Advertisement
  • পা | র্স | পে | ক্টি | ভ রোব-e-বর্ণ
  • ডিসেম্বর ৩, ২০২৩

প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি

প্রকৃতিই ছিল তাঁর দীক্ষাগুরু আর পথ ছিল শিক্ষাগুরু । পুঁথিগত বিদ্যার বাক্সে বন্দী করে রাখেননি নিজের সত্তাকে

বদরুদ্দোজা হারুন
প্রতিবিম্বের দর্শন ও নিঃসঙ্গতার মাধুরি

আইমো ক্যামেরায় রবীন্দ্রনাথের তথ্যচিত্র নির্মাণে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, নিতিন বোস, বি এন সরকার

 
রবীন্দ্র বলয় থেকে বেরিয়ে যখন কল্লোল যুগের কবি সাহিত্যিকরা স্বতন্ত্র ধারায় বাংলা সাহিত্যেকে দাঁড় করাতে চাইছেন, ঠিক সেই সময় প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সাহিত্যিক হিসেব আত্মপ্রকাশ । তাঁর ‘চাষার মেয়ে’ উপন্যাস আকারে যখন বের হয়, তখন ‘কল্লোল’ পত্রিকা গোষ্ঠীর সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ বাংলা সাহিত্যে সুপ্রতিষ্ঠিত ।
 
প্রেমাঙ্কুর আতর্থী এই আবহে লেখার বিষয়-ধারাকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের দ্বারা কিছুটা প্রভাবিত হয়েই।
 
১৮৯০ সালের জানুয়ারি, ফরিদপুর জেলায় সাধারণ পরিবারে তাঁর জন্মগ্রহণ, তখন বাংলা সাহিত্য শক্ত ভিতের দাঁড়িয়ে আছে । রামমোহন, বিদ্যাসাগর, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথ বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন ।
 
রামমোহনের চার যুগ পরে বিদ্যাসাগর, তার দেড় যুগ পরে বঙ্কিমচন্দ্র এবং আরও চার যুগ পরে রবীন্দ্রনাথ বাংলা সাহিত্যের চারটি স্তম্ভ, এর উপর ভর করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সৌধটি এত শক্তপোক্তভাবে গড়ে উঠেছিল যে, ঝড় ঝাপটায় তার পতনের আশঙ্কা এক্কেবারেই ছিল না  । দেশি কিংবা কোন বিদেশি ভাষার সাধ্য ছিল না যে তার গায়ে কাঁটার আঁচড় কাটে । উনিশ শতকের শেষ ভাগে নজরুল, জীবনানন্দ ও কল্লোল যুগের কবি সাহিত্যিকরা সে সৌধটিকে কারুময়,শৈলীবৈভবকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছিলেন । সুতরাং প্রেমাঙ্কুরের সমসাময়িক কালে বাংলা সাহিত্যের ভূমি কর্ষিত উর্বরতায় যে সম্ভাবনাময় সোনালী শষ্যের ক্ষেত্রভূমি হিসেবে গড়ে উঠেছিল এবং তাতে বিশ্বমানের সৃজন ক্রিয়ার মুক্ত পরিবেশের শিকড় যে গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল, এ বিষয়ে সন্দেহের অবকাশই নেই । একের পর এক সাহিত্যিকদের অভ্যুদয় হয়েছিল । কিছুটা আগে পরে জন্মগ্রহণ করলেও প্রেমাঙ্কুর তাঁদের সমকক্ষ সারিতে এসে দাঁড়িয়েছিলেন স্বীয় প্রতিভার আলোকে চতুর্দিক উদ্ভাসিত করে ।
স্বভাবে নজরুলের সঙ্গে তাঁর এক আশ্চর্য মিল ছিল । ভবঘুরে মনোবৃত্তি তাঁদের উভয়েই মধ্যে এত গভীরে শিকড় গেঁড়েছিল যে ছিল যে ‘ঘরেতে রইলে মন হইত উচাটন’ । তাই কৈশোরেই তাঁরা বাড়ি থেকে পলাতক, একজন যুদ্ধ ফেরৎ, আর একজন হিল্লি-দিল্লি-বোম্বে ফেরৎ । স্বভাবে উভয়েই বহেমিয়ান, তাই স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া তাঁদের সম্ভব হয়নি । ছকে-বাঁধা জীবন যেন তাঁদের জন্য বরাদ্দ ছিল না । প্রকৃতিই ছিল তাঁদের দীক্ষাগুরু আর পথ ছিল শিক্ষাগুরু । পুঁথিগত বিদ্যার বাক্সে তাঁরা বন্দী করে রাখেননি নিজেদের সত্তাকে।
 
তাঁদের দেখার চোখ ছিল অসাধারণ। ছোট ছোট জিনিসগুলোও তাঁদের চোখ এড়িয়ে যেতে পারত না । সবাই তাঁদের সঙ্গে কথা বলার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকত । ‘If you have something to say, the words will come flow’– এরকম ঋষি-বাক্যটি যেন তাঁদের ক্ষেত্রে সুপ্রযোজ্য হয়ে উঠেছিল। তবে উভয়ের মধ্যে অপ্রযোজ্য বিষয়ও ছিল বিস্তর ।
 
প্রেমাঙ্কুরের প্রতিভার পূর্ণ পরিচয় মিলে তাঁর আত্মজীবনী-মূলক রচনা ‘মহাস্থবির জাতক’-এ । তাঁর বাবা মহেশচন্দ্র এখানে মহাদেব । রাগলে রক্ষা নেই । দক্ষযজ্ঞ বাঁধিয়ে দিতে তাঁর বিশেষ সময় লাগে না । পুত্র প্রেমাঙ্কুর কার্তিক বা গণেশ নন । খামখেয়ালিতে তাঁর জুড়ি নাই । ব্যাগের মধ্যে পড়ার বইয়ের সঙ্গে গল্পের বইও থাকে । আর তখন মহাদেবকে রুখে কে? মারের চোটে পুত্রের বাপের নাম ভুলে যাবার জোগাড় হয় । ধর্মের মহাদেব তো তাঁর সন্তানদের দেখভালের ভার তাঁদের মাতৃদেবীর হাতে ছেড়ে দিয়ে স্বস্তি ও মস্তিতে থাকতেন; এ মহাদেব সে মহাদেব নন । ছেলেদের দিকে তাঁর বাজপাখির শ্যেন দৃষ্টি । পান থেকে চুন খসার জো নাই । পড়ার সময় একটু বেখেয়াল হলে তাঁর হাতের ছড়ি আর রক্ত চক্ষু দেখে যমদূতের মত নির্দয় বলে মনে হত তাঁকে । এত শাসনেও কিন্তু পুত্র প্রেমাঙ্কুরের লেখাপড়ায় মতি ফিরলো না । পিতা বহু চেষ্টা করেও পুত্রকে স্কুলের গণ্ডি পার করাতে পারেননি ।
 

স্বভাবে নজরুলের সঙ্গে তাঁর এক আশ্চর্য মিল ছিল । ভবঘুরে মনোবৃত্তি তাঁদের উভয়েই মধ্যে এত গভীরে শিকড় গেঁড়েছিল যে ছিল যে ‘ঘরেতে রইলে মন হইত উচাটন’ । তাই কৈশোরেই তাঁরা বাড়ি থেকে পলাতক, একজন যুদ্ধ ফেরৎ, আর একজন হিল্লি-দিল্লি-বোম্বে ফেরৎ । স্বভাবে উভয়েই বহেমিয়ান, তাই স্কুলের গণ্ডি পার হওয়া তাঁদের সম্ভব হয়নি

 
পিতা মহেশচন্দ্র আতর্থী তাঁর পুত্রের লেখাপড়ার সুব্যবস্থা করার জন্য তাঁকে দেশের বাড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে এসেছিলেন । ধর্মবিশ্বাসে ব্রাহ্ম ছিলেন এবং এই ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কাজে নিযুক্ত ছিলেন এবং সেটাই তাঁর জীবিকা ও জীবনব্রত । প্রথমেই ব্রাহ্ম বিদ্যালয়ে প্রেমাঙ্কুরকে ভর্তি করে দেন । কিছুদিন পর ডাফ স্কুলে তাঁর পড়ার ব্যবস্থা করা হয় । যে কোন কারণেই হোক এই স্কুলে প্রেমাঙ্কুরের বেশি দিন থাকা হয়নি । তাঁকে তখন কেশব একাডেমিতে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। এইভাবে একাধিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করা হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি । যে ছেলে স্কুলের নিয়ম কানুন মেনে চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দি জীবন কাটাতে চায় না, তাঁকে তো আর আটকিয়ে রাখা যায় না ! ফাঁক পেলেই স্কুলের ক্লাস ফাঁকি দিয়ে এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ান প্রেমাঙ্কুর। ফলে ক্লাসে ভাল রেজাল্ট তাঁর হয় না । কারণ তাঁর ব্যাগের ভেতর ক্লাসের বইয়ের থেকে কবিতার বই, গল্পের বই বেশি থাকে। তবু হাল ছাড়েন না মহেশ বা মহাদে ব। তিনি তাঁকে সিটি স্কুল পাঠিয়ে দেন । আশা ছিল হয়ত এবার লেখাপড়ায় পুত্রের মন বসলেও বসতে পারে। কিন্তু যে মন সদাই উড়ু উড়ু করে, ফাঁক পেলেই পালাই পালাই করে, সে মন বসবে কেন? কাজেই দু’একজন বন্ধুর পরামর্শ মত এরপর প্রেমাঙ্কুরকে ব্রাহ্ম বয়েজ বোর্ডিং ও ডে স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয় । বোর্ডিং-এ থাকলে পালানোর সুযোগ থাকবে না বলে এই ব্যবস্থা করা হয় । ব্যবস্থা, ব্যবস্থাই থাকে । ছেলেটির স্বভাব পাল্টায় না । পিতা মারধর করতে করতে সময় সময় আধমরা করে দিলেও ছেলেটিকে কিছুতেই বশে আনতে পারেন না । পিতা পুত্রের মধ্যে ব্যবধান বাড়তে থাকে ।
 
প্রেমাঙ্কুর তাঁর বাবা মহেশচন্দ্র আতর্থীর যে ছবি এঁকেছেন তাতে মনে হয়, তিনি ‘spare the rod and spoil the child’ তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন । তাঁর তিন ছেলের একজনকেও আদর করার মানসিকতা তাঁর ছিল না । ছেলেদের কাছে তাই তিনি দূরের মানুষ হয়ে রইলেন । মাঝে মাঝে এত রেগে যেতেন যে মারের চোটে ছেলেদের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার উপক্রম হত । একটু বেশি মাত্রার দুষ্টু হওয়ায় প্রেমাঙ্কুর সবচেয়ে বেশি মার খেতে হত । একবার তো পিতার মারে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন তিনি, আর একবার মুখ দিয়ে রক্ত বমি পর্যন্ত হয়েছিল । বেশ কিছুদিন চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং স্থির করেন, লেখাপড়া করে ভাল ছেলে হয়ে চাকরি করা তাঁর ধাতে সইবে না, তবে খামাকা আর বাড়িতে থেকে পিতার গলগ্রহ হয়ে যন্ত্রণার জীবন কাটাবেন কেন? বরং যেদিকে দুই চোখ যায় সেদিকে পালিয়ে যাবেন ।
 
তার আগেও কিছু কথা আছে । পলায়নের আগে পলাতক মনোবৃত্তি তৈরির কথা । যে কথার সঙ্গে জড়িয়ে আছেন এক প্রতিবেশী ভাবুক মানুষ ।
 
তিনি, তাঁদের বাড়ির কাছাকাছি থাকতেন । নেশার মধ্যে ছিল দেশ বিদেশের বই পড়া আর বাচ্চাদের সঙ্গে গল্প করা । সব বাচ্চারা স্কুলের পড়া ফেলে তাঁর কাছ ঘেষত না, প্রেমাঙ্কুর ছিলেন ব্যতিক্রম । সুযোগ পেলেই সে বয়স্ক বন্ধুর কাছে ছুটে যেতেন । বন্ধু তাঁকে বড় বড় মানুষের গল্প বলতেন ।
 
কোলরিজের ‘দি রাইম অফ এনসিয়েন্ট ম্যারিনার’ গল্পটি একদম বাচ্চা বয়সেই তাঁর কাছে শুনে প্রেমাঙ্কুর এক অদ্ভুত শিহরন অনুভব করতেন । বাড়ি ফিরতে প্রায়ই দেরি হত । তারজন্য পিতার তর্জনগর্জন, গালাগালি আর মারধোর সবই বরাদ্দ ছিল তাঁর ভাগ্যে ।
 
তবু অমোঘ আকর্ষণে তিনি ছুটে যেতেন গল্পওয়ালা বন্ধুর কাছে । মাঝে মাঝে তিনি ‘দি কুবলাই খানের’ পাতাগুলো উল্টিয়ে বেছে বেছে কিছু অংশ শোনাতেন । বলতেন, ঘরে নয়, পথেই আছে মানুষ ও প্রকৃতিকে জানার অঢেল সুযোগ । প্রকৃত জ্ঞান আছে ভ্রমণে, পুঁথির পাতায় নয় । এ এক অদ্ভুত প্রেরণা! যেন কোন দেবদূত তাঁর কানে কানে মন্ত্র দিচ্ছেন, ‘পথে নামো বন্ধু, পথই তোমাকে পথ দেখাবে’।

 

♦দুই♦

এর পাশাপাশি ছোটবেলার অন্য একটি ঘটনা তাঁর জীবনে অনুঘটকের কাজ করেছিল । তখন তাঁর বয়স নয় কি দশ । তাঁর বাবা একবার সপরিবারে দেওঘরে পুজোর সময় ছুটি কাটাতে গিয়েছিলেন । সেখানে কাছাকাছি ছিল রাজনাথ বসুর বাড়ি । সেখানে তখন রাজনাথের ছেলে মনীন্দ্রনাথ বসু বাস করতেন । ডিটেকটিভ উপন্যাস লিখে তখন তাঁর খুব নামডা ক। কৌতুহলী প্রেমাঙ্কুরকে একদিন তিনি কাছে ডেকে আলাপ করেন । তিনি প্রথমেই তাঁকে জিঞ্জাসা করলেন, ‘স্কুলের পড়া ছাড়া আর কি কি করতে তাঁর ভাল লাগে’। প্রেমাঙ্কুর তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ‘কবিতা লিখতে । আমার একটি কবিতার খাতা আছে । যদি স্যার, দয়া করে দেখেন, তবে আরও লিখব ।’ মনীন্দ্র বললেন, ‘ঠিক আছে, দেওঘরের উপর একটা ছোট্ট কবিতা লিখে শোনাও, দশ মিনিট সময় দিলাম ।’ প্রেম লিখলেন এবং পড়ে শোনালেন:
 
“সন্ধ্যা হইল
নন্দন পর্বত গুহে
ব্যাঘ্র প্রবেশিল
জীবজন্ত মানবাদি নিন্দ্রায় মগন
শর্বরী সঘন”….
 
ছোট্ট এক শিশুর মুখে গুরুগম্ভীর কবিতা শুনে মনীন্দ্রনাথ হো হো করে হেসে উঠলেন । বললেন, ‘কবিতা নয়, তুমি একটা গল্প লিখে কাল দেখাবে নন্দন পর্বত নিয়ে।’ খানিকক্ষণ চুপ থেকে প্রেমাঙ্কুর বললেন, ‘কি লিখব স্যার, মাথায় কিছুই আসছে না ।’
‘ঠিক আছে। আমার চোখে দেখা একটি গল্প বলছি শোন । আমার ছোট বেলার কথা । নন্দন পাহাড়ের ওপরে একটা পরিত্যক্ত ভাঙা ঘর ছিল । আমি তখন কয়েকজন সমবয়সী ছেলেদের নিয়ে ওখানে আড্ডা দিতাম । একদিন সন্ধ্যায় দেখি একজন কুষ্ঠ রোগী বহু কষ্টে বুকে হেঁটে ওপরের দিকে উঠছে । তার হাত পায়ের আঙ্গুলগুলো খসে গিয়েছে । দগদগে ঘা । সে কাছাকাছি হতেই আমি এগিয়ে গেলাম । সে বলল, খুব পিপাসা । একটু জল দেন । প্রাণে বাঁচব না । হাসপাতাল যেতে হবে ।
 
তাকে আমি জল খাইয়ে ভাঙা ঘরটিতে শুইয়ে দিলাম । তখন অন্ধকার নেমে এসেছে । রাতে ঠিক ঘুমুতে পারলাম না । খুব ভোরে লোকজন ঠিক করে ডুলি নিয়ে গিয়ে হাজির হয়ে গিয়ে দেখি পাহাড়ি শেয়ালের দল লোকটিকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে খেয়ে নিয়েছে, শুধু রক্তমাখা হাড়গোড় পড়ে আছে ।… একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে থামলেন মনীন্দ্রনাথ । এ দুঃসহ যন্ত্রণার ছবি বালক প্রেমাঙ্কুরের মনে এমনভাবে গেঁথে গেল যে, তাঁর আপাত হাস্যরসের আড়ালে সেই অন্তরস্পর্শী বেদনা চাপা থাকেনি কখনো । জীবনে হাজারো কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা তাঁর ভেতর থেকেই তৈরি হয়েছিল তখন থেকেই । নইলে মাত্র বারো বছর বয়সেই বাড়ি ছেড়ে পলাতক মানসিকতা কি অর্জন করতে পারতেন ? অনিশ্চয়তার পথে পাড়ি দেওয়া আর জল না মেপে নৌকা থেকে ঝাঁপ দেওয়া তো একই কথা ।
 
পকেটে পয়সা নেই । থাকার জায়গা নেই । তাতেও পরোয়া নেই । রাস্তা আছে, রাস্তার ভিখিরিরা আছে । তারাই তাঁর আপনজন-স্বজন-সুহৃদ-বন্ধুজন সব কিছুই । তাই পথ চলতি মানুষের কাছে হাত পাততেও তাঁর বিন্দুমাত্র সংকোচ হয়নি । ‘আমা সবাকার ধন আছে তোমা সবাকার ঘরে’। রক্তে ছিল তাঁর বোহেমিয়ানের উল্কা-স্রোত । কিশোর বয়স থেকে যৌবনের উন্মেষকাল পর্যন্ত কোথাও এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকা তাঁর ধাতে সইত না । চলার পথে তিনি ভালো মানুষ দেখেছেন, খারাপ মানুষ দেখেছেন, চোর ডাকাত দাগাবাজ দেখেছেন, পশুমানুষ দেখেছেন, আবার দেখেছেন ভালোবাসার জন্য মানুষের সর্বস্ব ত্যাগ করার আশর্য ক্ষমতা । এ দেখার যেন শেষ নেই । এ জানার চেষ্টাও অশেষ ।
 
সহায় সম্বলহীন মানুষের শেষ ঠিকানা গয়া-কাশী-বৃন্দাবন । তবে কাশীবাসী হতে চাইলে মন –’বয়স বারো কি বিরাশি, বুঝে না সজ্জন ।’– ‘ওঠ’ বললেই সাধুর কাঁধে ঝুলি, – ‘ও মন চল বৃন্দাবন ।’
 
ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির পীঠস্থান । শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম, গৌতম বুদ্ধ থেকে মধ্যযুগীয় ভক্তি আন্দোলনের পাদপীঠ কাশী আর বারাণসী । রবিদাস, কবীরের মত সন্ত-সন্ন্যাসীরা এখানে বসেই মরমীয়া গান শুনিয়েছেন । সাধু সন্ন্যাসী তীর্থ যাত্রীদের ভিড়ে ঠাসাঠাসি কাশী-বারানসী-বৃন্দাবন । আর ‘এখানেই ছুটে মন, মন যখন হয় উচাটন / আর সে উচাটন মনের টানে, কিশোর প্রেমাংকুররাও আসে বৃন্দাবনে !’
 
তাই কিশোর বয়সে তাঁর পথে পথে ঘোরা, যত্রতত্র খাওয়া ও সাধু বাবাদের আশ্রমে আশ্রয় ভিক্ষা করার স্মৃতি পরবর্তীতে তাঁর লেখক-সত্তার সহায়ক হয়েছিল ।
 

কাশীই হয়ে উঠে তাঁর ভালোবাসার, তাঁর রোমান্টিক শিহরণের এক বিচিত্র স্মৃতি-জাগানিয়া শহর । এখানেই সে আশ্চর্য গুরুমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে । তাঁর নিভৃত সাধন-কক্ষ একসময় তাঁর অবাধ অধিকারের ক্ষেত্রভূমি হয়ে ওঠে

 
গৌতম বুদ্ধের অহিংসার বাণী, কবীর, রবিদাস বা রুইদাসের ভক্তি-সিঞ্চিত সম্প্রীতির বাণী, তৎসহ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষকে ভালবাসার উৎসভূমিও কাশীর জমি । গুরু রামানন্দ ব্রাহ্মণকূলে জন্মগ্রহণ করেও সাম্য-ধর্মের প্রচার করেন । তাঁর উপলব্ধীজাত, রামের সন্তানদের মধ্যে কোন ভেদাভেদ থাকতে পারে না । শুধু মুখে বলেই ক্ষান্ত থাকেননি তিনি, তাঁর মতবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি মুচি রুইদাস, জোলা কবীর, নাপিত সইদাস, কসাই সাধন দাস (পরিবর্তিত নাম) প্রমুখ তথাকথিত নীচু বা অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষকে আপন শিষ্যত্বে বরণ করেন । কবির রামকে রহিমের স্বরূপ মনে করতেন । এ যেন আকবরের দীন-ই-এলাহির পুনঃপ্রতিষ্ঠা । বাদশা আকবরের প্রতিষ্ঠিত বিশাল আকারের শিব মন্দির, বিষ্ণু মন্দির দেখে বালক প্রেমাঙ্কুর বিস্মিত । এক সন্ত-সাধকের কাছে শুনেন শ্রীগুরু রবিদাস যে সমস্ত স্থানে তাঁর কর্মকান্ড বিস্তার করেন, যেমন উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, গুজরাট, মহারাষ্ট্র, মধ্য প্রদেশ, পাঞ্জাব ও হরিয়ান ইত্যাদি স্থানগুলি উল্লেখযোগ্য । কাজেই বালক প্রেমাঙ্কুরের মনে এইসব স্থানগুলি দেখার জন্য এক ধরণের অস্থিরতা তৈরি হয় । অদৃশ্য নিশির ডাক শুনেন তিনি । আর ডাককে উপেক্ষা করার সাধ্য তাঁর নেই ।
 

কাশী তাঁকে কাছে টানে । তারপর এই কাশীই হয়ে উঠে তাঁর ভালোবাসার, তাঁর রোমান্টিক শিহরণের এক বিচিত্র স্মৃতি-জাগানিয়া শহর । এখানেই সে আশ্চর্য গুরুমার সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ ঘটে । তাঁর নিভৃত সাধন-কক্ষ একসময় তাঁর অবাধ অধিকারের ক্ষেত্রভূমি হয়ে ওঠে । তিনি যখন দর্শন দিতেন, তখন ভক্তের ঢল নামতো । তার জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় ছিল । অন্যথায় তাঁর বিশ্রাম সময়ের ব্যাঘাত ঘটানো ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ । লোক-বিশ্বাস, তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিনী । তাই তাঁর বিশ্রামে ব্যাঘাত ঘটানোর সাহস কোনো ভক্তের ছিল না, একমাত্র বালক প্রেমাঙ্কুর ছাড়া । ‘মহাস্থবির জাতক’- এ সে বর্ণনা তিনি দিয়েছেন পরিণত বয়সের প্রান্তসীমায় এসে ।
 
আশ্চর্য সে বর্ণনা ! গুরূমার একই অঙ্গে একান্ন রূপ ! অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারিনী তিনি । সে ক্ষমতার প্রতাপ প্রেমাঙ্কুর বহুবার উপভোগ করেছেন । কী এক আশ্চর্য্য শক্তিবলে তিনি মাঝে মাঝে গত জীবনের রাজকুমারী হয়ে উঠতেন । আর বালক প্রেমাঙ্কুরকে জড়িয়ে ধরে আদর করতেন । সে আদরের-আলিঙ্গন এত তীব্র যে, তার নিষ্পেষণে বালকের সারা শরীর ঘর্মাক্ত হয়ে উঠত । বহুক্ষণ তাঁকে পড়ে থাকতে হত নিস্তেজ হয়ে । শরীরের সব শক্তি হিমেষে বাষ্প হয়ে উবে যেত !
 
আবার এই কাশীবাসেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক মহিলার । পরিচয় থেকে প্রেম, আর প্রেম থেকেই ঘনিষ্ঠতা । ঘনিষ্ঠতা মনের সঙ্গে মনের । কেননা রাধাকৃষ্ণের প্রেমসত্তা ছড়িয়ে আছে কাশী বৃন্দাবনে ! আকাশে বাতাসে তাই রঙ্গরসের ফিসফিস ধ্বনি! যে প্রেমিক সে শোনে, যার মন আছে, সে মানে । প্রেমাঙ্কুরের মন রসে টইটম্বুর ।
 
বলা যেতে পারে, প্রেমের অঙ্কুরোদ্গম হয়েছে প্রেমাঙ্কুরের কাশীবাসের অজ্ঞাত জীবনে । অজ্ঞাত; কারণ অনেক কথাই তিনি খুলে বলেননি । খুলে বলা লেখকের ধর্ম নয়, অনুমান করে বুঝে নেওয়া পাঠকের কর্ম । ওই মহিলা লেখক প্রেমাঙ্কুরের জীবনের এক নিটোল ভালবাসার প্রেরণা-প্রতীক । যে ভালবাসা কাছে টানে, আবার দূরে সরিয়ে দেয় । কেন দেয়, যে ভালবাসে, সেই-ই সেই-ই জানে । যার ভালবাসায় খাদ নেই সেই্ এ বিষয়ে অবগত । প্রেমাঙ্কুরের সাহিত্যগুরু শরৎচন্দ্র বলেছেন, ‘বড়োর প্রেম শুধু কাছে টানে না, ইহা দূরেও ঠেলিয়া দেয়।’
 
হ্যাঁ ঠিক তাই । ছিটকে গিয়েছিলেন দু’জন দু’দিকে । তারপর…, বহুপর, যখন তাঁর মন মানুষির সঙ্গে লেখকের আবার দেখা হয়েছিল, তখন বাল্যজীবনের প্রেম-জাগানিয়া সে নারী, রূপ যৌবনের গৌরব হারিয়ে রাস্তার ভিখারি ! তবুও চিনতে ভুল হয়নি; তাঁর–খাঁটি প্রেমের ধ্রুবতারা যে তিনি । বিগত-যৌবনা হয়েও যৌবনের চিত্তাকর্ষককে চিনে নিতে তাঁর মুহূর্তমাত্র বিলম্ব হয়নি ।
 
ক্রমশ…

♦—•—♦♦—•—♦♦—•—♦


  • Tags:
❤ Support Us
error: Content is protected !!