- ন | ন্দ | ন | চ | ত্ব | র
- আগস্ট ৩০, ২০২৩
নারী শক্তির ক্ষমতায়নকে স্বীকৃতি । ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যাওয়ার্ডে সম্মানিত বর্ষা ও স্বাতী

মেয়েরা অন্তপুরবাসিনী নয়, সেটা আজ থেকে বহু আগে বেগম রোকেয়া প্রমাণ করেছেন। তার পর থেকে সেই ধারা চলে আসছে। স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়েও আমরা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদর, মাতঙ্গিনী হাজরাদের মতো মহিলাদের দেখেছি, যাঁরা নিজেদের ঘরের কোনায় সনাতনী মহিলা হিসেবে আটকে রাখেননি।শিক্ষায়, বিপ্লবে, সংসারযাপনে নারীর ভূমিকা যুগযুগ ধরে প্রশংসিত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়েও সেই ধারা বজায় রয়েছে। মহিলারা নিজেদের জগৎ নিজেরাই তৈরী করে নিচ্ছেন, অর্থনৈতিক ভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন। নিজেরাই নিজেদের চলার পথ খুঁজে নিচ্ছেন।
এমনই একজন মহিলা হলেন কলকাতার বর্ষা সেন। এই মুহূর্তে চারিদিকে অনলাইন বিক্রেতাদের রমরমা ব্যবসা। কেনা-বেচা থেকে প্রমোশন, আজকের দিনে অধিকাংশ মানুষই চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে। সেই প্ল্যাটফর্মকে সঙ্গী করেই নিজের আখ্যান লিখতে শুরু করেছিলেন বর্ষা সেন। সেই আখ্যান এখনও চলছে। আর চলার পথে সেই আখ্যানের পাতায় জুড়ে গিয়েছে বহু মানুষের ভাল থাকার ভাল গল্প।
মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম বর্ষার। ছোট থেকেই ইচ্ছে ছিল নিজের জন্য কিছু একটা করার। এমন কিছু, যা তাঁকে পরিচিতি দেবে। নিয়ে যাবে এক অন্য দুনিয়ায়। দু’চোখে সেই স্বপ্ন নিয়ে ঠিক ৭ বছর আগে স্বপ্নপূরণের পথে নেমে পড়েন বর্ষা। বেছে নেন অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে। প্রাথমিক স্তরে সেলার হিসাবেই কাজ করতে শুরু করেন বর্ষা। ব্যবসা কিছুটা পরিণত হওয়ার পরেই বর্ষার মাথায় আসে অন্যান্য মেয়েদের কথা। বর্ষার কথায় , “এক জন মেয়ে হয়ে যদি আমি পারি, তা হলে অন্য মেয়েরা পারবে না কেন?’— কার্যত এই ভাবনা থেকেই মাত্র ১ বছরের মধ্যে বর্ষা তৈরি করেন ফেসবুক গ্রুপ ‘বর্ষা অ্যান্ড হার টিম ওম কালেকশনস’। বর্তমানে এই গ্রুপের সদস্য সংখ্যা প্রায় ৩ লক্ষ।
বিভিন্ন ধরনের শাড়ি, ব্লাউজ, জামা সহ বিভিন্ন পরনের জিনিস কেনাবেচা করা হয় এই গ্রুপে। পাশাপাশি, অফলাইন ইভেন্টেরও আয়োজন করে এই গ্রুপ। এই গ্রুপের মাধ্যমে বহু মহিলা তাঁদের কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছেন। নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেতে পেরেছেন বর্ষা সেন, পেরেছেন অন্য মেয়েদের সাবলম্বী হওয়ার রাস্তা দেখতে। তবে ২০১৭ সালে শুরুর সময় এই রাস্তাটা খুব সহজে অতিক্রম করতে পারেননি বর্ষা সেন। বর্ষা বলেন, “করোনার সময় যখন ঘরে ঘরে অভাব অনটন শুরু হয়, তখন অনেক মেয়ে আমাকে ফোন করে বলে, দিদি আমাদের বাঁচাও। অনেকের বাড়ির সকলের কাজ চলে গিয়েছিল। সবাই-ই প্রায় বাড়ি বসেছিল। হাতে টাকা ছিল না। অনেকের স্বামী মারা গিয়েছেন। সেই সময়ে ওদের চোখের জল আমাকে আরও শক্ত করে তোলে।” অতিমারির সময় বর্ষা একটি বড় দল তৈরি করেন। মাতৃস্নেহে সকলকে আগলে রেখে, তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ান তিনি। বাড়িতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা থেকে শুরু করে অসুস্থদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, সব ক্ষেত্রেই সেই সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল বর্ষা ও তাঁর দল।
আর এই কাজের জন্যই ২০২৩ এর বি আর আম্বেদকর পুরস্কার -এর জন্য মনোনীত হন বর্ষা সেন। সম্প্রতি রাজভবনে রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস বর্ষা সেনের হাতে পুরষ্কার তুলে দেন।
কলকাতার স্বাতী দাস হলেন আর এক মহিলা যিনি তাঁর নিজের উদ্যমকে সম্বল করে জীবনের অনেকটা পথ হেঁটে এখন একটা জায়গায় এসে পৌঁছেছেন। স্বাতী মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে, তাঁর বাবা চাকরির পাশাপাশি বেশিরভাগ সময়টা টিউশন করে সংসার চালিয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমে কাজ করা দিয়ে তাঁর কাজের জগতে প্রবেশ। ভালো কথা বলতে পর স্বাতীর একটি বিশেষ যোগ্যতা। ২০১০ সালে বাবার চাকরি চলে গেল একটিমাত্র মেয়ে সংসারের দায়িত্ব নিয়ে নিলাম নিজের কাঁধে। আর সেই থেকে আজ ২০২৩, স্বাতী দাসের লড়াই চলছে। কোনও দিনের জন্য ভেঙে পড়েননি তিনি। নজর সামনে রেখেই তিনি এগিয়ে চলেছেন। স্বাতীর কথায়, “সংবাদ মাধ্যম, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা সবকিছুতেই এগিয়ে গেছি। নিজের কাজের ফাঁকে অফিসের টাইম টুকু বাদ দিয়ে বাকি সময়টা বসে থাকার মেয়ে কোনদিনই আমি ছিলাম না কিন্তু ওই যে সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হয় সবকিছু তাই ২০১৮ সালে বিয়ে হওয়ার পর মিডিয়ার কাজটা ছাড়তে হলো। ঘরে বাইরে সময় দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠিছিল না। কিন্তু ভেতরে কে যেন বলছিল, এগিয়ে চলতে হবে। শুরু করলাম ওই মিষ্টি নিয়ে ব্যবসা। তখন বেরিয়ে পড়তাম ভোর চারটের সময়। এবং বাড়ি ফিরতাম ঠিক রাত বারোটায় তারপরেও কিন্তু নিজের সংসারকে নিজেই দেখতাম। সংসারে মানুষগুলোকে আগলে রাখতাম। কলকাতায় সম্ভবত আমিই প্রথম মেয়ে ,যে এইভাবে মানুষের বাড়ি গিয়ে গিয়ে একদিন ছাড়া ছাড়া দই মিষ্টি পৌঁছে দিতাম।”
করোনার সময় প্রচুর মানুষ যারা বাড়িতে বসে ছিলেন বয়স্ক থেকে শুরু করে বাচ্চা যারা, একটু খাবারের জন্য হাহাকার করত তাদের আমি আমার তরফ থেকে দই এবং মিষ্টি দিতাম, যেটা তারা ভীষণ খুশি মনে গ্রহণ করতেন। পরবর্তীকালেও টাকা পয়সা দিয়ে না পারলেও প্রচুর ছোট ছোট বাচ্চা এবং কিছু পরিবারের দায়িত্ব নিজের কাধে তুলে নিয়ে সবার অজান্তে কাজ করেছি, বলছিলেন স্বাতী।
এখন স্বাতী দাস প্রায় তিন লক্ষের উপর মানুষের ঘরে পৌঁছে দিচ্ছেন দই মিষ্টি এবং ঘি। স্বাতীর এই কাজের জন্য তাঁর ডাক পড়ল দিদি নাম্বার ওয়ান এবং দাদাগিরিতে।
স্বাতী দাসকেও সম্প্রতি তাঁর এই উদ্যোগের জন্য রাজভবনে “ইন্টারন্যাশনাল বৌদ্ধ পিস অ্যাওয়ার্ড” প্রদান করলেন রাজ্যপাল সি ভি আনন্দ বোস। রাজ্যপাল বর্ষা সেন ও স্বাতী দাসের এই অসাধারণ উদ্যম এবং কাজের প্রতি নিষ্ঠার প্রশংসা করে বলেন, “এটাই হচ্ছে মানুষের ভেতরকার শক্তি, যা জাগিয়ে তুলেছেন বর্ষা ও স্বাতী। এই শক্তিকে জাগ্রত করতে পারলে কাজটাই তখন হয়ে ওঠে মানুষের পরিচয়, নারী-পুরুষ প্রভেদ তথন আর থাকে না।”
❤ Support Us