- গ | ল্প
- জানুয়ারি ৩০, ২০২২
সৎকারগাথা

অলঙ্করণ: দেব সরকার
চিতা প্রস্তুত। সামান্য কাঠ, টায়ারই বেশি। মর্গের লাশ। চারদিনের বাসী। মাথার ওপর চক্কর মারে শকুন – চিল। পচা গন্ধ টের পেয়ে গেছে। পাঁচু ডোমও নাকে হাত চাপা দেয়। দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। দূষিত হচ্ছে বাতাস। যত তাড়াতাড়ি পোড়ানো যায়। গা গোলায়। বাঁশের খাটিয়ায় শোয়ানো। গলা থেকে পেট পর্যন্ত চেরা। ট্রেনে কাটা মরা। পোস্টমর্টেম হয়েছে। পচন শুরু হলেও যুবকটির স্বাস্থ্য এখনও অটুট। পেশিবহুল। পাঁচুর কেমন মায়া হয়– আহা বেচারা। আত্মহত্যাই হবে। অভাব আর বেকারত্বের জ্বালা আর কত সহ্য হয়। এক ফালি ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে কোমরের নীচটা ঢেকে দেয়। সঙ্গের ছেলেগুলো কাছে নেই। কোন ঝুপড়িতে নির্ঘাত দেশি বোতল মারছে। পাঁচু লুঙ্গির খুঁট খুলে দেখে নেয় দুশো টাকা ঠিক আছে কিনা। বেওয়ারিশ লাশ। বেশি আর কি আশা করবে। টেনে হিঁচড়ে লাশটা চিতায় তোলে একাই। মরা মানুষের ওজন বেশি হয়। কয়লার মতো কালো বুক বেয়ে দরদর করে ঘাম ছোটে। একটা বিড়ি ধরায়। দেশলাই কাঠির আগুন না নিভিয়ে চিতায় ছুঁড়ে ফেলতে যায়।
হঠাৎ শ্মশানের বাইরে হৈ চৈ। পাঁচু শুনতে পায় হরিধ্বনি – বল হরি হরি বোল। মুহূর্তে চারপাশটা অগরু সেন্ট আর চন্দন ধূপের গন্ধে ভরে যায়। নির্ঘাত বড়লোক মরা। পাঁচু ভাবে – আমদানি ভালই হবে। আগের লাশটা তাড়াতাড়ি পোড়াতে হবে। মালের বোতল থেকে খানিকটা ঢেলে দেয় মৃতদেহে। হাওয়া এখন গঙ্গার দিকে। দেশলাই মারলে দুঘণ্টার মরা আধঘণ্টায় নেমে যাবে। হঠাৎ চারজন ষণ্ডামার্কা যুবক চিতার সামনে আসে। পরনে সাদা পাজামা পাঞ্জাবি। দুজনের গালে কাটা দাগ। দূর্গন্ধে নাকে রুমাল চাপা দেয়। গলা সপ্তমে চড়িয়ে একজন বলে – কে আছিস? পাঁচু জবাব দেয় – আজ্ঞে বাবু আমিই আছি। পাঁচু ডোম।
— লাশটা নামা।
— চিতা থেকে লাশ নামানো পাপ। আগে ও চিতায় উঠেছে।
— বেশি বাওয়ালি করিস না। আমাদের নেতা আগে উঠবে।
— শ্মশানে নেতা বা বেওয়ারিশ কোন তফাৎ নেই। সব সমান।
— জ্ঞান মারিস না। চারজনই ধমকে ওঠে। একজন ফিসফিস করে বলে –শালা যেন পাবলিক বাথরুম। শ্মশানেও আজকাল লাইন।
— আস্তে নেতা শুনতে পাবে।
— নেতা তো মরেই ভূত। শুনবে কি রে?
— আরও নেতা এসেছে, গলায় মালা দিতে।
হঠাৎ পাঁচু ডোমের মনে পড়ে গঙ্গার পাড়ে ফেলে আসা বেওয়ারিশ লাশটার কথা। ওটার সদগতি করতে হবে। নীচে নেমে দেখে লাশ নেই।
পাঁচু আর কথা বাড়ায় না। বেওয়ারিশ লাশটাকে সিঁড়ি দিয়ে টানতে টানতে গঙ্গার পাড়ে নামিয়ে আসে। ফুলের মালায় প্রায় দেখা যাচ্ছে না নেতার মুখ। রজনীগন্ধার গন্ধে ভরে গেছে চারপাশ। পাঁচু মালাগুলো নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে গঙ্গার পাড়ে। একটা মালা বেওয়ারিশ লাশের গলায় পড়ে। প্রচুর লোক এসেছে। শ দুয়েক হবে। গিজগিজ করছে শ্মশান, কোভিড বিধি তোয়াক্কা না করে। মাস্কে ঢাকা নেই নেতার মুখও। নেতাদের করোনা হয় না, করোনা ছড়ায়। দুর্নীতি, কাটমানি, হিংসা, বিভেদের করোনা। মানুষ মরে গেলে সাধারণতঃ চোখের পাতা আপনা থেকেই বুজে যায়। কিন্তু এখনও অপলক চেয়ে আছে নেতা। জবা ফুলের মতো লাল টকটকে। পাঁচু এমন ভয়ংকর চোখ দেখেনি জীবনে। যেন এইমাত্র জেগে উঠে বসবে; বলবে – আমি মরিনি এখনও। নেতারা মরে না কখনও। খাকি পোশাকে দুএকজন পুলিশ অফিসারও এসেছে। একজন পুলিশ অফিসার ফিসফিস করে একটি ছেলেকে কিসব বলে। দৌড়ে যায় ছেলেটি। হাতে একটা টিন নিয়ে আসে। পাঁচু খুলে দেখে টাটকা ঘি। কিলো দশ বারো হবে। মনে মনে ভাবে, নেতা বেঁচে থাকাকালীন ভালই কামিয়েছে। এখন তাঁর প্রতি, তাঁর মৃত আত্মার প্রতি কৃতজ্ঞতা দেখাচ্ছে।
পাঁচু আর দেরি করে না। চিতা সাজাতে শুরু করে। আকাশের অবস্থা ভাল নয়। যে কোন মুহূর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। বর্ষার জলে চিতা জ্বালিয়ে রাখা মুশকিল। অর্ধদগ্ধ নেতার দেহ বেওয়ারিশ ট্রেনে কাটা পড়া লাশটার মতই বীভৎস দেখাবে। পাঁচু নেতার পাঞ্জাবি খুলে ফেলে। ধুতি খুলতে গেলে সবাই হৈ হৈ করে ওঠে। তাদের কথায় কান না দিয়ে নিজের মনে কাজ করে যায়। একটি ষণ্ডামার্কা ছেলে আস্তে আস্তে বলে – কি করছিস? ন্যাংটো করে ফেলবি নাকি? পাঁচু খুলতে খুলতেই জবাব দেয় – আজ্ঞে বাবু এটাই নিয়ম। মানুষ ন্যাংটো হয়ে জন্মায়, ন্যাংটো হয়েই মরে। সঙ্গে কিছুই নিয়ে যেতে পারে না। সিল্কের ধুতি পাঞ্জাবি এক জায়গায় জড়ো করে রাখে। মনে মনে ভাবে, এরকম দু-একজন নেতা মাসে অন্তত মরলে পাঁচুর বরাত খুলে যাবে। কিন্তু নেতাদের জান শক্ত। সহজে মরে না। উদোম শরীরে পাঁচু ঘি মাখায়। একজন মন্তব্য করে – ভাল করে মাখা। এক ফোঁটা যেন পড়ে না থাকে। পাঁচু কথায় কান না দিয়ে কায়দা করে অল্প ঘি তালুতে ঘষে ঘষে মাখায়। হাতের তালুর উষ্ণতায় ঘি গলে গিয়ে বেশি পরিমাণ মনে হয়। ভাবে, নেতার নাদুস-নুদুস ঘি খাওয়া শরীর। বেশি মাখাতে হবে না। বরং বাঁচাতে পারলে তার লাভ।
চিতায় ধরাধরি করে নেতাকে তোলা হয়। পাটকাঠির ডগায় আগুন ধরিয়ে অপেক্ষা করে মুখাগ্নির জন্য। উপস্থিত শবযাত্রীদের মধ্যে চাপা শোরগোল শুরু হয়। পাঁচু তাড়া দেয় – তাড়াতাড়ি করুন। বড় ছেলে কে? কেউ এগিয়ে আসে না।
—তবে ছোটজনই আসুক। সবাই নিরুত্তর।
পাঁচু অধৈর্য হয় – বাবার মুখে আগুন দিতে কোন ছেলেই আসেনি। আশ্চর্য! মনে মনে বলে, একটাও আসেনি। কি পাষণ্ড ছেলেগুলো। নেতার মতো বাবার মুখে আগুন দেওয়ার জন্য কেউ আসেনি। শালা দিনকাল কি হোলো!
উপস্থিত একজন শবযাত্রী আমতা আমতা করে বলে – উনি ব্যাচেলর।…. তবে ওনার অনেক পোষা মেয়েছেলে ছিল। তাদের গর্ভে হয়ত … মুখ ফসকে বলতে গিয়েও চেপে গেল।
ষণ্ডামার্কা ছেলেগুলো হঠাৎ বলে ওঠে – আমরাই ওনার ছেলের মতো। চলবে? একজন এগিয়ে পাটকাঠির আগুন নেতার মুখে গুঁজে দেয়। পাঁচু চেঁচিয়ে ওঠে – বল হরি হরি বোল। উপস্থিত সবাই তার সঙ্গে গলা মেলায়। দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে নেতার দেহ। পাঁচু একটা বাঁশ নিয়ে তৈরি থাকে নেতার মাথাটা সময়মত এক মোক্ষম ঘা-এ গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা লাগে দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যেতে। কলস থেকে গঙ্গাজল ছিটিয়ে চিতা ঠান্ডা করে।
সন্ধ্যা হয়ে আসছে। ইনকাম ভালই হয়েছে। সারা শরীর জুড়ে একরাশ ক্লান্তি। আগুনের তাতে ভাজাভাজা। ভাবে, এক বোতল মেরে এলে মন্দ হয় না। চিতার আগুন নেভে না কখনও। যে কোন মুহূর্তে মরা পোড়ানোর জন্য আবার তার ডাক পড়বে। অবসর নেই। হঠাৎ পাঁচু ডোমের মনে পড়ে গঙ্গার পাড়ে ফেলে আসা বেওয়ারিশ লাশটার কথা। ওটার সদগতি করতে হবে। নীচে নেমে দেখে লাশ নেই। শকুন-কুকুরে খুবলে ছিঁড়ে খেয়ে সাবাড় করে দিয়েছে প্রায় পুরো দেহটা। হাড় কখানা অবশিষ্ট পড়ে আছে। মনটা বিশ্রী হয়ে যায়। এত দ্রুত সব শেষ হয়ে যাবে ভাবেনি সে। তাকে আর কষ্ট করে পোড়াতে হয় না। হঠাৎ দেখে বিস্মিত হয়। তলপেটের কাছে নাভিটা এখনও অক্ষত। সামান্য দেরি হলে ওটাও খেয়ে ফেলত শকুন-কুকুরগুলো। পাঁচু তাড়া দেয়। ওরা সরে যায়। নাভিটা তুলে নেয়। গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেয়।
♦−♦−♦♦−♦−♦
❤ Support Us