- গ | ল্প
- নভেম্বর ১৫, ২০২১
আব্বা
চিত্র: সমীর কুন্ডু
ফর্সা মুখের ওপর ধবধবে দাড়ি। লোকে বলত, ফেরেশতার মুখ। ঠোঁটের ওপর একটা মিষ্টি হাসি সবসময় লেগে থাকত। আব্বা না ছিল বেঁটে না ছিল লম্বা। যাকে বলে মাঝারি। উঠোনের ডালিম গাছটার ডালে অবশ্য মাথা ঠেকে যেত। হাতের নাগাল দিয়েই গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ত। ঘরের ডাপে মাথা ঠেকে যাবে বলে মাথাটাকে ছাপুর করত। নাক ছিল টিকালো। ইতিহাসের ছাত্র বড়ভাই বলত, আর্যীয় নাক। আমি তখন প্রশ্ন করতাম, তাহলে কি আমাদের পূর্বপুরুষরা উত্তর-পশ্চিমের সিন্ধু সীমা দিয়ে এ দেশে ঢুকেছিলেন? আব্বা অবশ্য অত কিছু না বললেও এটা বলত যে আমাদের পূর্ব পুরুষরা হিন্দু ছিলেন। আমি বলতাম, সেজন্যেই কি আমাদের পদবি আর মাহিষ্য পাড়ার নিখিল কাকুদের পদবি একই? অর্থাৎ মণ্ডল? আব্বা বলত, হতে পারে। আব্বার ছিপছিপে চোখে তখন সনাতন ভারতবর্ষকে দেখতে পেতাম। আব্বার মাথায় বাবরিচুল। দুই কানের পাশে ফুলে থাকত। আব্বা এক জীবনে আলকাপ দলের শিল্পি ছিল। গাঁয়ে গাঁয়ে গোনায়যাত্রা-রূপবানযাত্রার পালা করে বেড়াত। সাতদিন দশদিন বাড়ি ফিরত না। মার মাথায় তখন সংসারের বোঝা। ছেলে-পিলে মাঠ-ঘাট মুনিশ-কিশেন গরু-গোহাল আর রান্না-বান্নাতে খিজিবিজি লেগে থাকত। মা তখন আব্বাকে খিচখিচ করত, মিনশেটা এবারকার মতো ফিরুক ওর গান করা বের করছি। সে রাগ অবশ্য ততদিন বিষ নিয়ে থাকত না। আব্বাকে লোটাকম্বল বেঁধে ফিরতে দেখলেই সে রাগ গলে জল হয়ে যেত। চাল ডাল তেল আলুতে আব্বার ঘাড় মাথা বোঝা হয়ে থাকত। মা আকাবাকি করে সেসব নামিয়ে নিয়ে আব্বার ঘাড় মাথা হাল্কা করে দিত। আব্বা তখন এক মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে মা’র দিকে তাকাত। মা’র ছলছল চোখ তখন খিলখিল করে উঠত। বুকের হা হা করা শূন্যতা ভরে যেত। আব্বা আলকাপ দলে ‘ছুকরি’র পাঠ করত। সেজন্যেই কি আব্বার মাথায় বাবরি চুল? মা সে কথা বললেও আব্বা কথাটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিত। বলত, নবী রসুলের মাথায় নাকি এরকম চুল ছিল। সেদিক দিয়ে এ চুল ছিল সুন্নত। আব্বাকে একদিন জানতে চেয়েছিলাম, গানটা ছেড়ে ছিলে কেন? আব্বা বলেছিল, সংসারের হিল্লে করতেই গানকে পর করতে হয়েছে রে। মা অবশ্য অন্য কথা বলেছিল। ধর্মেকর্মে মতি হওয়ায় আব্বা গানকে হারাম করেছিল। কিন্তু আব্বা মন থেকে সে গানকে পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারেনি। গান যার হাড়ে গান যার মজ্জায় সে কি গান ভুলে থাকতে পারে? আব্বা যখন প্রচন্ড জ্বরে কাহিল হয়ে যেত তখন গলা ছেড়ে গায়ত—
‘আয়রে সুবল একবার কোলে
জন্মের মতো গেলি চলে
আমি পিতা এই অভাগা
না পাই যেতে কোন কূলে।
গানটি ছিল গোনায়যাত্রার গান। আব্বা শেষ জীবনে জমি রেজিস্ট্রি অফিসের সাহেব আমলাদের হুকুম শোনা কর্মচারী ছিল। সরকারে চাকুরে ছিল না। আব্বার ক্ষেত্রে সেসব প্রশ্নই আসে না। কারণ আব্বা শিক্ষিত আইএ বিএ পাশ ছিল না। জীবনে স্কুলের তিন সীমনায় পা দেয়নি। তবে নিরক্ষর ছিল না। গ্রামের সালেমুদ্দি দফাদারের কাছে কোনরকমে লিখতে পড়তে শিখেছিল। আব্বা বলত, সালেমুদ্দির মকতব। অফিসে কাজ বলতে গেলে তালা খোলা আর বন্ধ করা। তার মাঝে মহুরি কপিরাইটারদের ফাইফরমাইশ শোনা। অফিসে আসার আগে অবশ্য আবাদপানিতে হিল্লে দেওয়া আর অফিস শেষে হাটবাজার করে বাড়ি ফেরা কাজগুলোও করতে হত। একদা আড়তদারির কারবারও করত আব্বা। তখনই হাতে দুটো পয়সা এসেছিল। মেয়েদের বিয়েসাদি দেওয়া ছাড়াও কিছু জমিজিরেত কিনেছিল। আব্বাকে কোনদিন সাইকেল চালাতে দেখিনি আমি। বুদ্ধি হয়ে থেকেই দেখেছি, পায়ে হেঁটেই সব জায়গায় যেতে। আমাদের গ্রাম থেকে বাজারটা এক মাঠ দূরে। আমাদের মৌজা আর ব্লকঅফিসের মৌজা গা লাগালাগি। দুই জায়গাকে একটা আঁকাবাঁকা নালায় বেঁধে রেখেছে। আবার অন্যভাবে বললে বড়ঘাট্টা বিলের এক মাথায় আমাদের গ্রাম আর অন্য মাথায় আমাদের হাটবাজার। এই বিলের পাড় বরাবর হাঁটা পথই ছিল আব্বার হদ্দিনের রাস্তা। গায়ে বড় বহরের পাঞ্জাবি আর পরনে চেক লুঙ্গিতে দূর থেকে মনে হত কোন ফকির-দরবেশ হেঁটে যাচ্ছে। আব্বার এই শ্বেতশুভ্র চেহারাতেই নাকি জিনেরা মানুষের রূপ ধারণ করত! অবশ্য তারা ছিল ভালো জিন। মৌলবিদের কথায় ‘শাদা জিন’। একদিন হল কি আলাউদ্দির মেয়ে জাহানারা টিউশন পড়ে বাড়ি ফিরতে দেরি করে ফেলল। তখন সন্ধ্যা ঘুটঘুটে হয়ে নেমে গেছে। বিলের এপার ওপার জনমানবহীন। মাঠজুড়ে গাছাপাটের জঙ্গল। সে জঙ্গলজুড়ে নামছে নৈশব্দ। ঝিঁঝিঁ তো ডাকছেই মাঝেমধ্যে শেয়ালও হুক্কা হুয়া শুরু করে দিয়েছে। জাহানারা ভয়ে জুবুথুবু। তার ভেতরে হালুনি শুরু হয়ে গেছে। সে দুরুদুরু মন নিয়ে এদিক ওদিক হন্যে হয়ে কাউকে খুঁজছে। হঠাৎ ময়েরের ঢেঁড়সের ভুঁইয়ের আলে দেখতে পেল আব্বা হেঁটে যাচ্ছে! জাহানারার ধরে যেন প্রাণ ফিরে এল। সে পিছন থেকে গলা ছেড়ে থড়বড় করে ডাকল, ‘ও উস্তুম নানা, দাঁড়াও গ, আমার একা ভয় লাগছে।‘ জাহানারার ডাক শুনে দাঁড়িয়ে পড়ল আব্বা। তারপর পুরো মাঠ দুজনে একসঙ্গে এল। গ্রামে ঢোকার আগে আছে একটা বটগাছ। বটগাছের তলা দিয়ে হাঁটার রাস্তা। একটা রাস্তা সোজা গ্রামে ঢুকেছে আরেকটি রাস্তা ঢালু হয়ে চলে গেছে পাশের বড়ঘাট্টার বিলে। বটগাছের তলায় এসে আব্বা জাহানারাকে বলল, ‘তুই বাড়ি যা আমি বিলে পাটের জাগটা দেখে আসি।‘ পরে জাহানারা যখন বাড়ি পৌঁছল তখন তার মা লুতফন বিবি চোখ কপালে তুলে জানতে চায়ল, এত সন্ধ্যায় কার সাথে এলি খুকি! জাহানারা যখন জানাল, উস্তুম নানার সাথে, তখন লুতফন তার কপালে উঠে যাওয়া চোখজোড়াকে আরও রসগোল্লা করে বলল, তা কী করে হয়? উস্তুম খালু তো অনেকক্ষণ আগেই বাড়ি চলে এসেছে। আমি যখন গোয়াল ঘরে সাঁজাল দিচ্ছিলাম তখনই বাড়ি যেতে দেখলাম। জাহানারার চোখে-মুখে তখন বিস্ময়, তাহলে আমার সঙ্গে যে লোকটি এল সে লোকটি কে! আব্বার রূপ ধরে ভালো জিন নাকি এভাবে কতজনের যে উপকার করেছে তার ইয়াত্তা নেই।
আব্বার দরাজ গলা ছিল। একবার হাঁক ছাড়লে মাঠের এপার থেকে ওপার শোনা যেত। আব্বাকে সেজন্যে মোয়াজ্জিনের কাজটাও মাঝেমধ্যে করতে হত। তখন আমাদের পাড়ার ওক্তিও মসজিদে মাইক ছিল না। খালি গলায় আজান দিতে হত। সবাই আব্বাকে ঠাট্টা করত, ‘উস্তুম মাইক থাকতে আবার মাইক কী হবে?’ আব্বা শুধু মোয়াজ্জিনের কাজই করত না। আব্বাকে গাঁয়ের সালিশির মাতব্বরের কাজটাও করতে হত। আব্বা যে গ্রামের দশ(সমাজ)এর মোড়ল ছিল। পরের বউয়ের সাথে কিম্বা পরের স্বামীর সাথে লটঘট আর ফষ্টিনষ্টির সালিশি বেশি হত। তার শাস্তিও ছিল কড়া। কাউকে গরম বাউলি ছেঁকা দেওয়া হতো, কাউকে মাথা নাড়া করে গ্রাম ঘোরানো হতো, কাউকে টাকা জরিমানা করা হতো তো কাউকে কাউকে ‘একঘরে’ করা হতো।
আব্বা সুপুরুষ ছিল। তিন কুড়ি বয়সেও কাঁধে জোয়াল নিয়ে মাঠে যেত। হাতে লাঙল ধরে জমি চষত। মাথায় করে বোঝা আনত। আর মা হল ভালো ফলনদায়িনী। লোকে মাকে মশকরা করত, গোয়ালঘর আর গর্ভঘরেই মেয়েটির জীবন ফুরিয়ে গেল! আমরা হলেম আব্বা-মার দশটি সন্তান। চার ভাই পাঁচ বোন। একভাই বসন্ত রোগে মারা গেছে। আমাদের বড় ভাবি আর আমার মা একসাথে গর্ভবতী হয়েছিল একবার। আমি আর আমার বড় ভাইজি হলাম একই বয়সের। আমাতেই ইতি টেনেছিল আব্বা। সেজন্যে সবাই আমাকে ‘উস্তুমের নামলা বেটা’ বলে রাগাত। মা’র কাঁখও ছিল শক্ত। ধান ভর্তি গম ভর্তি ধামা একাই কাঁখে তুলে নিত। বিঘে বিঘে ধান একা হাতেই ভাপাত। সেদ্ধ করত। উঠোনে মেলে শুকোত। তা দেখে পাশের বাড়ির খৈজন দাদি মাকে ঠাট্টা করত, ‘তোর গতরে আল্লা ফেরেশতার বল দিয়েছে রে সুবেহা।‘ আমাদের উঠোনেই ছিল ধানের গোলা। পিছনে ছিল ধান গম ঝাড়াই মাড়াইয়ের খৈলেন। আব্বার হাতও ছিল ফেরেশতার হাত। আব্বার হাতে বোনা বিত্তিতে ঝেরে মাছ পড়ত। আব্বা যে ঘরের মটকা মারত সে ঘরে এক বিন্দু বৃষ্টিও পড়ত না। আব্বা পেশাদার ঘরামি ছিল না। তবে নিজের বাড়ি-ঘরের কাজ নিজে হাতেই করত। এই যেমন দড়ি পাকানো। আমি পাকাতাম আর আব্বা সুতো জোড়া দিত। পাকাতে পাকাতে হাত ফসকে গেলেই ধমকাত। আব্বার ধমকও ছিল ভয়ঙ্কর! আমি তো রীতিমত হেলে উঠতাম। এই আব্বাকেই আমি একবার ফুঁপিয়ে কাঁদতে দেখেছিলাম। আমাদের বাড়িতে ছিল দুটো তাগড়া বলদ। একটা কালো রঙের আর একটা সাদা। কালোটা ছিল কেনা। আর সাদাটা বাড়ির। দাদোর(ঠাকুরদা) আমলে বিইয়ে ছিল। সেবার আমার যমজ দুই বোনের বিয়ে লাগল। অনেক টাকার ব্যাপার। জামাইদের সাইকেল আংটি বোনেদের কানের নাকের গলার গয়না দিতে হবে। সঙ্গে বরযাত্রীদের খাওয়া দাওয়ার আয়োজন। মেল্লা খরচ। ধার-দেনা করেও গোছানো গেল না। অগত্যা কোপ পড়ল বলদজোড়ার ওপর। কালো বলদটাকে বেচার জন্যে হাটে নিয়ে যাওয়া হল। সেদিন ছিল আমাদের বাড়ির একটা দোজখ দিন। সবাই কেঁদেছিল। সবচেয়ে বেশি কেঁদেছিল মা আর সাদা বলদটা। আব্বা গোয়ালঘরের খুঁটি ধরে ফুঁপিয়েছিল। সেই প্রথম আব্বাকে কাঁদতে দেখেছিলাম আমি। আর ভেবে অবাক হয়েছিলাম, পশুও মানুষকে কাঁদায়!
আব্বার হাড়শক্ত ভুঁড়িমোটা শরীরে যেদিন সুগারের ব্যামুটা ধরা পড়ল সেদিন কোথা থেকে একটা লাল রঙের কুকুর আমাদের বাড়িতে এল। কোথা থেকে এসেছিল কেউ বলতে পারেনি। রাত-দিন বাড়ির গেটে বসে থাকত। যে আব্বা ‘বাড়িতে কুকুর থাকলে ফেরেশতা ঢোকেনা’ বলত সেই আব্বাই কুকুরটাকে দু বেলা খেতে দিতে বলত। আব্বা তখন শুকিয়ে খড়ি হয়ে উঠছে। ওষুধ নিয়ম বেঁধে চললেও শরীরের মাংস শুকিয়ে যাচ্ছিল। ছোট হয়ে আসছিল চোখ। একদিন ভোর রাতে কুকুরটাকে যাচ্ছেতাই ‘ঘেউ’ ‘ঘেউ’ করতে দেখে আব্বা আমাকে বলল, “হানিফ, দেখ তো কুকুরটা অত ঘেউ ঘেউ করছে কেন?”
আমি গেটের কাছে গিয়ে এদিক ওদিক জরিপ করে এসে বললাম, “নাহ, কিচ্ছু নেই। অন্য কোন কুকুরও আসেনি। কোন শেয়াল টেয়ালও দেখলাম না।
“তাহলে আমি যা ভাবছি তাই।“ আব্বা ফিস করে কথাটা বলল। আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম, “তুমি কী ভাবছ আব্বা?”
“আমার জান কবজের জন্যে মরণের ফেরেশতা আজরাইল এসেছিল। কুকুরটাকে দেখে আর ঢুকতে পারেনি।“ মিনমিন করে বলল আব্বা। আমি রেগে বললাম, “তোমার মাথায় কি সবসময় ওই মরণের চিন্তা ঘুরঘুর করে?” কথাটা শুনে আমি কষ্ট পেয়েছি দেখে আব্বা ঠোঁটে একটা মিষ্টি হাসি লাগিয়ে বলল, “এখনও দুনিয়াদারির ভাত ফুরোয়নি আমার। আজই মরণ কীসের রে।“ আব্বা যতই এসব কথা বলে আমাকে ভোলাক না কেন আমি বুঝতে পেরেছিলাম, আব্বার সময় ফুরিয়ে আসছিল। খাবার কমে আসছিল। সবসময় দাদো-দাদির(ঠাকুরদা-ঠাকুরমা) কথা বলত। রাতের বেলা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করত। আর মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে স্বপ্নে কাকে ‘যা পালা, দূর হো এখান থেকে’ বলে তাড়াত। আর সেইদিন সেই আশ্চর্য ঘটনাটা ঘটল। আব্বা মারা যাওয়ার দিন কয়েকের মধ্যে কুকুরটাও মারা গেল। মারা যাওয়ার তিন দিন আগে থেকে শোকে সমস্ত খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল কুকুরটা। আমরা তার হাদিসি কোরানি ব্যাখা না পেলেও একটা জিনিস ঠিক ঠাহর করেছিলাম, আব্বার জন্যেই কুকুরটা এতদিন বেঁচে ছিল।
❤ Support Us








