- দে । শ
- নভেম্বর ২৫, ২০২৩
বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপনী প্রচার নিয়ে সুপ্রিম অভিমতে রুষ্ঠ রামদেব। অভিযোগ প্রমাণিত হলে “মৃত্যুদণ্ড” নিতে প্রস্তুত, পাল্টা হুঙ্কার
আবার বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঘনিষ্ট স্বঘোষিত যোগগুরু বাবা রামদেব। দেশে মহামারীর সময় “করোনার ওষুধ” কিংবা অন্য কোনও রজার চিকিৎসায় আয়ুর্বেদিক জড়িবুটির সাফল্য নিয়ে বিভিন্ন সময়ে রামদেবের আয়ুর্বেদিক সংস্থা “পতঞ্জলি”র বিভিন্ন পণ্য বিজ্ঞপন করেছে এবং সেই বিজ্ঞাপন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। আগেও বিজ্ঞাপনী প্রচারে এই “ভুল বার্তা” দেওয়ার অভিযোগে পতঞ্জলির বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে আদালতে। তবে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপনী প্রচারের জন্য পতঞ্জলির পণ্য পিছু ১ কোটি টাকা করে জরিমানা করা হতে পারে। এই কথা কানে আসতেই রামদেবও পাল্টা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন। স্বঘোষিত যোগগুরুর দাবি, যদি তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়ানোর অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তবে তিনি মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি পর্যন্ত হতেও প্রস্তুত।
প্রসঙ্গত, গত ২১ নভেম্বর বাবা রামদেবের আয়ুর্বেদিক সংস্থা পতঞ্জলির উদ্দেশে কঠোর সতর্কবার্তা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। শীর্ষ আদালত বলেছে, বিভিন্ন রোগের নিরাময় হিসাবে তাঁর সংস্থার বিজ্ঞাপনে যে “মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর দাবি” করছে তা বন্ধ করতে হবে। সেটা না করলে প্রতিটি দাবির জন্য পণ্য পিছু ১ কোটি টাকা জরিমানা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলিকে।
প্রসঙ্গত, ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএমএ-এর একটি আবেদনের ভিত্তিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি আহসানউদ্দিন আমানুল্লাহ এবং বিচারপতি প্রশান্তকুমার মিশ্রের বেঞ্চে গত ২১ নভেম্বর এই মামলা শুনেছে। তারপর আদালতের মৌখিক পর্যবেক্ষণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপনী প্রচারের জন্য প্রতি পণ্য পিছু রামদেবের সংস্থাকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করা হতে পারে। আদালত এটা মৌখিক ভাবে জানানোর পর কোমর বেঁধে ময়দানে নেমে পড়েছে রামদেবের সংস্থা।
রামদেবের অভিযোগ, কয়েক জন চিকিৎসক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে তাঁর সংস্থাকে কালিমালিপ্ত করতে চাইছেন। এবং সেই চেষ্টাই তাঁরা ক্রমাগত করে আসছেন। রামদেবের দাবি, ওই চিকিৎসকেরা আসলে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছেন, শুধু রামদেবকেই হেয় করছে তা নয়। রামদেবের পাল্টা অভিযোগ, “পতঞ্জলি সংস্থার নামে মিথ্যা প্রচার করা হচ্ছে।”
২১ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের এই পর্যবেক্ষণ এবং মন্তব্য জানার পর উত্তরাখণ্ডের হরিদ্বারে একটি সাংবাদিক বৈঠক করেন রামদেব। সেখানে স্বঘোষিত যোগগুরু বলেন, “বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এখন একটি খবরই ভাইরাল। সেটা হল, সুপ্রিম কোর্ট পতঞ্জলিকে ভর্ৎসনা করেছে। শীর্ষ আদালত বলেছে, যদি মিথ্যা প্রচার চালানো হয় তবে জরিমানা দিতে হবে।”
সাংবাদিক বৈঠকে রামদেব দাবি করেন, “আমার সংস্থা কোনও মিথ্যা প্রচার করেননি। তাঁদের বিরুদ্ধে কয়েক জন চিকিৎসক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছেন।” তার আরও উচ্চগ্রামে গিয়ে সুর চড়িয়ে রামদেব বলেন, “যদি আমরা মিথ্যাবাদী হই, তবে ১০০০ কোটি টাকা জরিমানা করুন। আমরা মৃত্যুদণ্ডের মুখোমুখি হতেও প্রস্তুত।”
বস্তুত, গত কয়েক বছরের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি-ঘনিষ্ঠ এই স্বঘোষিত যোগগুরুর সংস্থা পতঞ্জলির নাম যেমন বিতর্কে জড়িয়েছে, তেমনই উল্টো দিক থেকে তাঁর সংস্থার শ্রীবৃদ্ধিও ঘটেছে খুব বড় আকারে। সারা দেশে তাঁর সংস্থার শোরুম রয়েছে।
সাম্প্রতিক বিতর্ক নিয়ে রামদেব দাবি করেছেন, “আমরা যদি মিথ্যাবাদী না হই, তা হলে যাঁরা যাঁরা মিথ্যা ছড়িয়েছেন, প্রত্যেককে শাস্তি দিন। গত ৫ বছর ধরে রামদেব এবং পতঞ্জলিকে নিশানা করা হচ্ছে।”
এই বিতর্কের সূত্রপাত দেশে মহামারীর সময় থেকে। সেই সময় “করোনা প্রতিরোধী” ওষুধ “করোনিল কিট” বাজারে এনেছিল রামদেবের আয়ুর্বেদিক সংস্থা পতঞ্জলি। তখন অভিযোগ ওঠে, করোনা প্রতিরোধী না-হওয়া সত্ত্বেও শুধু করোনিল কিট বিক্রি করেই প্রায় আড়াইশো কোটি টাকার বেশি মুনাফা করে রামদেবের সংস্থা।
২০২০ সালের ২৩ জুন প্রথম বার বাজারে এসেছিল করোনিল কিট। করোনিল এবং শ্বাসারি বটি নামে দু’ধরনের ট্যাবলেট এবং অণু তেল নামের ২০ মিলিলিটারের একটি তেলের শিশি নিয়ে তৈরি ওই কিটের দাম রাখা হয় ৫৪৫ টাকা। তখন বিজ্ঞপনে উল্লেখ করা হয়েছিল, চাইলে আলাদা ভাবে ট্যাবলেট এবং তেল কেনা যাবে বলেও। এই বিজ্ঞপন দিয়েছিল রামদেবের সংস্থা পতঞ্জলি। প্রচুর পরিমানে সেই ওষুধ বিক্রি হয়। মানুষ তখন মৃত্যু ভয়ে ভীত, তাই হাতের কাছে যা পেয়েছে সেটাকেই প্রাণ রক্ষাকারী ওষুধ হিসেবে কিনেছে, শুধু বাঁচার আশায়। রামদেবের সংস্থা হিসাব দিয়ে জানিয়েছিল, গত অক্টোবর মাস পর্যন্ত মোট ২৩ লক্ষ ৫৪ হাজার করোনিল কিট বিক্রি করেছে তারা।
তখন থেকেই করোনিল-বিতর্ক শুরু হয়। ওই সংস্থার বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে মিথ্যা বিজ্ঞাপনী প্রচারের অভিযোগ এনেছিল আইএমএ। সেই প্রেক্ষিতেই সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনার মুখে পড়েছে রামদেবের সংস্থা।
রামদেবের সংস্থার বিরুদ্ধে মামলার শুনানিতে সরকারের উদ্দেশেও বেশ কিছু বার্তা দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। বলা হয়েছে, এমন মিথ্যা বা বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনী প্রচার বন্ধ করতে সরকারের কোনও নির্দেশিকা থাকলে ভাল হয়।
সুপ্রিম কোর্টের মন্তব্যের পর রামদেব কিন্তু মাথা নোয়াতে একদম রাজি নন। তাঁর বক্তব্য, “যত রকম খারাপ এবং অপশক্তি রয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংস্থার লড়াই চলছে এবং চলবে।”
এর আগেও রামদেবের বেফাঁস মন্তব্য নিয়ে বিতর্ক হয়েছে। কিছু দিন আগে রামদেবের একটি ভিডিয়ো ছড়িয়ে পড়েছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ভিডিওতে বাবা রামদেবকে বলতে শোনা গেছে, “মেয়েদের শাড়ি পরলে দেখতে ভালই লাগে, সালোয়ার পরলেও ভাল লাগে। কিছু না পরলেও ভাল লাগে।” এ ছাড়াও অ্যালোপ্যাথি ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে মন্তব্য করেও বিতর্ক তৈরি করেছেন রামদেব। এ জন্যও তাঁর সমালোচনা করেছিল সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এনভি রমণার নেতৃত্বে একটি বেঞ্চ। সেই বেঞ্চ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিল, রামদেব আয়ুর্বেদশাস্ত্র জনপ্রিয় করার জন্য প্রচার চালাতেই পারেন। কিন্তু তার জন্য তাঁর অন্যান্য চিকিৎসা ব্যবস্থার সমালোচনা করা উচিত নয়। কিন্তু তার পরেই বাবা রামদেব কোনও এক অদৃশ্যি শক্তির ইন্ধনে থামেননি। তাই এবারও সুপ্রিম কোর্টের পর্যবেক্ষণের বিরুদ্ধে তিনি গলা ছেড়েছেন। তবে তাঁর সংস্থা পতঞ্জলির ওষুধ যে করোনা নিরাময়ে সক্ষম সেটা প্রমাণ করা বা তাঁর সংস্থার অন্যান্য ওষুধ যে রোগ নিরাময়ে মহৌষধি সেটা কি তিনি প্রমাণ করতে পারবেন? এই প্রশ্ন উঠছে কারণ তিনি শীর্ষ আদালতের পর্যবেক্ষণ শোনার পরেই মহা হুঙ্কারে অন্যান্য চিকিৎসা পদ্ধতিকে আবারও তাঁর নিজস্ব ঢঙে সমালোচনা করা শুরু করে নিজের ওষুধের জীবন রক্ষার পক্ষে মুখ খুলেছেন, আর এটাই তাঁকে করতে নিষেধ করেছিল শীর্ষ আদালত।
❤ Support Us