না —ডাল আলুভাতে চটকে খেতে গিয়ে, বাতাসের বিশেষ মোহনীয় গন্ধটি কীভাবে যেন মিশেল হয়ে গ্যাছে। টনসিল জোড়া কুলতে কুলতে স্বরযন্ত্র রুদ্ধ। চ্যাঁচাতে পারছেনা, কান্নায় অক্ষম, কথা বলতে পারা দুঃসাধ্য।
তোমরা নাইটি রাখল? বেণু ঢুকে জিজ্ঞেস করল।
আছে কিন্তু নাই! ছেলের বউটি অচেনা খদ্দের বুঝে জবাব দিল।
মানে? তুমি আমার সামনে আছ, না নাই?
থামত খেয়ে, বউটি বলে, সব তুলে গাট্টি বেঁধে বসে আছি!…কী যে হবে আমাদের জানি না!
পুষ্পা দি কোথায়?
গ্যাছে!
ফিরবে এক্ষুনি?
মা সব জানতে গেছে।
কোথায়?
বলে গেছে গাট্রি বাধাছাদা থাকবে! বেচাকেনা! দ্যাখেন তাকাইয়া, ফুটের সবার ঘরে এই অবস্থা!
বেণু এবার চারপাশ লক্ষ করে, থোকায় থোকায় মানুষ, ভাঙাচোরায় নানা ধুলো, শব্দ। কাপড় পেতে, কোথাও কোথাও বউ ছেলেমেয়েরা শুয়ে আছে। নানা কিসিমের প্রতিবাদের পতাকা টাঙানো। দু-দুটো পুলিশ ভ্যান কর্তব্যরত দাঁড়িয়ে । নজর রাখছে সব প্রকার পরিস্থিতির ওপর। উঁচু অফিসারদের সঙ্গে যন্ত্রে বিবরণের যোগাযোগ চলছে। কিছু আরক্ষকের কাঁধে আধুনিক অস্ত্র। ফাঁকতালে যাতে, মালপত্তর লুঠ না হতে পারে—স্বঘোষিত ভলান্টিয়ারা যত্রতত্র ছড়ানো।
গন্ধের প্রসঙ্গটি নতুনভাবে উৎপলাকে ভাবিয়ে তুলল। আজ বেরুবার মুখে, কিংবা আজ সকাল থেকেই রবিশেখরের সঙ্গে খুটখুটানি যা যা ঘটেছিল—ভাবতেই নিঃশব্দে মজা জাগল। মানুষটা অনেক কিছু টের পায়, আগে থেকেই বুঝতে পারে— কিন্তু স্বভাবে খানিকটা হাঁক। নিজের বিশ্বাস ও সিদ্ধান্তকে মুঠোয় আঁকড়ে ধরে রাখতে জানে না। দুর্বল পুরুষ। তবে, তখন উৎপলা বোঝে, বাতাসে গন্ধের অনুমান নিয়ে তখন বাড়াবাড়িটা না করলেই হত। রবি যখন বলেছিল, আজও বাতাসে গন্ধটা চোরাগোপ্তা ছড়িয়ে পড়েছে, উৎপলা সহমত হতে চায়নি। তাই-ই নয়, ফুৎসারে উড়িয়ে ফ্লাট থেকে নেমে এসেছিল। সানগ্লাস, হাল্কা প্রিন্ট-এর শাড়ি সোনালি ডাইং-এর চুল, ম্যাচিং রংয়ের টিপ, দেহ থেকে ইয়ার্ডলে —বডিস্প্রের গন্ধ। উৎপলা একজন প্রসাধনখোড়। ফ্ল্যাটে থেকে বেরুবার আগে এ সকল গন্ধ ছড়ানো থাকলেও রবিশেখরের বিশেষ ক্ষমতাটুকু সজাগ ছিল। পইপই করে বলেছিল, গন্ধটা পাচ্ছনা? এখন বেরুন ঠিক হচ্ছে না।
শুরু হল জ্ঞান? জ্ঞানদা?
মধ্যাহ্নের আলোয় উ১পলার ত্বকের বর্ণটি দাউদাউ করছিল। ও এমনিতেই খুব ফর্সা, এখন যেন চর্বির প্রলেপে জিল্লাগুলো ফেটে বেরুচ্ছে।
রবিশেখর পেছন পেছন বলেছিল, বিশ্বাস হচ্ছে না? বডিস্প্রে মাখলে কি বিপদের গন্ধ নাকে ঢোকে? এইতো বেরুচ্ছি! একটা নাইটি কিনতে হবে!…দেখি কোন বিপদটা এসে দাঁড়ায়?
তুমিতো এ.সিতে গিয়ে ঢুকবে! …ওরা এ-গন্ধ পাবে না।
ক্রমশ..
চরিত্র এবং ঘটনা কাল্পনিক । বাস্তবের সাথে এর কোন মিল নেই, কেউ যদি মিল খুঁজে পান তাহলে তা অনিচ্ছাকৃত এবং কাকতালীয় ।
❤ Support Us