- গ | ল্প
- ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২১
খেলাঘর

চিত্র: রাজকুমার দাস ।
ক্যালেন্ডার অ্যাক্টিভিটি শেষ হতেই বিছানায় বসে, জোরে ক্লাপ দিয়ে উঠল শ্রেষ্ঠা।পাশের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে, মাধুরী হাসতে হাসতে ওকে অ্যাপ্রিশিয়েট করল। শীতের সন্ধ্যা, দুজনের হাত তালির আওয়াজে পুরনো কমপ্লেক্সের একতলার স্তব্ধ ঘরটা মুহূর্তে গম গম করে উঠল।
হাসির আওয়াজ মিলিয়ে যেতে না যেতেই সুর ছড়িয়ে দেয় শ্রেষ্ঠা—
আমি আকাশে পাতিয়া কান…ন, শুনেছি শুনেছি তোমারই গান…ন—ওগো বিদেশিনী।
দারুণ।দারুণ।খুব সুন্দর বলতে বলতে মাধুরী চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চেয়ারটা একপাশে সরিয়ে রেখে, একটু এগিয়ে, হাত নেড়ে অ্যাকশন করে বলল—ম্যায় এক ছোটিসি কাঠ পুতলি, রোনা মুছকো আতা নেহি। শুনেই শ্রেষ্ঠা মাধুরীকে অনুকরণ করল। গলার স্বর নামিয়ে মাধুরী চুপ। কারন সে জানে, বাকি লাইনগুলো চটপট বলে দেবে শ্রেষ্ঠা।
মাধুরী যা চাইছিল, ঠিক তেমনি শ্রেষ্ঠা হাত নেড়ে নেড়ে কবিতাটা শোনাল, শোনাতে শোনাতে একটু কেশে উঠল।
মাধুরী বলল, মাম্মাম আস্তে আস্তে। দাঁড়াও জল আনছি।
দরজা ঢেলে, বাইরে বেরিয়ে, বসার ঘরে রাখা টেবিলের ওপর থেকে জলের বোতলটা নিয়ে এল মাধুরী। অল্প একটু জল শ্রেষ্ঠার গলায় ঢেলে দিল। নিজেও কয়েক ঢোক খেয়ে নিল।
অভ্যাসবশত মাধুরী দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল, সন্ধ্যে সাতটা।
বলল, এখন আমাদের বল খেলার সময়। তুমি কি বল খেলবে?
মাধুরীর প্রশ্নের জবাব না দিয়েই হঠাৎ বেশ জোরে বলে উঠল শ্রেষ্ঠা, ‘কিছু ছুঁড়ব না, ফেলব না। কাউকে মারব না…
মাধুরী বুঝল, শ্রেষ্ঠা কী বলতে চাইছে। শ্রেষ্ঠাকে না থামিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমি লক্ষী মেয়ে। আমি ছুঁড়ব না।
মাধুরীর কথা ওর কানে যাচ্ছে না।নিজের খেয়ালে আঙুল নেড়ে নেড়ে একনাগাড়ে বারবার বলে গেল, আন্টিকে মারবে না, ছুড়বে না।
এখন কী করা উচিত, মাধুরী তা জানে।
কিছুদিন ধরে ওবেসিটির কারনে কিছু কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে শ্রেষ্ঠার। ইর্দানিং মেজাজটা বিগড়ে যাচ্ছে। মুইড সুইং। মাঝে মাঝে হঠাৎ রেগে গিয়ে হাতের সামনে যা পাচ্ছে ছুঁড়ে দিচ্ছে।
শ্রেষ্ঠার পছন্দের কবিতার একটা লাইন আবৃত্তি করল মাধুরী —
আমি মণি, আমি ছড়া বলি, ছবি দেখি। অ আ পড়ি।
ননী আমার ভাই সে কালি মাখে। তালি দিয়ে নাচে। মা তাকে বকে।
হ্যাঁ, মা তাকে বকে, সে হাসে
উত্তেজিত শ্রেষ্ঠা আবার দাঁত বের করে হাসল।
এই তো আমার লক্ষ্মী সোনা বলে মাধুরী ওর মাথায় হাত রাখল। জানতে চাইল, এবার কি শ্রেষ্ঠা বল খেলবে?
ঠিক সে মুহূর্তে বাইরে গাড়ি পার্কিয়ের শব্দ শোনা গেল। শ্রেষ্ঠাদের আবাসনের ফ্ল্যাটগুলো ঠিক ইংরেজি ‘ইউ’ লেটারের মতো সাজানো। দুপাশে সমান মাপের বহুতল। মাঝখান দিয়ে চওড়া রাস্তা। সারি সারি গাছ। একেবারে শেষপ্রান্তে প্লে গ্রাউন্ড। তার চারপাশে ঘেঁষাঘেষি করে আবাসনের বাসিন্দাদের গাড়িগুলো দাঁড়িয়ে থাকে। নতুন কোনো গাড়ি এলে বা এখান থেকে গন্তব্যের দিকে এগোলে হর্ণ অথবা মিউজিকের আওয়াজ শ্রেষ্ঠার ঘর থেকে শোনা যায়। তীক্ষ্ণ আওয়াজে শ্রেষ্ঠা রেগে গেল।
জানলার পাশে ঝুড়ির ওপরে রাখা বলটা হাতে তুলেই ছুড়ে দিল মাধুরী। এক লহমায় লুফে নিল শ্রেষ্ঠা, হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে নাম্বার কাউনটিং শুরু করে বলল, ওয়ান।
বল একবার মাধুরীর হাতে, আরেকবার শ্রেষ্ঠার হাতে। এভাবেই হান্ড্রেড কাউন্টিং করে ফেলল দুজন। মাধুরী ক্যাচ মিস করলেও শ্রেষ্ঠা অপরাজেয়। খুশিতে সে হাসছে, ভাবখানা এমন অ্যান্টিকে হারিয়ে দিয়েছি।খেলা শেষ হতেই মাধুরী বলটা চেয়ারের ওপর রেখে অন্য প্রসঙ্গ বলতে শুরু করতেই, মুহূর্তে শ্রেষ্ঠা ওর দূষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ওটা, ওটা…
মাধুরী প্রথমে বুঝতে পারেনি, বোঝার চেষ্টা করল।
শ্রেষ্ঠার দিকে তাকিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলল, ও বুঝতে পারছি, বলটা ।
মাধুরী তাড়াতাড়ি সঠিক স্থানে বল রেখে দিল।
শ্রেষ্ঠা অর্গানাইজ, পারফেক্ট । সব জিনিস গুছিয়ে ঠিকঠাক জায়গায় রাখে, রাখতে চায়। শুধু ও নয়, অন্য যে কেউ নিয়ম ভাঙলেই শ্রেষ্ঠা রেগে যায়। যতক্ষণ না কাজটা ঠিক হচ্ছে, ততক্ষণ ওর জেদ চেপে থাকে। লেখা হয়ে গেলে পেন অথবা পেন্সিল ডেক্স-এর ওপর রাখা যাবে না। ঠিক জায়গায় রাখতেই হবে।
শ্রেষ্ঠার এই সূক্ষ্ণতা, নিয়মাণুবর্তিতা বিস্ময়কর। মাধুরী খুব একটা গোছানো নয়। প্রয়োজনীয় জিনিস মাঝে মাঝে হারিয়ে ফেলে। কতবার বাসে, ট্রেনে ছাতা, রুমাল, টাকা, বই হারিয়ে এসেছে। আগে যদি শ্রেষ্ঠার সঙ্গে দেখা হত, তাহলে হয়ত কিছুই হারাত না, মাঝে মাঝে ভাবে সে।
ডেস্ক এর ওপর থেকে শ্রেষ্ঠার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ঘষতে ঘষতে মাধুরী বলল,
আমার নাম শ্রেষ্ঠ মজুমদার।
শ্রেষ্ঠাও হাততালি দিয়ে বলল, আমার নাম শ্রেষ্ঠ মজুমদার।
আর এভাবেই বাবার নাম, মায়ের নাম, ঠিকানা মোবাইল নাম্বার—বলার ফাঁকে বারবার চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশ টা দেখতে লাগল। তখনও মাধুরী নিজের হাতে আদর ছুঁইয়ে ওর হাতটা ধরে রেখেছে। হঠাৎ ঝটকা দিয়ে শ্রেষ্ঠা জের হাত সরিয়ে নিল। মাধুরী জানে, জোর করে লাভ নেই। ওকে ওর মতো থাকতে দেওয়া দরকার।
শ্রেষ্ঠাকে কথায় ব্যস্ত রেখে, আজকের সব কাজ করতে চায় মাধুরী, হল না। আগে অনেকবার এ কৌশল এপ্লাই করে শ্রেষ্ঠার নখ কেটেছে, গত কয়েকদিন ধরে নখের ডগাটাই ছুঁতে দিচ্ছে না। হাত দিলেই গম্ভীর হয়ে সরিয়ে নেয়। মাধুরী চিন্তিত। রোজই ভাবছে, নতুন কোনও উপায় বের করে কাজটা সারতে হবে। অন্ধকার কেটে যাবে। ভয় কাটিয়ে শ্রেষ্ঠা আবার স্বছন্দে ফিরে আসবে।
একবার মাধুরীর হাতে, আরেকবার শ্রেষ্ঠার হাতে ঘুরতে থাকল বল । এভাবেই হান্ড্রেড কাউন্টিং করে ফেলল দুজন। মাধুরী ক্যাচ মিস করলেও শ্রেষ্ঠা এখানে অপরাজেয়। খুশিতে সে হাসছে, ভাবখানা এমন অ্যান্টিকে হারিয়ে দিয়েছে।
সন্ধ্যায় করিডরের দরজা ঠেলে মাধুরী এ বাড়িতে পা রাখলেই শ্রেষ্ঠার ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসি ঝিলিক দেয়। চোখের ভাষায় ধরা পড়ে ওর উচ্ছ্বাস। নির্ভেজাল খাঁটি ভালোবাসা।প্রতি দিনই একই অভ্যর্থনা, তবু তা পুরনো হয় না, কোথায় যেন এক চোরা স্রোত মাধুরীর শরীর এবং মনকে জাগিয়ে দেয়।
প্রতিদিন শুরুতেই জলখাবার।এখানেও ভ্যারাইটি। মাধুরী আর শ্রেষ্ঠা দুজনেই খেতে খুব ভালোবাসে। ওদের চাহিদা শ্রেষ্ঠার মা বোঝেন। রোজ নিত্যনতুন পদ। খাবার পর্ব শেষ হলেই মাধুরীর হাত ধরে শ্রেষ্ঠা পড়ার ঘরে ঢুকে পড়ে।
মাঝারি সাইজের ঘর, ভেতরে ছড়িয়ে রয়েছে একধরনের সূক্ষ্ণতা। সাদামাঠা চার দেওয়ালের এক কোণে সিঙ্গেল খাট, ঝকঝকে বেডশিট। দেওয়াল জুড়ে বড়ো বড়ো শিল্পীদের পেন্টিং। খাটের কোন ঘেঁষে একখানা চেয়ার। ঠিক তার উল্টো দিকে তাক জুড়ে বই আর বই। খাটের উপর দেওয়াল কেটে, দুটো র্যাক। একটায় ডিভিডির সঙ্গে সিডির ছড়াছড়ি। রবীন্দ্র-নজরুল, আধুনিক সহ কত গানের। শ্রেষ্ঠা গান ভালোবাসে। অনেক সময় গানে ডুবে থাকে; মিউজিক ওকে স্টিমুলেট করে, যখন গায় একটানা গাইতেই থাকে।সুর-তাল-লয় ছন্দ সব ঠিকঠাক। গান শুনে মুগ্ধ হতে হয়। নাচটা ও মন্দ করে না। তবে ওর দেহের ওজন এখন ওর ভিলেন। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে শুধু হাত-পা নাড়ে। দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কলের পুতুল নাচছে। নাচ-গানের পাশাপাশি রংতুলিতেও পারিবারিক সূত্রে সে অভ্যস্ত। মাতৃগর্ভে ওর অনুশীলন শুরু, স্বাধীনচেতা মায়ের শিক্ষা, বাবার রুচি, দাদার সূক্ষ্ণতা ওর আশৈশব সঙ্গী।
শ্রেষ্ঠা কুইক লার্নার। মেমরি অসাধারণ। তবুও স্বাভাবিক লেখাপড়া খুবএকটা এগোয়নি। কো-কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিতে ওর ইন্টারেস্ট অনেক বেশি। সব এগোচ্ছিল ঠিকঠাক। হঠাৎ ছন্দপতন! ওর প্রাণ-ভোমরা মাসতুতো দিদির বিয়ে হয়ে গেল। রুটিনেবাঁধা গিটগুলো আলগা হতে শুরু করল —। চাকরিজীবীদের অবসরের পর যেমন সময় মেপে কাজ করার অভ্যাস হারিয়ে যায়, শ্রেষ্ঠারও এরকম। এক লহমায় ওর গতি অনকটা কমে গেল।সময় মতো সব কাজে, সব হাজিরায় ওকে সঙ্গ দেওয়ার দিদিকে সে মিস করে। সংসারের লাইভ লাইন চলে গেলে যেরকম হয়, শ্রেষ্ঠারও সেরকম ঘটল।
মাধুরী আর শ্রেষ্ঠার যোগযোগের আরম্ভ নাটকীয়। একটা এনজিও-র চাকরি ছেড়ে দিয়েমাধুরী হন্যে হয়ে কাজ খুঁজছিল। ঠিক তখনই শ্রেষ্ঠাকে পড়ানোর অফার পায়।। ব্যস তারপর থেকেই শুরু—অজান্তে শ্রেষ্ঠা ওর সন্তান হয়ে উঠল।শ্রেষ্ঠার হাবভাবে নিজের ছেলেবেলা ফিরে পায় মাধুরী। নাচ-গান, আঁকা— বরাবর তাকে টানত। সাংসারের জাতাকলে সব ইচ্ছা চাপা পড়ে যায়। আজ আর আক্ষেপ নেই। শ্রেষ্ঠাকে পেয়ে আবার তার ইচ্ছে জাগে বেরঙা ক্যানভাসে রঙ ছড়াতে, কখনওকখনও নেচে উঠতে, গান ধরতে। বেশ আছে মাধুরী, রঙের ওপর দিয়ে রঙ দেখতে দেখতে হাটে। গুন গুন করতে করতে হাঁটে, রাস্তা পার হয়।বাড়িতেও শ্রেষ্ঠাকে দেখতে পায় নিজের ছেলে-মেয়ের মধ্যে।
সেদিন বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া সারল।তখন গভীর রাত। একসময় সব কোলাহল বন্ধ হয়ে যায়। তখনও মাধুরী তাকিয়ে থাকে । মশারির ভেতর থেকে ছোট্ট নাইট বাল্বের লাল আলো মায়াবী নেশা ধরিয়ে দেয় ওর চোখে। আস্তে আস্তে ওর চোখ বন্ধ হয়ে আসে । চোখের সামনে ভেসে ওঠে খোলা মাঠ।মাঠে ছেলেমেয়েরা ছোটাছুটি করছে।মাধুরীও ওদের দলে মিশে যায়। ওরা হাঁসছে, খেলছে, দৌঁড়চ্ছে। এমন সময় হঠাৎ ছুটে এসে, হাসি ছড়িয়ে শ্রেষ্ঠা ওকে হাতছানি দিয়ে ডাকল। এই যে অ্যান্টি, এই যে, এই দেখো আমি এসে গেছি । আমায় ধরো, ধরো…কানামাছি ভোঁ ভোঁ …
❤ Support Us