- পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
- ডিসেম্বর ১৭, ২০২৩
প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি। অন্তিম পর্ব
পর্দায় দেখে ধরাছোঁয়ার বাইরে জগতের মানুষ বলে দর্শক যখন মনে করতো, তখন তাঁদের থিয়েটারে নিয়ে এসে আমজনতার সঙ্গে পরিচিতিকরণের অনুঘটকের কাজটিও করে দিয়েছিলেন প্রেমাংকুর আতর্থী, স্বপ্নের মানুষদের নামিয়ে এনেছিলেন মর্তের মাটিতে....তারপর
![প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি। অন্তিম পর্ব](https://aramva.co/wp-content/uploads/2023/12/prmankur-atietha.png)
চিত্রকর্ম: দেব সরকার
♦ পাঁচ ♦
প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর বর্ণাঢ্য জীবনে তাঁর সাহিত্য জীবন এতটাই প্রোজ্জ্বল ছিল যে, তিনি অন্য কিছু না করলেও ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকতে পারতেন শুধু লেখার সুবাদে। তিনি তাঁর নিজস্ব কল্পনা-শৈলীকে সৃজনরসে জারিত করে অনুপম লোকায়িত প্রত্যাশার স্বর্ণচুড়ে স্থাপন করতে পেরেছিলেন অতি সহজিয়া ভঙ্গিতে। ‘চাষার মেয়ে’ উপন্যাসের পরই তাঁর ‘আনারকলি’ (১৯২৫) উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাঠকমহলে তাঁর জনপ্রিয়তা ঈপ্সিত উচ্চতায় পৌঁছে যায়। অবশ্য তার আগে ১৯১৯ সালে গল্প সংকলন ‘বাজিকর’ পাঠকমনে তাঁর আসন পাকা করে দেয়। ‘তখত তাউস’ উপন্যাসটি লেখক হিসেবে তাঁর সৃজন ক্ষমতার স্বরূপটি পাঠকদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়, কল্লোল যুগের বিতর্ক এড়িয়ে সাহিত্যকে ছকবন্দী ধারার বাইরে অন্য খাতে প্রবাহিত করার জাদুকাঠি তিনি যে আয়ত্ত করে ফেলেছেন, সমঝদার পাঠকদের চোখে সহজেই তা ধরা পড়ে গিয়েছিল।
‘বোম্বে’ থাকাকালীন যেমন তিনি ভিখিরিদের সঙ্গে রাত কাটিয়েছিলেন, তেমনি অঢেল অর্থশালী ও বিলাসবহুল জীবন যাপনে অভ্যস্ত মানুষদের সংস্পর্শেও এসেছিলেন। কিন্তু তাঁর ফকিরিসুলভ মনের আলখাল্লা কোথাও খসে পড়েনি।
কখনো কোন বাড়িতে ফাই-ফরমাশ খাটা চাকরের কাজও যেমন করেছেন, তেমনি গৃহশিক্ষক হিসেবে কারও বাড়িতে থেকে দু’মুঠো পেটের ভাত সংগ্রহ করেছেন। প্রকৃতির জগতে জীবজন্তু, কীটপতঙ্গ, পক্ষীকূল, সবার যেমন আহারের সংস্থান থাকে, তেমনি মানুষেরও থাকে। তাঁর চোখে সাধু-সন্ন্যাসী, সন্ত-ফকিরগণ প্রকৃত আদর্শ মানুষ বলে বিবেচিত হয়েছেন। তবে সাধকদের মধ্যে যেমন পোহারী বাবার মত বায়ু-ভক্ষণকারি উচ্চ-মার্গের মানুষদের সন্ধান তিনি পেয়েছেন, তেমনি সাধুবেশে চোর-চুট্টা দাগাবাজ লুম্পেনদেরও খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি যেখানে গিয়েছেন শুধু মানুষ দেখেছেন। মানুষ, আর মানুষ। আর এই সমুদ্রের ফেনারাশির মত জগৎব্যাপী মানুষের ঢল দেখে তিনি যেমন বিস্মিত হয়েছেন, তেমনি পাশাপাশি যখন সর্বহারা দুস্থ রোগী, কুষ্ট ব্যাধিগ্রস্ত মানুষদের দেখেছেন, তখন তাদের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা, দিনের পর দিন বসেও থেকেছেন। বাল্যকালে শোনা দেওঘরের রাজনারায়ণ বসুর বাড়ির গল্প জীবনে কোনদিন ভুলেননি।
তাঁর মনের কোণে ঘাপটি মেরে বসে থাকা অজস্র স্মৃতির-মেঘমালা তাঁকে কখনো স্বস্তি দেয়নি। ভেতরে ঘূর্ণির আবেগ তৈরি করেছে। সেই আবেগ সৃষ্টি-প্লাবনে রূপান্তরিত হয়ে তাঁকে দিয়ে শুধু লিখিয়ে নিয়েছে। বাল্যকালে পিতার মার খেয়ে রক্ত উঠেছিল তাঁর মুখে, আর জীবনের পথে চলতে গিয়ে তিনি দেখেছিলেন সবলের মারে দুর্বলকে মুখে রক্ত উঠে মরতে। তাই দুর্বলদের প্রতি স্বভাবসুলভ নীরব টান অনুক্ষণ অনুভব করেছেন তিনি।
একদা লাটাই ছেঁড়া ঘুড়ির মত তাঁর জীবন ছিল, খাবারের সংস্থান ছিল না, তবু সে জীবনে রূপ-সচেতনতা ছিল, নারীর প্রতি নিঃশব্দ প্রতিক্রিয়াহীন মোহ ছিল, তাঁর মতো আশ্রয়হীনকে যাঁরা আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ ছিল। জীবনে হয়ত কলঙ্ক ছিল, কিন্তু সৌর-কলঙ্কের মতোই তা স্বাভাবিক ছিল। তাই তারজন্য বিশেষ অনুশোচনা ছিল না মনে। ‘অস্থি ও মস্তির সম্পর্ক’ যে অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত।
রূপোলী পর্দার জগতে এসে তারই প্রতিফলন দেখেছিলেন কাঁচের গ্লাসে বিচ্ছুরিত সৌর-সৌন্দর্যের মতো। কখনো বা দেখেছিলেন, সৌন্দর্য নয়, অর্থ-প্রাচুর্যকেই ব্যক্তিত্বের ক্রমণ-শক্তি হয়ে উঠতে; নিয়ন্ত্রিত নয়, অনিয়ন্ত্রিত উপভোগ্য-জীবনকেই জীবনের চাবিকাঠি হয়ে উঠতে। দেখেছেন ওই পর্যন্তই, কিন্তু অটল রেখেছেন নিজেকে। কারণ তিনি জানেন, প্রেম চিরন্তন, ভিলেনের পাথর-হৃদয়কেও তা টলিয়ে দিতে পারে, শুকনো চোখে বন্যার জল আনতে পারে, তাই প্রেম প্রাণ-রাধিকা, জীবনের দীপ্ত-শিখা, যুগ যুগান্তর তার জন্য শুধু অপেক্ষাই করা যায়, তাকে ছোঁয়া যায় না। বোধের শুদ্ধিকরণ-শেষে তাঁর পরিক্রমণ সমাপ্ত হয়, পথের ক্লান্তিবিষ সবটুকই গলার্ধকরণ করে তিনি হয়ে ওঠেন নীলকন্ঠ,–অমরলোকের সুপ্ত কণ্ঠ। ‘বিষ পরিহরি’ ‘মধুর ভান্ড’ তিনি। বিষের বিশুদ্ধকরণের মধ্য দিয়েই মধুর জন্ম হয়। তাই পরিণত বয়সে সেই বিশুদ্ধ-বিষই তাঁকে ‘মহাস্থবির জাতক’ লেখার অনুপ্রেরণা দেয়।
৭৪ বছরের জীবন কাহিনীর মধ্যে মাত্র ২৫টা বছরকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসের জন্য। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য –’যখন গল্প লিখলুম, লোকে বলল, এসব আমার নিজের কথা। আর যখন আত্মজীবনী লিখলুম সবাই বলল–গল্প লিখেছি।’ সবাই যে ভুল বলেছে বলা যাবে না, কারণ জীবন তো গল্পের মতই
১২ বছর বয়সে প্রথম সারনাথ দর্শন করে, বুদ্ধের চরণতলে সব ভক্তিরস অর্পণ করে, আরও বারো বছর পরিব্রাজক-জীবন শেষে স্বভূমি কলকাতায় ফেরেন তিনি। শুরু হয় তাঁর কর্মজীবন। আর সে-জীবনের সমাপ্তির ডংকা যখন বেজে ওঠে, তখন মহাজীবনের পোট্রেট নির্মাণের আবেগ তিনি অনুভব করেন। তবে জীবনের সবটা নয়, খন্ড খন্ড কয়েকটি জীবনের ছবি, পূর্ণ জীবন থেকে বেছে নেওয়া পঁচিশ বছরের জীবনের ছবি। এই জীবনের ইতিবৃত্ত লেখার তাগিদ ভেতর থেকে অনুভব করেন–যেন কোন অন্তর-দেবতার প্রত্যাদেশেই তা করেন। প্রত্যাদেশ পালন করা ছাড়া তাঁর সামনে কোন বিকল্পও থাকে না তখন।
জীবনের অর্ধশতক অতিক্রম করার পর এটা ছিল তাঁর আত্মইচ্ছার-নৈবদ্য, চার খন্ডের অনন্য সৃষ্টির রসদ-ভান্ডার, যেন আর এক জাতককাহিনী! এক জীবন তো বহু জীবনের সমাহার, সবই যেন পুনর্জন্মের বাহার! লাটাই ছেঁড়া ঘুড়ির মত তিনি ঘুরেছেন, কিন্তু পরিক্রমণ শেষে নিশ্চিত হয়েছেন যে লাটাই রয়েছে অন্য হাতে। যখন সে গুটিয়ে নেবে, যেতে হবে। মুহূর্ত-বিলম্বও সে সইতে পারে না যে!
‘মহাস্থবির জাতক’, তাই বোধহয় তাঁর জীবন-প্রবাহের শেষ লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে। অনবরত কলম চালাতে থাকেন তিনি। প্রথম তিন খন্ড লেখার পর অনুভব করেন, মন চাইলেও শরীর চাইছে না। তবু থামেন না। অন্যের সাহায্য নিয়ে শেষ খন্ডের নির্মাণের কাজ শেষ করেন। এই জীবন-আলেখ্য লেখার কাজ যখন শুরু করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৫৪ বছর, আর যখন শেষ করেন তখন বয়স জানান দেয় তাঁর বয়স হয়েছে ৬৪ বছর।
প্রশ্ন ওঠে কেন তিনি তাঁর চার খন্ডের ৭০০ পৃষ্ঠার আত্মজীবীমূলক এই বইয়ের নাম ‘মহাস্থবির জাতক’ দিলেন? ‘জাতক’ নাম শুনলেই তো পাঠক ধরে নেবে গৌতম বুদ্ধের জাতক কাহিনি, হয়ত কোন নতুন আঙ্গিকে লিখেছেন তিনি। কিন্তু কাহিনির কথক-স্বর যে মহাস্থবির শর্মা তার সঙ্গে বুদ্ধ বা বৌদ্ধ ধর্মের লেশমাত্র সংযোগ নেই। বস্তুতঃ এটা লেখকের নিজের আত্মার জবানবন্দী, অকপট স্বীকাোক্তি, যার পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এক আশ্চর্য্য মুগ্ধতার আবেশ। বুদ্ধ তাঁর অজস্র জন্মের কথা বলে গিয়েছেন তাঁর জাতক কাহিনিতে। আর মহাস্থবির শর্মা তাঁর এক জন্মেই বহু জন্মের কথা বলে গিয়েছেন, খন্ড খন্ড উপস্থাপনার ভঙ্গিতে।
না, তাঁর ৭৪ বছরের জীবন কাহিনীর মধ্যে মাত্র ২৫টা বছরকে তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাঁর এই আত্মজৈবনিক উপন্যাসের জন্য। এ সম্পর্কে তাঁর বক্তব্য হল–’যখন গল্প লিখলুম, লোকে বলল, এসব আমার নিজের কথা। আর যখন আত্মজীবনী লিখলুম সবাই বলল–গল্প লিখেছি।’ সবাই যে ভুল বলেছে বলা যাবে না, কারণ জীবন তো গল্পের মতই।
আত্মজীবনী বলতে সাধারণতঃ লোক লেখকের নিজস্ব-কথা, বংশ-পরিচয়, কূল-গৌরব, বংশীয় লোকের কীর্তি-কাহিনী এবং তারসঙ্গে পরিবার-পরিজন, সন্তান-সন্ততি, জমিজমা ও তাই নিয়ে বিস্তর মামলা-মকর্দ্দমা ইত্যাদি ষয়গুলিই বুঝে থাকে। কিন্তু আত্মীয়দের বাইরেও যে আত্মীয়, যাদের সঙ্গে কোন রক্তের সম্পর্ক ননেই, এমনকি জাত-ধর্মে-বর্ণে-গোত্রে কোন মিল নাই, ভাষার মিল নেই, তারাও যে জীবনের সবখানি জুড়ে থাকতে পারে –একথা তারাই শুধু বোঝে, যারা বোঝে জীবন শুধু বোঝার জন্য, নিক্তি পাল্লা দিয়ে ওজন করার জন্য নয়। রক্তের সম্পর্কের থেকে মনের সম্পর্ক বহুগুণ ভারী। আর ভারী বলেই হৃদয়-কন্দরে পাথরের মত চেপে বসে থাকে, কিছুতেই উঠানো যায় না তাকে। সচেতন লেখক শুধু সচেতন পাঠকদের জন্যই লেখেন, কোন আত্মীয়-পরিজনদের জন্য নয়। তাই প্রেমাঙ্কুরের লেখার মধ্যে রাজকুমারী, দিদিমণি, পরেশদা, হিমালয়ের আড়াইশো বছরের সাধু, নবাব সাহেব কিম্বা পেয়ারা সাহেবের মত মানুষেরা জীবন্ত হয়ে উঠে, রক্তের সম্পর্কের লোকেরা ‘ফসিল’ হয়ে আড়ালে চলে গিয়েছে।
শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ আর ‘মহাস্থবির’ শর্মার মধ্যে পাঠক সূক্ষ্ম-মিলের সম্পর্ক খুঁজে পেতে পারেন। শরৎচন্দ্রের থেকে বয়সে তিনি ১৫/১৬ বছরের ছোট হলেও সাধন-সঙ্গী হিসেবে তাঁরই সমসাময়িক। তাই লেখার ক্ষেত্রে তাঁর প্রদর্শিত পথকেই অনুকরণীয় বলে মনে হয়েছিল তাঁর। অনেকেই প্রশ্ন করেন এর কি গৌণ কারণ ছিল? হয়ত ছিল কিংবা ছিল না। আর থাকা বা না-থাকা তো কোন সার্বজনীন ব্যাপার নয়। অজান্তেই কখন কার মনে কার ছায়া পড়ে, তাও গবেষণার বিষয় নয়, অনুভবের বিষয়। তবে শরৎচন্দ্র তাঁর অনুজ ভাতৃতুল্য প্রেমাঙ্কুরের প্রতি যে তাঁর স্নেহময় প্রীতির-দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছিলেন, তা বলা যেতে পারে। তবে তিনি তাঁর অগ্রজ শরৎচন্দ্রের ‘বড় দিদি’, ‘পরিণীতা’, ‘পল্লীসমাজ’, ‘দেবদাস’, ‘চরিত্রহীন’, ‘দত্তা’, ‘গৃহদাহ’ ইত্যাদি বইগুলো থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তার প্রমাণ আছে। প্রমাণ প্রথমতঃ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী নিয়মিতভাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় শরৎচন্দ্রের গ্রন্থের আলোচনা করতেন এবং সেসব আলোচনা এত উচ্চাঙ্গের হত যে স্বয়ং শরৎচন্দ্র তাঁকে ডেকে রীতিমত ভর্ৎসনা করে একদিন বলেছিলেন,–‘তুমি লিখছ না কেন?’ অর্থাৎ শরৎচন্দ্র যে প্রেমাঙ্কুরের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রত্যয়ী ছিলেন তা বলা যেতে পারে। কারণ গুরু মেলে লাখে লাখে, শিষ্য মেলা ভার।
এতদসত্ত্বেও প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ব্যাপারে আক্ষেপের কারণ আছে। তাঁর লেখা কোন বই আজ বইমেলায় খুঁজে পাওয়া যায় না। পাঠকও খোঁজ করে না। প্রকাশকরাও তাই ছাপেন না। অথচ এই কয়েক দশক আগেও তাঁর বই হটকেকের মতো বিক্রি হয়েছে।
তাঁর স্বল্পকালীন সৃষ্টিশীল জীবনে তিনি ১৫ টি বই লিখেছেন, ১৭ টি চলচিত্রে অভিনয় করেছেন এবং অনেকগুলির পরিচালনার দায়িত্বভার স্বহস্তে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু হালফিল পাঠক কি চাইছে, আর কি চাইছে না, সেটা বড় কথা নয়, তাঁর ‘মহাস্থবির জাতক’ বাংলা সাহিত্যর ১০০ টি সেরা বইয়ের মধ্যে যে একটি —সেটাই বড় কথা।
তাঁর কলকাতার জীবনে বিচিত্র ঘটনার বিবরণ আছে, তেমনি যৌবনের উন্মেষ-কাল থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত আসা-যাওয়া প্রেম-জাগানিয়া নারীদের কথাও আছে। সোজা কথাটি সোজাভাবে না বলে, হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবেশন করে গিয়েছেন আতর্থী
কি আছে এই বইটিতে? তার আভাস আগেই দেওয়া হয়েছে। পুনুরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন জেনেও সারসংক্ষেপ অনভিপ্রেত নয়। কেন নয়? নামে বইটি যতটা গুরুগম্ভীর, চরিত্র-চলনে তার ধারেকাছেও নয়। কারণ তাঁর ৭৪ বছরের জীবন কালের মধ্যে মাত্র পঁচিশ বছরের জীবনবৃত্তান্ত আছে এতে, যে জীবন পুরোপুরি বোহেমিয়ান ভবঘুরের জীবন। তাই চলতে চলতে যাদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল এবং নানা সম্পর্কের বন্ধন তৈরি হয়েছিল, স্রেফ তাদের কথা দিয়েই বইটি মালার মত গাঁথা হয়েছে। বোম্বে গিয়ে ভিখিরীদের সঙ্গে যেমন বসতে হয়েছে, খাবারের ভাগ নিয়ে বচসা, এমনকি মারামারি পর্যন্ত করতে হয়েছে, একটানা ১২ ঘণ্টা খিদের জ্বালায় চাষীর খেতে ছ’পয়সা মজুরিতে শষ্য রোপন করতে হয়েছে, জমির আগাছা ও ঘাস নিংড়ানোর কাজ করতে হয়েছে, তেমনি আবার বড় লোকের ড্রয়িং রুমে প্রবেশের করার মত সৌভাগ্যও হয়েছে।
তাঁর কলকাতার জীবনে ঘোড়ায়-টানা ট্রাম, ব্রাহ্ম-সমাজ, পাগলা-সন্ন্যাসী ইত্যাদি বিচিত্র ঘটনার বিবরণ আছে, তেমনি যৌবনের উন্মেষ-কাল থেকে মধ্যকাল পর্যন্ত আসা-যাওয়া প্রেম-জাগানিয়া নারীদের কথাও আছে। প্রেম আর বিয়ে এক নয়। প্রেম করার জন্য মনের টান, আর বিয়ে করার জন্য শরীরের টানই আসল, বাকি সব প্রক্রিয়া-উপক্রিয়া এবং শাস্ত্রীয় বচন-প্রবচন, বাহ্যিক-ক্রিয়াকলাপ লোক-দেখানো ভন্ডামির ফসল। এই সোজা কথাটি সোজাভাবে না বলে, বরং হাস্যরসের মাধ্যমে পরিবেশন করে গিয়েছেন আতর্থী। শুধু পরিবেশন করে নয়, জীবনে করে দেখিয়েও গিয়েছেন তিনি। তাই ‘লোতু’কে যখন বিয়ে করেন, সাক্ষী রাখেন ‘চাঁদ’-কে।
–’কেন পুরোহিতের পরিবর্তে চাঁদ?’ প্রশ্ন করলে তাঁর রসঘন উত্তর ছিল–’পূর্ণিমার চাঁদ দেখেই তো মানুষের প্রেম উথলিয়ে ওঠে, আবার মরা চাঁদ দেখে প্রেমও মাঠে মারা যায়।’
খিদের রাজ্যে পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি মনে হয়, একটিবারও প্রিয়ার মাধুরীমাখা ঠোঁটে চুম্বনের ইচ্ছা জাগে না। ‘অভাব যখন ঘরে ঢোকে, প্রেম জানলা দিয়ে পালায়’–এ কালের এক জনপ্রিয় নায়কের এই সংলাপ সম্ভবতঃ প্রেয়ামাঙ্কুরের কাছ থেকেই ঋণ করা।
মহাস্থবির শর্মার ভিক্ষু-জীবনে সুরাটের ম্যাজিস্ট্রেট গোয়ারাম সাহেবের কথা আছে, কথা আছে তাঁর বন্ধু পন্ডিকজীরও। এঁরা অযাচিতভাবে আতিথ্যে, ভালোবাসায় তাঁর মনপ্রাণ ভরিয়ে দিয়েছিলেন। এ-ছাড়া পন্ডিকজীর কন্যা দেবকী রয়ে গিয়েছে তাঁর মনে, তানপুরায় প্রথম সুর-তোলা ‘স্বর্ণকন্যে’ হয়ে। কেন স্বর্ণকন্যে? ‘সোনার মতই দামী, আটপৌরে ব্যবহারের যোগ্য নয় যে কন্যে, তাকে কি মাটির কন্যে বলা যায়?’ হাল্কা চালে, দুলকি চালে এত গুরুগম্ভীর কথা শুধু দাদাঠাকুর নয়, বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ তন্ন তন্ন করে খুঁজেও পাওয়া যাবে না। আশ্চর্য আতর্থীর কথার জাদু, আশ্চর্য তার সম্মোহন শক্তি!
আত্মীয় স্বজন নয়, বরং হেলাফেলার মানুষ বলে যাদের আমরা এড়িয়ে চলি, তারা যে এত ওজনদার মানুষ হতে পারে, প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘মহাস্থবির জাতক’ না পড়লে– পাঠক তা হয়তো কোনদিন বুঝতেই পারতো না।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, এ বইয়ের বিশেষতঃ এই যে, একবার পাঠ শুরু করলে পাঠককে চুম্বকের মত টানে। পুরনো প্রেমের মত সে টান! তারসঙ্গে পুরনো দিনের কলকাতা, বুম্বাই, আহমেদাবাদ, রাজস্থান, কাশী, বৃন্দাবন ইত্যাদি স্থানের না-দেখা দর্শনীয় স্থানগুলো দর্শনের টান । সে এমন দর্শন যা, ট্যুরিস্ট হিসেবে গিয়েও দর্শন সম্ভব নয়। একশ বছর আগের সেই জায়গাগুলো খুঁটিয়ে দেখতে হলে ‘মহাস্থবির জাতক’ যেন একটি ‘গাইড বই’ হয়ে যায়! এই ধরনের বই পড়া ছাড়া পাঠকের তখন গত্যন্তর থাকে না। সব কিছুর জন্য যেমন প্রশিক্ষণ দরকার, তেমনি দেখার জন্য চোখের প্রশিক্ষণ দরকার। শার্লক হোমস কথাটা একটু ঘুরিয়ে বলেছিলেন–’ছোটবেলা থেকে শিখেছিলাম কি করে দুই চোখের ক্ষমতা দিয়ে চোখে দেখা জিনিসের খুঁটিনাটি ধরা পড়ে।’
মহাস্থবির জাতক নিঃসন্দেহে একটি আত্মজৈবনিক উপন্যাস, প্রথাগত ফর্মে নয়, বিষয়বস্তুর ভারে। ‘জাতক-কাহিনি’তে যেমন তুচ্ছ জীবনের মধ্যে মহৎ জীবনের ইঙ্গিত আছে, মহাস্থবির জাতকেও তেমনি কথাই বলা আছে। সেই অর্থে ‘মহস্থবির জাতক’ নাম সার্থক। ‘বুদ্ধের জাতক’ আর ‘প্রেমাংকুরের জাতক’ – উভয়ের উদ্দেশ্যই মহৎ। এই মহত্ত্বের কথা হার্ডসন একটু অন্যভাবে বলেছেন : ” …a novel is great only when it lays it’s deep foundations, broad and deep in the things which most constantly and seriously appeals to us in the struggles and fortune of our common humanity.” ‘মহাস্থবির জাতক’–রীতি-প্রকরণ, স্থান-কাল-ঐক্য, সংলাপ, স্টাইল, কথাবস্তু বা প্লট-বিন্যাসে, ঘটনা-পরম্পরায় ঠিক সেই অর্থে ‘গ্রেট’। সরস রহস্যময়তার মধ্য দিয়ে গুঢ়বাহী জীবন-যন্ত্রণার যে পোট্রেট-সমূহ চিত্রিত হয়েছে এই এপিসোড-ধর্মী উপন্যাসটির ভেতর, তা যে ‘নব্য-মহাকাব্যের মডেল’ হতে পারে–সেটা বলার জন্য ক্ষুরধার বুদ্ধি বা গবেষণার প্রয়োজন নেই। বরং আর্নল্ড কেটলের কোটেশন দিয়ে বলা যায়–’The novel does not simly convey life; it reveals some kind of pattern in life.’
বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও বিনোদন জগতে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সেই ‘pattern in life’ -কে এমন উচ্চ-স্বরগমে বেঁধে দিয়ে গিয়েছেন যে, জীবনের অনিত্যতাও সেখানে নিত্যতার প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে। নিঃসঙ্গতার আবরণে নিজেকে আপাদমস্তক আবৃত্ত করতে না পারলে এই প্রতিবিম্বের দর্শন হয় না। ‘মহাস্থবির জাতক’ তাই এক প্রতিবিম্বের দর্শন, নিঃসঙ্গতার সুধাসিন্ধু।
সমাপ্ত
♦—•—♦♦—•—♦♦—•—♦
❤ Support Us