- খাস-কলম পা | র্স | পে | ক্টি | ভ
- আগস্ট ২৪, ২০২২
গণতন্ত্রে সংখ্যাগুরু, সংখ্যালঘু—এ আবার কী কথা
সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে, সংখ্যার আয়তনে, কেউ সবল, কেউ দূর্বল হতে পারেন, তাই বলে তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের তারতম্য থাকা অসঙ্গত ।

১৮ আগস্ট, জন্মাষ্টমী উপলক্ষে, ঢাকায়, বাঙ্গময় সমাজের একাংশ আর সাংবাদিকদের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বার্তা, বার্তায় উচ্চারিত ভাবাবেগ– গণতন্ত্রের একটি আবশ্যিক শর্তকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে । পরিপ্রেক্ষিত অবশ্যই বাংলাদেশ এবং সে দেশের প্রত্যাশিত অভিমুখ । তা হচ্ছে এই যে, এক নাগরিকের সঙ্গে আরেক নাগরিকের তফাৎ নেই, ধর্মাচারণে, ভাষা ব্যবহারে সবার একই অধিকার । দ্বিতীয়ত, কেউ সংখ্যালঘু নয় । সংখ্যাগুরুও নয় । সবাই দেশের নাগরিক । সাম্প্রদায়িক পরিচয়ে, সংখ্যার আয়তনে, কেউ সবল, কেউ দূর্বল হতে পারেন, তাই বলে তাঁদের প্রতি রাষ্ট্রের দায়িত্বের তারতম্য থাকা অসঙ্গত ।
বিশ্বে গণতন্ত্রের বয়স কম হল না, তার ডালপালা সবদেশেই ছড়াচ্ছে । যে সব দেশ সেরা গণতন্ত্র আর বৃহত্তম কিংবা প্রাচীনতম গণতান্ত্রিকতার দাবি করে, সে সব দেশের শাসনতন্ত্রে সবার জন্মগত অধিকারের পূর্ণ বিকাশ, এখনও, সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে আছে । পশ্চিমের দাবি, তাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অনেকটা সফল, শিল্প বিপ্লব আর রেঁনেসার সদর্থক ছায়াপাত, দুই মহাযুদ্ধের বিভীষিকা পেরিয়ে বহুদিন, বহু বছর, বহুযুগ জুড়ে, সব দেশ গণতন্ত্রের পূর্ণাঙ্গ নির্মানে উজ্জ্বল প্রভাতের ছবি এঁকে রেখেছে । পশ্চিমের দুর্ভাগ্য, তারা পূর্বের দিকে তাকিয়ে নিজেদের সাফল্যের মূল্যায়ন করে, নিজের চারপাশে, মনের ভেতরে আর বাইরে, যে অন্ধকার, যে বৈষম্য, যে শ্রেণী বিভাজন এবং সাম্প্রদায়িক অহমিকা তাদের ঘিরে রেখেছে, তা তারা দেখতে পায় না । বড়ো গাছ ছোট গাছকে ওপর থেকে দেখে, ধনীরা নির্ধনের শূণ্যতাই শুধু দেখতে পায়, অন্যের ক্ষুদ্রতায় সে বিস্মিত বোধ করে, এ নিয়ে নিন্দায়, উপহাসে সে অভ্যস্ত, নিজের শূণ্যতা, দুর্বলতা, ক্ষীণদৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নেয় ।
পাশ্চাত্যের এ অসুখ তার গণতান্ত্রিকতাকে খন্ডিত করে রেখেছে । না হলে, বর্ণবৈষম্য, ইসলামফোবিয়া তাকে গ্রাস করার সাহস পেত না। ব্রিটেন, আমেরিকা, জার্মানি, কানাডার মতো কিছু সংখ্যক দেশে, সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে, চিত্রকর্মে, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে, গণতন্ত্রের সত্যচর্চা যতটা স্বতঃস্ফূর্ত, যতটা প্রসারিত, সমাজে তার প্রতিচ্ছায়া কোথায় ? গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে কালোচিহ্ন এখনও মাঝে মাঝে দাঁত নখ বের করে ধেয়ে আসে । পশ্চিমীদের স্বভূমিতে গণতন্ত্রে দূষণ যদি ছড়িয়ে পড়ে, পূর্বেও তার দূষ্টিপাত পড়বে ।
এশিয়ার বহু দেশে গণতন্ত্র এখনও দূরবর্তী ভাবাদর্শ । চিন থেকে মধ্য এশিয়া, পশ্চিম এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ভূখণ্ডে গণতন্ত্র স্থাপনের চেষ্টা সুদূর স্বপ্নমাত্র । পশ্চিম এশিয়ায় নাম কা ওয়াস্তে ভোট হয়, রাজতন্ত্র, দলতন্ত্র, শিয়াতন্ত্র বহাল তবিয়তে টিঁকে আছে । প্রতিটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ আজও গর্ভস্থ, সন্তান কবে ভূমিষ্ঠ হবে কে জানে ? সাদ্দাম জামানার ইরাক একটু ব্যতিক্রম ছিল। স্বৈরতান্ত্রিকতা সত্ত্বে খ্রিস্টান ও শিয়াদের মনোনয়ন বা ক্ষমতার অংশ হতে বাধা ছিল না। লেবাননে মুসলিম ও শিয়াদের জনসংখ্যার বিশেষ তারতম্য নেই । একসময় রাজনৈতিক অধিকারকে ঘিরে দুপক্ষের সঙ্ঘর্ষ বহু রক্তক্ষয়ের কারণ হয়ে ওঠে। পরে ফিলিঞ্জিস্ট (খ্রিস্টান) আর মুসলিমরা শাসনপর্বকে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় । এরকম দুর্ভাগ্যজনক ভাগাভাগি পরিস্থিতিকে জটিল করেছে । ইরানের মদতপুষ্ট হিজবুল্লাহ ফ্রান্সের একদা উপনিবেশে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। আরব খ্রিস্টানদের অধিকারকে যারা আমল দেয় না,সুন্নিদের শাসন ক্ষমতাকেও স্বীকার করে না । তবু লেবানন ছাড়া, পশ্চিম এশিয়া আর উপসাগরীয় অঞ্চলের একটি দেশও মিলবে না, যে-সব দেশে, শাসনকর্মে, সমাজ কর্মে বহুমত, বহুভাষিকতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বীকৃত । গণতন্ত্র বিকশিত বা স্থাপিত হলে, এ ব্যাপারে শাসকের চেতনার উদ্রেক হত ।
প্রসঙ্গত বলা দরকার, হজরত মহম্মদের ধর্মাদর্শ গণতন্ত্র আর সব ধর্মের মানুষের অধিকারকে খর্ব করেনি । এ ব্যাপারে, আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের প্রশ্ন ওঠে না । আমরা এখানে নৈর্ব্যক্তিক । যথাসম্ভব ইতিহাসনিষ্ঠ। ইতিহাসের সত্য– ইসলাম পূর্ব আরবে ইহুদি, খ্রিস্টান, প্রকৃতিবাদীরা পাশাপাশি বসবাস করতেন । কোনও ধরণের সঙ্ঘর্ষ গোত্রপ্রধান সমাজকে সাম্প্রদায়িকতা দুষ্ট করার সুযোগ পায়নি। এক গোত্রের সঙ্গে আরেক গোত্রের লড়াই হত । গোত্রপ্রধান অথবা সর্বমান্যরা মীমাংসায় বসতেন। যৌবনে হজরত মহাম্মদকেও এরকম সমস্যার মীমাংসা করতে দেখা গেছে । পৌত্তলিকতাকে অস্বীকার করে যখন কৃষিনির্ভর মদিনায় আশ্রয় নিলেন, তাঁকে, তাঁর সহগামীদের আশ্রিতের সম্মান দিয়েছেন ওখানকার ইহুদি আর প্রকৃতি উপাসক আরবরা । মদিনায় যখন সমাজ পরিচালনার (রাষ্ট্র নয়, তখনও মূল আরব ভূখন্ডে রাষ্ট্রের ধারণা তৈরি হয়নি) জন্য বৃহত্তর সঙ্ঘ গঠন করলেন, সে সঙ্ঘে মুসলিম, খ্রিস্টান, ইহুদি ও প্রকৃতি উপাসকদের সমগুরুত্ব দেওয়া হল । পশ্চিম বহুধর্মীয় আরবদের এ উত্থানকে সুনজরে দেখেনি । বাইজেনটাইন আর পারস্য সাম্রাজ্য ওই আরবজাগরণকে গুড়িয়ে দিতে চাইল। প্রতিক্রিয়ায় আরবরাও সংহত হয়ে উঠল ।
বানিজ্য নির্ভর ইসলাম, তরবারির জোরে নয়, তার অন্তরের বাণী সাজিয়ে এমন একটি আদর্শ স্থাপন করল যার ভিত্ একেশ্বরবাদ, সাম্যচিন্তা আর বানজ্যিক আদানপ্রদান। যুদ্ধ নয় । বৈষম্য নয় । মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগ রচনাই ইসলামের ইহজাগতিক গন্তব্য হয়ে উঠল। হজরত মুহাম্মদের (দঃ) উত্তরণের পথে, যুদ্ধের ভূমিকা নেই, ধর্মীয় বিভাজনের চিহ্ন নেই । কোরন আর হদিসের কোথায় ধর্ম বা ভাষার নিরিখে, মানুষকে সংখ্যালঘু, সংখ্যাগুরু ( আকলিয়ত, আকসরিয়ত) আখ্যা দেওয়া হয়নি। মক্কায় শেষ ভাষণে, পরিষ্কার ভাষায় নবি বলেছেন, ভাষা বা অন্য কোনও নিরিখে মানুষকে ভাগ করা চলবে না, বৈষম্য চলবে না। সমাজ পরিচালনায় কাউকে বঞ্চিত করা চলবে না, সবার অধিকারকে সমান গুরুত্ব দিতে হবে।পয়গাম্বরের আদর্শকেই বাংলাদেশের মাননীয় প্ৰধানমন্ত্রী, জন্মাষ্ঠমির আগে অনুচ্চারিত ইঙ্গিতে মনে করিয়ে দিলেন বাংলাদেশের মানুষকে। বিশ্ব তাঁর বার্তাকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে, সচেতন সমাজকে এবার্তা কীভাবে ভাবাচ্ছে, তা ভেবে দেখা দরকার। দরকার ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর বার্তাটির আনুপূর্বিক পর্যালোচনা।
১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন থেকে ৭১ এর মু্ক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত, প্রতিটি মহিমান্বিত অধ্যায়ে, বাংলাদেশের আলোড়নে, সব ভাষিকের, সব ধর্মীয় সমাজের সংযোগে কোথাও কোন বিয়োগ নেই। নেতৃত্বের, লড়াইয়ের অঙ্গীকারের লক্ষ্য ছিল একটিই— শোষণমুক্ত, বৈষম্যমুক্ত, সুবিচারের আশায় উদ্দীপ্ত দেশ গঠন। এটি এমন একটি ভাবাদর্শ, দেশভাগের প্রায় সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানবাদী, সংখ্যাগুরুবাদী সংঙ্কীর্ণতাকে নাকচ করে ভবিষ্যতের বহুত্ববাদিতার ভিত আর একের পর এক সিড়ি রচনা করে গেছেন পূর্বতন পূর্ববঙ্গের লেখক, কবি, চিত্রকর, সাংবাদিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও জনমুখী রাজনীতিকরা।
ষাটের দশকের গোড়ার দিকে, প্রগাঢ় প্রজ্ঞার গবেষক আনিসুজ্জামানের ‘মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য ’ শীর্ষক গবেষণা সন্দর্ভের পরীক্ষক ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় আপ্লুত চিত্তে লক্ষ্য করেছিলেন যে পূর্ববঙ্গে উজ্জ্বল, দীপ্তময় গবেষক আর বুদ্ধিজীবীদের উত্থান তাঁকে প্রবল আশান্বিত করে তুলেছে । নীহাররঞ্জনের ওই পর্যবেক্ষণে কোথাও কোনও অতিরঞ্জন নেই । পরের, একের পর এক গণজাগরণ, গণতন্ত্রের লড়াই এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, তাজউদ্দিন আহমেদ, মানিক মিঁয়া সহ প্রদীপ্ত, স্বপ্নময়— স্বাধীন দেশ গড়ার কারিগরদের ত্যাগ আর সংগ্রাম, বাস্তব বোধ আর দূরদৃষ্টির প্রয়োগ প্রমাণ করেছে, বাংলাদেশ যান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়, আধুনিক দেশ হতে চেয়েছিল । ধর্মহীন সেকুলার রাষ্ট্র নয়, ধর্মনিষ্ঠ মানুষের, সব সম্প্রদায়ের ভাব আর ভাবাবেগের মানবজমিন হয়ে ওঠার ভেতর বাইরের সাধনাকে, প্রস্তুতিপর্বেই অশেষ গুরুত্ব দিয়েছিল। ধর্মময়, নিরপেক্ষ এবং সহিষ্ণুতা চর্চার মানবজমিন হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার অভীষ্ট । ১৯৭২ সালে, সংবিধানের খসড়া প্রস্তাব পেশ করে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, বাংলাদেশে সামাজিক বৈষম্য থাকবে না, প্রতিটি সম্প্রদায় নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে, মন্দিরে থাকবে, মসজিদ থাকবে। ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করবে না। প্রশাসনের চোখে সবাই সমান।
যে সর্বজনীন অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, যে সর্বাত্মক অংশগ্রহন তার আন্দোলনের ভিতকে শক্তপোক্ত করেছিল, যে লোকায়তিক আদর্শকে ঘিরে বাংলাদেশের উত্থান ও বিজয়ের প্রারম্ভিক সূচনা, তা আবেগদীপ্ত ভাষণে দেশবাসীকে, বিশ্বকেও স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন রাজনীতির অন্যতম মহানায়ক। দেশদ্রোহীরা সময় দেয়নি। হত্যা করেছে তাঁকে, তাঁর স্বপ্নকে। সে স্বপ্নের পূনর্জন্মের সমূহ লক্ষণ ভেসে উঠছে। বাংলাদেশ ঘুমিয়ে পড়েনি । কতিপয় অন্তর্ঘাত স্বত্ত্বেও তার বৃহৎ সত্ত্বা, তার জনপ্রবাহ, চিন্তাপ্রবাহ জাগ্রত। এসব পর্যবেক্ষন করেই সম্ভবত শেখ হাসিনা বলেছেন, কেউ সংখ্যাগুরু নয়, সংখ্যালঘু নয় । সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। তাঁর এ আশ্বাস বিশ্বাসের বাস্তব, প্রতিজ্ঞার দৃঢ়তা সমাজকে আশান্বিত করছে। প্রকারান্তরে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে গণতন্ত্র আর আধুনিকতার অন্যতম মৌলিক শর্ত— সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।
❤ Support Us