- খাস-কলম
- মে ৫, ২০২৪
দ্রব্যমূল্যে অগ্নিকান্ড ! পাকিস্তানি মৌলানার মতলব কী?

পাকিস্তানে , দ্রব্যমূল্যে বেনজির অগ্নিকান্ড! ১ কেজি আটার দাম ৮৭৬ টাকা। চাল ৩৩০। পেঁয়াজ ২৬০। আলু ৯০। মুরগির মাংস ৭৫০-৯০০। চিনি ২০০ এর ওপর। নিত্য প্রয়োজনীয় প্রতিটি বস্তুর মুল্য আজ গণবিস্ফোরণের রসদ। রাষ্ট্রের অর্থভাণ্ডার শূন্য। টাকা শুধু ১ শতাংশের হাতে। প্রবল সঙ্কটে দেশ আর শাসক। এরকম পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে শাসকের দিকে তর্জনী উঁচিয়ে জমিয়ত নেতা ফজলুর রহমান বলেছেন – ভারতকে দেখুন। ওরা বিশ্ব শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে । আর আমরা বাঁচার জন্য ভিক্ষা করছি । নিজ দেশের দুর্দিনে কেন হঠাৎ জ্বলে উঠলেন মৌলানা? রহস্য কী? পরশ্রীকাতরতা? না নির্বাচনকালীন ভারতীয় শাসককে আরো বেশি ক্ষমতামত্ত, প্রচারসর্বস্ব করে তোলবার ইন্ধন? বিশ্লেষণাত্মক প্রশ্ন জুড়লেন বাহার উদ্দিন
আর্থ সামাজিক বিন্যাসের গলদ আর সরকারের ব্যর্থতাকে দায়ী করে ভারতের প্রশংসায় পঞ্চমুখ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর একদা জোটসঙ্গী ‘জমিয়ত-এ- উলেমা-এ-ফজল’-এর প্রধান ফজলুর রহমান । ধর্মীয় নেতা এবং রাজনীতিক বলে সুপরিচিত । পাকিস্তানের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে ভাষণ দিতে গিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফকে লক্ষ্য করে বলেছেন, আমরা বিভিন্ন দেশের ঘরে ঘরে খালি হাতে ছুটছি, ভিক্ষা চাইছি। প্রতিবেশী ভারতকে দেখুন, তাঁরা উন্নত।শুধু উন্নয়নশীল দেশ নয়, সুপার পাওয়ার হওয়ার চেষ্টা করছে। সেখানে আমরা দেউলিয়া। প্রান বাঁচাতে হাত পাতছি।
পাকিস্তানি মৌলানা ফজলুর রহমান পরশ্রীকাতরতায় পুড়ছেন। সে এক জ্বালা। কে তাঁকে বোঝাবে, ভারত এগোলে তার নিকটতম ছন্নছাড়া, দরিদ্র প্রতিবেশিও এগোবে।উন্নয়নের বহু পথ খুঁজবে। মৌলানা নেতা না অভিনেতা , জানেন তিনি নিজে ।আমরা টের পাচ্ছি , তাঁর দেশের অনাকাঙ্ক্ষিত চালচিত্র আর ভারতের উন্নয়ন দেখে তিনি জ্বলছেন
পাকিস্তানের আর্থিক সঙ্কট নতুন নয়। জন্মের পর থেকে দেশটি পরাশক্তির উপর নির্ভরশীল। অস্ত্র শক্তিতে ক্ষমতাবান আর ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠবার জন্য আমেরিকা ও চিনের সাহায্য চাইত। দেশের জনসংখ্যা আর আয়তনের তুলনায় সেনা, আধাসেনার ক্ষমতা বেশি। প্রতিরক্ষা খাতে খরচও বেলাগাম। কখনও গণতন্ত্র স্থাপিত হয়নি। দেশভাগের সঙ্গে সঙ্গে মহম্মদ আলি জিন্নাহ গলা টিপে গণতন্ত্রকে হত্যা করেছিলেন।নিজেকেই প্রেসিডেন্ট পদে বসিয়ে দেন। ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছিলেন লিয়াকত আলি খানের হাত থেকে। তারপর খাজা নিজামুদ্দিন , মহম্মদ আলি বুগড়া , চৌধুরী মহম্মদ আলিসহ অনেকেই নামমাত্র প্রধানমন্ত্রী হয়ে থাকলেন। কিছুদিন রাষ্ট্রপ্রধান ছিলেন হোসেন শাহিদ সোহরাবরদি, ইব্রাহিম ইসলাম চুন্দিগড়, স্যার ফিরোজ খান নুন। তার পরেই তেরো দিনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হলেন নুরুল আমীন। এখানেই নড়বড়ে গণতন্ত্রের অবসান।সামরিক শাসন জারি করে সব ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠলেন জেনারেল আয়ুব খান পরে বাংলাদেশের উত্থানের আগে পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়া খান।
পাহাড় , সমুদ্র আর সমতলে ঘেরা ১৪১,১৫৪ বর্গ কিলোমিটারের অখণ্ড পাকিস্তানে কিংবা ৭৯৬,০৯৬ বর্গ কিলোমিটারের অধুনা দেশটিতে শাসনতন্ত্র কখনও মসৃণ হয়নি। কাশ্মীর ইস্যু, ভারতের সঙ্গে পরপর তিনবার যুদ্ধে বিপর্যয়, নির্বাচিত অস্থায়ী সরকার, আমলাতন্ত্র আর সামরিক তন্ত্র তার সমূহ উন্নয়নকে গ্রাস করে বসে। সামন্তবাদী অর্থনীতি তার অনুন্নয়নের অন্যতম উৎস।আদব কায়দায়,ভাবনা-চিন্তায় নেহেরুর অনুসারী জুলফিকার আলী ভুট্টো স্থায়ী গণতন্ত্র চেয়েছিলেন। তাঁকে মৌলবাদী জামাত-এ -ইসলামির সমর্থন নিয়ে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিলেন নিজাম-এ-মোস্তফার (ইসলামি শাসন) প্রবক্তা জিওয়াউল হক। জিয়াও রেহাই পাননি। রহস্যাবৃত বিমান দুর্ঘটনায় মারা গেলেন। নির্বাচিত নেত্রী হয়ে ক্ষমতায় বসলেন বেনজির ভুট্টো।তাঁকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় সন্ত্রাসবাদীরা। যে দেশ এরকম অস্থিরতা আর হিংসার লাগাতার শিকার, তার সামগ্রিক উন্নয়ন কি সম্ভব? আড়ালে বসে যে দেশ চালায় সামরিক শক্তি ও সামন্তবাদী মানসিকতার আমলারা, তার অর্থনীতি কি কখনও স্বচ্ছ, সবল হতে পারে? পরমাণু অস্ত্র বানিয়ে , আমেরিকার অর্থ আর অস্ত্র সাহায্য নিয়ে ,৫.৬০ লক্ষ সেনা পুষে, এরকম যে কোনও ছোট দেশের পক্ষে স্থিতিশীল হওয়া দুষ্কর। পাকিস্তানের দুর্দশা তৈরি করেছে রাষ্ট্র ।জনগণ বার বার অব্যাহতি চেয়েছে। পশ্চিমি উপনিবেশিকতা থেকে মুক্ত হয়ে আভ্যন্তরীণ অবক্ষয় আর দারিদ্রের কবলে পড়েছে বিভিন্ন জনসত্তা। অসন্তোষ বেড়েছে । রাষ্ট্র বন্দুক আর লাঠি উঁচিয়ে, ধর্মের জিগির তুলে, সনাতন পন্থার পুনরুত্থান দাবি করেছে, অভিজাত শ্রেণীকে নেতৃত্বে বসিয়ে। সংঘবদ্ধ পুঁজির বিকাশ হয়নি। ব্যক্তিপুঁজিও সীমাবদ্ধ থেকে গেল। ভুমি সংস্কার আর জমিবণ্টনের আর্জিও অবহেলিত হয়ে রইল। রফতানির চেয়ে আমদানি বেশি, সুষম বিকাশ স্তব্ধ, স্থগিত। যে সমাজ পাকিস্তানের জন্মকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিল, সেই অভিজাতরাই অর্থ, সামরিক আর অসামরিক শক্তির নিয়ন্ত্রক থেকে গেল। দেশভাগের প্রাক্কালে, পরেও মুসলিমদের সতর্ক করেছিলেন মৌলানা আবুল কালাম আজাদ,- এই দেশ টিকবেনা।ভবিষ্যতের ছবি আন্দাজ করেছিলেন প্রাজ্ঞ মৌলানা। তাঁর সতর্কতা , তাঁর দুঃস্বপ্ন আজ অক্ষরে অক্ষরে সত্য। ভারত বিদ্বেষ , সামন্তবাদী অর্থনীতির অপচ্ছায়া , সামরিক শক্তির সীমালঙ্ঘন পাকিস্তানকে কুরে কুরে গ্রাস করেছে। শাসক আসছে, শাসক যাচ্ছে। বহাল থাকছে সাধারণ মানুষের বর্ণনাতীত দুর্দশার করুন চালচিত্র।
মওলানা ফজলুর রহমান অতীতের দিকে তাকাননি। খতিয়ে দেখেননি সামাজিক নেতৃত্বের দায়িত্বহীনতা এবং পাকিস্তান তৈরির ঐতিহাসিক ভুল। বারবার রূপ বদলেছেন , কিন্তু পিপলস পার্টি নওয়াজ শরিফের মুসলিম লিগ পরিচালিত, এখনকার সরকারের শরিক হননি। এক সময় ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ পার্টির পাশে ছিলেন। ইমরানের গদিচ্যুতির পর শাহবাজের নেতৃত্বে যে জোট সরকার তৈরি হয়েছিল তাতে যোগ দেয় তাঁর দল। সাধারণ নির্বাচনের পর নবগঠিত জোট সরকারের বিরোধিতা শুরু করলেন সংসদে। সংসদের বাইরেও , ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতেই অভিযোগ করলেন , ‘২৪ সালের জাতীয় ভোটে কারচুপি হয়েছে। তাঁর এই অভিযোগের ভিত্তি কী ,তা অবশ্য প্রমাণিত নয়। কেউ কেউ বলছেন, ক্ষুব্ধ মৌলানার মনোভাব রহস্যময় । অভিসন্ধি, চাপ তৈরি করে সুযোগ সুবিধা আদায় করতে চাইছেন। উপমহাদেশে এই ধরণের ধর্মীয়, ছদ্মবেশী নেতার অভাব নেই। তারা যতটা না নেতা, তার চেয়ে অনেক বেশি অভিনেতা। রাজনীতি তাঁদের বিষয় নয়, তবু রাজনীতিকের অভিনয় কোলাহলময়, পরশ্রীকাতর, প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক উগ্রতা এসব নেতাকে জনসমক্ষে নিয়ে আসে, ক্ষমতায়ও বসিয়ে দেয়।
রবীন্দ্রনাথ যেখানে সমাজকে নেশনের আওতাভুক্ত করতে অনাগ্রহী, ইকবাল সেখানে নেশনকে প্রথমে অবিভাজ্য ভেবেছেন, পরে তাঁর ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে জনগোষ্ঠীভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তা বনে গেলেন
কবি মহঃ ইকবালের শাণিত উপলব্ধি বারবার স্মরণে আসে, দু রাকাত নামাজের ইমাম সমাজের দুঃখ আর গভীর অসুখ কী করে বুঝবে ? ইকবাল মসজিদ , ইমাম আর নামাজকে হেয় করেননি। উদারপন্থা আর মুক্ত দর্শনই ছিল তাঁর অধ্যবসায় আর পর্যবেক্ষণের বিষয়। দূরদর্শী কবি, পার্সিয়ান দ্বৈতবাদ, প্রাচ্য আর প্রতীচ্যের ধারাবাহিক দর্শন তাঁর অসাধারণ প্রতিভার সহগামী। তাঁকে ভাবিয়ে তোলে ভারতীয় সমাজের সমগোতীয়তার ভেতরে বেড়ে ওঠা বিশাক্ত কীট আর দুষণ, যা একসময় ব্যবহারিক রাজনীতি, মৌলবাদ আর সাম্প্রদায়িকতার প্ররোচনাকে বাড়িয়ে দেয়, সংক্রমিত হয় রাষ্ট্রচিন্তায়। রবীন্দ্রনাথ যেখানে সমাজকে নেশনের আওতাভুক্ত করতে অনাগ্রহী, ইকবাল সেখানে নেশনকে প্রথমে অবিভাজ্য ভেবেছেন, পরে তাঁর ঘোষিত অবস্থান থেকে সরে গিয়ে জনগোষ্ঠীভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের প্রবক্তা বনে গেলেন । কবির অসাধারণ মেধা আর প্রজ্ঞা সম্পর্কে তাঁর মৃত্যুর পর ‘প্রতিভার অপচয়’ বলেছিলেন তাঁরই একদা বান্ধবী আতিয়া বেগ। বিদুষী মহিলা। আলাপ জার্মানিতে। ইকবালকে নিয়ে আমৃত্যু অভিমান পুষে রেখেছিলেন। ভুলতে পারেননি প্রিয় বন্ধুকে। ক্ষমা করাও সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রকে ঘিরে ইকবালের অতিরিক্ত মাথাব্যথা তাঁর উদ্বেগের , তাঁর প্রেমের স্বচ্ছতার অন্তরায় হয়ে ওঠে। বদলে গেল দুজনের পথ। ইকবালের ব্যক্তিস্বরূপের পূর্ণতা দেখার সুযোগ ঘটল না আর। অক্লান্ত বেদনা আর ভারি বিরহের সাক্ষী হয়ে রইলেন।
আতিয়া চেয়েছিলেন কবি হয়ে থাকুন তাঁর প্রেমিক, দর্শন চর্চায় মগ্ন থাক কবির দূর ভাবনা। সে স্বপ্ন অসমাপ্ত,অর্ধপুর্ণ করে রাখলেন ভারত প্রেমিক ইকবাল (সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তা হামারাঁ)। ভারতীয় সেনার প্যারেড গীতিতে অনবরত ইকবাল বাজছেন। শাসকের বুদ্ধি চূড়ান্ত ভ্রষ্ট নষ্ট না হলে , ইকবালের অখন্ড দেশপ্রেম , তাঁর বহুত্ববাদিতা, তাঁর মৃত্যুহীন ভারতপ্রীতি সমস্ত বিভাজনকে প্রচার সর্বস্বতার নগ্নতাকে রুখতে আমাদের উজ্জীবনের শক্তি যোগাচ্ছে, যোগাবে।
পাকিস্তানি মৌলানা ফজলুর রহমান পরশ্রীকাতরতায় পুড়ছেন। সে এক জ্বালা। কে তাঁকে বোঝাবে, ভারত এগোলে তার নিকটতম ছন্নছাড়া, দরিদ্র প্রতিবেশিও এগোবে।উন্নয়নের বহু পথ খুঁজবে। মৌলানা নেতা না অভিনেতা , জানেন তিনি নিজে ।আমরা টের পাচ্ছি , তাঁর দেশের অনাকাঙ্ক্ষিত চালচিত্র আর ভারতের উন্নয়ন দেখে তিনি জ্বলছেন। কীট তাঁকে কামড়াচ্ছে। এ এক অদ্ভুত, মুণ্ডহীন কীট, যার বংশধরেরা ক্ষমতামত্ততা ছড়িয়ে পেছনে টানছে ভারতকে। উন্নয়নের নাম করে এক দেশ, এক জাতির শ্লোগান তুলে আত্মগরিমার পাগলা ঘোড়াকে বলছে , যাও দূর অতীতে। বাস করো অতীতে। সংশয় আর অবিশ্বাস দিয়ে ঢেকে দাও স্তাবকতা আর অবাস্তব কল্পনার জগতকে।
❤ Support Us