- দে । শ
- মে ২, ২০২৩
অভিষেকের “নবজোয়ারে” ছন্দ ফেরাতেই কী মমতার মালদা সফর?
নিজের ভোট নিজে দিন। এটাই ভারতীয় রাজনৈতিক দল এবং ভারতের নির্বাচন কমিশনের মুখ্য স্লোগান। ভারতের গনতন্ত্রেরও এটাই ভিত। তবে এবার বঙ্গরাজনীতিতে “নিজের প্রার্থী নিজে নির্বাচন করুন”, এই নতুন ধারণার জন্ম দিলেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূলে নবজোয়ার কর্মসূচি শুরু করলেন মানুষের দ্বারা নির্বাচিত প্রার্থীদের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে, মানুষের পঞ্চায়েত গঠনের লক্ষ্যে। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জায়গা বামনহাট থেকেই অভিষেক তাঁর নবজোয়ার কর্মসূচির সূচনা করেন ২৫ এপ্রিল। এর আগে ২৪ এপ্রিল সোমবার রাতে এই সীমান্তবর্তী বামনহাট ফুটবল মাঠের তাঁবুতে রাত্রিযাপন করেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মঙ্গলবার এই বামনহাট তাবু থেকেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের টানা ৬০ দিনের জনসংযোগ যাত্রা শুরু হয় । যাত্রা শুরুর আগে বামনহাট -এ বিএসএফ-এর গুলিতে নিহত, প্রেমকুমার বর্মন ও মোজাফ্ফর হোসেনের পরিবারের সঙ্গে তাঁবুতেই বৈঠক করেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। এই দুই পরিবারের অভিযোগ, বিএসএফ-এর গুলিতেই তাদের পরিবারের সদস্যরা নিহত হয়েছেন। অভিষেক এই বৈঠকের পর বাননহাট কালী মন্দিরে পুজো দিয়ে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। অভিষেক মঙ্গলবার সাহেবগঞ্জ, সিতাই এবং শীতলকুচিতে সভা করেছেন। রাতে মাথাভাঙায় তৃণমূল ব্লক, জেলা সভাপতি এবং স্থানীয় বিশিষ্ট মানুষদের সঙ্গে বৈঠক করবেন তাঁবুতে এবং তারপর পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থী নির্বাচনের জন্য গণভোট কর্মসূচি ছিল। সাড়ে তিন হাজার মানুষের এই ভোট পর্বে অংশ নেবেন বলে কর্মসূচি সুরির দিন সকালেই তৃণমূলের তরফে জানানো হয়েছিল। শেষে নৈশ ভোজ। অভিষেক মঙ্গলবার যখন তাবু থেকে বার হয়ে ৫০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটে মাধাইখাল কালী মন্দিরে যাচ্ছেন তখন তাঁকে স্থানীয় মানুষেরা ঘিরে ধরে বাড়ি, পানীয় জলের অভাবের কথা বলেছিলেন। অভিষেক তাঁদের আশ্বাস দেন, “সব কিছুর ব্যবস্থা হবে, আমি আবার আপনাদের কাছে আসব।” এই সময় অভিষেক সাধারণ মানুষদের কাছে বলেন, কেন্দ্র আবাস যোজনার টাকা দিচ্ছে না। রাজ্যের প্রাপ্য আটকে রেখেছে। এর মধ্যেই রাজ্য সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে।”
তবে এই নবজোয়ারের প্রথমদিনই সিতাই -এ অভিষেক সভাস্থল ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর সিতাই-এর সভা মঞ্চে “নিজের প্রার্থী নিজে নির্বাচন” করার অভিষেকের নির্দেশ ভেস্তে যায় তৃণমূলের গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে। ব্যালট বক্স ভেঙে, ব্যালট পেপার কুচি করে তৃণমূলের দুই বিবদমান গোষ্ঠী এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যা নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়।
এর পরও এই সাতদিনে কোনও কোনও সভায় পঞ্চায়েতের প্রার্থী নির্বাচন নিয়ে তৃণমূলের গোষ্ঠী কোন্দল ও মারপিট মানুষের নজরে এসেছে। এরই মধ্যে অভিষেক বন্দোপাধ্যায়ের সফর নিয়ে নবজোয়ারের পঞ্চম দিনে কার্যত বিস্ফোরক মন্তব্য করলেন বিধায়ক আব্দুল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, “আমি এখনও কোনও খবর পাইনি। অভিষেকের অফিস থেকে পিওন আমায় ফোন করে সভায় আসার কথা বলে। আমি প্রবীণতম বিধায়ক, এটা আমার প্রাপ্য? আমি পুলিশ সূত্রে জেনেছি, “অভিষেক আমার বাড়িতে আসতে পারে। তাই আমি কার্পেট পেতে রেখেছি তাঁকে বরণ করার জন্য। তবে অভিষেক যে আমার বাড়িতে আস্তে পারে দলের তরফে এমন কিছু আমায় জানানো হয়নি। তাই আমি ওই সভায় যায়নি। অভিষেক বলছেন দলের প্রার্থী মানুষ নির্বাচন করবে। তাহলে এই সব পদের কি প্রয়োজন? সব তুলে দিক। এতদিন যে ভাবে প্রার্থী নির্বাচন হয়েছে সেটা কি ঠিক ছিল না?” পাশাপাশি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে তিনি চেনেন না বলেও মন্তব্য করেছেন। পাশাপাশি বলেছেন, “আমার মমতা ব্যানার্জীর উপর আস্থা আছে। অভিষেককে আমি সামনাসামনি কখনও দেখিনি,আমি ওনাকে চিনি না। টিভি তে দেখেছি।
রবিবার চোপড়ার সভা শেষ করে অভিষেক যখন ইসলামপুরে সভা করছেন, তখন আব্দুল করিমের মুখে এই কথা শুনে তাঁর সমর্থক তৃনমুল কর্মীরা প্রবীণ বিধায়কের বাড়িতে ভিড় প্রচুর সংখ্যায় হাজির হন। কানাইয়ালাল আগরওয়াল নয়, আব্দুল করিম চৌধুরীই শেষ কথা বলে দাবি করেন দলীয় কর্মীরা। প্রসঙ্গত, কানাইয়ালাল আগরওয়াল সহ একাধিক ইস্যুতে আব্দুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের দূরত্ব বেড়েই চলেছে।এদিন তিনি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের সভায় না আসায়, সেই দূরত্ব আরও বাড়িয়ে নিজেকে আবারও বিদ্রোহী বিধায়ক বলে ঘোষণা করলেন।
তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, বিধায়ক আব্দুল করিম চৌধুরীকে দলের শীর্ষ স্তর থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। দলের কর্মসূচী সম্পর্কেও জানানো হয়েছিল। ইসলামপুরের সভায় যোগদান করতেও বলা হয়েছিল তাঁকে । তবে অভিষেকের উত্তরবঙ্গ সফরের প্রথম সাতদিনে আব্দুল করিম চৌধুরীর এই প্রতিবাদই যে এই অনুষ্ঠানের সবচেয়ে বেশি ছন্দপতন ঘটিয়েছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই ঘটনা দেখে বিজেপি নেতা শমীক ভট্টাচার্য বলছেন, আব্দুল করিম চৌধুরীর সাহস আছে তাই তিনি প্রতিবাদ করেছেন। এপর্যপন্ত সব জেলাতেই প্রতিবাদ কখনও প্রকাশ্যে কখনো আড়ালে হচ্ছে। এবার এই প্রতিবাদ কলকাতায় শুরু হবে।
তবে বিরোধীদের এই মন্তব্যে কর্ণপাত না করে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “দলের কর্মীদের অতি উৎসাহে এরকম কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে। আসলে এমন একটা অভিনব রাজনৈতিক ঘটনা এর আগে কেউ দেখেনি, তাই এসব হচ্ছে।” পাশাপাশি সিতাই-এর ঘটনার দিনই অভিষেক দলের কর্মীদের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন,”কেউ যদি ভেবে থাকে গায়ের জোরে প্রার্থী হবে তাহলে থাকে বলে রাখছি এসব এখানে চলবে না। পাহারাদারের নাম অচিশেক বন্দ্যোপাধ্যায়।”
দিলীপ ঘোষ আবার অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই “অতি উৎসাহিত” হওয়ার তত্ত্ব শুনে বলেছেন, “এর পর নেতাকে কিডন্যাপ করে নিয়ে গেলেও বলবেন উৎসাহের বহিঃপ্রকাশ।”
এরই মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুধবার তিনদিনের সফরে মালদা যাচ্ছেন। ৩ তারিখ মমতা মালদা পৌঁছবেন তৃণমূলনেত্রী। ৪ তারিখ তিনি প্রশাসনিক ও দলের জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করবেন। মালদার প্রশাসনিক সভায় উত্তরদিনাজপুর জেলা নেতৃত্বকেও উপস্থিত থাকতে বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এমনটাই তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে। তৃণমূল সূত্রে এমনও শোনা যাচ্ছে মুখ্যমন্ত্রী মালদা সফরে থাকাকালীন অভিষেকের তৃণমূলে নবজোয়ার যাত্রার সভাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যোগ দিতে পারেন। তাহলে কী তৃণমূল সুপ্রিমো অভিষেকের তৃণমূলে নবজোয়ার যাত্রার কেটে যাওয়া ছন্দে আবার ছন্দ ফিরিয়ে আনতেই মালদা সফরে যাচ্ছেন? রাজ্য রাজনীতিতে এটাই এখন সবচেয়ে চর্চিত বিষয়।
❤ Support Us