- এই মুহূর্তে দে । শ
- অক্টোবর ১৭, ২০২৫
ঝাড়গ্রামের ‘বিক্রি’ হয়ে গেল গোটা গ্রাম ! বকরা-সহ চারটি মৌজায় ৪০০ একর জমি বেহাত, নথিভিত্তিক প্রতারণার অভূতপূর্ব ঘটনা

ঝাড়গ্রামের সাঁকরাইল ব্লকের পাথরা গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত বকরা, অঙ্গারনালি, মনিক ঝাটিয়া ও চুনাপাড়া— এই ৪টি গ্রাম থেকে সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে এক বিস্ময়কর প্রতারণার অভিযোগ। পশ্চিমবঙ্গের ভূমি প্রশাসনের উপর বড়োসড়ো প্রশ্নচিহ্ন তুলে দিয়েছে। অভিযোগ, গোটা অঞ্চলের প্রায় ৪০০ একর জমি জাল উত্তরাধিকার সনদ ও নকল দলিলপত্রের মাধ্যমে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। একাধিক কৃষকের জমি, বাড়ি, এমনকি পঞ্চায়েত অফিস, জুনিয়র হাই স্কুল, কর্মতীর্থ কেন্দ্র— বাদ যায়নি কিছুই।
গ্রামের মানুষজন এ খবর জানতে পারেন সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। প্রথমে এক ব্যক্তি নিজের জমির হালখাতা খুঁজতে গিয়ে দেখতে পান, দলিলে তাঁর জমির মালিকানা অন্য একজনের নামে। আর তারপর একে একে প্রকাশ্যে আসতে থাকে আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য। দেখা যায়, যাঁরা জীবিত, তাঁদের নথিতে মৃত দেখানো হয়েছে। একাধিক ক্ষেত্রে বাবা-মাকে মৃত দেখিয়ে সম্পূর্ণ ভুয়ো উত্তরাধিকার সনদ তৈরি করে সেই ভিত্তিতে জমি বেচে দেওয়া হয়েছে তৃতীয় ব্যক্তির কাছে।
জালিয়াতির পরিধি এতটাই বিস্তৃত যে, স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান দীপক বৈষ্ণব নিজেও জানিয়েছেন, তাঁর নিজের প্রায় দুই একর জমি, যা তিনি সরকারের উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্পে পেয়েছিলেন, সেটিও বিক্রি হয়ে গিয়েছে নকল দলিলের মাধ্যমে। তিনি আরো জানান, তাঁর সই ও গ্রাম পঞ্চায়েতের সিল ব্যবহার করে অসংখ্য উত্তরাধিকার সনদ তৈরি করা হয়েছে। জালিয়াতির পর্দা ফাঁস হতেই ধীরে ধীরে সামনে আসতে থাকে একের পর এক ভুক্তভোগীর গল্প।
এই প্রতারণা কাণ্ডে জড়িয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও ভূমি দফতরের কিছু কর্মীর নামও। গ্রামবাসীরা সরাসরি অভিযোগ করেছেন যে, এই জালিয়াত চক্র সফল হয়েছে ভূমি মাফিয়া, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও রেজিস্ট্রি অফিস এবং বিএলএলআরও-র কিছু কর্মকর্তার যোগসাজশে। প্রাক্তন শিক্ষক ধীরেন্দ্রনাথ মাহাতো জানিয়েছেন, তাঁকে মৃত বলে দেখিয়ে এক একর জমি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।
জানা যাচ্ছে, ঝাড়গ্রাম জেলা প্রশাসন ইতিমধ্যেই এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মামলায় ইতিমধ্যেই শুক্রঞ্জন মাহাতো নামে এক চিহ্নিত ভূমি মাফিয়াকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পাশাপাশি, একই মামলার ভিত্তিতে আরও দু-জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির প্রতারণা, জালিয়াতি ও ষড়যন্ত্র সংক্রান্ত ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে। এ নিয়ে,ঝাড়গ্রাম জেলার সাব-রেজিস্ট্রার জয়জিত চন্দ্র জানিয়েছেন, রেজিস্ট্রি অফিসে দলিলপত্র সম্পাদনের সময় পরিচয়পত্র, দশ আঙুলের ছাপ, ছবি ও সাক্ষীর স্বাক্ষর নেওয়া হয়। কিন্তু যেহেতু প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট পঞ্চায়েত প্রধানের স্বাক্ষরিত উত্তরাধিকার সনদ ছিল, তাই তা যাচাই করেই দলিল রেজিস্ট্রি করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ আগে ওঠেনি বলে দাবি তাঁর। তবে এখন অভিযোগ আসার পর জেলা প্রশাসনের নির্দেশে তদন্ত শুরু হয়েছে। জেলার বিএলএলআরও অসিত দোলুই জানান, ওই জমিগুলি শিল্প ব্যবহারের জন্য কেনা হলেও কোনো রকম মিউটেশন হয়নি, কারণ শিল্প খাতে জমির মিউটেশনের জন্য সরকার নির্ধারিত রাজস্ব (প্রতি শতকে ১,০০০ টাকা) কেউ দেয়নি। ফলে আইনগত ভাবে এখনো প্রকৃত জমির মালিকরাই স্বত্বাধিকারী। আপাতত সমস্ত জমি কেনাবেচা বন্ধ করা হয়েছে এবং সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোকে ‘লক’ করে দেওয়া হয়েছে যাতে ভবিষ্যতে এমন প্রতারণা না ঘটে।
তবে প্রতারণার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আতঙ্ক ছড়িয়েছে গোটা অঞ্চলে। গ্রামবাসীরা তাঁদের কাজকর্ম ছেড়ে প্রতিদিন ঝাড়গ্রামে গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন— তাঁদের জমি এখনো তাঁদের নামে আছে কি না। এক দিকে আইনি জটিলতা, অন্য দিকে ভিটেমাটি হারানোর আশঙ্কায় অনেকেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেকেই। ঘটনার নিরপেক্ষ, পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়ে পথে নেমেছে কৃষক সংগঠন সহ বহু সংগঠন। ‘সারা ভারত কৃষক সভা’র ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির সহ-সভাপতি অর্জুন মাহাতো জানান, তাঁরা বিএলএলআরও অফিসে ডেপুটেশন জমা দিয়েছেন এবং দাবি করেছেন দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও প্রকৃত মালিকদের জমি ফেরতের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসন এখনো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি বলেই দাবি তাঁর। বহুজনের অভিযোগ, এ ধরনের প্রতারণা এতদিন ধরে চলতে পারে না যদি না প্রশাসনের ভিতরে কেউ না কেউ সহযোগিতা করে। প্রশ্ন উঠেছে, একই গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে একাধিক দিনের ব্যবধানে একই ব্যক্তি কীভাবে একাধিক জমির বিক্রেতা বা সাক্ষী হিসেবে থাকতে পারে? কেন এত দিন কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি? অজস্র প্রশ্ন, উত্তর জানার আগেই, এখনো প্রতিদিন বকরা ও তার আশপাশের গ্রামের কোনো না কোনও বাসিন্দা জানতে পারছেন যে, তাঁদের নামেই থাকা জমি বা বাড়ি কোনো বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
❤ Support Us