- গ | ল্প
- জানুয়ারি ১৫, ২০২২
জাদু দরজার ভেতরে ও বাইরে
চিত্র: দেব সরকার ।
অফিসপাড়া নিস্তব্ধ। গলির দুপাশ জুড়ে সারিবদ্ধ গেটে তালা ঝুলছে। ফটকের মাথায় নেমপ্লেটগুলো দেখতে দেখতে এগিয়ে যাচ্ছে তনিমা। চেনা কোনো মুখের দেখা নেই আজ । দিন কয়েক আগেও বাহারি পোশাকের অফিসকর্মী ছেলে-মেয়েদের গল্প-গুজব আর হৈ-হুল্লোড়ে এই পাড়া গমগম করত । এখন চারদিকে কেবল নিস্তব্ধতা।
রুবিমোড়ে বাস থেকে নেমে মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। তনিমার মতো অফিস পাড়ায় কর্মরত অনেক যুবক-যুবতী এটুকু পথ হেঁটেই আসে। দুপাশে আকাশছোঁয়া বাড়ি, মাঝবরাবরা চওড়া ঝকঝকে রাস্তা। একাধিক গলির ভিতরে ছড়িয়ে আছে নানা অফিস। হোটেল, রেঁস্তোরা, সাজানো দোকানপাট। অফিসটাইমে ইয়া বড়ো বড়ো গাড়িও হেঁকে বেড়ায়। বুট-শ্যুট পরা লোকজন দেখতে তনিমার বেশ লাগে। লাঞ্চ বক্স সঙ্গে নিয়ে আসে, চায়ের ব্যবস্থাও অফিসে। তাই বাড়ি ফেরার সময় ছাড়া, অন্য কোনো সময়ে, তনিমা অফিসার বাইরে বের হয় না। ওদের প্রকাশনা সংস্থা আর পত্রিকার হেড অফিস। মূলত দুই ধরণের কাজ এখানে হয়। এক. ডেস্কে দুই. মার্কেটিং । তনিমা ডেস্কে বসে কম্পোজিংয়ের কাজ করে।
প্রতিদিনই অফিসে আসার সময় তনিমা চারপাশের ব্যস্ত মানুষ, পশুপাখি, গাছপালা, যানবাহন, দোকানপাঠ আগাগোড়া বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখে। এ পাড়ায় নতুন কিছু হলে সবার আগে ওর চোখেই ধরা পড়ে । মাসখানেক হল একটি মজাদার দৃশ্য উপভোগ করার জন্য রীতিমতো বাড়ি থেকে একটু আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে বের হচ্ছে। ওদের অফিসের ঠিক উল্টোদিকে গ্রাফিক্স ডিজাইনের অফিস। সেখানে কর্মরত দুই যুগলের টুকিটাকি তনিমার চোখ এড়ায় নি। দুজনের লাইভ ছবি বেশ উপভোগ করছে । ফর্সা, মিষ্টি মুখের মাথাভর্তি চুলওয়ালা মেয়েটি আর লম্বা টিকালো নাকের ছেলেটি যখন জড়াজড়ি করে, তনিমার শরীরের ভেতরটাও মাঝেমাঝে সুড়সুড় করে ওঠে। দশটার অনেক আগেই ওরা এখানে চলে আসে। হাতের ওপর হাত রেখে এগলি-ওগলি দিয়ে শ্লথ পায়ে ঘুরে বেড়ায়। কখনও আবার একে অপরের বুকে মাথা রেখে মগ্ন হয়ে যায়, পাশ থাকে কে বা কারা হেঁটে যাচ্ছে, তা ওদের চোখে পড়ে না। আবার কখনও একে অন্যকে কিস করে, খুনসুটিও করে—তনিমা এসব টুকরো টুকরো মুহূর্ত মিস করতে চায়না। দুটিকে দেখে, ওর নিজের শরীর-মন দুটোই জেগে ওঠে। কলেজের দিন গুলোতে ফিরে যায়। নীলয়ের হাতে হাত রেখে লাল নীল স্বপ্ন দেখত। স্বপ্নের সঙ্গে ছুটত। নিলয়ের কথা ভেবে এখনও তার মন খারাপ করে। যখন প্রথম ওদের ব্রেকআপ হল, নাওয়া-খাওয়া ভুলে গেল তনিমা। সারাদিন মন মরা হয়ে বসে থাকত। কখনো নিলয়কে, কখনো নিজেকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাত । সব ক্ষত আড়ালে চলে গেছে। লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে তনিমা এখন সংসার ও চাকরি দুটোই সামলাচ্ছে। কিন্তু পাশের অফিসের যুগলের খুনসুটি ওকে আবার জাগিয়ে দেয়। ওদের দেখলেই উৎসুক হয়ে ওঠে। আজ অফিস পাড়ায় সে এলেও, ওর মন ভালো করা যুগলের দেখা মিলবে না, এটা ভেবে একটু বিমর্ষ হয়ে পড়ল ।
হাই তুলে আনমনা হয়ে হাঁটছে। রাস্তা জনশূন্য। সব দোকানপাঠ বন্ধ। পথে ঘাটে উদ্বৃত্ত, এঁটোকাটাও না পেয়ে পশু-পাখিদের দেখা নেই। তনিমা একা। ওর গা টা কেমন যেন ঝমঝম করছে। নিঝুম রাস্তাটা ওর পদধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠছে। দিনে-দুপুরেও তনিমার ভয় করছে। গত রাতে হরোর মুভি দেখে সারারাত কিছুতেই চোখের পাতা এক করতে পারে নি। চোখ বন্ধ করলেই ভয়ঙ্কর চেহারাটা ওর সামনে এসে দাঁড়াবে, এই ভেবে জেগে জেগে সারারাত কাটাল। ছোটোবেলা থেকে ভুতের সিনেমা দেখলেই তনিমার চারদিকে ভয় ছড়িয়ে পড়ে। তবু ভূতের সিনেমা ওর দেখতে ভালো লাগে। কাল রাতেও চ্যানেল ঘোরাতে ঘোরাতে পোড়ো বাড়ির দৃশ্যটা দেখেই সে সোফার ওপর লাফ দিয়ে বসে পড়ে। দীপেন বারণ করল, তবু জোর করে সিনেমাটা দেখতে শুরু করল। ঘন্টা খানেক পর, শুতে যাওয়ার আগে, দীপেন জানতে চায়—কী গো ভয় করছে না? তনিমা ভয় পেয়েও দীপেনকে কিছুই বলে নি। তাহলেই তো টিভি বন্ধ করে দিত দীপেন। সিনেমাটা শেষ হল রাত ১ টায়। টিভির সুইচ অফ করে আলো জেলে রাখল তনিমা।
চাবি ঘুরিয়ে গেট খুলেতেই ম্যাজিক ডোর। যে কোনও আগন্তুক এলে জাদু দরজার ভেতর থেকে তাঁর দেখা মেলে কিন্তু বাইরে থেকে ভেতরের কাউকে দেখা যায় না।
রাতভর না ঘুমিয়ে শরীরটা ম্যাজম্যাজ করছে। এটুকু পথও যেন দীর্ঘ মনে হচ্ছে । জোরে হাঁটার চেষ্টা করল। এনার্জি পাচ্ছে কই ? ওই তো মোড়ের চা দোকানটা দেখা যাচ্ছে। ওরে বাবা, কী ভয়ঙ্কর সুনশান। ঝাপ বন্ধ। খদ্দের নেই। দোকানদার নেই। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে। তনিমার দেহটা শিরশির করে উঠল। চোখ-কান বন্ধ করে বন্ধুদের গুঞ্জন, তর্ক বিতর্ক, বুট-শ্যুট পরা ছেলে-মেয়েদের একহাতে গরম চায়ের ভাড় অন্যহাতে জল্বন্ত সিগারেটের ধোঁয়া গন্ধ খোঁজার চেষ্টা করল । কিছু নেই চারপাশে শুধু স্তব্ধতা। চোখ খুলে শূন্য দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল তনিমা।
আর একটু এগোলেই ওর নিজের অফিস। ওই তো, নিশান চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে কার্পাস তুলোর আকাশছোঁয়া গাছটা। এখানে অফিস টাইমে সারিবেঁধে দুচাকা, চারচাকা দাঁড়িয়ে থাকে। আজ একটাও গাড়ি নেই। নেই ওই মেয়েটির টু-হুইলার । যেটি স্ট্যান্ড করে তার উপর বসে প্রতিদিন অফিসে ঢোকার আগে মেকআপ বক্স খুলে শেষ টাচ আপটা গালে ছড়িয়ে দিত। তনিমা আর ওর সহকর্মী লীনা দূর থেকে ওর অঙ্গভঙ্গি উপভোগ করত। লাল টুকটুকে ঠোঁটের ওপর আরো একটু রঙের ছোঁয়া লাগিয়ে সে পাউচ করে সেলফি নিত, কখনো ব্রাশ দিয়ে চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে দুষ্ট হাসি হেসে আকাশের দিকে তাকাত। ওর মোহময় চোখ, লাস্যময়ী গাল, বড়ো বড়ো নখ আর রঙ মাখানো খোলা চুল দেখে তনিমার মাঝে মাঝে ওকে হরোর মুভির নায়িকা মনে হত। আজ সে নেই, ওর স্কুটিও নেই। তনিমা মনে মনে বলল, ভালোই হয়েছে। এমনিতেই ভয় করছে, তার উপর …। ও জানে এখন থেকে আর কারোর দেখা মিলবে না । সবাই ওয়ার্ক ফ্রম হোক করছে। তবুও ওর মন বারবার একে-একে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ওষুধের দোকানটা খোলা। বাইরে বোর্ডে লেখা অনলাইন ডেলিভারি। আরো কয়েক পা এগিয়ে নিজের অফিস বিল্ডিং এর সামনে এসে দাঁড়াল । চাবি ঘুরিয়ে গেট খুলেতেই ওদের অফিসের ম্যাজিক ডোর চোখে পড়ল। একা একা হেসে উঠল তনিমা। প্রতিদিন দুপুরে, লাঞ্চ ব্রেকে ওদের এই ম্যাজিক দরজার বাইরে একদল মেয়ে এসে দাঁড়ায়। ফ্যাশনেবল পোশাক, ব্র্যান্ডের জুতো, টুকটুকে লাল ঠোঁট, ভাসা ভাসা চোখ। হাতে দামি অ্যানড্রয়েড সেট, মুখে ইংরেজি বুলি ছড়াতে ছড়াতে ওরা এই দরজার আয়নার কাচে নিজেদের দেখে নেয়। বাইরে থেকে ভেতরের কাউকে ওরা দেখতে পায় না। তনিমাদের অফিসের ভেতর থেকে ওদের দেখা যায়। শুধু ওরা কেন, বাইরের যে কোনও আগন্তুক এসে এখানে দাঁড়ালে ভেতর থেকে দেখা মেলে। এ জন্যই তনিমা এ দরজার নাম দিয়েছে ম্যাজিক ডোর।
অফিসে পা রেখেই ভীষণ নিঃসঙ্গ বোধ করছে। কী আর করা যায় ? বাকি কলিগদের মতো ওর বাড়িতে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করার ফেসিলিটি নেই। ওর বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব মাত্র এক কিলোমিটার। বসের কাছে একপ্রকার করজোড়ে অনুরোধ করেই অফিসে এসে কাজ চালিয়ে যাওয়ার পারমিশন পেয়েছে। সামনের স্ট্যান্ডে পা দিয়ে প্রেশ করতেই হাতে কয়েক ফোঁটা স্যানিটাইজার বেরিয়ে এল। হাতে হাত ঘষতে ঘষতে সিঁড়ি বেড়ে নিজের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল । দরজা ঠেলে রুমে প্রবেশ করতেই ওর মনে হল, কে যেন ওর সঙ্গে ভিতের ঢুকে পড়ল। বেশ হকচকিয়ে চারপাশটা দেখে নিল। আলোর সুইচ টিপল, কই কেউ নেই তো, ও তো একাই। ধূর, কী যে হচ্ছে ? গতরাতের ভয়ের রেশ এখনও কাটেনি। দু হাতে চোখ রগড়ে তাড়াতাড়ি কম্পিউটার অন করে পেন্ডিং কাজ শুরু করল। ঘন্টা দুয়েক পর মনিটর থেকে সরিয়ে মুঠোফোনে স্কিনে চোখ রাখল। টুক করে শব্দ তুলে ম্যাসেজ ঢুকল ইনবক্সে । ম্যাসেজ বক্স খুলতেই ভেসে উঠল বসের লেখা —’মেল চেক করুন। আর্জেন্ট।’
মোবাইল সরিয়ে রেখে আবার মনিটরে কাজ শুরু করল। অফিসের মেল খুলে দরকারি প্রিন্টআউট বের করল তমিনা । মোটা হরফে লেখা ‘ছায়ার সঙ্গে মধুচন্দ্রিমার রাতে ‘। পাঁচ পাতার গল্পের প্রিন্টআউটটা ডেস্কের ওপর রাখল। গল্পের নামটা ইন্টারেস্টিং। মধুচন্দ্রিমার নাম শুনলেই শরীরটা জেগে ওঠে। না আর বসা যাচ্ছে না। ওয়াশরুমের দিকে এগোল। কাচের দরজা ঠেলে বাইরে বের হবে, এমন সময় ওর সিঁড়ির ওপরের দেওয়ালে টাঙানো ছবিটার ওপর চোখ পড়ল ওর। বিশাল বড় ছবি জুড়ে রঙ আর ব্রাশের ছোঁয়ায় রহস্যময় আবহ ছড়িয়ে দিয়েছেন শিল্পী। এর আগেও কয়েকবার এই ছবি দেখে রিতীমতো ভয়ে কেঁপে উঠেছে সে। আর আজ আবার ছবিটা হঠাৎ নড়তে শুরু করেছে। বাইরে জোরে হাওয়া বইছে। এ ঘরের জানালা বন্ধ। ওই তো, ওই তো জোরে, আরও জোরে ছবিটা দুলছে । এক্ষুণি দড়ি ছিড়ে আছড়ে পড়বে। না আর এক মুহূর্ত নয়, তনিমা সিঁড়ি দিয়ে দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। বেসিনের কল খুলে ভালো করে চোখে ঠান্ডা জল দিল। মাথাটা ঘুরছে। ধূর কী দরকার ছিল রাত জেগে সিনেমা দেখার ! চোখ জ্বালা করছে। রুমাল দিয়ে চোখ রগড়ে নেয় তনিমা। বাইরে বেরিয়ে আবার ছবিটার কাছে গেল। সব ঠিকঠাক আছে। আর দেরি নয়। তাড়াতাড়ি কাজ সেড়ে বাড়ি ফিরতে হবে।
বেসমেন্ট সাজানো ফাঁকা চেয়ারগুলো দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের ডেস্কে চলে এল। অনেকটা ফ্রেশ লাগছে। ভাবল, মোবাইলে গান শুনবে । কিন্তু বাইরে থেকে যদি কেউ আওয়াজ দিলে শুনতে না পায় । এই ভেবে গান শোনা আপাতত স্থগিত রেখে কাজ শুরু করে দেয়। খটখট আওয়াজ তুলে কে যেন সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল। শব্দটা কানে আসতেই রিতীমতো কেঁপে উঠল, পুরো অফিসে সে ছাড়া আর কেউ নেই । তাহলে, এ আওয়াজ কোথা থেকে এল ? কে নীচে গেল? চাবি তো ওর কাছে। দরজা বন্ধ করে রাখলে কারোর পক্ষে বাইরে থেকে ভেতরে আসা বা বেরোনো সম্ভব নয়। তাহলে? কী যেন ভাবল। তারপর সাহস করে কেবিনের দরজাটা খুলে বাইরে মুখ বার করল। কউ, কেউ তো কোথাও নেই। কোথাও নেই । নিজের মাথায় নিজেই চাটি মেরে বলল—ধূর, কানটাও বোধহয় খারাপ হয়ে গেছে, একটু বেশি বেশি আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে। একথা ভাবলেও, ভয়টা মনের গহনের ভেতরে থেকে উঠে এসে তনিমার গোটা শরীরে তরঙ্গের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল। মাথাটা ভার হয়ে আছে। চা খাওয়া যাক। ফ্লাক্সে জল ঢেলে সুইচ টিপে গরম জল কাপে ঢেলে নিয়ে টি ব্যাগ ফেলে চা-এ চুমুক দিয়ে টাইপ শুরু করল। দ্রুত গতিতে কম্পোজ করছে। গল্পটা বেশ সুন্দর । পাঠকের মন ভরে উঠবে।
কয়েক বছর ধরে এই পাবিলিশিং হাউসে কাজ করতে করতে তনিমা এখন যে কোনও লেখা একবার পড়লেই ভালো-মন্দ বুঝতে পারে । নায়কের প্রেম, তারপর বিয়ে, তারপর হানিমুন । এসব নিয়েই গল্পটি পড়তে বেশ ভালো লাগছে। প্রেম এবং বিয়ের পর্বে কোনও সমস্যা, কোনও বাধা-বিঘ্ন ঘটে নি। ভালোই এগোচ্ছে । তনিমার হাতও দ্রুত গতিতে কিবোর্ডের ওপর পড়ছে। হঠাৎ অভাবনীয় মোড় । ঠিক তখনই পিঠের শিরদাঁড়া বেয়ে আবার ভয়টা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল । গল্পের নায়ক তার স্ত্রীকে নিয়ে মধুচন্দ্রিমা যাপনে এক রাজবাড়িতে গেছে। প্রাচীন রাজবাড়িটি ট্যুরিস্টদের খুবই প্রিয়। স্থানীয় কয়েকজন এ বাড়িতে ভূত দেখেছে বলে দাবি করে। অনেকে আবার বলে, সব মিথ্যে। ট্যুরিস্ট আটকাতেই এমন ভুয়ো খবর কেউ রটিয়ে দিয়েছে। নায়কের বন্ধুরা বারবার বারণ করেছিল, আমপোতার এই রাজবাড়িতে যেন তাঁরা না আসে। কিন্তু নায়ক আর তাঁর সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী দুজনেই শহর থেকে পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরের এই শান্ত, নির্জন রাজবাড়িতে একান্তে সময় কাটাতে খানিকটা গোপনেই এখানে চলে আসে।
রাজবাড়ির চারপাশে সুন্দরের লীলাখেলা চিত্তকর্ষক ঘর, দালান। বড়ো ঝাড়বাতি। দেওয়ালে টাঙানো বিশাল এক ওয়েল পেন্টিং। পালঙ্ক, থেকে শুরু করে ঘরের আসবার পত্র সবই নস্টালজিক। স্বামী স্ত্রীর মুগ্ধ হয়ে দেখছে। প্রাসাদ জুড়ে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ নায়ক তাঁর স্ত্রীর হাতটা টেনে তাঁকে নিজের বুকের মধ্যে জাপ্টে ধরে । সোহাগে রাঙা হয়ে দৌঁড়ে বাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকটায় ছুটে যায় স্ত্রী । নায়ক তার পেছন পেছন ছোটে। স্ত্রীকে খুঁজে পায় না। বারবার নাম ধরে ডাকতে থাকে। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ নায়কের সামনে এসে পড়ে স্ত্রী। নায়ক বারবার জানতে চায় —তুমি কোথা থেকে এলে, আমি এতক্ষণ ধরে ডাকলাম, সাড়া দিচ্ছিলে না কেন? স্ত্রী অদ্ভুত হাসি ছড়িয়ে নাকে নাকে সুর করে বলে, —এই তো আমি। তারপর সারা দিন দুজন একসঙ্গে সময় কাটাতে থাকে। স্ত্রীর কথাবার্তা নায়কের অসংলগ্ন মনে হয়। স্ত্রীকে যতই কাছে টানছে ততই সে দূরে সরে যাচ্ছে। ঘোমটার আড়ালে নিজের মুখ লুকিয়ে রাখছে। স্ত্রীর ঘোমটা সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় নায়ক। রাগ করে বলেই ফেলল—কী ব্যাপার, তুমি হঠাৎ করে মাথায় ঘোমটা দিচ্ছে কেন ? এখানে আসার আগে তো এরকম করোনি। বেশ রহস্য ময় হাসি ছড়িয়ে স্ত্রী জবাব দেয়, —মশাই একটু ধৈর্য্য ধরো। চাঁদ উঠুক আকাশে। নায়ক হেঁসে বললেন—তুমিই তো আমার চাঁদ। স্ত্রীর হাতটা টেনে নিয়ে নিজের হাতে জড়িয়ে নেয় নায়ক। এক টুকরো বরফ হাতে চেপে ধরেছে ভেবে আঁতকে উঠল। গল্পের এ অংশ কম্পোজ করতে তনিমাও ঘাবড়ে গেল। ওর ঘাড়ের পেছনাটা কেমন বরফ শীতল অনুভূতিতে অবশ হয়ে আসছে।
নায়ক স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে করতে বিছানার শরীরটা এলিয়ে দিল। তারপর স্ত্রীর শরীর নিয়ে খেলা শুরু করল। কিন্তু যতবারই মুখের কাছে মুখ আনে, ততবারই মুখটা দেখতে পায় না। কাপড় ঢাকা মুখটা। নায়ক স্ত্রীকে জাপ্টে ধরে নরম বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। আনন্দ আর উত্তেজনায় তাঁর শরীর টগবগ করছে। হঠাৎ কী মনে করে পালঙ্কের উল্টো দিকের দেওয়ালে টাঙানো বড়ো আয়নায় নায়কের চোখ পড়তেই, আতর্নাদ করে উঠল। ভেসে উঠল শাড়ি, গয়না পরা ভয়ঙ্কর রক্তখেকো পিশাচের মুখ। আর ঠিক তখনই তনিমার মনিটরেও ভেসে উঠল গত রাতে মুভিতে দেখা ভূতের মুখটা। স্কিন ভেদ করে বাইরে বেরিয়ে আসছে। তনিমার হাত কাঁপছে। কপালের ওপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। চিৎকার করতে পারছে না। ওর সব আওয়াজ ফুরিয়ে যাচ্ছে। এমন ভাবে কতক্ষণ বসে ছিল, নিজেই জানে না। স্তব্ধতা খানখান করে বেজে উঠল মোবাইলের রিং টোন। তনিমা দেখল মুঠোফোনে ওর বরের নম্বর। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করতেই শুনতে পেল—তাড়াতাড়ি এসো। বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। বাড়ি যাবে না। কটা বাজে খেয়াল আছে ?
❤ Support Us